অপর প্রান্তে,পর্ব-০৫

অপর প্রান্তে,পর্ব-০৫
লেখা- হাবিবুর রহমান হাবিব

পুলিশের অছি নিবিরের কলার ধরে টেনে বাহিরে নেয়ার সময় রুমি চিৎকার করে বললো,
–মামা তুমি ওকে কেন ধরে নিয়ে যাচ্ছো!? আর, কিডন্যাপ করেছে মানে!? কে বলেছে তোমাকে এ কথা!? ও আমাকে কিডন্যাপ করেনি, আমি নিজেই এসেছি এ বাসায়। ওকে তুমি এক্ষুনি ছাড়ো।

রুমির বাবা হনহন করে রুমির কাছে এসে ওর গালে সজোরে চড় বসান। রুমি আতঙ্কে টলমল করতে থাকে। রুমির বাবা ওর হাত শক্ত করে ধরে ওকে বলেন,
–(ধমকের সুরে) অনেক বড়বড় পাখা গজিয়েছে তোর, তাই না? খুব উড়াউড়ি শিখে গেছিস। আজ শুধু বাসায় ওঠ, তোর উড়াউড়ির স্বাধ জনমের মতো মিটিয়ে দেবো।

রুমির বাবা রুমির হাত ধরে টেনে মেইন দরজার বাইরে বের করে আনলেন। পুলিশের অছি নিবিরের ঘাড় ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। রুমির বাবা অছিকে বললেন,
–কি হলো রুমান? এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? আমার মেয়ের কথায় গুরুত্ব দিও না। ঐ বজ্জাতটাকে পরিবারসহ থানায় নিয়ে যাও, পরের টা পরে দেখা যাবে।

রুমি ক্রন্দন কন্ঠে চিৎকার করে বললো,
–ওদের কোনো দোষ নেই মামা। ছেড়ে দাও ওদের। আমি নিজেই..

রুমির বাবা ওর মুখ চেপে ধরে নিজের গাড়িতে ওঠালেন।
———-

থানার ছোট একটা সেলে বন্দী নিবির, সোমা ও ওদের মা। মূহুর্তের মধ্যে জীবনে একি ঘটে গেলো ওরা কেউই বুঝে উঠতে পারছে না। সোমার চোখে-মুখে তীব্র আতঙ্কের ছাপ। ওর মার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরেই যাচ্ছে, হালকা অসুস্থও তিনি। নিবির হাটু উচু করে বসে স্থির দৃষ্টিতে একদিকে তাকিয়ে আছে। ও সব ঘটনাগুলো ধাপে ধাপে সাজানোর চেষ্টা করছে- কি হলো? কেন হলো? কিভাবে হলো?
আজ রাতটা নিবিরদের থানার সেলেই কাটলো।
পরের দিন সকাল বেলা অছি রুমান রুমিদের বাসায় আসলেন। এসে শোনেন, রুমিকে ওর রুমে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। রুমির বাবা বলেন,
–রাকিবের সাথে বিয়ের আগ পর্যন্ত ওকে ঐরুমেই আটকে রাখবো। আগের বার তো জানালা দিয়ে পালিয়েছিলো। এবার জানালায় গ্রিল লাগিয়েছি। মেয়েটা কত্ত বড় নিমকহারাম ভেবে দেখেছো! নিজের বাসার গয়না-গাতি, জিনিসপত্র চুরি করে পালিয়েছে। ওকে নিয়ে এখন কি করি বলো।

অছি রুমান/ রুমির মামা,
–বিষয়টাতো খুবই ভয়াবহ শোনাচ্ছে। কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন ওকে নাকি কিডন্যাপ করেছে কেউ।

–কিডন্যাপের কেস তো বাধ্য হয়ে করেছিলাম। তা নাহলে তো তোমরা বিষয়টাকে এতো সিরিয়াসলি নিতে না। আর, মেয়ে পালিয়ে গেছে বললে সমাজে আমি মুখ দেখাবো কি করে!? তুমি যেভাবেই হোক আমার মেয়ের বিয়ের আগ পর্যন্ত ওদেরকে জেলে আটকে রাখো। আর মাত্র তিন দিনের মধ্যেই মেয়ের বিয়েটা সেরে ফেলবো আমি। একয়দিন যেভাবেই হোক ব্যাপারটা ম্যানেজ করো।

রুমান দরজা খুলে রুমির রুমের ভিতরে আসলো। রুমিকে দেখে কিছুটা হকচকিয়ে উঠলো। রুমির কপালের একপাশ ছিলে গেছে, পুরো চেহারা আঘাতের ছাপে লাল হয়ে গেছে। ও বিছানায় বসে একদৃষ্টিতে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। চোখে ও গালে অশ্রুর দাগ।

রুমান হতাশভাব নিয়ে রুমির পাশে বসলো। হালকা কাশি দিয়ে বললো,
–তোর বাবা কি অনেক মেরেছে?

রুমি কোনো জবাব দিলো না। জানালার বাইরে তাকিয়েই রইলো। রুমান বললো,
–আচ্ছা, তুই রাকিবকে বিয়ে করতে চাইছিস না কেনো বল তো? কি কমতি আছে রাকিবের!? ওর বাবার এতো সম্পত্তি, এতোবড় ব্যবসার মালিক; বিয়ের পর ওদের সাথে তোর বাবার ব্যবসায়িক খাতিরও অনেক বাড়বে; অথচ তুই তোর বাবার কথা না শুনে বিয়েতে অমত করেই যাচ্ছিস, কেন রে?

রুমি কিছুক্ষন চুপ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
–বাবা তো সারাজীবন নিজের ব্যবসাটাই বুঝলো। ব্যবসার আগে ওনার কাছে কোনোকিছুর গুরুত্ব আছে নাকি।? ব্যবসার খাতিরে আমাকেও উনি বিজনেস ডিল হিসেবে তুলে দিচ্ছে ঐ জানোয়ারের ঘরে।

–আচ্ছা তুই রাকিবকে এতো ঘৃণা করিস কেন বল তো!? ছেলেটা যে ইকটু বেয়াদব টাইপের সেটা আমি জানি। কিন্তু তোর ওকে এতো ঘৃণা করার কারন কি!?

রুমি কোনো জবাব দিলো না। ওর মুখ কঠিন হয়ে গেলো। রুমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসা থেকে উঠে চলে যেতে উদ্যত হলে রুমা বললো,
–মামা..তুমি কি ওদের জেলে বন্দী করে রেখেছো?

রুমান মুখ কালো করে ধীরেধীরে হ্যা সূচক মাথা নাড়লো। রুমি ভাড়ী গলায় বললো,
–বাবার চামচা হয়েছো তুমি, তাই না? তুমি যদি এই মূহুর্তে ওদেরকে ছেড়ে না দাও তাহলে আমি ভুলে যাবো যে, পৃথিবীতে আমার কোনো মামা আছে; তোমাকে কোনোদিন ক্ষমা করবো না।
———

থানায় বসে অনেক চিন্তা-ভাবনার পর রুমান সেলের তালা খুললো। নিবিরদের উদ্দেশ্যে বললো,
–আপনারা চলে যান। তবে একটা কথা,ঐ চোধুরী বাড়ির আশেপাশেও আপনারা যাবেন না। কথাটা যেন মনে থাকে।

ছাড়া পেয়ে নিবিরদের বুক থেকে যেন বিশাল একটা পাথর সরে গেলো। বাসায় এসে হাফ ছেড়ে বাচলেও নিবিরের মনে অসংখ্য প্রশ্ন এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে। রুমির ব্যাপারটা কোনোভাবেই মাথা থেকে ঝাড়তে পারছে না ও। ভাবছে, রুমি হয়তো কোনো বিপদের মুখে আছে।

নিবির সোমার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এ রুমেই রুমি থাকতো ভেবে বাসাটা বড্ড ফাকা ফাকা লাগছে ওর কাছে। একপ্রকার একাকিত্ববোধ যেন চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে নিবিরের ভিতর। ওর বুঝতে বাকি নেই যে, রুমি এ বাসার পাশাপাশি ওর মনেও মায়ার ছাপ রেখে চলে গেছে।
———–

পরের দিন সকালে রুমিদের বাসায় রাকিব এসে হাজির। ওর উদ্দেশ্য রুমির সাথে দেখা করা। ও রুমির রুমের দরজাটা খুলে ভিতরে ঢুকলো। ওকে দেখে মুহুর্তেই রুমি শিউরে উঠলো। রুমির চোখে-মুখে প্রচন্ড রাগ ও একপ্রকার আতঙ্গের ছাপ। রাকিব রুমিকে দেখে অদ্ভুতভাবে মুচকি হাসলো। হাসিতে একপ্রকার দুষ্টভাব। রুমি কাপাকাপা হাতে পাশের টেবিল থেকে একটা ছোট আয়না হাতে নিলো। আয়নাটা এমনভাবে ধরে আছে যেন যেকোনো সময় আক্রমনে প্রস্তুত। রাকিব দু-হাত উচু করে স্যারেন্ডার করার মতো দাঁড়িয়ে দাত দেখিয়ে হেসে বললো,
–রিল্যাক্স..রিল্যাক্স.. আমি এখানে তোমার সাথে নোংরামি খেলা খেলতে আসিনি। এসেছি আমাকে দেখার পর তোমার রিঅ্যাকশন দেখতে। আমার থেকে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলে, তাই না? কই..পারলে নাতো। আমার থেকে তুমি জীবনেও রেহাই পাবে না জেনে রেখো।

রুমি,
–(প্রচন্ড রাগী কন্ঠে) তুই কি মনে করেছিস? আমাকে বিয়ে করলে তুই জিতে যাবি!? শুনে রাখ, তোর জীবন আমি নরক বানিয়ে ছাড়বো।

রাকিব অট্ট হাসি হেসে দাত কিড়মিড় করে রুমির সামনে এসে বললো,
–নরক তো হবে তোর জীবন। আমার গলার কামড়ের দাগটা দ্যাখ.. কাধে কলম ঢুকিয়ে দেয়ার দাগটাও এখনো আছে। সেদিন ভালোই চর্বি জমেছিলো তোর, তাই না? তিনজন মিলেও সেদিন তোর সাথে কিছু করতে পারলাম না, এই দুঃখ এখনো আমার ভিতরে কাটার মতো খোচায়। তবে চিন্তা করিস না, এর ফল তুই হারে হারে টের পাবি বিয়ের পর। কি ভাবিস তুই নিজেকে, হ্যা!? তোর মতো মেয়ে একবার ইউস করে টিসু পেপারের মতো ফেলে দিই আমি। আর, তুই কিনা আমার সাথে ইগো দেখাস। বিয়ের পর দেখবো তোর ইগো কোথায় যায়। তুই হবি আমার গৃহবন্দী পোষা দাসী।

রুমি,
–লাশ হওয়ার শখ হয়েছে তোর, তাই না? এতো জখমের পরও কি তোর শিক্ষা হয় নি!? নিজের জীবনের কি কোনোই মায়া নেই তোর? তোর গলায় বটি চালিয়ে দিতে দুই সেকেন্ডও সময় লাগবে না আমার।

রাকিব,
–(দুষ্ট হেসে) ওয়াও, আই লাইক ইয়োর অ্যাটিটিউড। বিয়ের পর তোর দাপট, ইজ্জত আর অহংকার ভাঙতে আমার কি যে ভালো লাগবে, সেটা এখন ভাবতেই ভিতরটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে আমার। রেডি থাক্; শিগগিরি তোর এন্ট্রি হবে আমার বাড়িতে। এখন তাহলে আসি..সি ইউ ভেরি ভেরি সুন।

রাকিব দাত কেলিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেলো রুমির রুম থেকে। রাগে রুমির সারা শরীর কাপছে। দুচোখ লাল হয়ে গেছে আর চোখের পাতায় অশ্রু টগবগ করছে।রুমি হাতের আয়নাটা খুব জোরে দেয়ালে ছুরে মারলে সেটা চুরমার হয়ে গেলো। হাত খুব শক্তভাবে মুষ্টি করে চেহারায় প্রচন্ড রাগ আর বিষাদের ছাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও।
———-

রাতে একপ্রকার হতাশভাব নিয়ে ঘরে ঢুকলো নিবির। বাসায় ঢুকতেই সোমা দৌড়ে এসে বললো,

–ভাইয়া জানিস, রুমি আপু ফোন করেছে আজ দুপুরে।

–বলিস কি!! কি বলেছে ফোন করে?

–জানতে চেয়েছিলো আমরা থানা থেকে ছাড়া পেয়েছি কিনা।

–ওর ওখানে এখন কি অবস্থা? ও ভালো আছে তো?

–জানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আপু প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললো, ‘তোমরা ভালো থেকো, আমাকে নিয়ে ভেবো না।’ বলেই ফোনটা কেটে দিলো।

কথাবার্তার পর সোমার থেকে রুমির ফোন-নাম্বারটা নিয়ে কল করলো নিবির।

ফোন রিসিভ করে নিবিরের কন্ঠ শোনা মাত্র রুমির চোখ কিছুক্ষনের জন্য স্থির হয়ে যায়।

ফোনে কথা বলার একপর্যায়ে নিবির বললো,
–আচ্ছা, রাকিব কে? খবর নিয়ে জানলাম রাকিব নামের কারো সাথে আপনার বিয়ে হবে। অথচ বাসায় এসে সোমার মুখে শুনলাম আপনি নাকি রাকিব নামের একজনকে খুব ঘৃণা করো, ওর জন্যই নাকি বাসা থেকে পালিয়েছিলেন আপনি। বিষয়টা কি সত্যি?

রুমি কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো। এরপর ক্ষীণ কন্ঠে ‘হ্যা’ বললো।

নিবির,
–যার উপর আপনার এতো ঘৃণা, তার সাথে আপনার বাবা বিয়ে কেন ঠিক করলেন!?

রুমি ভারী গলায় এ বিয়ের কারন নিবিরকে বললো।

নিবির,
–আপনার বাবাও দেখছি আমার বাবার মতো পাষাণ। আমার বাবা না হয় পুলিশের ক্রসফায়ারে মরে ক্ষান্ত হয়েছে, কিন্তু আপনার বাবা এখনও গলার কাটা হয়ে আছে আপনার জীবনে, ব্যাস এটুকুই পার্থক্য। আচ্ছা, রাকিবকে আপনার ঘৃণা করার কারনটা কি জানতে পারি?

রুমি,
–(রাগী কন্ঠে) ওর মতো অমানুষ আমি জীবনেও দেখিনি। বেহায়াটা আমার সাথে বিয়ে বসতেও পিছপা হয়নি। ও যে কান্ড করেছিলো আমার সাথে তা বলার মতো না। বছরখানেক আছে একটা খালি ক্লাসরুমে ও আমাকে…

রুমি পরে কিছু না বলে ফুপিয়ে কেদে ওঠে। নিবির সান্তনার স্বরে বললো,

–থাক..থাক.. আর বলবেন না।

রাকিবের ব্যাপারটা শুনে এখন নিবিরের রাগে গাঁ ফেটে যাওয়ার উপক্রম। চাপা কন্ঠে রুমিকে বললো,
–ফ্যামিলিকে বলেন নি ব্যাপারটা?

রুমি,
–না। ফ্যামিলিকে বলার ইচ্ছা আমার নেই। আমি যতদূর জানি, বললেও কোনো লাভ হবে না। আমার কথার কোনো গুরুত্ব নেই এ ঘরে। যদি থাকতো তাহলে আমার এতোবার নিষেধ করার পরেও আমাকে ঐ বজ্জাতটার সাথে জোর করে বিয়ে দিত না। আমার এখন বিষ খেয়ে মরে যেতে ইচ্ছে করছে।

নিবির,
–(ভয়ার্ত কন্ঠে) কি বলছেন এসব!! ওরকম ভাবনা ভুলেও আর মাথায় আনবেন না। আপনি শান্ত হন, একটা উপায় আছে আমার কাছে। আমি সেই প্রথম দিনের মতো আপনাকে আজ বাসা থেকে বের করতে আসবো।

রুমি,
–কিন্তু বাবা তো এবার জানালায় গ্রিল লাগিয়েছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here