অন্ধকারের_মানুষ (পর্ব ৫)

#গল্প১৪১

১৮+ সতর্কতা

#অন্ধকারের_মানুষ (পর্ব ৫)

ঢাকার রমনা জোনের পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ে আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ সভা ছিল। অন্যান্য থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের মতো রাহাতও এসেছিল ওর সহকারী হাফিজকে নিয়ে। ইদানীং কিছু ঘটে যাওয়া অপরাধ আর তাদের ধরণ নিয়ে আলোচনা হয়। বিশেষ করে কিছু পুনর্বাসন কেন্দ্রে রোগীদের সাথে অমানবিক আচরণের বিষয়টি উঠে এসেছে। ক’দিন আগেই দেশের প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকায় একটা তথ্যবহুল পরিসংখান উঠে আসে, যেখানে বলা হয়েছে, ‘পুনর্বাসন কেন্দ্রের পুনর্বাসন প্রয়োজন’। কয়েকজন ভুক্তভোগী রোগী এবং তাদের আত্মীয়স্বজন অভিযোগ করেছেন যে এখানে রোগীদের সাথে নির্দয় আচরণ করা হয়। অনেকক্ষেত্রে নির্যাতনও চলে। তো অপরাধের এই দিকটা খুব একটা পুলিশের নজরে আসে না। তাই সভাতে সব পুলিশ অফিসারকে যার যার এরিয়াতে এই ব্যাপারটা নিয়ে চোখ কান খোলা রাখার জন্য বলা হয়।

সেদিন সভা শেষে ফিরতি পথে রাহাত হাফিজকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘হাফিজ, আমাদের থানার আওতায় এরকম কয়টা পুনর্বাসন কেন্দ্র আছে, বলতে পারো?’

হাফিজ মাথা চুলকে বলে, ‘স্যার, এই তালিকা মনে হয় নাই। তবে আপনি চিন্তা করবেন না, আমি সাতদিনের মাঝেই এটা করে ফেলব।’

রাহাত মাথা নাড়ে। গাড়িটা ট্রাফিক জ্যামে অনেকক্ষণ ধরেই আটকে আছে। ইদানীং ঢাকা শহরে যাতায়াত খুব ঝক্কির ব্যাপার। রাহাত মনে মনে কাজের একটা ছক কাটছিল। হঠাৎ কী মনে হতে ও কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘এই হাফিজ, তুমি না ক’দিন আগে একটা পুনর্বাসন কেন্দ্রে এক সাইকোপ্যাথকে ভর্তি করে আসলে? তার খবর কী?’

হাফিজ এবার উৎসাহের সাথে বলে, ‘স্যার, খবর নিশ্চয়ই ভালো। কারণ ডা. দেবদ্যুতি নিজে যখন দায়িত্ব নিয়েছেন, আর কোনো চিন্তা নাই।’

ডা. দেবদ্যুতির ব্যাপারে হাফিজের একটা দূর্বলতা আছে, রাহাত এটা জানে। রাহাত তাই হেসে বলে, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। তারপরও আমাদের একবার রুটিন ভিজিট যেতে হবে সব ক’টা কেন্দ্রে।’

রাহাতের কথা শেষ না হতেই হাফিজ উৎসাহের সাথে বলে, ‘স্যার, আজকেই চলেন। এই তো কাছেই ওনার পুনর্বাসন কেন্দ্রটা। এদিকে যখন আজ আসলামই দেখা করে যাই।’

রাহাত একটু ভাবে, তারপর বলে, ‘আচ্ছা, চলো তাহলে, একবার ঢুঁ মেরেই যাই। আর সেই লোকটাকেও দেখে আসি।’

ড্রাইভারকে বলতেই গাড়িটা সামনের মোড়ে গিয়ে হাতের বামে ঢুকে পড়ে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা সিলভার লাইন পুনর্বাসন কেন্দ্রে পৌঁছে যায়।

****-*********

দেবদ্যুতির মনটা ক’দিন ধরেই বিক্ষিপ্ত। বিশেষ করে রইস উদ্দিন এখানে আসার পর থেকেই কেন জানি বেশি বেশি করে ওর জীবনের কালো অধ্যায়টা বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে। সেদিন বাবা মা বাসায় ছিল না। পাশের বাড়ির এক আংকেল এসেছিল কী একটা কাজে। কিন্তু যেই শুনল কেউ নেই বাসায়, লোকটা কেমন যেন হয়ে গেল। দেবদ্যুতি সেদিন হতভম্ব হয়ে খেয়াল করে এতদিনের পরিচিত শ্রদ্ধার মুখটা কেমন পশু হয়ে যাচ্ছে। শেষ মুহুর্তে দেবদ্যুতি নিজেকে বাঁচাতে পেরেছিল। কিন্তু সেই যে ঘৃণা জন্মাল তা আর ঠিক হয়নি। তাই ইদানীং রইসকে দেখলেই ওর মাথায় খুন চেপে যায়। সেদিন রাতে নির্মলাকে নিয়ে ঢুকেছিল লোকটার রুমে। একটা বড় প্লায়ার্স দিয়ে আঙুল ভেঙে দেবার ভয়ও দেখিয়েছে। ইচ্ছে হচ্ছিল ভেঙেই দেয়, কিন্তু শেষ মুহুর্তে নিজেকে সামলেছিল ও। সেদিনের পর থেকে লোকটা ওদের দেখলে ভয়ে কেমন কুঁকড়ে থাকে, এটা দেখতেই ভালো লাগে। এতটা বছর ও যেমন এদের দেখলে কুঁকড়ে থাকত এখন ঠিক এর উলটো হয়েছে।

কিন্তু একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। সেদিন ও কি একটা কাজে বাইরে গিয়েছিল, এসে দেখে রক্তারক্তি কান্ড। রইসের ডান হাতের মাঝখানের আঙুলটা ভেঙেই ফেলেছে নির্মলা। নিজেকে ও সেদিন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। নাহ, ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। অবশ্য নির্মলাকে খুব একটা দোষও দেওয়া যায় না, ওর সাথে আরো জঘন্য ঘটনা ঘটেছিল। ও বিয়ের পর পরই গ্যাং রেপের স্বীকার হয়েছিল, আর তারপর স্বাভাবিকভাবেই ওর বিয়েটা ভেঙে যায়। সমাজেও হেয় হয়ে হয়ে মেয়েটা সুইসাইডই করে ফেলত। হঠাৎ করেই দেবদ্যুতির সাথে পরিচয়, আর তারপর থেকে ওকে নিজের কাছেই রেখে দিয়েছে। কেন জানি এমন মানুষকে ওর আপন মনে হয় বেশি। কিন্তু নির্মলা যখন রইসের আঙুলটা ভেঙে ফেলল তখন ওর টনক নড়ল। এ কী করছে ও! ওর অসুখটা নির্মলাকেও প্রভাবিত করছে আরও বেশি করে। নাহ, ওর নিজেরও কাউন্সেলিং দরকার। কথাটা মনে হতেই ওর মেডিকেলের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মোস্তাফিজ স্যারের কথা মনে পড়ে যায়। এই একজন অন্তত ওর সমস্যাটা জানেন। আগে প্রায়ই যেত ও কাউন্সেলিং এর জন্য। নাহ, আবার যেতে হবে।

এই যখন ভাবছিল ঠিক তখন নির্মলা ওর রুমে এসে একটু নার্ভাস ভঙ্গিতে বলে, ‘আপা, ওইদিনের পুলিশটা আসছে, সাথে আরেকজন।’

দেবদ্যুতি একটু ভ্রু কুঁচকে তাকায়, এত তাড়াতাড়ি পুলিশ জেনে গেল? নাকি এমনি দেখা করতে এসেছে? একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বলে, ‘আচ্ছা, তুই ওনাদের পাঠিয়ে দে। আর অমন ভয় পাওয়া মুখ নিয়ে থাকিস না। যা নাস্তা রেডি কর তুই।’

একটু পরই রাহাত আর হাফিজ এসে ঢোকে। হাফিজ উচ্ছ্বসিত গলায় বলে, ‘ম্যাডাম, কেমন আছেন? আপনাকে দেখতেই আসলাম। উনি মি. রাহাত, আমার বস।’

দেবদ্যুতি মৃদু হেসে ওদের বসতে বলে। রাহাত বসতে বসতে বলে, ‘আসলে আপনার সাথে এমনিতেও একদিন পরিচিত হতে আসতাম। হাফিজের মুখে তো শুধুই আপনার প্রশংসা শুনি।’

দেবদ্যুতি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, যাক অন্য কিছু না, এরা এমনিতেই এসেছে। দেবদ্যুতি হেসে বলে, ‘হাফিজ একটু বাড়িয়েই বলে আসলে। আমি শুধু আমার দায়িত্বটুকুই পালন করি।’

এর মাঝে নির্মলা নাস্তা নিয়ে আসে। ওদেরকে খেতে অনুরোধ করতেই হাফিজ সবার আগে খাওয়া শুরু করে। রাহাত ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে, খাবারের ব্যাপারে হাফিজের একটা দূর্বলতা আছে। রাহাত চা টা নেয়, চুমুক দিতে দিতে বলে, ‘ম্যাডাম, এমন ভয়ংকর সব মানসিক রোগী নিয়ে থাকেন, ভয় করে না? এদেরকে নিশ্চয়ই সবসময় বন্দি করেই রাখতে হয়?’

দেবদ্যুতি হেসে বলে, ‘আসলে এখানে যাদের রাখি তারা সাধারণত ভায়োলেন্ট কেউ না। এরা নিজেদের মানসিক সমস্যার বৃত্তে বন্দি। আমরা ওদের সেখান থেকে বের করে আনার চেষ্টা করি। তাই এদের অমন বন্দি রাখতে হয় না। তবে, রাতের বেলা দরজাগুলা বাইরে থেকে আটকে দেওয়া হয়, সেটা ওদের নিরাপত্তার স্বার্থেই।’

রাহাত মাথা নাড়ে। তারপর নাস্তা শেষ হতেই ওরা যখন উঠে পড়বে ঠিক তখন হাফিজ বলে, ‘ম্যাডাম, রইসের কী খবর? বেটারে একবার দেইখা যায়, স্যারেরও ইচ্ছা ছিল।’

রাহাত বিরক্ত হয়, এই হাফিজ বেশি কথা বলে। চলে গেলেই হতো। দেবদ্যুতি একটু থমকায়, ইচ্ছে করলেই ও না করতে পারে চিকিৎসার দোহাই দিয়ে। কিন্তু সেক্ষেত্রে এরা না আবার সন্দেহ করে। দেবদ্যুতি মাথা নেড়ে বলে, ‘কোনো সমস্যা নেই, আপনিও তো এই কেসের একটা অংশ। চলুন আমিই নিয়ে যাচ্ছি।’
****************-**

রইস মনমরা হয়ে ভাঙা আঙুলটার দিকে তাকিয়েছিল। এ ও কাদের পাল্লায় যে পড়ল! কী ভয়ংকর ওই নির্মলা। এরা কেন ওর উপর এত খেপে আছে? অবশ্য এটাই ওর পাওনা, আঙুলগুলো অবশ্যই ভেঙে ফেলা উচিত। এত জঘন্য ইচ্ছে ওর হয়, সেটার শাস্তিই ও পাচ্ছে এখন।

ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দরজায় দু’জন লোককে দেখে, তাদের মধ্যে একজন সেই পুলিশ অফিসারটা, সাথে ডা. দেবদ্যুতি। রইস উঠে দাঁড়াতেই দেবদ্যুতি গম্ভীরমুখে বলে, ‘তুমি বসো, দাঁড়াতে হবে না।’

রাহাত ভালো করে লোকটাকে দেখে, তেমন কোন চোখে পড়ার মতো বৈশিষ্ট্য নেই। রাহাত অবশ্য এটা জানে, মুখ দেখে বেশিরভাগ মানুষের ভেতরটা পড়া যায় না।

হাফিজ কাছে যেয়ে আন্তরিক গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘কী মিয়া কেমন আছ? চিন্তা কইরো না, আপা যখন আছে তখন সব ঠিক হইয়া যাইব।’

তারপর আঙুলের ব্যান্ডেজের দিকে চোখ পড়তেই বলে, ‘কী, আঙুল কাটছ কেমনে?’

রইস অসহায় মুখে দেবদ্যুতির দিকে তাকাতেই দেবিদ্যুতি ঠান্ডা গলায় বলে, ‘হাফিজ, তোমাকে আমি পরে বলছি সব।’

এবার রাহাত ব্যান্ডেজ করা আঙুলটা দেখতে পায়, লোকটা এতক্ষণ ওই হাতটা আড়াল করেই রেখেছিল।

আর কিছু টুকটাক কথা বলার পর ওরা বের হয়ে আসে। বাইরে এসে দেবদ্যুতি বলে, ‘আসলে রইসের মনে ভীষণ অনুতাপের সৃষ্টি হয়েছে। তাই সেদিন রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছিল তখন সে নিজেই রুমের দরজার ফাঁকে চাপা দিয়ে আঙুলটা ভেঙেছে। ওর সামনে ইচ্ছে করেই কথাটা তুললাম না।’

কথাটা শুনে হাফিজ শিউড়ে ওঠে, মুখ ফস্কে বলেই ফেলে, ‘কী সাংঘাতিক!’

রাহাত চিন্তিত মুখে বলে, ‘তাহলে তো চিন্তার কথা। ওকে সামলাবেন কী করে? আরও বড় কিছু করে ফেললে?’

দেবদ্যুতি আশ্বাসের সুরে বলে, ‘এগুলো চিকিৎসার অংশ, ওর কাউন্সেলিং চলছে, ঠিক হয়ে যাবে।’

রাহাত মাথা নাড়ে, তারপর বলে, ‘,ভালো হয়ে যাক, এটাই চাই। আপনি অনেক সময় দিলেন, অনেক ধন্যবাদ।’

দেবদ্যুতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, বিশেষ করে হাফিজের কাজের।

ওরা চলে যেতেই দেবদ্যুতি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। নাহ, নির্মলাকে ভালো করে কাউন্সেলিং করতে হবে। এমন মাথা গরম করলে তো ও ধরা পড়ে যাবে।
***********

সেদিন রাহাত থানায় ফিরে হাতের কাজগুলো সেরে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বেজে যায়। কেন যে শুধু শুধু তখন ওই পুনর্বাসন কেন্দ্রে গেল। অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে গেল শুধু শুধু। বাসায় ফিরতেই করবী গম্ভীরমুখে বলে, ‘রোজ এমন দেরি করে আসলে কিন্তু এরপর দরজা বন্ধ করে চুপ করে বসে থাকব।’

রাহাত দুষ্টুমির হাসি হেসে বলে, ‘আমিও তাহলে সারারাত দরজায় কড়া নেড়েই যাব, আর একটু পর পর ওই পাখিটার মতো বলব, বউ, কথা কও।’

করবী হেসে ফেলে, তারপর বলে, ‘যাও, আর দেরি করো না। গোসলটা সেরে আসো।’

গোসল শেষ করে রাহাত বের হতে যেতেই দেখে বাথরুমের দরজাটা খুলছে না। নিশ্চিত করবী দুষ্টুমি করে বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে রেখেছে। রাহাত মনে মনে হেসে করবীকে ডাকতে যেতেই হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা কথা ওর মনে হয়, আচ্ছা, ওই রইস লোকটাকেও তো রাতে বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে রাখা হয়। তাহলে ও নিজের আঙুল ভাঙল কী করে? বন্ধ দরজায় তো আর ইচ্ছে করলেই আঙুল চাপা দেওয়া যায় না। তাহলে কী এরা মিথ্যে বলল? ঘটনাটা রাতে না হয়ে দিনে হলে সমস্যা ছিল না। কিন্তু ওর স্পষ্ট মনে আছে ডা. দেবদ্যুতি বলেছেন রাতের বেলা সবাই যখন ঘুমিয়ে তখন রইস এই কাজ করেছে। উম, তাহলে কী সেদিন ভুলে দরজাটা খোলাই ছিল? নাকি পুনর্বাসন কেন্দ্রের লোকজনের কাজ? ভাবনাটা আসতেই ও জোরে মাথা ঝাকিয়ে ভাবনাটা সরিয়ে দেয়। নাহ, কি আবোলতাবোল ভাবছে।

এমন সময় হঠাৎ বাথারুমের দরজা খোলার শব্দ হয়, করবী ভয় পাওয়া গলায় বলে, ‘এই, অমন দাঁড়িয়ে কী বিড়বিড় করছ? আমি তো দুষ্টুমি করে দরজা বন্ধ করতে যেয়ে নিজেই চিন্তায় পড়ে গেছিলাম। দেখি তোমার কোনো সাড়াশব্দ নাই।’

রাহাত ঠোঁট কামড়ে বলে, ‘উহু, তুমি বরং একটা ভালো কাজ করেছ। একটা কেস নিয়ে ভাবনার খোরাক হলো।’

করবী চোখ পাকায়, ‘আর একটা কথাও না। আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছ, আসো তো।’

খাওয়া শেষে ও যখন ঘুমোতে যায় তখনও ভাবনাটা ওকে খুঁচিয়েই যায়। আসলে পুলিশের মন, তথ্যের গোলমাল থাকলে খালি সন্দেহ হয়। ছোট্ট একটা বিষয়, রইস রাতের বেলা সবাই ঘুমিয়ে পড়লে দরজায় চাপা দিয়ে নিজের মাঝের আঙুলটা ভেঙেছে। কিন্তু রাতে তো দরজা বন্ধ থাকে, তাহলে?

পরদিন ও যখন থানায় আসে তখনও ভাবনাটা স্বস্তি দেয় না। ব্যাপারটা কী একটু তলিয়ে দেখা দরকার? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটা কথা মনে হয় আচ্ছা ক’দিন আগে ওর থানার আওতাধীন একটা লোকাল বাসে এক তরুণীর গায়ে হাত দেবার চেষ্টা করেছিল একটা লোক। তার একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। তখন এটা নিয়ে পত্রিকাতে খুব তোলপাড় হয়েছিল। কিন্তু লোকটাকে চিহ্নিত করা যায়নি। আচ্ছা ভিডিওর ওই লোকটাই কী রইস?

হাফিজকে ডেকে জিজ্ঞেস করতেই ও মাথা নেড়ে বলে, ‘আসলে স্যার, ওই রোগীর অতীত সম্পর্কে আমাকে কিছু বলেনি ডাক্তার আপা।’

রাহাত একটু ভাবে, তারপর কম্পিউটার খুলে সেই ভাইরাল ভিডিওটা বের করে, মনোযোগ দিয়ে দেখে। তারপর ভিডিও থেকে কয়েকটা ছবি নিয়ে নেয় ওর মোবাইলে। এটা নিয়ে ও আবার যাবে ওই পুনর্বাসন কেন্দ্রে, একটু মিলিয়ে দেখতে হবে। আর এই ছুতোয় আঙুল ভাঙার রহস্যটাও জানতে হবে।

কয়েকদিন পর এক বিকেলে রাহাত সিলভার লাইন পুনর্বাসন কেন্দ্রে আসে। এবার একাই, ইচ্ছে করেই হাফিজকে নিয়ে আসেনি। ওর মনের সন্দেহটা আগেই ওকে জানালে হয়তো ও ব্যাপারটা ডাক্তারের সাথে শেয়ার করে ফেলতে পারে।

দেবদ্যুতি রাহাতকে দেখেই একটু চমকে যায়, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘আরে, আপনি। কী ব্যাপার, কোনো সমস্যা?’

রাহাত হেসে বলে, ‘আসলে তেমন কিছু না। আপনার ওই রইস সম্পর্কে জানার পর আমার হঠাৎ একটা কথা মনে হলো। ঢাকার একটা লোকাল বাসে কিছুদিন আগে একটা মেয়ের গায়ে হাত দেবার জন্য একটা লোককে ধরেও ধরা যায়নি। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল এই লোকটাই ওই রইস। আপনি কিছু জানেন এই সম্পর্কে?’

দেবদ্যুতি মনে মনে বিরক্ত হয়, এই পুলিশ অফিসার তো মহা উৎসাহী আর সন্দেহপ্রবণ। ও মাথা নাড়ে, ‘আসলে রইস নিজের ইচ্ছেয় যতটুকু বলে আমি সেটাই শুনি। ওর অতীতের অপরাধগুলো এখনও সবটা শোনা হয়নি।’

রাহাত মাথা নাড়ে, তারপর বলে, ‘আমি একটু ওকে পেছন থেকে দেখব। আর একটু টুকটাক কথাও বলতে চাই যদি আপনি অনুমতি দেন।’

দেবদ্যুতি চেয়ে থাকে, তারপর নিচু গলায় বলে, ‘আচ্ছা, অসুবিধে নেই। নির্মলাকে বলে দিচ্ছি ও নিয়ে যাবে।’

রইস জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। আজ কতটা দিন ও এখানে, বন্দি জীবন। খুব ইচ্ছে করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে। ভাবতে ভাবতে পায়ের শব্দে পেছন ফিরে তাকায়, সেদিনের সেই নতুন পুলিশটা।

রাহাত কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে, তারপর বলে, ‘কী খবর রইস সাহেব, ভালো আছেন?’

রইস একবার নির্মলার দিকে আড়চোখে তাকায় তারপর মাথা নাড়ে, বলে, ‘হ্যাঁ, ভালো আছি।’

ব্যাপারটা খেয়াল করে রাহাত, গতবারও যখন এসেছিল লোকটা কোনো প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে নির্মলা বা দেবদ্যুতির দিকে একবার তাকাত যেন অনুমতি নিচ্ছে, এমন। নাহ, এই রইসকে একটু একান্তে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।

রাহাত সামনের চেয়ারটায় বসে আয়েশী ভঙ্গিতে বসে, তারপর বলে, ‘নির্মলা, আমাদের জন্য চা দেওয়া যাবে? একটু চায়ের তেষ্টা পেয়েছে?’

নির্মলা একটু ইতস্তত করে বলে, ‘আচ্ছা, আমি ব্যবস্থা করছি।’

নির্মলা বেরিয়ে যেতেই রাহাত আলতো করে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কী সেদিন নিজেই নিজের আঙুল ভেঙেছিলেন? নাকি এখানকার কেউ?’

রইস চমকে ওঠে, তোতলানো গলায় বলে, ‘না না, এরা না। সেদিন রাতে আমি নিজেই আমার আঙুল ওই দরজায় চাপা দিয়ে ভেঙেছি।’

এই কথাটা নির্মলা ওকে শিখিয়ে দিয়েছিল। কেউ জিজ্ঞেস করলে যেন এই কথাটাই বলে।

রাহাত চেয়ার থেকে উঠে দরজাটার কাছে যায়, ভালো করে দেখে। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করার কোনো ব্যবস্থা নেই, বাইরে থেকেই শুধু বন্ধ করা যায়।

রাহাত এবার চেয়ারে এসে বসে, তারপর বলে, ‘কিন্তু রাতে তো এই দরজা বাইরে থেকে বন্ধই থাকে, তাহলে? বন্ধ দরজার ভেতর আপনি কী করে আঙুল চাপা দিলেন?’

রইস এবার পুরো বিভ্রান্ত হয়ে যায়। সত্যিই তো এটা অসম্ভব! এই পুলিশটা দারুণ বুদ্ধিমান। ইচ্ছে করছে সব বলে দিতে। কিন্তু ওদের সেদিনের হুমকির কথা মনে হতেই ও কুঁকড়ে যায়।

এর মধ্যেই নির্মলা চলে আসে, হাতে দু’কাপ চা। রাহাত নিজে নিয়ে ওকে চা দেয়। বলে, ‘নিন, চা খান।’

চা খেতে খেতে রাহাত আরও টুকটাক কিছু কথা বলে।

আসার সময় দেবদ্যুতিকে বলে আসে যে রইসের সাথে ওই লোকটার কিছুটা মিল আছে। দরকার হলে ও আবার আসবে।

রাহাত চলে যেতেই দেবদ্যুতি চিন্তা করতে থাকে, নাহ, এই পুলিশটার ভাবগতিক সুবিধার মনে হচ্ছে না।

রাহাত ফেরার পথে ভাবছিল কোথাও একটা গোলমাল আছে। মিথ্যেটা কেন বলল রইস? আর ওই ডাক্তারও সেদিন এটাই বলেছিল। একটা কথা মনে হতেই ও একটা নাম্বারে ফোন দেয়, ‘কালাম, কী খবর তোর? ইদানীং দেখি নতুন কোনো খোঁজ খবর দিস না।’

পুলিশের সোর্স কালাম ওপাশ থেকে বিনয়ের গলায় বলে, ‘স্যার, নতুন খবর পাইলে সবার আগ আপনারেই জানাই।’

রাহাত হাসে, তারপর বলে, ‘শোন, তোরে একটা কাজ করতে হবে। একজনের উপর একটু নজর রাখতে হবে, তুই একটু থানায় আসিস।’

সেদিন কালাম থানায় আসার পর রাহাত সিলভার লাইন, ডা. দেবদ্যুতি, নির্মলা এদের সম্পর্কে ধারণা দেয়। তারপর বলে, ‘তুই আগামী একটা সপ্তাহ নজর রাখবি ভালো করে। আমাকে প্রতিদিন রিপোর্ট দিবি। ওখানে কে ঢুকল, কে বের হলো। বিশেষ করে ওই দু’জন।’

কালাম শিয়ালের মতো হেসে বলে, ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন, কোনো ঝামেলা থাকলে আমি ঠিক বাইর কইরা নিয়া আসমু।’

কালাম চলে যেতেই রাহাত ভাবতে বসে, আচ্ছা, ও কী অযথা সন্দেহ করছে? সব হয়তো ঠিকই আছে। কিন্তু রইস মিথ্যে বলল কেন?

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
১৯/০৪/২০২২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here