অতঃপর প্রণয়,পর্ব:৪

অতঃপর প্রণয়,পর্ব:৪
অরিত্রিকা আহানা

ইরিনের সাথে তুমুল ঝগড়া হয়েছে আয়াজের।প্রি-টেস্ট পরীক্ষায় ইংরেজীতে ত্রিশ পেয়েছে ইরিন।মায়মুনা বেগম আয়াজকে ডেকে নিয়ে বিচার দিয়েছেন।বর্তমানে ডাইনিং এর পাশে ওয়াশরুমে ঢুকে মেঝেতে থম মেরে বসে আছে ইরিন।এই মুহূর্তেই ওর বুক ফেটে কান্না আসার কথা কিন্তু আসছে না।আয়াজ তাকে প্রচুর ধমকাধমকি করেছে।মায়মুনা বেগম সেই সাথে তাল দিয়েছেন।

মূলত তিনি ইরিনের পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে চাইছিলেন।যেই মেয়ে ইংরেজীতে তেত্রিশ পেয়ে পাশ করতে পারে না তাকে পড়িয়ে লাভ কি হবে? আয়াজ বুদ্ধি করে ইরিনকে বকাবকি করার ফলেই তিনি আর বেশি কিছু বলতে পারছেন না।কিন্তু সেইটুকু বোঝার মত জ্ঞান ইরিনের নেই।তার ধারনা আয়াজ সুযোগ বুঝে পুরোনো সব রাগ তার ওপর ঝেড়ে ফেলেছে।তাই আয়াজের মুখের ওপর দরজায় বাড়ি দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসছিলো সে,কিন্তু বিপত্তি ঘটলো তখন, যখন দেখলো আয়াজ ওর পেছনে দাঁড়িয়েছিলো।দড়াম করে দরজার বাড়ি লাগলো আয়াজের কপালে। কপাল ফুলে আলু হয়ে গেছে।ইরিন ভয়ে তাড়াতাড়ি ওয়াশরুম ঢুকে যায়।সেই থেকে বিগত পনেরো মিনিট যাবত ওয়াশরুমে বসে আছে।

দুম করে ওয়াশরুমের দরজায় বাড়ি মারলো। আয়াজ।ইরিন সাড়া দিলো না।

——–“ইরিন দরজা খোল, কথা আছে তোর সাথে!”

অনবরত দরজায় বাড়ি মেরে যাচ্ছে আয়াজ।অনেক্ষন বাদে ইরিন দরজা খুলে বেরিয়ে এলো।মুখ বাকিয়ে বলল,”কি হলো আয়াজ ভাই?.আপনি ওয়াশরুমে যাবেন?..আমার হয়ে গেছে আপনি যেতে পারেন।”

ইরিনের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে একটু আগে কিছুই হয় নি। আয়াজ অগ্নিকন্ঠে বলল,

—“আমার কপালের কি অবস্থা করেছিস দেখেছিস,তারপরেও আবার উলটো রাগ দেখাচ্ছিস? কি রে তুই? দেখি সর আমি মাথায় পানি ঢালবো।মাথা ঘুরছে।”

কপালের অবস্থা দেখে ইরিনের খাপার লাগছে।সত্যিই ফুলে আলু হয়ে গেছে।হাতের তালু দিতে কপাল চেপে দাঁড়িয়ে আছে আয়াজ।ফর্সা না লাল হয়ে গেছে।

—“কি হলো?..সর?

—“আমি কি আপনার মাথায় পানি ঢেলে দেবো?”

—“লাগবে না।তুই সর আমি ঢালছি।”

—“কেন আমি ঢাললে কি সমস্যা?

—“কোন সমস্যা নেই।কিন্তু আমি তোর হাতে পানি ঢালবো না।আমার ইচ্ছে।তুই সর আমার সামনে থেকে।”

—“আমি ঢালি না?”

—“ইরিন সামনে থেকে সর।”

ইরিনের রাগ উঠে গেলো।সে পানি ঢাললে সমস্যাটা কোথায়? ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল,,

—“ভালো ছাত্র হয়েছেন বলে মাটিতে পা পড়ে না তাই না? অন্যদের মানুষ মনে হয় না?

আয়াজ অবাক হয়ে বলল,

—“তোকে আমি কি করেছি?”

—“আপনি আমাকে এতগুলো কথা শোনালেন কেন? আমি আপনার খাই না পরি?

আয়াজ চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছে,ইরিনের কথা গুলো যতটা না ওর কানে লাগছে তার চেয়ে বেশি অন্য কোথাও লাগছে!কতবড় বড় অসভ্য এই মেয়ে!

—“কি বললি তুই?…আবার বল কি বলেছিস?..এখন কথা বলছিস না কেন? তুই ভুল করলে আমি তোকে শুধরে দিতে পারবো না? ”

ইরিন এবার আর একফোঁটাও জবাব দিলো না।চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।আয়াজের কষ্ট লাগছে।ইরিন তাকে এতবড় কথা বললো কি করে? সে কি ইরিনের খারাপ চায়? দাঁতেদাঁত চেপে বলল,

—“লজ্জা থাকলে আমাকে এই কথা গুলো বলতি না তুই!ক্লাস এইটের ফাইনাল পরীক্ষায় যখন ইংরেজীতে ফেল করেছিলি মনে আছে? তখন তোর আম্মাজান শ্রদ্ধেয় মায়মুনা বেগম এসে আমার হাতে পায়ে ধরেছিলো,তোকে পড়ানোর জন্য।গাধার মত খেটেছি তিনমাস!…যেই মেয়ে ইংরেজীতে তেরো পায় সেই মেয়ে ঊননব্বই পেয়ে পাস কারছে কার জন্য?.একটা কানা কড়ি দিয়েছিস?তুই এখন আমার সাথে মুড নিয়ে কথা বলিস?…যা সর আমার চোখের সামনে থেকে।”

—“আপনি আমাকে টাকার খোঁটা দিলেন? ”

ছলছল চোখে প্রশ্নটা করলো ইরিন।ওর চোখের পানি দেখে আয়াজের রাগ কমে গেলো।শীতল কন্ঠে বলল,

—“হ্যাঁ দিয়েছি।ইটের জবাব পাটকেলে না দিলে হয় না।তুই আমাকে হার্ট করেছিস তাই আমিও তোকে হার্ট করেছি।এবার সর!”

—“আপনি জানেন আপনি খুব খারাপ এবং জঘন্য প্রকৃতির একজন লোক?আমি আপনাকে বদদোয়া দিচ্ছি আপনি জীবনে শান্তি পাবেন না।দুনিয়ার সব কষ্ট আল্লাহ আপনাকে দিবেন।আপনার বউয়ের ডেলিভারির সময় যেন পেইন আপনার উঠে!আপনি তখন ব্যথায় ছটফট করতে করতে নিজের গালে নিজে চড় বসাবেন,মাথার চুল ছিঁড়ে টাক হয়ে যাবেন।”

—“শকুনের দোয়ায় গরু মরে না।আর শোন,পারলে পড়াশোনা করে দেখিয়ে দে।এসব ফালতু রাগ দেখিয়ে কোন লাভ নেই।”

আয়াজ ঠাস করে ইরিনের নাকের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলো।পানির কল চালু করে মাথায় পানি দিলো সে।তার মাথাটা ঘুরছে।ইরিনের কথা গুলো ঘুরপাক খাচ্ছে।ঠাস করে ইরিনের গালে একটা চড় বসাতে ইচ্ছে করছে তার।মাথা ফাটিয়ে দিয়েও শান্তি হয় নি ফাজিল মেয়েটার।উল্টোপাল্টা কি সব জঘন্য বদদোয়া করে গেছে তার জন্য।বদ মেয়ে!

এদিকে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করলো ইরিন।এখন থেকে জানপ্রাণ লাগিয়ে পড়াশোনা করবে সে।আর কোনরকম ফাঁকিবাজি করবে না।খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবে।
সেদিনের পর থেকে আয়াজদের বাসার ত্রিসীমানায় যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে ইরিন।বারান্দায় দাঁড়ানোও পুরোপুরি বন্ধ।আয়াজের ইন্টার্নি শুরু হয়ে গেছে।সে ব্যস্ত তার হস্পিটাল, ডিউটি,বিসিএস এর প্রিপারেশন, এসব নিয়ে।

তার প্রায় তিনমাসপর আয়াজের বড় ভাই মহসিন এর বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো ইরিনের খালাতো বোন মুক্তার সাথে।মুখে না বললেও এতগুলো দিন আয়াজকে খুব মিস করেছে সে।একধরনের শূন্যতা অনুভব করেছে।

হলুদের দিন পুরো এপার্টমেন্ট আলোতে ঝলমল করছে।মরিচ বাতি দিয়ে পুরো বিল্ডিং সাজানো হয়েছে।বাড়ির সামনে রাস্তা পর্যন্ত লাইটিং করা হয়েছে।মামীরা,খালামনিরা কাজিনরা সব এক হয়েছে।সবাই একজোট হয়ে গল্পগুজব,হাসি ঠাট্টাতে মজে আছে।ইরিন এসবের কিছুতে যোগ দিলো না।
নেক্সট মান্থে ওর ফাইনাল পরীক্ষা।প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে।

ওর পড়ার রুমে কারো ঢোকা নিষেধ।দরজা আটকে ধুমছে পড়াশোনা করছে সে।পানি খাওয়ার জন্য ডাইনিং এ আসতেই আয়াদের গলার আওয়াজ পেয়ে থমকে গেলো।আজকেই এসেছে আয়াজ।ইরিনের বুকের ভেতর ঢিপঢিপ আওয়াজ শুরু হয়ে গেলো।হাতের গ্লাসটা কাঁপছে। দ্রুত হেঁটে সেখান থেকে সরে গেলো সে।রুমের এসে ভালোকরে দরজাটা লক করে দিলো।বই নিয়ে পড়তে বসে গেলো।কিন্তু পড়ায় মন বসছে না,বসার কথাও না।আজ কতদিন পর মানুষটার গলা শুনেছে সে!কতদিন পর!

ইরিন ঘরের বন্ধ দরজায় অনবরত নক করছে মুনা!ইরিন বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে ওকে ঠেলে ভেতরে ঢুকতে দিলো।মুনা কোন কথাবার্তা ছাড়া খাটের নিচ থেকে একজোড়া নারকেল নিয়ে বেরিয়ে গেলো।দরজার বাইরে আয়াজ দাঁড়িয়ে ছিলো।ইরিন খেয়াল করে নি।দরজা আটকানোর সময় চোখে চোখ পড়ে গেলো।অনিচ্ছাসত্ত্বেও ইরিনের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো,

—“আপনি?

—“কি অবস্থা তোর? পড়াশোনা ঠিক মত করছিস?”

—“সেটা জেনে আপনার কি দরকার?”

আয়াজ হাসলো।মায়মুনা বেগমের কাছ থেকে সব খবরই পেয়েছে সে।ইরিন খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করছে।খবরটা শুনে আয়াজের ভালো লাগছে,ওর ওপর জেদ করে হলেও পড়াশোনায় মনোযোগী হয়েছে ইরিন।ইরিন ভ্রুঁ কুঁচকে বললো,

—“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”

—“ভাবছি।তুই সত্যি সত্যি পড়াশোনা করছিস কি না কে জানে? নাকি ভাব ধরে বসে আছিস?”

—“আপনি যান,বেরোন।”

—“যাবো না।দেখি ঠেলে বের করতে পারিস কি না?”

—“আমার পড়া আছে।”

—“কি পড়ছিস তুই?”

—“আপনি জেনে কি করবেন?”

—“বাব্বাহ্,রাগ করেছিস?”

—“আপনি আমার কন্সেন্ট্রেশন নষ্ট করছেন।”

—“ইহ্।”

—“কিসের ইহ্? আপনি যান আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”

—“তুই এমন করছিস কেন আমার সাথে?..কি করেছি আমি তোকে?”

—“কিচ্ছু করেন নি।কিন্তু আপনি যান।আমি পড়তে বসবো।আমার সময় নষ্ট করছেন আপনি।”

আয়াজ ভ্রু নাচিয়ে ভিলেনটাইপ হাসি দিয়ে বলল,

—“যাচ্ছি,যাচ্ছি,আমি তো ভুলেই গেছিলাম তুই বোর্ড ফার্স্ট হওয়া স্টুডেন্ট,দশমিনিট না পড়লে তোর প্লেস করা আটকে যাবে।তখন তো আবার মহা মুসিবত।”

—“আপনি আমাকে ইনসাল্ট করছেন?”

আয়াজ শব্দ করে হেসে উঠে বলল,

—“ইনসাল্ট বানান কর তো দেখি? তুই তো ইংরেজীতে ডাল।দেখি পারিস কি না?”

—“করবো না।আমি কি আপনার কথা মত চলবো?”

—“আচ্ছা থাক।আমার কথা মত চলতে হবে না।আমি যাচ্ছি তুই পড়।অবশ্য পড় তেমন কোন লাভ হবে কি না কেন জানে?রেজাল্ট বেরোলে দেখা সেই গোল্লা পেয়েছিস। যাই হোক আমি যাই।”

আয়াজ বেরিয়ে গেলো।ইরিনের রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে।যে করেই হোক ভালো রেজাল্ট করে আয়াজকে দেখিয়ে দিতে হবে।তার জন্য যতদূর পর্যন্ত যেতে হয় ইরিন যাবে।দরকার হলে দিনরাত এক করে পড়াশোনা করবে।ইরিনকে নিজের অবস্থান তৈরী করতেই হবে।আয়াজের ভোঁতা মুখ যে করেই হোক থোতা করতে হবে।
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here