অজান্তে_আগমন,পর্বঃ- ১০,১১
সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ- ১০
— শুনছ?
নিজের স্বামীর মাথায় এক আঙুল দিয়ে খোঁচা দিয়ে বলে উঠলেন দ্রোহের মা।
— হ্যাঁ, শুনছি।
খবরের কাগজ থেকে মুখ না সরিয়েই বলে উঠলেন দ্রোহের বাবা।
— একটা কথা ছিল বলার।
— কি চাও?
— চাই না, যা বলছি তাই হবে।
— যদি রাজি না হই তাহলে?
— তাহলেও লাভ নাই। আমি শুধু জানাতে এসেছি। অনুমতি না দিলে পরে জোর করে অনুমতি নিব। আমার ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের জোর কিন্তু তুমি জানো না।
— এই জন্যই তো যত ঝামেলা। ডিশ লাইন কেটে দিয়েই শান্তি নাই। ফোনে এমবি কিনে দেখবে তুমি নাটক।
— ওরা গুরুজন হয়, সম্মান দিয়ে কথা বলো।
— তুমি কি আমাকে নাটক নিয়ে কিছু বলতে এসেছ দিবার মা? তাহলে আর বলো না। ওই নাটকের ‘ন’ ও আমি বদলাতে পারব না। ওদের নাটকে পরিবর্তন করতে হলে ওদের সরাসরি ফোন দিয়ে বলে দেও যে কোন পর্বের কোন অংশ তোমার পছন্দ হয়নি। ওরা পারলে আবার নতুন করে শুটিং করবে।
“হ্যাঁ, একবার বলতে যাও। পিস্তল দিয়েই তোমাকে শুটিং করে দেখাবে”
কথাটা মনে মনে বলেই আবার খবরের কাগজে মন দিলেন দ্রোহের বাবা। দ্রোহের মা অতিরিক্ত পরিমাণে ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন। তিনি মূল বিষয় থেকে সরে গিয়েছেন বুঝতে পেরে আসল কথায় আসার কথা ভাবলেন।
— নাটক এর উপর আঙুল তুলবে না বলে রাখলাম বাবুর বাবা। আর আমি তোমাকে এই কথা বলার জন্য আসিনি। আসল কথা হলো, আমাদের বাড়িতে একটা রুম ফাঁকা আছে না?
— হ্যাঁ। আছে। কেন?
— ওখানে একটা মেয়েকে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে? বাড়ি ভাড়া দিয়েই থাকবে সে। আমার কথা হয়েছে তার অভিভাবকের সাথে।
— কি জন্য ভাড়া দিতে চাও তুমি?
— আরে, মেয়েটা একা থাকে। এখানে বাড়ি ভাড়ার কথা উঠতেই একার পক্ষে ওর থাকা সুরক্ষিত না। ……
এভাবে দ্রোহের আগে বুঝানো সব কথা সুন্দর ভাবে পুনরায় বললেন তিনি। দ্রোহের বাবাও এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। নিজের স্ত্রীর উপর পুরো ভরসা আছে। তাই আর বেশি কথা বললেন না। আর একটা রুম তো ফাঁকা পড়েই আছে। সেখানে কাউকে থাকতে দিয়ে যদি কারো সাহায্য করা যায়, তাহলে তো ভালোই।
মা যখন দ্রোহকে ফোন করে কথাটা জানালেন, তখন দ্রোহ কোন মতে কল কেটে সিদ্ধান্ত নিল বাড়ি গিয়ে বাবার লুঙ্গি নিয়ে ঘরে দরজা আটকে “লুঙ্গি ড্যান্স” গানে নাচবে। সব কিছু কি সুন্দর ভাবে হয়ে যাচ্ছে! শুধু রেখা বেঁকে না বসলেই হলো। আর কয়েক দিনের অপেক্ষা। নতুন মাসের সাথে বাড়িতে অনুন সদস্যের আগমন ঘটতে চলেছে।
“আচ্ছা, নিচের ঝালমুড়ি মামার কাছ থেকে লুঙ্গি ১০ মিনিটের জন্য ধার নিলে কেমন হয়?”
মনে মনে কথা বলতেই দ্রোহের মন ওর কথার বিপরীতে যুক্তি দাঁড় করালো,
“গাধা, তাহলে ঝালমুড়ি মামা কি পরবেন? ওই ১০ মিনিটে তুই কি উনার ইজ্জত নেওয়ার কথা ভাবছিস?”
দ্রোহ বিড়বিড় করে বলে উঠল,
“আবার আমি আমাকে গাধা বললাম? ভয়ংকর ব্যাপার। ভাবা যাবে না এসব।”
__________
নিজের ব্যাগে ল্যাপটপ ঢোকাতে ঢোকাতে মনোয়ারা বলে উঠলেন,
— আজ আমার জরুরি ক্লাস না নিতে হলে তোকে আমিই পৌঁছে দিতাম। কিন্তু সেটা পারলাম না। আগে এমনিই পরপর তিনটে ক্লাস মিস দিয়েছিলাম। সেগুলো কমপ্লিট করানো হয়নি। তাই আজ তোর সাথে যেতে পারব না। তার বদলে তোকে একটা নাম্বার দিচ্ছি, ওই নাম্বার থেকে ফোন এলে জিনিস পত্র নিয়ে নিচে একেবারে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে পড়বি। তার সাথে সোজা চলে যাবি। সে তোকে একেবারে বাড়ি পৌঁছে দিবে। বুঝলি? আমার চেনা মানুষ। এখন চুপ করে বসে থাক। আমি গেলাম।
বিশাল এক বক্তব্য স্থাপন করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন মনোয়ারা খাতুন। ঘরে দরজা লাগিয়ে খালামণির কথা মতো বিছানায় চুপ করে বসে রইল রেখা। টানা ২ মাস খালার সাথে থাকার পর আর যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু যেতেই হবে। বাইরের মানুষদের থাকার নিয়ম এখানে নেই। এতদিন যে লুকিয়ে ছিল, এটা ওর ভাগ্য, যে কেউ দেখে ফেলেনি। অন্যরাও সাহায্য করেছে। কিন্তু এখন কাজের জন্য বাড়ি বদলাতে হবে। সেখানে গিয়ে নতুন করে টিউশনি খুঁজতে হবে। সে আরেক বাড়তি কাজ। নিজেকে গুছিয়ে নিতে না জানি কত সমস্যা হবে আর ওই বাড়ির মানুষগুলো কেমন হবে – এসব প্রশ্ন তো বারবার আসে মনে।
দিন পার হলেই নতুন মাস পড়বে। নতুন স্কুলে সব কাজ নতুনভাবে শুরু করতে হবে। রেখা নিজের চারদিকে যেন খালি “ঝামেলা” দেখছে। ঝামেলা নামক দেওয়ালে আটকে গিয়েছে সে।
ফোনের সেই চিরপরিচিত রিং টোন কানে আসতেই ভাবনার ইতি ঘটে। নাম্বারটা “বাড়ি খুঁজে দিবেন” নামে সেভ করে রেখেছে। সেটা দেখেই ফোন তুলল রেখা। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করার সাথে সাথেই কেউ বলে উঠল,
— দ্রুত নেমে আসুন।
বলেই কল কেটে দিল। রেখার জবাব দেওয়ার অপেক্ষার পর্যন্ত করল না। রেখা দেরি না করে নিজের লাগেজ দুটো নিয়ে আর কাঁধে ঝোলানোর কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে নিচে নেমে পড়ল। নামার আগে এক পলক বুড়িগঙ্গা নদীটা দেখে নিল।
মেইন গেটের সামনে আসতেই মানুষের উপচে পড়া ভিড় খেয়াল করল রেখা। দুপুরের এই সময়টাতে সকল কর্মজীবী মানুষ দুপুরের খাবার শেষ করে আবার নিজের কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। তাই রাস্তায় আর ফুটপাথে তাদের ভীড় লক্ষণীয় একটি বিষয়। যে কেউ এই ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যেতে বাধ্য। বাংলায় তখন জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি সময়। আর দুপুরে সূর্যের উত্তাপ থাকে অসহনীয়। এর সাথে মানুষের ভিড়, ঠেলাঠেলি, আর পায়ে লাথি খাওয়া- সব মিলিয়ে এক আলাদা অপ্রকাশ্য অনুভূতির সৃষ্টি করে সেখানে উপস্থিত সকলের মনে। এই অবস্থার সাথে পরিচিত মানুষের মধ্যে কিছু মানুষ এই বিষয় নিয়ে ভাবে-ই না। আবার কিছু মানুষ অবাক হয়। এর মাঝামাঝি পর্যায়ে যারা আছে, তারা হলো এই ভিড় সম্পর্কে জেনেও বিরক্ত হয়। রেখা এই হিসাবে মাঝামাঝি পর্যায়েই পড়ে। সে জানে, দুপুরে গরমের মধ্যে ভিড়ে কেমন পরিস্থিতির শিকার হতে হবে। তাও বিরক্ত হয়। এক এক করে বাস সামনে দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে। বাস কনডাক্টররা হেঁকেই চলেছে কতগুলো জায়গার নাম। এদের মুখে শুনে শুনেই মুখস্ত হয়ে যায় কোন এলাকার পর কোন এলাকা আসে সামনে। রিকশা গুলো তো মানুষের হাঁটার জন্য সামনেও এগোতে পারছে না। সকলের কোলাহলে ফোনের রিং টোন কান পর্যন্ত পৌছাচ্ছেই না। ভাইব্রেশন চালু করা ছিল বলেই হাতের দিকে কাপাকাপি অনুভব করে সেদিকে তাকাল। “বাড়ি খুঁজে দিবেন” নাম্বার থেকে কল করেছেন সেই লোকটা। ফোন তুলে কথা বলার জন্য সালাম দিতেই সামনে চোখ পড়ল দ্রোহের উপর। রেখা সরাসরি ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ‘হ্যালো’ বলল। ওপাশ থেকে কি বলল লোকটা সেদিকে খেয়াল নেই। হঠাৎ কানে চেপে ধরা ফোনে জোরে চিৎকার করে উঠল অপাশের লোক।
— শুনতে পারছেন?
— হ… হ্যাঁ, শুনতে পারছি।
— আমি হাত তুলছি। হাতে ফোন ধরেই। এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা ফোন ওয়ালা হাতের কাছে চলে আসলে আমাকে দেখতে পারবেন।
— ঠিক আছে।
বলেই রেখা ফোন নামিয়ে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটায় ফোন রেখে দিল। উপরের দিকে তাকিয়ে ওই কাঙ্ক্ষিত হাতও খুঁজে পেয়ে গেল। লোকটার কথা মতো ইতি-উতি না করেই সোজা হাতের দিকে নজর রেখে সামনে এগিয়ে গেল। একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে হাত থেকে চোখ নামিয়ে নিচে তাকাল। সামনে দ্রোহকে দেখে অবাক হলো সে। নিজের ফোন বের করে আবার ওই নাম্বারে কল করতেই দ্রোহর ফোন বেজে উঠল। রেখা খপ করে দ্রোহের হাত থেকে ওর ফোন ছিনিয়ে নিল। নিজের নাম্বার ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠতে দেখে আরেকদফা অবাক হলো। বিস্ময়ে তার মুখ খুলে বিশাল গর্তের সৃষ্টি করল। দ্রোহ নিজের ফোন ফিরিয়ে নিয়ে হাত দিয়ে রেখার মুখ বন্ধ করে বলল,
— এবার চলুন। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। হাত ধরলাম যাতে হারিয়ে না যান আপনি।
বলতে বলতে রেখা এক হাত ধরে সামনে হাঁটা শুরু করল। হাতে টান অনুভব করতেই রেখাও সামনের দিকে হাঁটা ধরল। হঠাৎ খেয়াল হলো, দ্রোহ হাত ধরার পাশাপাশি ভারী লাগেজটাও নিজে নিয়েছে। রেখা বিস্ময়ের জন্য ব্যাগটাও ফিরিয়ে নেওয়ার সময় পেল না।
দ্রোহের সাথে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হতেই আরেকটা ঘর কেটে বের হল রেখা। যতই দূরে থাকুক না কেন, রেখা ফ্লাইওভার ব্রিজ ছাড়া রাস্তা পার হয় না। দরকার পড়লে গন্তব্য একেবারে সামনে থাকলেও রিকশা ভাড়া করে ঘুরে যায়। আর রিকশা ভাড়া না থাকলে হেঁটেই যায়। রেখা বরাবর সমস্যা এড়িয়ে চলার মতো মানুষ। রাস্তায় কি না কি হবে এই ভেবে কখনো নিজে নিজে পার হয়নি সে। আগে বাবার হাত ধরে কিংবা মায়ের হাত ধরে পার হত। কিন্তু পরে আর তেমন হয়নি গত তিন বছরে। সেসব পুরনো কথা। অনেকদিন পর এভাবে হাত দেখিয়ে বাস থামিয়ে, অন্য সব গাড়ি থামিয়ে রাস্তা পার হলো রেখা। সে কথা ভাবতেই এক শীতল শিহরণ বয়ে গেল রেখার মাঝে। এখনো বিষয়টা বিশ্বাস হতে চাইছে না তার কাছে।
আশেপাশে তাকিয়ে দেখল, দ্রোহ সিএনজি ঠিক করার চেষ্টা করছে। অনেকক্ষণ পর দ্রোহ একাই ফিরে এলো। আর বলল,
— বাসে যেতে হবে। সিএনজি যাবে না এখন অতদুর।
— রিকশায় যাওয়া সম্ভব না?
— সম্ভব। দুটো রাস্তা আছে। এক, রিকশা বার বার বদলাতে হবে। মানে রাস্তা ভেঙে ভেঙে যেতে হবে। আর এই দুপুরে রিকশা কি পরিমাণে ভাড়া নিবে সেটা হিসাব করতে বসেন। নাহলে দুই, রিকশায় উঠে পুরো রাত হয়ে যাবে যেতে যেতে। এর মাঝে রিকশাওয়ালা অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন। তারপর আপনার নামে কেস করলে আমার কিছু করার নাই।
রেখা ঘাবড়ে গেল। একা একা এতদূর যাওয়া হয়নি কখনো। তার উপর দ্রোহ তাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে। রেখা মাথা নিচু করে ফেলল। দ্রোহ রেখার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।
চলবে।
#অজান্তে_আগমন
#সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ- ১১
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও খালি বাস না পেয়ে দ্রোহ আজ বাড়ি ফেরার আশাই ছেড়ে দিয়েছিল। রেখার দিকে তাকাতেই দুপুরের রোদে রেখার ক্লান্ত চেহারা বোধগম্য হয়ে উঠল না। বলতে গেলে দেখতেই পেল না। মেয়েটা হয়তো এখনো রিকশাওয়ালা অজ্ঞান হলে কিভাবে হাসপাতালে নিয়ে যাবে সে আর তারপর কি কি করবে, সেসবের হিসাব-ই করছে। কথাটা মাথায় আসতেই আনমনে হাসল দ্রোহ। রেখা রিকশাওয়ালার কাছ থেকে গামছা নিয়ে সেটা মাথায় বেঁধে রিকশা চালাচ্ছে। ব্যাপারটা বেশ ভালো লাগল দ্রোহের। ওর সত্যি সত্যি রেখাকে লুঙ্গি পরতে দিয়ে রিকশা চালানোর কথা বলতে ইচ্ছা করল। কিন্তু সেই ইচ্ছা তখনই দমে গেল। নিজের বউ হলে নাহয় জোর করেই এখনই একটা লুঙ্গি পরতে দিত। তারপর রিকশা চালাতে বলত। কিন্তু রেখার সাথে এখনো তার তেমন কোন সম্পর্ক নেই। তাই ইচ্ছা জাগলেও কিছু বলল না দ্রোহ। আবার সে রেখাকে বিয়ে করার কথা ভাবছে দেখে বাসের দিকে মন দিল। না জানি, কিছু সময়ের জন্য অমনোযোগী হয়ে পড়ায় কোন খালি বাস মিস করল না কি!
শেষে বাধ্য হয়ে একটা ভরা বাসেই রেখাকে তুলে দিয়ে নিজেও উঠে পড়ল দ্রোহ। একটা সিট থেকে একটা লোককে উঠিয়ে সেখানে রেখার বসার ব্যবস্থা করে দিয়ে নিজে ভিড় থেকে বের হয়ে আসলো। পাশে মহিলা আছে দেখেই ওই সিটে রেখার বসার ব্যবস্থা করেছিল সে। বাসের দরজায় ঝুলতে ঝুলতে যাওয়ার আরেক আনন্দ। মোটামুটি ঝুলন্ত অবস্থায় আছে দ্রোহ। রেখার দিকে তার খেয়াল নেই। দরজার কাছে দাঁড়িয়েই বাইরের তপ্ত বাতাস অনুভব করতে বেশ একটা অসুবিধা হচ্ছে না তার। জাদুর বলে এই গরম বাতাসকে মুহূর্তে বরফ বানাতে ইচ্ছা করলেও এমন কোন জাদু আছে কি না সেটা দ্রোহ জানে না। আর থেকে থাকলেও তার মন্ত্র দ্রোহ শোনেনি আর মুখস্তও করতে পারেনি। হঠাৎ রেখার কথা মনে পড়তেই ভিড়ের মধ্যে দিয়ে রেখাকে দেখার চেষ্টা করল। রেখার পাশে মহিলাটা ততক্ষণে উঠে পড়েছে। সেখানে একটা লোক এসে বসেছে। রেখার সিটের পাশেও কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে। রেখার মুখ দেখে ওর অবস্থা আন্দাজ করতে পেরে সবচেয়ে অপ্রিয় “ভিড়” নামক অবস্থার মধ্যে পা ফেলতে হলো তাকে। রেখার সিটের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। দ্রোহকে সেখানে তাকে আগলে দাঁড়াতে দেখে রেখা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এমন পরিস্থিতিতে বারবার পড়লেও ব্যাপারটা অস্বস্তির তার কাছে। কিছু দূর সামনে যেতেই রেখার পাশে বসা লোকটা উঠে পড়ল বাস থেকে নামার জন্য। দ্রোহ সাথে সাথে রেখাকে জানালার পাশের সিটে বসতে বলে। রেখা সেখান থেকে সরতেই ধপ করে নিজে ওই সিটে বসে পড়ল।
__________
বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে ৩-৪ ঘণ্টা সময় লেগে গেল। ততক্ষণে বিকেল পার হয়ে গিয়েছে। আরও কিছু সময় গেলেই অন্ধকার হয়ে যাবে আকাশ। ভাস স্ট্যান্ডে বাস থামতেই দুজনে নেমে পড়ে। দ্রোহ পিছু পিছু হাঁটা ধরতেই দ্রোহ তাকে থামিয়ে লাগেজ দুটো সমেত রিকশায় বসিয়ে দেয়। রিকশাওয়ালাকে জায়গার নাম বলে চলে যেতে বললে রেখা বাঁধ সাধে। এই রিকশাটা সাধারণ রিকশার মতো নয়, মোটর চালিত এবং আকারে সাধারনের থেকে বড়ই। ঢাকা শহরে সচরাচর এই রিকশা দেখা যায় না। বলতে গেলে একদমই দেখা যায় না। কিন্তু এই এলাকা প্রচুর পরিমাণে আছে। রিকশাটাকে আরেক্টুর জন্য সিএনজি নাম দেয়নি রেখা। সেখানে পাশাপাশি ৩ জন বসার মতো জায়গা আছে আর রিকশাওয়ালার বসার জায়গার পাশেও বেশ জায়গা আছে যাত্রীর বসার জন্য। এতকিছু থাকতেও দ্রোহ কেন হেঁটে যাবে- এই নিয়ে রেখা ভ্রূ কুঁচকে রেখেছে। রেখার বেশি চিন্তা হচ্ছে একা একা যাওয়া নিয়ে। কিন্তু সেটা তো আর মুখে বলতে পারবে না। দ্রোহ বাধ্য হয়ে রিকশাওয়ালার পাশে বসে পড়ল।
তবুও নিজের শান্তি লাগছিল না বলে মাঝ পথে রিকশা থেকে নেমে এগিয়ে যেতে বলল তাদের। শেষে রিকশা যখন গন্তব্যে এসে থামল তখন রেখা অবাক হলো। কারণ দ্রোহ ওদের আগেই সেখানে এসে পৌঁছেছে। দ্রোহ তখন দুই হাত মুঠ করে দুদিকে ছড়িয়ে নিজের জড়তা ভাঙাতে ব্যস্ত। রেখাকে আসতে দেখে রিকশাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে রেখার লাগেজ দুটোই নিজে নিয়ে নিল আগে। তারপর বিল্ডিং এ ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে ওঠা শুরু করল। রেখা মনে মনে কিছু কথা আওড়ে নিল হাঁটতে হাঁটতে।
“শেষ পর্যন্ত এসে পৌছালাম! তবে যাই হোক, এলাকাটা গ্রামাঞ্চল বলা চলে। গাছপালায় ভরপুর। এখানের বাতাসেও শহরের মতো গুমোট ভাব নেই। মন ভালো হয়ে গিয়েছে এই ১০ মিনিটেই। শুরুতে স্কুল বদলানো নিয়ে যেই প্রশ্ন বারবার মনে আসছিল, সেটাও এখন হাওয়া হয়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছে, আগে কেন আসিনি এখানে? তবে এই এলাকাটাও কয়েক বছর পর শহরে পরিণত হলে খুব খারাপ লাগবে। কিন্তু কিছু করার নেই।”
দরজা বেল বাজাতেই ২০-২১ বয়সী একটা মেয়ে দরজা খুলে দিল। রেখা তাকে ভালোভাবে লক্ষ্য করল। মেয়েটি দরজা খুলেই দুজনকে সালাম দিল আর দ্রোহের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
— কি ব্যাপার? একেবারে বিয়ে করে বউ নিয়ে এলি না কি? বাবা-মাকে ডাকব?
রেখা তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। বউ?
দ্রোহ দিবার মাথায় টোকা দিয়ে বলে উঠল,
— ছাগল, কালকে যার জন্য ওই রুমটা পরিষ্কার করলি, তাকে নিয়ে এসেছি?
— ওহ, নতুন সদস্য? দাঁড়িয়ে আছো কেন ভেতরে এসো।
— দরজার কাছ থেকে সরবি তো আগে।
— তুমি ভিতরে ঢুকবে না। আগে নিজের কথা ফেরত নেও। আমাকে ছাগল বললে কেন? কমনসেন্স নেই তোমার? আমি মেয়ে।
— তাহলে তো আমি ছাগলের স্ত্রী লিঙ্গ কি সেটা জানি না, বাট ছাগলের বউ লিঙ্গ জানি।
— কি?
— মানে, ছাগলের বউ তুই, ছাগী।
— ভাইয়া, ভালো হচ্ছে না কিন্তু বলে দিলাম।
— তুই আর কি বলবি, সর তো সামনে থেকে।
— সরবো না। স-র-বো না।
দ্রোহ নিজের হাত থেকে লাগেজ দুটো নামিয়ে ফ্লোরে রেখে দিল। তারপর হাত দুটো দুদিকে ছড়িয়ে অলস ভঙ্গিতে বলল,
— তাহলে এই লাগেজ দুটো তুই দিয়ে আসিস ঘর পর্যন্ত। আমি গেলাম।
তখন দিবার পিছন থেকেই একটা মহিলাকে নিজের শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে দরজার কাছে আসতে দেখা গেল। রেখা এতক্ষণ হা করে দুই ভাইবোনের ঝগড়া দেখছিল। মহিলাটির কথায় তার ধ্যান ভাঙল।
— আর একটা কথাও বললে তোদের দুটোর কানের নিচে গুনে গুনে দশটা করে থাপ্পড় লাগাবো। সর দরজার সামনে থেকে।
বলেই তিনি রেখাকে ধরে ভেতরে ঢুকিয়ে ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ার টেনে সেখানে তাকে বসতে দিলেন। রেখার বসতে বসতে রান্না ঘর থেকে দুটো গ্লাসে করে শরবত এনে দিলেন। রেখা আর দ্রোহকে গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে তিনি রেখাকে প্রশ্ন করায় লেগে পড়লেন। আসতে কোন সমস্যা হয়েছে কি না, দ্রোহ ঠিকমতো তাকে এখানে এনেছে কি না, রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিল কি- এসব প্রশ্ন করতে দেখে রেখার মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠল। সে হাসিমুখেই জবাব দিল সব প্রশ্নের। এর মাঝে দ্রোহের বাবাকে নিজের ঘর থেকে বের হয়ে আসতে দেখা গেল। দ্রোহের বাবা রেখাকে দেখে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।
— তুমিই তাহলে সেই?
রেখা থতমত খেয়ে কোনমতে সালাম দিল। তিনি জবাব দিয়ে বললেন,
— তোমার নাম কি?
— রিখিয়া ইসলাম রেখা।
দ্রোহের বাবা কিছু মনে করার চেষ্টা করে তারপর বলে উঠলেন,
— তুমি কি রকিবুল ইসলামের মেয়ে? ধামরাই এ থাকত অনেক আগে, সে ৮-৯ বছর আগে?
— জ্বি। কিন্তু আপনি আমার বাবাকে চিনলেন কি করে?
— মনে নেই? দ্রোহ তো তোমাদের বাড়িতে ২ বছরের জন্য ছিল। কলেজে পড়ার সময়।
— অভিনব? অভি?
বিড়বিড় করে বলে উঠল রেখা। সে মাথা ঘুরিয়ে দ্রোহের দিকে তাকাল। বেচারা মাত্রই শরবতের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বেশ খানিক শরবত নিজের মুখে চালান করেছিল। বাবার কথা শুনে ফুঁস করে সবটা বের করে দিয়েছে। নিজের শার্ট আর প্যান্টও ভিজিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যে। আর এখন সে রেখার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে। রেখা ঢোক গিলে গলা ভেজানোর বৃথা চেষ্টা চালাল। পুরনো স্মৃতি ঘাটতেই চিনতে পেরে হাসি মুখে দ্রোহের দিকে তাকাল। তারপর দ্রোহের বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
— মনে পড়েছে আঙ্কেল। আজমল আঙ্কেল।
— হ্যাঁ মামনী।
ওদিক থেকে দ্রোহের মায়ের কাঠ কাঠ গলা শুনতে পাওয়া গেল।
— মেয়েটাকে এখনো হাত মুখ ধুতে দিলে না তোমরা। আর কোন কথা না। রেখা, তুমি যাও তো। ওই যে, ওই কোণার ঘরটা তোমার।
হাতের ইশারায় দেখিয়ে কথাটা বলে উঠলেন তিনি। রেখা দেরি না করে সেদিকেই চলে গেল। দ্রোহ আগেই ওই ঘরে ওর ব্যাগ রেখে এসেছিল। তাই সমস্যা হলো না।
রেখাকে যেই ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছে, সেই ঘরের সাথে একটা বাথরুম আর বারান্দা থাকতে থেকে সাথে সাথে বারান্দায় চলে গেল রেখা। সামনে অনেক দূর পর্যন্ত তেমন বড় বিল্ডিং নেই। সবগুলোই দোতলা কিংবা একতলা। তার মাঝে মাঝে গাছগাছালির মেলা। দেখতেই চোখ জুড়িয়ে এলো এলো তার। ঘোরের মধ্যে পড়ে গেল যেন সে। আযানের শব্দ কান পর্যন্ত পৌঁছাতেই ঘোর কেটে গেল তার। সে দেরি না করে এক সেট জামা লাগেজ থেকে বের করে বাথরুমে ঢুকে পড়ল।
দ্রোহ সেদিন আর কাজের জন্য বের হল না। ঘুরে ফিরে রেখার ঘরের সামনে দিয়েই ঘুরঘুর করছিল সে। রিখিয়া নামটা শুনেই প্রথমবার অবাক হলেও সেদিন সে কিছু ভাবেনি তেমন। কথাটা মাথা থেকে ঝেড়ে বের করে দিয়েছিল। দ্রোহ হাঁটতে হাঁটতেই ভাবল,
“এইটা রিখি? বাবা পর্যন্ত চিনে গেল আর আমি এতদিনেও চিনলাম না? কি করে? কিন্তু এটা রিখি হয়ে কি করে? এটা কিভাবে সম্ভব? চেহারার সাথে মিল পেলাম না কেন এতদিন? নাকি খুঁজে দেখিনি, ঠিক করে খেয়াল করিনি এখনো। দেখতে হবে। এইটা ‘রিখি’ কিভাবে হলো? কখন হলো? আমি চিনতে পারলাম না।”
— তুই আপুর ঘরের সামনে এতো ঘুরঘুর করছিস কেন? আমার কথা ভাবছিস না কি? রেখা আপুকে কি তুই সত্যি সত্যিই বিয়ে করবি না কি রে ভাইয়া? বল বল। আমরা আমরাই তো। বলে ফেল দেরি না করে।
দিবার হঠাৎ কথায় চমকে উঠে নিজের বুকে থু থু ছিটানোর ভঙ্গি করল দ্রোহ। তারপর পুরো কথা শুনে রেগে বলে উঠল,
— চুপ কর। আমি এমনই হাঁটছিলাম। আর এটা রেখার ঘর তো আজ হয়েছে। আগে তো সাধারণ গেস্ট রুম-ই ছিল। আমি অতো কিছু ভাবিনি। আমি অন্য কথা চিন্তা করছিলাম আর হাঁটছিলাম। আর তুই আবার আমাকে একেক সময়টা একেকটা ডাকা শুরু করেছিস। এক সময় ‘তুই’ আবার আরেক সময় ‘তুমি’। কেন?
— আমার যখন যা ইচ্ছা, আমি তাই করব। আর আমার কথা কিন্তু ভেবে দেখতে পারিস। অবশ্য ২ বছর একসাথে ছিলি। একে অপরকে তো চিনিস-ই, সমস্যা কোথায়?
— একসাথে ছিলি-র মানে কি? একই বাড়িতে থাকতাম। তুই বেশি কথা বললে তোর যে বাকি ৩০ টা দাঁত আছে, সেগুলোও ৩০ টা থাপ্পড়ে ভেঙে ফেলব। যা এখান থেকে।
দিবা ভেংচি কেটে চলে গেলে দ্রোহ আবার হাঁটাহাঁটি শুরু করে দেয়। হঠাৎ করে মা-বাবার কথা মাথায় আসতেই নিজের রুমে চলে যায়। এবার তো দিবা দেখেছিল বলে ধমকে ওকে পাঠিয়ে দেওয়া গিয়েছে। মা-বাবা দেখলে তো সর্বনাশ। আর মা তো এক নম্বরের নাটকের পোকা। তিলকে শুধু তাল না, একেবারে তরমুজ বানাতে এক সেকেন্ডও সময় নিবে না।
রাতে খাবার টেবিলেও নিজের পর্যবেক্ষণ চালাল দ্রোহ। তার এখনো নিজের উপর অবিশ্বাস হচ্ছে। সে একটা মানুষকে কি করে চিনতে ভুল করল- কথাটা বার বার মাথায় ঘুরছে তার।
“না, নাকটা বোঁচা। চোখ দুটো ছোট করেই তাকিয়ে থাকে সব সময়। হুটহাট ডাগর চোখেও তাকায়। কান… না, কান আলাদা করতে পারি না আমি। চুল আগের থেকে বড় হয়েছে। হাত-পাও বড় হয়েছে কিন্তু এখনো আমার কাঁধ পর্যন্তই পড়ে আছে। খুব তো বড় করে বলেছিল- ‘আপনি দেখে নিবেন অভি, কয়েক বছর পর আমি আপনার থেকেই লম্বা হবো। রোজ নিয়ম করে কপ্লেইন খাচ্ছি। হরলিক্স খাচ্ছি।’ আমি নিজেও ওকে বলেছিলাম তখন- ‘এই জন্যই অ্যান্টি আমাকে বলছিল ঘরে ভূত কিংবা চোর ঢুকেছে। হরলিক্স চোর। যাহ্, এর পর থেকে আর আমাকে বলিস বারবার দোকান থেকে হরলিক্স কিনে আনার কথা।’ কিন্তু আজও লম্বা হতে পারেনি। কি একটা ঝামেলা। সবই তো মিলে যাচ্ছে। খাওয়ার সময় বারবার পানির গ্লাস ধরবে। কিন্তু পান করতে গিয়েও করবে না। একেবারে শেষে পুরো গ্লাস একবারে শেষ করবে। যাহ্, এটাও মিলে গেল?”
— বাবু, খেয়ে নে। জানি, পেঁপের তরকারি খেতে তোর ভালো লাগে না। তাই বলে যে মাখিয়ে বসে থাকবি সেটা চলবে না। আর এখন না খেলে আগামী দুই সপ্তাহে তোর মুরগি খাওয়া বন্ধ।
মায়ের কথায় হুঁশ ফিরতেই আশেপাশে তাকিয়ে দেখল, তার বাবা, মা , বোন এমনকি রেখাও মুখ চিপে হাসছে। দ্রোহ মনে মনে আবার একটা কথা বলে খাওয়ায় মনোযোগ দিল।
“তুই একটা গাধা, দ্রোহ!”
চলবে।