অজান্তে_আগমন,পর্বঃ- ১৬,১৭
সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ- ১৬
কাঁদতে ইচ্ছা করছে খুব দ্রোহের। কেন যে সেদিন মুখ ফসকে হ্যাঁ বলে দিয়েছিল। তাও মায়ের সামনে। এখন খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছে দ্রোহের। একটা “হ্যাঁ” এর জোর সম্পর্কে তার ধারণা ছিল না। এতদিন ধরে তো সহ্য করেই যাচ্ছিল। আজ তার প্রথম পরীক্ষা। এখন সেই তার বলা “হ্যাঁ” কে “না” তে পরিণত করতে পারছে না সে। কি করে করবে? মা তো একেবারে রেকর্ড করে হোয়াটসএপ এ সবাইকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। উনি পারেন না শুধু ফেসবুকে একটা পেজ খুলে সেখানে সেই রেকর্ড করা হ্যাঁ শব্দটুকু পোস্ট করতে এই ক্যাপশন লিখে- সুদীর্ঘ সময় পর বুড়ো বয়সে বিয়ের জন্য ‘হ্যাঁ’ বলেছে আমার ছেলে। যারা যারা বিয়ে করতে ইচ্ছুক, ম্যাসেজ অপশন এ গিয়ে নিজের বায়োডাটা দিয়ে দিন।
এতদিন সেই নিয়ে কথা হয়েছে। সাথে “বাবু বিয়ে কর” ডায়ালগ ফ্রি। এতদিনের এই ঝামেলার মধ্যে রেখার সাথে কথা বলে ওঠা হয়নি। সেদিন রাতে সেই একবার ঘোরাঘুরির পর রেখা যেন তাকে এড়িয়ে চলছে। কেন চলছে, সেটা জানা নেই। তবে এমনটাই মনে হচ্ছে দ্রোহের। অবশ্য বাড়িতে এতগুলো মানুষের পাহারার মাঝে রেখার সাথে শান্তিতে কথা বলার সুযোগও নেই। শুধু দূর থেকে দেখেই নিজের ইচ্ছাকে দমিয়ে রাখতে হচ্ছে। দ্রোহের সাথে রাতে রিহান আর রাহাত থাকে। রেখা চলে গিয়েছে দিবার ঘরে। দ্রোহের পাশের ঘরে আপাতত মামা মামি থাকছেন। তাই সেই দিনের মতো রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলার সুযোগটুকু নেই। রাতে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোতে লেগেছে নিষেধাজ্ঞা। দ্রোহ পরিকল্পনায় মেতে উঠেছে কি করে মেয়ের বাড়ি থেকে “না” কথাটা বের করানো যায়। যদিও মাথা শূন্য এই বিষয়ে। বন্ধুদের সাহায্য নিবে ভেবেছিল। কিন্তু সেই আশায় এক বস্তা বালি ঢেলে দিয়েছে বন্ধুরা। দ্রোহ বুঝে পায় না, বালুর ব্যবসা ও করে। আর বন্ধুরা ওর আশায় বালু ঢেলে দেয় কি করে? বন্ধুরা কি তার ব্যবসার জায়গা থেকে বালু চুরি করছে? নাকি মায়ের সাথে হাত মিলিয়েছে। বন্ধুরা আরও জোর দিচ্ছে বিয়ে করার জন্য। সে আরেক চিন্তার বিষয়।
সবাই ঘর থেকে বের হবে বেশ কিছু সময় নিয়েই। দ্রোহের মা এমন সময় রেখাকে ডাক দিলেন। কিন্তু রেখা কিছু বলল না। ছুটির দিন হওয়ায় স্কুলের বাহানাও দিতে পারছে না সে। দ্রোহ মায়ের কাছ থেকে রেখার সম্পর্কে শুনে কথা বলার সুযোগ পেয়ে গেল। সে সরাসরি দিবার ঘরে চলে গিয়ে দিবাকে বের হতে বলল। দিবার তখন ডাক পড়েছিল মামির কাছ থেকে। তাই সে তখন ঘর থেকে বের হয়ে যায়। রেখার কাছে অদ্ভুত অনুভুত হলে সে গোছানো জিনিস আবার গোছানো শুরু করে। মাঝে মাঝে কিচ্ছু একটা খোঁজার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু কি খুঁজছে সেটা হয়তো সে নিজেও জানে না। দ্রোহ খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করল রেখাকে। তারপর বলল,
— মা বলছিল তোকেও যেতে। তুই যাবি না?
— না, আসলে স্কুলের…
— স্কুল বন্ধ আজ।
— হ্যাঁ, বন্ধ তো। কিন্তু ওই যে পরীক্ষার খাতা…
— দেওয়ার শেষ দিন পার হয়ে গিয়েছে।
— ঝামেলা ছিল কিছু।
— সেটাও করার চান্স নেই। রেজাল্ট কার্ডে নাম্বার তোলা হয়ে গিয়েছে।
— তাও…
— তুই চাস না আমি মেয়ে দেখতে চাই? তুই চাস না আমি বিয়ে করি?
— আমি কেন এমন ভাবব? আমি তো…
— তাহলে কথা বলছিস না কেন কয়েক দিন ধরে? এড়িয়ে চলছিস কেন?
— ওসব আপনার ভুল ভাবনা অভি।
— তা নাকি রে রিখি?
— হ্যাঁ তাই।
— কিন্তু আমার তো অন্য কিছু মনে হচ্ছে।
— কি মনে হবে? কিছু না, কিছু না।
— তুই কি আমার মেয়ে দেখতে যাওয়া নিয়ে মন খারাপ করেছিস?
— আবার একই কথা বলছেন কেন? আমি তো বললাম, আমার কাজ আছে।
— মনে যদি কোন দোটানা থেকে থাকে তাহলে সেটা বলে দেওয়া উচিত।
— অভি, আসলে আমি কিছু ভাবছিলাম।
রেখার উত্তরে দ্রোহের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। সে আগ্রহের সাথে বলে উঠল,
— কি বলবি? বল।
— আসলে কয়েকদিন পর বলি। বাড়ি সম্পর্কিত ব্যাপার।
— ওহ। আমি যাই।
বলে দ্রোহ চলে যেতে উদ্যত হলো। দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দ্রোহ পিছনে ঘুরে বলল,
— আজ একটা শাড়ি পরবি রেখা? দিবার কাছ থেকে নিয়ে নিস। এরপর আর বলতে পারব কি না জানি না।
বলেই ঘর থেকে বের হয়ে গেল দ্রোহ। রেখা অবাক হয়ে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল।
_____
মেয়ের বাড়ি যাওয়া হয়। পুরো পরিবার মিলেই যায় সবাই। রেখাও বাদ পড়েনি। রেখা দিবার কাছ থেকে একটা আকাশি রঙের শাড়ি নিয়েছিল। দিবাআ জোর করে রেখাকে সাজিয়ে দিয়েছিল। দ্রোহের মা তো রেখাকে দেখে মুখ ফসকে বলেও ফেলেন যে – বাবু চাইলে রেখাকে বিয়ে করতে পারিস তুই। তারপর সবার নজর উপেক্ষা করে তিনি গাড়িতে গিয়ে বসে পড়েন। হয়তো অতটা গুরুত্ব দিয়ে বলেননি এই ভেবে সবাই শান্ত হয়ে গাড়িতে উঠে বসে। তারপর চলে যায় মেয়ের বাড়ি। সব দেখাদেখির পর যখন দ্রোহের পরিবারকে কিছু বলতে বলা হয় তখন দ্রোহ সবার আগে বলে দেয়,
— আমরা ভেবে দেখব।
বলেই সবাইকে জোর করে সেখান থেকে নিয়ে আসে।
কেউ হয়তো খেয়াল করেনি। কিন্তু খেয়াল করলে ঠিকই দেখত, দ্রোহ মেয়ে দেখতে গিয়ে ওই বাড়িতে বসে আড়চোখে খালি রেখাকেই দেখে গিয়েছিল।
_____
সকাল হতেই কারোর অনুপস্থিতি দ্রোহকে বেশ ভাবাচ্ছে। কিন্তু ঠিক কে অনুপস্থিত, সেটা ঠাওর করতে পারছে না। কিন্তু কেউ একজন অনুপস্থিত।
গতকাল ওই বাড়ি থেকে ফিরে দ্রোহ আর কারো সাথে কথা বলেনি। ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিয়েছিল। দরজা আটকানোর পরেও মায়ের জোর গলার কথাগুলো বুঝতে অসুবিধা হয়নি তার। মায়ের একটাই কথা- তাকে কেন কথা বলতে দেওয়া হলো না? কেন দ্রোহ অমন কথা বলে সবাইকে ফেরত আনলো? যদি এমন করারই ছিল তাহলে যাওয়ার কি দরকার ছিল?
দ্রোহ কিছু বলেনি। মাথায় বালিশ চেপে শুয়ে ছিল। পুরোটা সময় তার কি করা উচিত এই নিয়েই ভেবে গিয়েছে। তারপর শুধু ঘুমিয়েছে সারাদিন। একবার ঘুম ভাঙলে আবার ঘুমাতে চলে গিয়েছে। দরজায় বারবার ধাক্কা দিচ্ছিল বলে একবার দরজা খুলে তাকে জাগাতে মানা করে দিয়েছে। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মা আর কিছু বলেননি। সেদিন খাবারও ঠিক করে খাওয়া হলো না দ্রোহের।
আজ আবার সকাল সকাল এই অদ্ভুত অনুভূতির সম্মুখীন হয়ে আরও খারাপ লাগছে। সে আশেপাশে ভালো করে তাকাল। সবাই তো আছে। মামা-মামি, রিহান রাহাত সবাই। বাবা-মাও আছে। রেখা হয়তো স্কুলে গিয়েছে। এই ভেবে আর ঘাটাল সে নিজেকে। খাবার খেয়ে বের হয়ে পড়ল কাজের জন্য।
সারাদিন পর বাড়ি ফিরে যখন রেখাকে দেখল না তখন অবাক হলো। এতো রাতে কাউকে পড়াতে যাওয়ার কথাও না। মামা মামিরা দুপুরেই ফিরে গিয়েছেন। তখনও রেখাকে দেখেনি দ্রোহ। সে সরাসরি রেখা যেই রুমে থাকত, সেখানে গেল। পুরো ঘরটা আবার আগের মতো দেখে ভ্রূ কুচকাল সে। সোজা মায়ের কাছে গিয়ে নির্লজ্জের মতো জিজ্ঞেস করল,
— মা, রিখি কোথায়?
নির্লজ্জ বলার কারণ দ্রোহ মা-বাবা, কিংবা অন্য কারো সামনে রেখাকে “রিখি” বলে ডাকে না। দিবার সামনেও না। মূলত রেখার সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস-ই করে না। এই প্রথম এমন করল সে। মায়ের উত্তর শুনে সে হতাশ হলো।
— রেখা তো বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে।
— কয়দিনের জন্য?
— কেন? তোকে বলেনি যে ও আর আসবে না? আজ সকালেই তো চলে গেল।
— কোথায় গিয়েছে?
— সেটা জিজ্ঞেস করা হয়নি। ভাবছি পরে জিজ্ঞেস করব।
দ্রোহ আর কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগাল। বেশিক্ষণ না ভেবেই রেখাকে কল করল। ওপাশ থেকে ব্যস্ত শোনাচ্ছে। দ্রোহ বার কয়েক কল করে বসে থাকল। কিছুক্ষণ পর পর ট্রাই করল। কিন্তু বারবার ওই মহিলা একই কথা বলছে। “ব্যস্ত, কিছুক্ষণ পর পর ট্রাই করুন।” শেষে ধন্যবাদ জানাতেও ভুলছে না। দ্রোহ রেগে বিছানায় ফোনটা ছুঁড়ে ফেলল। তারপর বেশি সময় অপেক্ষা না করে শুয়ে পড়ল। মাথা গরম করে কোন চিন্তা ঠিকমতো করা হয়ে উঠছে না। সে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করা উত্তর পাচ্ছে না। তাই ঘুমই শ্রেয় আপাতত।
_____
কাজের ব্যস্ততায় কয়েকদিন চাইলেও রেখার সাথে দেখা করার কোন সুযোগ পেল না দ্রোহ। সে তো রেখার ঠিকানাই জানে না। মায়ের কাছেও সরাসরি জিজ্ঞেস করতে লজ্জা করছে। ওইদিন তো মাথা গরম করে তাও জিজ্ঞেস করে ফেলেছিল। কিন্তু এখন মায়ের সামনে দাঁড়াতেও পারছে না সে। এক অজানা লজ্জা ভর করছে তার উপর। দিবাকে জিজ্ঞেস করলেও দিবা সেই আরেক কথা তুলবে। তাই দিবাকেও জিজ্ঞাসা করেনি দ্রোহ। ক্লান্তির কারণে কয়েক বার ফোন দিলেও সেই “ব্যস্ত আছে” ডায়ালগ ঝেড়ে দেয় মূল কোম্পানি থেকে। দ্রোহ বুঝে পায় না এই মহিলার কি শত্রুতা ওর সাথে। সে রেখার সাথে কথা বলতে চায়। ওর এতো খারাপ দিনও আসে নি যে ওই মহিলার সাথে কথা বলবে। তাও কিছু বলতে পারে না। আগে মাঝে মাঝে রাগ হলে কারো নাম্বারে ফোন করে আগে বলে রাখত যে এইবার আমি কেটে আবার কল করব। তুই না ধরে কল কেটে দিবি। তারপর আবার ওই নাম্বারে কল করে ইচ্ছামতো রাগ ঝাড়ত। কিন্তু এখন সেটা করতেও ইচ্ছা হচ্ছে না। দ্রোহের মাথায় আসলো,
“রেখা তাকে ব্লক করেনি তো?”
চলবে।
#অজান্তে_আগমন
#সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ- ১৭
শুরুতে দ্রোহকে ভাইয়া বলে ডাকলেও পরে সেটা ছেড়ে দিয়েছিল রেখা। বলতে গেলে গুনে গুনে ২ কি ৩ বার ভাইয়া ডাকা হয়েছিল। প্রথম যখন দ্রোহ বাসায় আসে তখন বাবা পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল দ্রোহের সাথে রেখার। দ্রোহের বাবার সাথেও পরিচয়টা তখনই হয়। বয়সে বড়দের ভাই ডেকে অভ্যাস। তাই দ্রোহকেও কোন নামে না ডেকে ভাইয়া ডাকা হত শুধু। মেয়ে হিসেবে রেখা ছোটকাল থেকেই অন্তর্মুখী স্বভাবের। মনের ভাবনা মনে রাখা ছিল তার কাজ। দ্রোহকে বেশ কয়েকবার দেখলেও কখনো কথা বলার চেষ্টা করেনি। অবশ্য এখনো রেখার এই স্বভাব বহাল আছে। মাঝে মাঝে খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণেও দ্রোহকে ডাকতে হলে অন্যকে দিয়ে ডাক দেওয়ানোর চেষ্টা করত সবসময়। মাকে দিয়ে এই কাজটা বেশি করানো হত। রেখার মা যখনই খাবারের জন্য ডাকতেন, তখন রেখার একটাই কথা- “নিজেই ডাক দেও না।” বলেই কোনোমতে নিজের ঘরে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিত। বাবা ডাক দিত সেই তুলনায় কম। দরকার পড়লে নিজেই চলে যেতেন দ্রোহের কাছে। তাই প্রথম এক বছরে কথা বলা বলতে গেলে হয়নি তাদের মধ্যে। রেখা তখন কিশোরী বয়সে নানা ভাবনার সম্মুখীন, তবুও নিজের মধ্যে চেপে রাখত সব। দ্রোহের প্রতি জন্মানো অনুভুতিও তাই কোনদিন প্রকাশ পায়নি।
মাসখানেক পর একদিন শুনতে পারে দ্রোহ পাড়ার ছেলেগুলোর সাথে বাজি ধরেছে রেখাকে দিয়ে জোরে জোরে ভাইয়া ডেকে শুনাতে হবে ওদের। মূলত রেখার কথা না বলা স্বভাবের জন্য সবাই ধরেই নিয়েছিল দ্রোহ হারবে এই বাজিতে। আড়াল থেকে শোনার পরই রেখার খুব রাগ হয়েছিল। তাকে নিয়ে কেন বাজি ধরবে দ্রোহ? রেখার সেই ছোট মনটা খুব রাগ করেছিল। তাই জিদ ধরে দ্রোহ যখন তাকে চিৎকার করতে বলে তখন সে বলে দিয়েছিল আর জীবনে ভাইয়া বলে ডাকবে না দ্রোহকে। বাজি ধরা যে ভালোও না সেটাও বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। যদিও কতোটুকু সফল হয়েছিল সেটা রেখা কখনো ভেবে দেখেনি।
দ্রোহ যখন রেখাকে পড়ানো শুরু করে, তখন রেখা নিজেও রঙিন চশমা পরিহিত এক কিশোরী। দ্রোহকে নিয়ে যে মনে অনুভূতি জন্মাত না- এমনটা নয়। সেও ভাবত, অনেক ভাবত। তারপর নিজেকে নিজেই বকে সব ভাবনার ইতি ঘটাত। পরের দিন আবার ভাবত। সময়ের ব্যবধানে পড়াশোনার চাপে, দৈনন্দিনের কাজে এক সময় সেই অনুভূতি চাপা পড়ে যায়। হয়তো মানুষই পারে, যাদেরকে নিজের জীবনে অপ্রয়োজনীয় মনে করে, তাদের কথা ভুলে যেতে। কোন একটা কি দুইটা কথা মনে রাখলেও তার ব্যবহার, চেহারা- সবটা ভুলে যায় সে। রেখাও তার ব্যতিক্রম কিছু নয়। দ্রোহের স্মৃতি হাতে গোনা কয়েকটা মনে রাখলেও তার চেহারা, কথা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। সফলও হয়েছে। তবে আবার যে কোনোদিন দেখা হতে পারে সেটা ভাবেও নি। এটা অপ্রত্যাশিত ছিল তার কাছে। জীবনে নানা অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলোর মধ্যে এটাও একটি। তবে রেখার কাছে হয়তো এই একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনাই সুখকর ছিল। পুরনো ইচ্ছাগুলো আবার সতেজ হয়ে উঠেছিল। নতুন ভাবে। দ্রোহের করা প্রতিটা কাজ যেকোনো মানুষকে দুর্বল করতে বাধ্য- এমনটা ধারণা রেখার। বিশেষ করে দ্রোহ ভুল জায়গায় মুখ ফসকে কিছু এমন কথা বলে দেয় যেগুলো সরসরি মুখে না মানলেও মূলত সত্য। এই তো, কিছুদিন আগে মুখ ফসকে রিখিকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েই বসল। এসব কথা খুব করে রেখার মনে প্রভাব ফেলে। যেটা এড়িয়ে চলা তার পক্ষে সম্ভব না। কিছুদিন পর তো দ্রোহ বিয়ে করেই ফেলবে। তখন রেখার জন্য দ্রোহের নতুন সম্পর্কে সমস্যা হতে পারে বিধায় সেই স্থান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে। সবাইকে জানালেও দ্রোহকে জানায়নি। যদি দ্রোহ তার মনের অবস্থা বুঝে যায়? রাতের আধারেও কি সুন্দর রেখার মনের অবস্থা পড়ে ফেলে ছেলেটা। এতে দ্রোহের মা বিরোধ করলে? কিংবা যদি দ্রোহ নিজেই রাজি না হয়, তাহলে সেটা রেখার জন্য আরও লজ্জাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। তাই দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। যত যাই হোক, নিজেকেও তো আবার কাজের বেড়াজালে বেঁধে ফেলতে হবে। দ্রোহ সামনে থাকলে সেই ষোড়শী রেখা ফিরে আসতে চায় বারবার। আর দ্রোহ পাগলামিগুলো করে শুধু রেখার সাথে। সেটা তো সামলাতে হবে।
……
— মিস, মিস? রেখা ম্যাম, আপনার নেক্সট ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। আপনি এখনো যাননি কেন?
নিজের নাম শুনে ভাবনার জগত থেকে বের হয়ে আসে। তার সম্পূর্ণ কথা মাথায় ঢুকতেই রেখা কাগজপত্র গুছিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে চলে যায় নিজের ক্লাসের উদ্দেশ্যে। এই ভাবনাগুলো আজকাল বড্ড জ্বালাচ্ছে। দ্রোহের সাথে যোগাযোগ না থাকা স্বত্তেও তাকে ভুলতে পারাটা আগের মতো সহজ হচ্ছে না। আসলেই কি জলজ্যান্ত কোন মানুষকে এতো সহজে ভোলা যায়? জানা নেই রেখার, আবার জানতেও চায় না সে।
__________
নিজের একটু বুদ্ধি ব্যয় করে রেখার সাথে দেখার করার পরিকল্পনা করেছে দ্রোহ। অবশ্য শুরুতেই দেখা করবে কি করবে না সেটাও ঠিক করে জানে না। মায়ের কাছে শুনেছে রেখা মায়ের সাথে রোজ দেখা করে যায়। কথাটা জিজ্ঞেস করতে হয়নি আলাদা করে। রাতে খাবার টেবিলে বসে মা বাবাকে বলছিলেন। তখন কান উঁচু করে পুরোটা শুনেছে। রেখা আগে যেই টিউশনিগুলো করত সেগুলো এখনো করে। একই বিল্ডিং এ হওয়ায় একবার করে দেখা করে যায় রেখা পড়ানো শেষ হলে। মা আর দিবা মাঝে মাঝে সময় করে ওদের বাড়িতে গিয়েই রেখার সাথে গল্প করতে বসে পড়ে। সাথে যুক্ত হয় শিক্ষার্থীর মা। টিউশনিগুলো রাতে হওয়ায় দিবারও কোন সমস্যা হয় না। সেও গিয়ে দেখা করে আসে। বাবা বাসায় থাকেন না সেই সময় বিধায় বাবার সাথে দেখা হয় না। কিন্তু কথোপকথনের এই পর্যায়ে এসে শুনতে পাওয়া যায় রাস্তায় বাবার সাথে দেখাও হয়ে গিয়েছে কয়েকবার। দ্রোহ মনে মনে তখন বলেছে,
“এই মেয়ে বিয়ের পর বর ছেড়ে দিয়ে শশুর বাড়ির সবার সাথে সময় কাটাবে। সকাল থেকে সন্ধ্যা শ্বশুর শাশুড়ি আর অন্য সব পাশের বাসার অ্যান্টিদের সাথে। বাচ্চাগুলোও বাদ পড়বে না। তারপর রাতে ননদের সাথে ঘুমাতে চলে যাবে। আর বেচারা বর ‘একলা চলো রে’ গানটা গাইবে।”
দ্রোহ তো মনে মনে গানের ২ লাইন গেয়েও ফেলেছিল।
‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে,
তবে একলা চলো রে।’
এরপর মনে মনেই কয়েক মিনিট শোক প্রকাশ করল বেচারা রেখার বরের জন্য। তারপর আবার ওদের কথায় মনোযোগ দিল। রেখার ঠিকানা এতদিনে মা জেনে গিয়েছেন। কিন্তু মাকে তো আর সরাসরি জিজ্ঞেস করা যায় না। দিবাকে জিজ্ঞেস করলে এক কথা ধরবে। “ঠিকানা লাগবে কেন? বিয়ে করবে নাকি?” তারপর বাবা মায়ের কানেও এই কথা লাগাবে। দ্রোহ একবার ভাবল, মায়ের কানে দিবাকে দিয়ে এই কথা লাগানোই যায়। মা যদি ধরে বেঁধে রেখার সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়?
কথাটা ভেবেই একগাল হাসল দ্রোহ। পাশ থেকে দিবার আওয়াজ পেল সে,
— দাঁত ক্যালাচ্ছিস কেন ভাইয়া? কোলগেট স্মাইল দেওয়ার মানে কি? তোর দাঁত অতো সাদাও না যে দেখিয়ে বেড়াবি।
বোনের কথায় রাগ হলেও কিছু বলল না দ্রোহ। সোজা মাকে প্রশ্ন করেছিল,
— কি ব্যাপার মা? তুমি এতো শান্ত কেন? অন্যদিন হলে তো বিয়ে বিয়ে করে মাথা খারাপ করে দিতে!
— তোকে আর বিয়ের কথা বলব না আমি। তুই যা, সন্ন্যাসী হয়ে থাক। তোর বিয়ে জীবনেও দিব না আমি।
মায়ের এমন উত্তরে ধুপ করে দ্রোহের খুশি মুখটা নেমে গেল। দিবা বলল,
— কেন? তুমি কি বিয়ে করতে চাও?
— না, তোর বিয়ের কথা ভাবছি আমি। আজকালের মধ্যে একটা রিকশাওয়ালা ধরে এনে বিয়ে করিয়ে দেব।
— দিলে ফুচকাওয়ালা দেও, অন্তত ফুচকা ফ্রিতে তো খেতে পারব।
— ওকে, তাই হবে।
— ভাইয়া?
— আর কাঁদতে হবে না। আমার কথার উত্তর দিয়ে ভাব নিতে আসবি না। চুপচাপ খা।
যাই হোক, সবটা জানার পর সে আজ দ্রুত নিজের সব কাজ সেরে নিয়ে ইমনের বাইকের চাবি সবার সামনে দিয়ে ডাকাতি করে ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে। ইমন ছেলেটা কত করে বলল- আজ যাস না নিয়ে। নতুন নতুন জিএফ পাইছি। ওরে খাওয়াইতে নিয়ে যাওয়ার কথা আজ। বাইক না থাকলে এইটাও চলে যাবে। দ্রোহ মুখের উপর দিয়ে চাবি ঘুরিয়ে নিয়ে গিয়েছে। তামিম আর অর্পণ তখন সাথেই ছিল। তারাও দ্রোহকে সাহায্য করেছে। ইমনের পকেট সার্চ করতে। এমনকি মানিব্যাগের ভেতরে থেকে লুকিয়ে রাখা চাবিটা বের করে তো আরও পাঁচশো টাকার নোটও দ্রোহের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে তামিম। সিয়াম তখন কোন এক কাজে সেই মুহূর্তে রিকশায় করে যাচ্ছিল। ওদের রাস্তায় এমন কাণ্ড দেখে রিকশা থামিয়ে নামল। নিজের চোখের চশমাটা ঠেলে বলে ওঠে,
— কি ব্যাপার? তোরা এমন রাতে দুপুরে ডাকাতি করছিস কেন?
অর্পণ তার কথা ঠিক করে বলে ওঠে,
— বল সন্ধ্যায়- রাতে। ওটা তো দিনে দুপুরে হয়।
— আমাকে শিখাতে আসিস না। তোর এইটে ফেল করার রেজাল্ট নাম্বার সহ আমার এখনো মুখস্ত আছে। শুনতে চাস?
— মাফ কর। আমরা তো শুধু ইমনের বাইকের চাবি ডাকাতি করছিলাম।
ততক্ষণে তামিম রাফিকেও কল করে ফোন লাউড স্পিকারে দিয়ে দিয়েছে। ওদের কথা শুনে রাফি নিজের পুরনা ডায়ালগ ঝাড়ল।
— মামা, চাইল্ডহুড ক্রাশের সাথে রাতে দেখা করতে যাবা, আগে বলবা না? আমরা বন্ধু হয়ে এইটুকু করব না ভাবলা তুমি? আমরা তো ধার করে হলেও একটা বাস ভাড়া করে দিতাম।
রাফির কথায় বাকি ৪ জন ভ্রূ কুঁচকে দ্রোহের দিকে তাকাল। তারপর একসাথে “ও…” বলে উঠল। ওদের স্বমস্বরে শব্দ করতে শুনে কয়েকজন উৎসাহী হয়ে পিছনে ফিরে তাকাল একবার। শেষে যাওয়ার সময় ইমন এই বলে ছেড়েছিল,
— আমার এইটাও গেল এবার তুই আমার জন্য বউ খুঁজে দিবি ভালো দেখে কাজে ব্যবহারে উত্তম মেয়ে।
— যাও মামা, তোমার জন্য আমি পুরো এলাকায় কালকে মাইকিং করে করে মেয়ে খুঁজব।
— ধুর পাঠা, একেকটা হারামী সব। বলেও শান্তি নাই। খালি জোকস ভেবে নেয়।
তখন সিয়াম তামিম অর্পণ আর দ্রোহ মিলে ৪ দিক থেকে ইমঙ্কে জড়িয়ে ধরে বিদায় জানিয়ে দেয়। দ্রোহ বাইকে করে দৌড় লাগায় বাড়ির দিকে।
রেখা তখন শেষ টিউশনি পড়িয়ে বাড়ি ফিরছিল হয়তো। তাই দ্রোহ দেরি না করে রেখার পিছু নিল নিঃশব্দে। রেখা বাসে উঠে পড়লে সেই বাসের পিছু নিল দ্রোহ। উদ্দেশ্য রেখার বর্তমান ঠিকানা খুঁজে বের করা।
চলবে।