অপর প্রান্তে,পর্ব-০২
লেখাঃ হাবিবুর রহমান হাবিব
সকাল সকাল বিছানা থেকে উঠে মেয়েটা দেখলো মেইনগেটে তালা ঝোলানো। একপ্রকার চিৎকার করে বললো,
–সোমা.. আমি কি তোমাদের কায়েদী হয়ে গেছি!? একমাস বাসাবন্দী করে রাখবে আমাকে!?
সোমা ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে পাশের রুম থেকে বললো,
–না না, তা কেন হবে! আপনি তো আমাদের মেহমানের মতো। ভাইয়া তো বললো, শুধু ল্যাপটপ নিয়ে বাইরে যাওয়া মানা। ল্যাপটপ বাসায় রেখে আপনি যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারেন।
–(গম্ভীর গলায়) তালা কি এভাবেই ঝুলে থাকবে সবসময়?
–ও….আপনি খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছেন তো, তাই তালাটা খোলার সময় পাইনি। দাড়ান, আমি এক্ষুনি খুলে দিচ্ছি।
সোমা তালাটা খুলতে খুলতে বললো,
–রাত্রে কি ভালো ঘুম হয়েছে আপনার? আমার তো মনে হয় না। নইলে এতো সকালে উঠতেন না।
মেয়েটা কঠিন মুখ করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। চোখের নিচে হালকা কালো দাগ পড়ে গেছে। পাশের রুম থেকে “সোমা” বলে এক মহিলা ডাকলো। ডাক শুনে মনে হলো সে মহিলা খুব অসুস্থ। সোমা “আসছি মা” বলে দৌড়ে নিজের রুমে গিয়ে ল্যাপটপটা নিয়ে মায়ের রুমে আসলো। মেয়েটা সোমার এ কান্ড দেখে ভ্রু কুচকে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষন। এরপর আস্তে আস্তে সোমার মায়ের রুমে ঢুকলো। দেখলো একজন মহিলা বিচানায় শুয়ে একপ্রকার কাতরাচ্ছেন। তার মাথায় পট্টি দেয়া, চোখ হলুদ বর্নের। মেয়েটা সোমাকে জিজ্ঞেস করলো,
–কি হয়েছে ওনার?
–জন্ডিস। সঙ্গে হাইপ্রেসার ও ডাইবেটিস। তিন সপ্তাহের মতো হয়ে গেল, এতো চেষ্টা করছি কিন্তু রোগ সারার নামগন্ধও পাচ্ছি না।
–ডাক্তার দেখাও নি?
— দেখিয়েছি তো। মোতালেব ডাক্তার, হোমিওপ্যাথির। আমাদের খুব পরিচিত। কিন্তু কেন যে ওনার ওষুধে কোনো কাজ হচ্ছে না বুঝতে পারছি না।
–কি বলছো এসব! উনি এতো অসুস্থ আর তোমরা ঐ ফাউল হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের ভরসায় বসে আছো। মেডিকেলে নিয়ে যাও নি কেন?এতো এতো চুরির টাকা দিয়ে কি করো তোমরা যে মেডিকেলের খরচটাও করতে পারো না!?
মেয়েটা ভেবেছিলো ওর কথা শুনে সোমা কিছুটা হলেও রাগ হবে। কিন্তু তেমন কিছু হলো না। সোমা বললো,
–আপনি ভুল ভাবছেন। আমি মাকে অনেকবার বলেছি মেডিকেলে যাওয়ার কথা। কিন্তু ওনার মোতাবেল ডাক্তারের চিকিৎসায় এতো ভরসা যে কোনোভাবেই মেডিকেলে যেতে রাজি হচ্ছে না। বলে, ‘ শুধু শুধু মেডিকেলে টাকা উড়িয়ে কি লাভ। ওখানে তো সব ডাকাতের দল। টাকা চুসে চুসে খাবে ওরা। আর যদি কোনো সরকারি মেডিকেলে নিয়ে যেতে চাস, সেখানেও আমি যাবো না। ওখানে গিয়ে লাইনে ঝুলে থাকার ধৈর্যও আমার নেই। মোতালেব ডাক্তার ঔষধ দিয়েছে, সেটাতেই কাজ হবে। কাজ না হলে বুঝবি কারো বাপের সাধ্য নেই আমার রোগ সারাবার। কারন মরণ রোগের কোনো ঔষধ নেই, একথা সবসময় মনে রাখবি। ‘ বহু তর্কাতর্কির পরেও মায়ের সাথে পেরে উঠতে পারিনি। অন্যদিকে ভাইয়া তো ভাইয়াই, সারাদিন জুয়া খেলা নিয়ে পড়ে থাকে। সব টাকাতো সে জুয়াতেই উড়িয়ে দেয়। ড্রাইভারি করে সে(নিবির) যা টাকা পায় তাতে সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হয় আমাদের। আরেকটা কথা বলে রাখি, ভাইয়ার চুরির টাকা কখনোও সংসারের খরচে ঢোকে না। মায়ের কড়া নিষেধ আছে তাতে। তার পাপের কামাইয়ের ভোগ আমরা করি না। মা অনেকবার ভাইয়াকে বলেছে জুয়া খেলা ছেড়ে দিতে। কিন্তু সে জুয়া খেলা ছাড়া তো দূরে থাক, উলটো সেটার নেশায় চুরি করা শুরু করেছে। মায়ের অনেক বকাবকির পরেও তার কোনো গতি হলো না। এখন তো আমরা ভাইয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছি ধরতে গেলে। সে তার মতো থাকে। মাস শেষে ড্রাইভারি করে কামাই করা কিছু টাকা দেয় বাসায়। সেটার সাথে আমার টিউশনি করে পাওয়া টাকা মিলিয়ে কোনো মতে সংসার চলে আমাদের।
সোমার কথা শুনে মেয়েটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। চেহারার কাঠিন্যতা দূর হয়ে স্থিরভাব এসেছে। এরই মধ্যে নিবির এসে হাজির। ও মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো,
–ঘটনা কি!? এতো সকাল সকাল ঘুম ভাঙলো কিভাবে আপনার! সারারাত ল্যাপটপ নিয়েই পড়ে ছিলেন নাকি? চোখের নিচে তো মনে হয় কয়লা জমে গেছে।
মেয়েটা,
–(কর্কশ কন্ঠে) আপনি নিজের চোখের নিচ দেখেছেন কখনো? দুইটা ব্লাকহোল নিয়ে ঘুরছেন আর বলছেন আমার চোখে কয়লা জমেছে! যাজ্ঞে , এসব নিয়ে আমি একদমই কথা বাড়াতে চাচ্ছি না। আপনি আপনার মাকে মেডিকেলে নিয়ে যাননি কেন? উনি না যেতে চাইলেও আপনার উচিত ছিল জোর করে নিয়ে যাওয়া। এটুকু কমনসেন্সও কি নেই আপনার মাথায়! মায়ের প্রতি কি কোনোই মায়া নেই আপনার ভেতর।
নিবির,
–এইযে শুনুন, না জেনে কারো উপর কথা ঝাড়বেন না। এতোদিন হাতে তেমন টাকা ছিলো না বলে মায়ের চিকিৎসা করাতে পারিনি। কিন্তু এখন টাকা জোগার হয়ে গেছে। কিভাবে হয়েছে তা আপনি ভালো করেই জানেন।এতো সকাল সকাল এসেছি মাকে হাসপাতালে নেয়ার জন্যই । আপনার প্যাচাল আপনার কাছেই রাখুন।
নিবিরের মা কাতরানো গলায় বললো,
–সোমা.. ঐ শয়তানটাকে বেড়িয়ে যেতে বল। ও আমার সামনে কেন এসেছে? ওকে আর একমূহুর্তও সহ্য করতে পারছি না আমি। ওকে বল আমার সামনে থেকে সরে যেতে। ও কি মনে করেছে ওর হারাম টাকায় আমি নিজের চিকিৎসা করাবো!? এটা ভাবলো কিভাবে ও! আমি মরে গেলেও ওর হারাম টাকার আচ লাগাবো না। ওকে বল এখনই চলে যেতে।
নিবির,
–(ক্ষীন কন্ঠে) এসব কি বলছো মা! এতো অসুস্থতার পরেও চিকিৎসা করাবেনা মানে! তোমার চিকিৎসার টাকা জোগার করতে কত চেষ্টা আর হাঙ্গামা করেছি, আর শেষমেষ তুমি বলছো চিকিৎসা করাবেনা!… আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমি আর চুরি করবো না। গতরাতের চুরিই ছিলো আমার জীবনের শেষ চুরি। এই শেষবারের মতো আমাকে মাফ করে দাও মা। দয়া করে চিকিৎসার জন্য রাজি হয়ে যাও, শুধু এবারের জন্য না বোলো না। আমি সত্যি বলছি, তুমি চিকিৎসা করালে আমি চুরি করা আর জুয়া খেলা সারাজীবনের জন্য ছেড়ে দেবো।
নিবিরের মা,
–এরকম কথা তুই বহুবার বলেছিস। আমাকে বোকা পেয়েছিস তুই!? আমি এই বিছানায় শুয়ে মরে যাবো কিন্তু তোর হারাম টাকায় চিকিৎসা করাবো না। তুই যা, দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে।
মেয়েটা কথার মাঝখানে মহিলার উদ্দ্যেশ্যে বললো,
–ধরে নিন আমার ধার দেয়া টাকা দিয়েই সে আপনার চিকিৎসা করাচ্ছে। হাই-প্রেসার আর ডায়াবেটিস কিন্তু ডেডলি কম্বিনেশন। এভাবে বেশিদিন চললে সামনে ভয়াবহ বিপদ হতে পারে আপনার। চিকিৎসা না করালে হয়তো স্ট্রোক করবেন, না হয় কিডনি নষ্ট হয়ে যাবে, এমনকি হাত-পা কাটা লাগতে পারে পচন ধরার কারনে। তাই বলছি, এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে , আর দেরি করা একদমই ঠিক হবে না। আপনি চিকিৎসার জন্য রাজি হয়ে যান।
নিবিরের মা, সোমা ও নিবির মেয়েটার দিকে হতভম্ভ হয়ে তাকিয়ে রইলো। নিবির বিশ্বাসই করতে পারছে না মেয়েটার মুখে একি শুনছে। নিবিরের মা বললো,
–তোমার ধার দেয়া টাকা মানে!?
মেয়েটা,
–আপনার ছেলেতো আমার বাসা থেকেই চুরি করেছে। যেসব জিনিস চুরি করেছে সেগুলোর মধ্যে আমার জিনিসও রয়েছে। ধরে নিন আমার জিনিসগুলো আমি আপনার ছেলেকে দেনা হিসেবে দিয়েছি, আর সেগুলো বিক্রি করে সেই দেনার টাকা দিয়ে আপনার চিকিৎসা করানো হবে। পরে আমি টাকাটা আপনার ছেলের থেকে বুঝে নেব। এতে চিকিৎসার টাকাটা হারাম হবে না। এখন প্লিজ আপনি চিকিৎসার জন্য রাজি হয়ে যান। আর দেরি করা একদমই ঠিক হবে না।
নিবিরের মা, সোমা ও নিবির আবারো মেয়েটার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। নিবিরের মা বললো,
–(অবাক কন্ঠে) তোমার বাসা থেকেই চুরি করেছে ও!! আমিতো ভেবেছিলাম তুমি সোমার বান্ধবী। আমার তো মাথা ঘুরছে, কি শুনছি এসব! তুমি চোরের বাসায় এসে বলছো চোর তোমার দেনাদার! কাহিনী কি কিছুই তো বুঝতে পারছি না!
নিবির বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে মাকে কোলে নিয়ে বললো,
–বাকি যা বোঝার হাসপাতালে গিয়ে বুঝবে। শুনলেই তো, দেনার টাকা দিয়ে তোমার চিকিৎসা করানো হবে। এখন তো আর টাকাটা হারাম না। দয়া করে এবারের মতো জিদ করো না।মনে রেখো, তুমি মারা গেলে তোমার ছেলে কোনোদিনও ভালো হবে না। তুমি কি চাও আমি সারাজীবন এমন থাকি? এখন আর কোনো কথা শুনতে চাই না। তুমি আমার সাথে হাসপাতালে যাবে, এটাই ফাইনাল।
নিবির মাকে কোলে নিয়ে মেইন দরজার বাইরে চলে আসলো। ওর মা পিছনে ফিরে স্থির চোখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখে কিছুটা ছলছল ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মেয়েটাও কিছুটা মায়াবী দৃষ্টিতে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে আছে। ওর মুখের কাঠিন্যতা অনেকটাই দূর হয়ে সেখানে কিছুটা মায়াভাব উদয় হয়েছে। নিবির একটা রিক্সায় করে মাকে নিয়ে রওনা হলো হাসপাতালে।
সোমা মেয়েটার কাছে এসে মিটমিট হেসে বললো,
–আপনি কি বলছিলেন তখন! ভাইয়াকে ধার দিয়েছেন আর পরে তা বুঝে নিবেন বলেছেন! ভাইয়া আপনার টাকা কোনোদিন ফেরত দেবে এটা ভাবলেন কি করে!
মেয়েটা,
–এই মুহুর্তে টাকাটা বড় বিষয় না, বড় বিষয় তোমার মায়ের চিকিৎসা। আমার জিনিসগুলো যে গচ্ছা গেছে তাতো আমি আগেই জানি। অন্তত কথার জোরে তোমার মাকে চিকিৎসার জন্য রাজি করাতে পারলাম, এতে খারাপ কি। আমার জিনিসের টাকায় কারো জীবন বেঁচেছে ভেবে হয়তো নিজেকে কিছুটা সান্তনা দিতে পারবো।আচ্ছা, আমাকে একটা কথা বলোতো। তুমি কোন দলের? তোমার মায়ের, নাকি ভাইয়ের?
চলবে…