অন্ধকারের_মানুষ (পর্ব ১)

#গল্প১৪১

১৮+ সতর্কতা

#অন্ধকারের_মানুষ (পর্ব ১)

রইস উদ্দিন নাকে একটা হালকা পচা গন্ধ পাচ্ছে। কেমন একটা অস্বস্তি হয় রইসের, ও জানে গন্ধটা আস্তে আস্তে তীব্রতর হয়ে ওকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। আর তখন ও স্বাভাবিক মানুষ থাকবে না। এই যে এখন বাথরুম থেকে পানি পড়ার কল কল শব্দ ভেসে আসছে তাতে গন্ধটা আরো বেড়ে যাচ্ছে। কাজের মেয়ে কুলসুম একটু আগেই গোসলে ঢুকেছে। মেয়েটা কাজ সেরে এখানেই গোসল সারে। রিতা রান্নাঘরটা গুছিয়ে নিচ্ছে, পাঁচ বছরের ছেলে রঞ্জু বারান্দায় খেলছে। রইস মনটাকে অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করে, বারান্দায় এসে ছেলের সাথে একটু বসে। কিন্তু নাহ, পচা গন্ধটা বেড়েই চলছে। রইস একটা ঘোরের মাঝে চলে যাচ্ছে, মনের ভেতর শয়তানটা ওকে যেন দখল করে নিচ্ছে। চোখটা এখন কেমন একটা ঘোর লাগা মানুষের মতো যার কোনো বিবেক নেই।

রইস উদ্দিন বাসা থেকে বের হয়। রিতা গলা বাড়িয়ে জানতে চাইলে বলে, সিগারেট আনতে যাই। আজ শুক্রবার ছুটির দিন, জুম্মার নামাজ শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। আশেপাশের সব দোকানপাট বন্ধ, রাস্তায় লোক কম। রইস সন্তর্পণে চারপাশে তাকায়, তারপর বাসার পেছন দিকটায় চলে আসে। ওদের একতলা বাসার বাথরুমটা যেখানে সেখানটায় একটা ঝাকড়া গাছ ঢেকে রেখেছে, সাথে হালকা কিছু ঝোপঝাড়ও আছে। রইস আরেকবার দেখে নেয়, তারপর পা টিপে টিপে বাথরুমের কাছে আসে। গুন গুন শব্দে গান ভেসে আসছে। রইস এবার তীব্র পচা গন্ধটা পায়, একটা অশরীরী আত্মার উপস্থিতি টের পায়। শরীরটা কেমন ভারী লাগছে।

সতর্কতার সাথে রইস এবার মাথাটা তোলে, কুলসুমের ভেজা চুল দেখা যাচ্ছে, পেছন ফিরে আছে ও। রইস যেন এখন আর মানুষ নেই। দুই হাত দিয়ে গিরগিটির মতো দেয়ালের ইটগুলো চেপে ধরে, মুখের ভেতরটা কেমন শুকিয়ে আসছে। জানালাটা উঁচু, রইস এবার পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে মাথাটা আরেকটু উঁচু করে। ঠিক তখনই পকেটের মোবাইলটা তীব্র শব্দে বেজে উঠতেই রইস চমকে ওঠে, দ্রুত মাথা নিচু করে বসে পড়ে। তাড়াহুড়ো করে বের করতে যেয়ে হাত থেকেই মোবাইলটা পড়ে যায়। এদিকে রিংটোনটা বেজেই চলছে।

কুলসুম মাত্রই মাথার উপরে শাওয়ারটা ছেড়েছে, ঠান্ডা পানিটা শরীরে পড়তেই সারা দিনের ক্লান্তিটা জুড়িয়ে যায়। এত পরিশ্রম করতে হয় সারাদিন। এই বাসাটায় ও সবার শেষে আসে, রিতা আপা খুব ভালা মানুষ। এখানে এসে ও গোসলটা আরাম করে করতে পারে। শাওয়ারের পানিগুলা এমন করে গায়ে লাগাছে যে তাতে ওর ছোটবেলায় বৃষ্টিতে ভেজার কথা মনে পড়ে যায়। কুলসুম চোখ বন্ধ করে মনের সুখে গুন গুন করে গান ধরে। হঠাৎ করেই একটা মোবাইল বেজে ওঠে, যেন ওর কানের কাছেই। ঝট করে ঘুরে তাকাতেই একটা আবছায়ার মতো কিছু সরে যায়। ব্যাপারটা বুঝতে কুলসুমের এক সেকেন্ড সময় লাগে, তারপর দ্রুত হাতে গায়ের শাড়িটা ভালো করে পেচিয়ে অকথ্য ভাষায় গালি দেয়, ‘খাটাশের বাচ্চা খাটাশ…..’।

ততক্ষণে রইস লম্বা পায়ে কোনো দিকে না তাকিয়ে দ্রুত পেছনের রাস্তা দিয়ে হনহন করে এগিয়ে চলে। দ্রুত হাঁটতে গিয়ে কয়েকবার পা বেঁধে গেছে, বুড়ো আঙুলের নখটা মনে হয় একটু উঠে গেছে। তীব্র ব্যথা হবার কথা, কিন্তু রইসের তা হচ্ছে না। অনেক দূর হাঁটার পর একটা পার্কের মতো জায়গায় এসে একটা বেঞ্চের উপর শুয়ে পড়ে। চোখটা বন্ধ করে শ্বাস টানে, পচা গন্ধটা এখন আর নেই। শরীরটা এখন অনেক হালকা লাগে, অশরীরী আত্মাটাও এখন আর নেই।

ক্লান্ত লাগছে খুব, সারা শরীর ঘেমে গেছে। পায়ের বুড়ো আঙুলে একটা চিনচিনে ব্যথা টের পায়। একটা হালকা ঠান্ডা বাতাস বইছে, রইস উদ্দিনের সারা শরীর জুড়িয়ে যায়। কেমন একটা ঘুম চলে আসে।

বিকেলে ও যখন বাসায় ফিরে ততক্ষণে রিতার দু’বার কল এসেছে, টের পায়নি রইস। মোবাইল সেই যে সাইলেন্ট করেছিল তা আর ঠিক করা হয়নি। বাসায় ঢুকতেই রিতার উদবিঘ্ন গলা পাওয়া যায়, ‘এই, তুমি কই ছিলা? এতক্ষণ লাগল?’

রইস একটা বোকার মতো হাসি দিয়ে দূর্বল গলায় বলে, ‘আর বইল না, সব দোকান বন্ধ। এর মাঝে আবার হোঁচট খেয়ে ব্যথাও পাইছি। একটু স্যাভলন দাও তো, নখটা পরিস্কার করে ফেলি।’

রিতা এবার রইসের পায়ের দিকে তাকিয়ে আঁতকে ওঠে, ‘ইশ, কী অবস্থা হয়েছে। দাঁড়াও, আমি এখনই স্যাভলন এনে দিচ্ছি।’

রঞ্জু অবাক চোখে বাবার পায়ের নখের দিকে তাকিয়ে আছে। রইস সরাসরি ছেলের চোখের দিকে তাকায় না। কেমন যেন লাগছে ওর দিকে তাকাতে।

স্যাভলনটা নখে ঢালতেই জ্বলে ওঠে, মনে মনে নিজেকেই একটা গালি দেয়, উচিত শাস্তি হয়েছে ওর। রিতা একটা পরিস্কার কাপড় এনে বেঁধে দিতে দিতে বলে, ‘শোন, আজ একটা বাজে ঘটনা ঘটেছে।’

রইসের বুকের ভেতর হাতুড়ি পড়ে, কোনোমতে বলে, ‘কী হয়েছে?’

রিতা একবার দেখে নেয় রঞ্জু আশেপাশে আছে কিনা, তারপর গলা নামিয়ে বলে, ‘কুলসুম মেয়েটা আজ গোসল করার সময় কে যেন পেছনের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়েছে। বলো, মানুষ কত খবিশ হয়।’

রইস ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যায়, রিতাকে বুঝতে না দিয়ে অবাক হবার ভঙ্গিতে বলে, ‘কী বলো? কোন শয়তান এই কাজ করল? আর ও জানালাটা বন্ধ করে নেবে না?’

রিতা অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলে, ‘আরে ওইপাশটা তো গাছ দিয়েই ঢাকা থাকে। আমিই মাঝে মাঝে ভুলে যায় জানালা আটকাতে। তুমি একটা কাজ করো, একটা লোহার খাঁচা লাগিয়ে দাও পেছনে। তাহলে কেউ আসতে পারবে না।’

রইস মাথা নেড়ে বলে, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’

রিতা তারপর বিড়বিড় করতে করতে চলে যায়। রইস থম ধরে বসে থাকে, নিজের উপর নিজেরই একটা ঘেন্না চেপে ধরে। ওর কেন যে এমন হয়, মাঝে মাঝে ওই পচা গন্ধটা ও কেন যে পায়!

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই ও মনে মনে প্রতীজ্ঞা করে এমন আর কখনো করবে না। হাত মুখ ধুয়ে রেডি হয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়। আজ রাস্তায় অনেক জ্যাম, দেরি হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। পায়ের আঙুলের ব্যথাটা থেকে থেকে জানান দিচ্ছে কালকের ঘটনাটার।

অফিসে আসতে আসতে আজ ঘন্টাখানেক দেরিই হয়ে যায়। দ্রুত পায়ে লিফটে উঠে দশে চাপে। লিফটের দরজা বন্ধ হবার শেষ মুহুর্তে হুড়মুড় করে সাবরিনা ঢোকে লিফটে, হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘কী রইস ভাই, আপনিও আজ লেট?’

রইস একটা অসহায় মুখভঙ্গি করে বলে, ‘আর বইল না, কী যে জ্যাম।’

সাবরিনা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।

লিফটটা চলতে শুরু করে, কয়েকটা ফ্লোর যেয়েই লিফটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে যায়, ভেতরটা অন্ধকার হয়ে যায়। বিদ্যুৎ চলে গেছে, এই অফিসে মাঝে মাঝে এমন হয়। সাবরিনা ভয়ার্ত গলায় বলে, ‘রইস ভাই, কাউকে এখনই ফোন করেন।’

রইস পকেট থেকে মোবাইলটা বের করতে যেয়ে হঠাৎ করেই পচা গন্ধটা পায়। হাতটা থেমে যায়, মোবাইলটা আর বের করা হয় না। কেমন জানি অবশ লাগছে, শরীরটা ভারী হয়ে আসছে। শয়তানটা আবার ভর করেছে। রইস নিজেকে সামলানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে যায়। কিন্তু নিজের অজান্তেই হাতটা সন্তর্পণে সাবরিনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রইস এবার শেষ চেষ্টা করে, মনটা ঘোরানোর চেষ্টা করে।

এদিকে সাবরিনা অধৈর্য গলায় বলে, ‘কই রইস ভাই, ফোন দেন। আমার ভয় লাগছে।’

রইস ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলে, ‘মোবাইলটা পাইতেছি না।’

রইস যখন বোঝে ও হেরে যেতে চলেছে ঠিক তখনই লিফটা ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে শুরু করে, পুরো লিফটা আলোকিত হয়ে যায়। সাবরিনা জোরে একটা নিশ্বাস ছাড়ে, বলে, ‘উফ, বাঁচলাম। কেন যে এই লিফটাতে ব্যাকআপ থাকে না। আর আপনার কী হইছে, এমন ঘামতেছেন, মুখটাও কেমন লাল হয়ে গেছে? ভয় পাইছেন বেশি?’

রইস ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে, পচা ঘ্রাণটা চলে যাচ্ছে।

ইতিমধ্যেই অফিসে সবাই জেনে গেছে লিফট আটকে যাবার ঘটনাটা। সবাই সাবরিনাকে ঘিরে ধরেছে, সহানুভূতি জানাচ্ছে। রইসকে নিয়ে অবশ্য কারো তেমন আগ্রহ নেই। এটা ভালো, রইস মনে মনে ভাবে। লিফটের আটকে যাবার ঘটনায় ওর আজকের দেরি হয়ে যাবার ব্যাপারটা চাপা পড়ে যায়। রইস আড়চোখে দেখে বস এবার সাবরিনাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।

সেদিন অফিস ছুটি হতেই রইস সিঁড়ি দিয়ে নামে আজ। কয়েকজন সহকর্মী মুখ টিপে হাসে, সাবরিনার কল্যানে সবাই জেনে গেছে যে ও খুব ভয় পেয়েছিল। ভাবুক, আসল কথাটা তো কেউ জানে না যে ওর মনের পশুটার কথা।

রইস অফিসের গেট থেকে বের হয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে কিছুক্ষণ হাঁটে। মনটা ভীষণ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। এভাবে চললে তো ও খুব বেশিদিন নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারবে না। ওর কদর্য চেহারাটা একদিন ঠিক বেরিয়ে আসবে। তখন চাকরি, পরিবার, সম্মান সব হারাবে! কিন্তু ওই সময়টাতে কী যে হয়, এই করুণ পরিণতির কথাগুলো মাথাতেই আসে না।

এই যখন ভাবছে ঠিক তখন ও একজন হকারের গলার স্বরে চমকে তাকায়, ‘এই যে নিয়া যান, খোদ আরব দেশ থেকে আনা সুগন্ধি আতর। একবার লাগাবেন, সারাদিন সুন্দর ঘ্রাণ থাকব, দিল পবিত্র থাকব।’

রইস থেমে যায়, তারপর পায়ে পায়ে হকারটার দিকে এগিয়ে যায়। লোকটা ফুটপাতে একটা সাদা কাপড় বিছিয়ে তাতে হরেক রকমের আতরের ছোট ছোট শিসি নিয়ে বসেছে। রইস ব্যাগটা হাতের ভাঁজে রেখে হাঁটু গেড়ে বসে। শিসিতে লেখা নামগুলো পড়ে, ‘আমির আলুত, কস্তুরী, দরবার, কাস্মীরী অউদ, জান্নাতুল ফেরদৌস’। নানার নামের আতর।

রইস একটা একটা করে নিয়ে ঘ্রাণ শুঁকে, তারপর তীব্র সুগন্ধিওয়ালা একটা আতর কেনে। হাতের পিঠে একটু নিয়ে ঘষে, তারপর হাতটা নাকে ভালো করে ঘষে। একটা তীব্র সুন্দর ঘ্রাণে মাথা ধরে যাবার অবস্থা। রইস মনে মনে ভাবে, যাক, এখন থেকে পচা গন্ধটা পাওয়া মাত্রই ও এই আতরটা নাকে ঘষে নেবে। তাহলে ওর আর অমন হবে না। ভাবনাটা ভাবতেই একটা স্বস্তি টের পায় রইস। ইশ, কী সহজ একটা সমাধান, এতদিন কেন যে মাথায় আসেনি তাই ভেবে ও অবাক হয়।

রইস ফুরফুরে মেজাজে বাসে ওঠে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, বাসে ভীড় থাকার কথা। কিন্তু কেন জানি বাসটাতে অত ভীড় নেই। এমনকি একটা সিট খালিও আছে। রইস ব্যাগটা সামনে ধরে এগিয়ে যায়, কিন্তু বসতে যেয়েই থমকে যায়। একটা সুন্দর মেয়ে বসে আছে। ওর ইতস্ততভাব দেখে মেয়েটা বলে, ‘বসুন না, সমস্যা নেই।’

রইস অনিচ্ছাসত্ত্বেও বসে। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়! রইস অবশ্য আজ ভয় পায় না, পচা গন্ধটা পেলেই আজ আতরটা লাগিয়ে নেবে।

বাসটা এতক্ষণ জ্যামে আটকে ছিল, একটু ফ্রি হতেই ছুটে চলে। জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাসে মনটা জুড়িয়ে যায়। পাশে বসা মেয়েটা মনে হয় ক্লান্ত, ঘুমিয়ে পড়েছে, বুকের উড়নাটা সরে গেছে। রইস চট করে চোখটা সরিয়ে নেয়। কিন্তু একটু পরেই আবার তাকায়। হঠাৎ নাক কুঁচকে ওঠে, আতংকিত হয়ে রইস খেয়াল করে আবার সেই পচা গন্ধটা ফিরে আসছে। রইস দ্রুত হাতে আতরের শিসিটা খোঁজে, সবগুলো পকেট হাতড়ে দেখে, নেই! কই গেল শিসিটা? ব্যাগে না তো? রইস কাঁপা হাতে ব্যাগটা খুলতে থাকে, এদিকে সেই পচা গন্ধটা বেড়েই চলছে।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
০৯/০৪/২০২২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here