অজান্তে_আগমন,পর্বঃ- ০৮,০৯
সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ- ০৮
দ্রোহ আরও এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়াতেই রেখা ঘোর থেকে বের হয়ে বলে উঠল,
— আপনি এখানে? কেন এসেছেন?
দ্রোহ বেশ কিছু সময় নিয়ে মাথা চুলকে, এদিক-ওদিক তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজের মুখ থেকে কথা বের করতে পারল।
— আপনি আগে যেই বাড়িতে থাকতেন, সেটার পিছনে ওই লম্বা গাছটা ডাব গাছ না নারিকেল গাছ?
— কি?
— হ… হ্যাঁ, ওইটাই।
— আপনি এটা জিজ্ঞেস করতে এসেছেন?
— হ্যাঁ।
— ডাব আর নারকেলের মধ্যে পার্থক্য কি?
— বানান। একটা কেটে খাওয়া যায়, আরেকটা ফাটিয়ে খেতে হয়।
— কি?
— মানে, আমি ওটা জিজ্ঞেস করতে আসিনি। একদমই না।
— তাহলে?
— আসলে আমি… আমি…
— আপনি… তারপর?
— ওই তো, আমার এক বন্ধুর ভাইয়ের এক্সিডেন্ট হয়েছিল। তার সাথে দেখা করতেই আসছিলাম।
— তিন তলায় আসার কথা আপনার।
— আরে বাবা, এতো প্রশ্ন করছেন কেন? আগে পুরোটা বলতে তো দিন।
রেখা দুই হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাঁজ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
— আচ্ছা, বলুন।
— আমি কেমন আছি, সেটা তো জিজ্ঞেস করলেন না।
— আগের কথাটা পুরো শেষ করে নিন আগে। তারপর দেখা যাবে।
— আসলে তিন দিন আগে এখানে এসেছিলাম। এরপর ফেরার পথে আপনাকে দেখলাম। গত দুই দিনও এসেছিলাম আমি রোগীর সাথে দেখা করতে। আজও তাই করতে এসেছিলাম। সেদিন দুটো মেয়ের মুখে আপনার নাম শুনে ভাবলাম হয়তো ওরা আপনার কথাই বলছেন। তাই আজ দেখতে এলাম। এতটুকুই। এর থেকে বেশি না।
— ওহ। তাহলে বলুন, আপনি কেমন আছেন?
— আছি আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি? এখানে কি ঘুরতে এসেছেন?
— আমিও। হ্যাঁ, ওই ঘুরতে-ই আসা হলো। আবার চলে যাব।
“আর তার আগে আমি আপনাকে নিয়ে যাব।”
— বিড়বিড় করে কি বলছেন?
— কিছু না। আমি তাহলে আসি।
— কিছু খেয়ে যান।
— না, থাক।
— একটা পিঠা?
— দিন একটা। পিঠাকে না বলা যায় না।
রেখা হালকা হেসে বাটিটা চেয়ারের উপর থেকে তুলে নিল। সেখানে দ্রোহকে বসতে দিয়ে পুরো বাটিটাই ওর হাতে দিয়ে দিল। দ্রোহ খাওয়া শুরু করার আগে বলে উঠল,
— আপনাদের ওই বিল্ডিং এর ছাদে কোন ফুলের গাছ নেই? শুধু একটাই পেয়ারা গাছ?
— হ্যাঁ। বাড়িওয়ালার ওটা। কি মনে করে উনি ছাদে সব বাদ দিয়ে ওই একটাই পেয়ারা গাছ লাগিয়েছেন। গতবছর।
— ওহ, তাহলে একদিন আরেকটা কথা বলব ওই পেয়ারা গাছ নিয়ে।
— কি?
— বললাম না, আরেকদিন বলব।
— আচ্ছা।
দ্রোহ একটার নাম করে দুটো পিঠা খেয়ে নিল। রেখা পানি এনে দিলে সেটাও এক ঢোকে পান করে সেখান থেকে উঠে পড়ল। একেবাড়ে রাফির ভাইয়ের সাথে দেখা করে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। রেখার ব্যাপারটা তার মাথায় থেকে গেল।
এসেছিল সে ক্ষমা চাইতে, কিন্তু কিছু বলাই হলো না। উল্টো নিজের মান সম্মানের হালুয়া বানিয়ে চলে এলো। ডাব আর নারিকেলের কি সুন্দর-ই পার্থক্য দেখাল সে! ইচ্ছে করছে তালি দিতে, জোরে জোরে তালি দিতে, তাও নিজের গালে। কিন্তু বাসে দাঁড়িয়ে সে কাজ করলে আবার ‘পাগল’ উপাধি পেতে হবে ভেবেই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। যাওয়ার পুরো রাস্তা সে ভাবছিল রেখাকে কি বলবে। কিন্তু “কি বলবে?” এইটুকুই ভাবতে পেরেছে, শুধু এই দুটো শব্দ-ই। এর বেশি আর মাথায় আসেনি তার। তারপর মিটফোর্ডে পৌঁছে যখন রেখার সামনে গেল, তখন তো তার মাথা-ই খালি হয়ে গিয়েছিল। নিজেকে বড্ড “বেচারা” উপাধি দিতে ইচ্ছে করছে দ্রোহের।
__________
বাড়ি পৌঁছেও রেখার বিষয় ভাবতে ভাবতেই পুরোটা সময় পার হলো দ্রোহের। সারারাত ঠিক করে ঘুম হলো না। চোখ বন্ধ করলেও মনের মধ্যে অশান্তি বাসা বেঁধেছে যে।
তার করা একটা ভুল কাজের জন্য রেখা এতদিন ধরে সমস্যায় আছে। কি দরকার ছিল সেই রাতে রেখাকে জানালায় লুকিয়ে থাকতে দেখে একেবারে ঘরে চলে যাওয়ার? গিয়েছিল, ভালো কথা, কিন্তু অতটা সময় থাকার কি দরকার ছিল? ছিল, তাও মানা যায়, কিন্তু কি দরকার ছিল পানির জন্য অপেক্ষা করার? এসব প্রশ্ন না চাইতেও মনে আসছে বারবার। দ্রোহ জানে যে কাজটা সে করেছে, সেটা আর ফিরিয়ে নিতে পারবে না। তবুও আফসোস হয়, যদি পারতো ফিরিয়ে নিতে। যদি পারতো সময় পিছিয়ে সেই সময়ে গিয়ে নিজের করা ভুলটা শুধরে নিতে! কিন্তু সেটা কখনোই সম্ভব নয়। তখন খালি আফসোসটুকুই থেকে যায় সাথে। যেহেতু ভুলটা আর ঠিক করতে পারবে না, সেহেতু অন্যভাবে শুধরে কি করে নেবে- সেটাই ভাবছে দ্রোহ।
তাকে আরেকটা বিষয় ভাবাচ্ছে খুব। প্রথম দেখায় রেখাকে যতটুকু চিনেছে, তার থেকে ধরে নেওয়াই যায়- হঠাৎ কোন কঠিন মুহূর্তে পড়লে রেখা ঘাবড়ে যায়, সমস্যার মুখোমুখি হতে ভয় পায় সে। আজও তো দ্রোহকে দেখেই ঘাবড়ে গিয়েছিল সে। না জানি ওই পাশের বাড়ির অ্যান্টিগুলো কি কি বলেছিল রেখাকে, রেখা সেগুলো কিভাবে সহ্য করেছে। সরাসরি বুঝতে না পারলেও আন্দাজ করে নিল দ্রোহ। সাথে এও ধরে নিল, সেদিন রেখার খালা তাকে সেখান থেকে বাঁচিয়েছিল। অবশ্য দ্রোহ অ্যান্টিদের বোঝানোর চেষ্টা তো করেছে অল্প কথায়, কিন্তু তাতে যে তারা বুঝেছে, এটা বলা যায় না। কিছু কিছু মানুষ আছে, যারা শুধু নিজেদের চিন্তাকেই সঠিক মেনে নেয়। সত্য মিথ্যা যাচাই করে না। আর না অন্যের কথা দ্বারা প্রভাবিত হয়। ওই অ্যান্টিগুলো যদি এমন হয়ে থাকে, তাহলে তাদের থেকে ভালো কিছু আশা করাও উচিত নয়।
অনেক চিন্তা করে একটা মূল সিদ্ধান্তে এসে থামল দ্রোহ। রেখার সামনে যেটা বলেছিল, সেটাই করবে। শুধু কিছু কাজ করা লাগবে সেজন্য। এসব ভেবে ঘুমের দেশে পারি জমালো দ্রোহ।
__________
হাসপাতালে আজকাল রোজ আসা যাওয়া চলছে দ্রোহের। একেক দিন একেক কারণে আসা হয় এখানে। শুরুতে আসতো রাফির ভাই এর জন্য, তারপর রেখার জন্য আর এখন রেখার খালার জন্য। আজ শেষ কারণেই এসেছে সে এখানে। একেবারে সকালে চলে এসেছে। গত পরশু রেখার সাথে দেখা করার পর আর এখানে আসা হয়নি। তাই আজ সকালেই চলে এসেছে। রাফির ভাইকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রাফির ঢাকায় না ফেরা পর্যন্ত তার ভাইকে হাসপাতালের রাখার কথা ছিল বলেই এতদিন হাসপাতাল থেকে তাকে নেওয়া হয়নি। গতকাল রাফি নিজে এসে সব ব্যবস্থা করেছে। দ্রোহকে কষ্ট করে আর আসতে হয়নি। আজ দ্রোহ এসেছে নিজের কাজের জন্য। একজন নার্সকে পাঠানো হয়েছে মনোয়ারা খাতুনকে ডেকে আনার জন্য। প্রায় আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর তার দেখা মিলল। রিসিপশনিস্ট এর কাছ থেকে জেনে তিনি দ্রোহের সামনে এসে দাঁড়ালেন। নিজের পরিচয় দিতেও দ্রোহ সালাম দিয়ে তাকে আলাদা ভাবে অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্য বলল। তিনি রাজি হতেই তারা হাসপাতালের বাইরে চলে এলো। পাশের একটা হোটেলে গিয়ে বসল তারা। তারপর দ্রোহ নিজেই কথা বলা শুরু করল।
— আসলে অ্যান্টি, আমার আপনার সাথে রেখার সম্পর্কে কিছু কথা ছিল।
রেখার নাম দ্রোহের মুখে শুনে অবাক হলেও প্রকাশ করলেন না তিনি। দ্রোহকে নিজের বাকি কথা বলার সুযোগ দিলেন। দ্রোহ আবার বলতে লাগল,
— আমি অভিনব মাহমুদ দ্রোহ। রেখার সাথে আমার পরিচয় খুব কম সময়ের। প্রথম দেখা হয়েছিল রাতে উনি তখন ওষুধ কিনে নিজের বাড়ি ফিরছিলেন। তখন একটা বিপদে পরেছিলে তিনি। তখন আমি তাকে সাহায্য করি। এরপর আমাদের দেখা হয়েছিল স্কুলে। এই দুই বার-ই।
দ্রোহের শেষ কথায় মনোয়ারার ভ্রূ কুঁচকে যায়। বিষয়টা খেয়াল হতেই দ্রোহ বলে ওঠে,
— শেষ দেখা হয় এক মাস আগে, রাতে। আমি ওই বিল্ডিং এ উঠে পড়েছিলাম, আর জাস্ট পানি পান করে চলে গিয়েছি। কিন্তু এরপর আমি রেখাকে এই হাসপাতালে দেখলাম। কিছুদিন আগে। আমার বন্ধুর ভাই এর এক্সিডেন্টের জন্য তাকে এই হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। তারপর জানতে পারলাম রেখা এখানে আছে। তাছাড়া একটু সন্দেহ হয়েছিল, পরে ওই বাড়ি গিয়ে পুরোটা জানলাম। আমি রেখার সাথে দেখা করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু ঠিক কি বলা উচিত সেটা বুঝে উঠতে পারিনি। সত্যিই আমার করা একটা কাজের জন্য রেখার অনেক ক্ষতি হয়েছে। উনাকে বলতে পারছিলাম না, আর দেখা হচ্ছিল না। যেহেতু উনি সারাদিন কোন না কোন কাজ করে থাকেন- টিউশনি। তাই আপনাকেই পেলাম। আমার পক্ষ থেকে দুঃখিত জানাবেন উনাকে প্লিজ। আমি সত্যিই মন থেকে ক্ষমা চাচ্ছি। আপনাকে জানান ঠিক হবে বলেই মনে হলো। তাই আজ এতোটা সময় নষ্ট করলাম।
— ঠিক আছে।
বলেই চুপ করে থাকলেন মনোয়ারা। তিনি দ্রোহের ব্যাপারটা আগে থেকেই জানতেন। রেখা পরে তাকে সব বলেছিল, সেই রাতে কি কি হয়েছিল তার আগের ঘটনা, দু-একটা কথা বাদ দিয়ে। তাই মনোয়ারা অবাক হননি আজ। আর স্কুলে রেখার সাথে দেখা হওয়ার বিষয় থেকে তিনি ধরে নিলেন, দ্রোহ হয়তো কোন শিক্ষক বা স্কুল এর সাথে যুক্ত কোন ব্যক্তি। তাই কথা বাড়ালেন না। দ্রোহ সম্মতি দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
— মিস রেখার যদি কখনো কোন সমস্যা হয়, আমাকে জানাবেন। আমি যথাসাধ্য সাহায্য করার চেষ্টা করব। ঘর ভাড়া সংক্রান্ত সমস্যা হলেও আমাকে নির্দ্বিধায় জানাবেন। আজ আসি। আবারো দুঃখিত।
বলেই নিজের ভিজিটিং কার্ড দিয়ে চলে গেল দ্রোহ। মনোয়ারা দ্রোহের কথায় আবার অবাক হলেন। ‘ঘর ভাড়া সংক্রান্ত সমস্যা’ মানে কি?
চলবে।
#অজান্তে_আগমন
#সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ- ০৯
বাড়ি ফেরার পর থেকে রেখার শান্তশিষ্ট স্বভাবটা বোধগম্য হলো না মনোয়ারার। ঘরে ঢুকতে দেখলেই রেখা প্রতিবার কিছু না কিছু প্রশ্ন করেই থাকে। দিন কেমন কাটল, কাজের চাপ বেশি কি না, আজ এতো তাড়াতাড়ি ফিরলে- এমন সব প্রশ্ন। কিন্তু আজ খুব চুপচাপ। মনোয়ারা দাঁড়িয়ে থেকেই রেখাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপরও কোন কিছু বুঝতে না পেরে সরাসরি রেখার পাশে বিছানায় বসে পড়লেন। রেখা পাশে কারো উপস্থিতি অনুভব করে মুখ সেদিকে ফিরিয়ে নিল। খালামণিকে দেখে হাসি মুখে বলে উঠল,
— কখন এলে? টের পাইনি। দিনটা কেমন কাটল?
— আমারটা পরে বলি। আগে তোর নিজের কথা বল।
— আমার, এই তো। কেটেছে। তুমি বরং আগে হাত মুখ ধুয়ে এসো। পরে কথা বলি।
— ঠিক আছে।
বলেই মনোয়ারা চলে গেলেন। একেবারে রাতের খাবার একসাথে খেয়ে আবার রেখাকে নিয়ে খাটে বসে পড়লেন। তারপর মুখে অতি গম্ভীর ভাব এনে প্রশ্ন করলেন যাতে রেখা কথা বার বার না ঘুরিয়ে একটু ঘাবড়ে গিয়ে শুরুতেই সব কথা বলে ফেলে।
— বল, কি হয়েছে আজ তোর যে মুখে হাসি নেই।
— আসলে খালামণি, আমাদের স্কুলের অন্য শাখায় জরুরি প্রয়োজনে শিক্ষক কম পড়েছে। আমাকে তাই সেখানে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। তার উপর ওটা ছিল প্রধান শাখা, ওরাই শিক্ষক নির্ধারণ করে দিয়েছে। আমাকে যেতেই হবে। ১০ দিনের সময় দিয়েছে যাতে ওই এলাকায় বাড়ি খুঁজতে পারি। এই সিদ্ধান্ত বদলানোও সম্ভব না কারণ অন্য কেউ যেতে পারবে না। আর প্রক্সি দেওয়ার জন্যও টিচার নেই।
— কেন রে? সব শিক্ষক শিক্ষিকা কি ইংরেজি ফেল নাকি তোদের স্কুলের মূল শাখায়।
— কি? না মানে, অন্য শিক্ষকদের ফাঁকা জায়গা নেই।
— তো ভরা জায়গায় বসে পড়াবে, পড়ানোর জন্য কি বসা লাগে না কি শিক্ষার্থীদের মতো?
— মানে খালামণি, শিডিউলে ফাঁকা নেই, টানা ক্লাস চলে।
— তুই জানলি কি করে? জীবনেও ওই স্কুলে গিয়েছিলি? কারো সাথে যোগাযোগ আছে?
— আমি তো আন্দাজে বললাম।
— তুই আন্দাজে বল, আর আণ্ডা মাথায় ছুঁড়ে বল, সোজা কথা তোকে বাড়ি বদলাতে হবে। তাই তো? এখান থেকে কত দূর?
— জ্যাম ছাড়া ৩ ঘণ্টার রাস্তা।
— তাহলে তো বাসা বদলাতেই হবে। আমি দেখি কি ব্যবস্থা করা যায়। তুই চিন্তা করিস না। ঘুমিয়ে পড়। আর আমার কথা ভেবে ভেবে এখন মাথা ব্যথা করতে যাবি না। আমি শুধু তোকে একটু নার্ভাস ফিল করাচ্ছিলাম।
— খালামণি!
— আচ্ছা, বাবা। ঠিক আছে। আমি ব্যবস্থা করে দিব। তুই চিন্তা করিস না।
— ধন্যবাদ।
বলেই মনোয়ারাকে জড়িয়ে ধরল রেখা। মনোয়ারা ওকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বললেন,
— যা, ঘুমা।
__________
রেখাকে স্কুল থেকে বের করা কোন কাকতালীয় ব্যাপার ছিল না। এটা খুবই শ্রমসাধ্য ও কঠিন ব্যাপার ছিল যা ঘটানো হয়েছে। সেটা দ্রোহ নিজ হাতে করেছে। দ্রোহ পড়ালেখা শেষ করে শুরুতেই নিজের বাবার বন্ধুর স্কুলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করেছিল। কিন্তু পরে ধীরে ধীরে বাবার ব্যবসার সম্পূর্ণ দায়িত্ব কাঁধে পড়ায় ব্যস্ততার কারণে এই পেশা থেকে নিজেকে সরিয়ে এনেছিল। স্কুলের প্রিন্সিপাল বাবার বন্ধু হওয়ায় যেকোনো সময় সাহায্য নেওয়াই যায়। দ্রোহ আর রিহান একই স্কুলের দুটি ভিন্ন শাখায় কাজ করত। যার কারণে বেশি সুবিধা হয়েছে। স্কুলের প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলার মাধ্যমে দ্রোহ জানতে পারে ওদের স্কুলের একজন শিক্ষক ওই স্কুলের চট্টগ্রামের শাখা স্কুলে চলে যাবেন সামনের মাসে। সেখানে নিজের পরিবারের সাথে থাকবেন। সেই সুযোগটা নেয় দ্রোহ। বাবার বন্ধুর মাথায় ভালো করে ঢুকিয়ে দেয় অন্য শাখা থেকে শিক্ষক নেওয়ার। পাশাপাশি এর গুরুত্ব ও অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণের ঝামেলা, দ্রোহের পরিকল্পনা অনুসারে চললে সুবিধাসমূহ ভালো করে বুঝিয়ে দেয়। প্রিন্সিপালের খুব পছন্দ হয় দ্রোহের আইডিয়া। তিনি সেই ব্যবস্থাই করবেন বলে কল কেটে দেন। কিছু সময় পরে তিনি আবার দ্রোহকে কল করেন। কাকে এই পদে আনা যায় সেই নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেন। যার জন্য দ্রোহের আরও বেশি সুবিধা হয়ে যায়। সে ইতি-উতি করে রেখার নামে বেশি গুরুত্ব দেয়। তারপর এই নিয়ে ইমেইল পাঠিয়ে দেয় আর দ্রোহকে বলে কাজটা তদারকি করতে। দ্রোহ নিজের বলা কথাগুলো আবার মামাতো ভাইয়ের মস্তিষ্কে প্রেরণ করে দেয়। তারপর রিহান কথাগুলো সরাসরি রেখার মাথায় ভালো করে ঢুকিয়ে দেয়। রেখাও সবটা শুনে দোটানায় পড়ে যায়। পুরনো অভ্যাস, নতুন কিছু শুনলেই দোটানায় পড়া। দ্রোহ অবশ্য ৫০%- ৫০% এই পর্যায়ে আছে। রেখা সত্যিই রাজি হবে কি না- সে জানে না।
— বাবু, বাবু, কি এতো ভাবছিস সকাল সকাল? খাবারটা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে তো। খেয়ে নে।
বলে উঠলেন দ্রোহের মা। মায়ের ডাকে ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল দ্রোহের। নিজের খাবারে মনোযোগ দিতেই ছোট বোন দিবা বলে উঠল,
— মা, তোমার বাবু তো ৫ বছরের বাবু। নিজ হাতে খেতে পারবে না কি? তুমি এসে একটু খাইয়ে দিয়ে যাও। বাবু ভাইয়া, হা করো তো।
— দিবা, আমাকে বাবু বলে শুধু বড়রা ডাকে। তুই ডাকবি না। সম্মান দে। এদিকে আয়। কদমবুসি কর, আমার পায়ে ধরে সালাম দিয়ে দোয়া নিয়ে যা। সারাদিন ভালো যাবে। আর বাবু বলে ডাকলে থাপড়িয়ে গাল লাল করে দেব।
— আমার বয়েই গিয়েছে।
বলেই ভেংচি কাটল দিবা। দ্রোহের বাবা সেই সময়ে খবরের কাগজ হাতে নিয়েই টেবিলের একটা চেয়ার টেনে বসলেন। তারপর খবরের কাগজ ভাঁজ করে টেবিলের উপর রেখে বলে উঠলেন,
— কি ব্যাপার দ্রোহ? শুনলাম, তুই নাকি না খেয়ে কিসব চিন্তাভাবনা করছিস? প্রেমে ট্রেমে পড়েছিস না কি?
— বাবা, তুমি এবার কি শুরু করলে? কোথায় এই বখে যাওয়া মেয়েকে সামলাবে তা না করে…
— তো কি করব? তোর বয়সে তোর ছোট বোনের অর্ধেক বয়সী বাচ্চা থাকার কথা। আর তুই এখনো বিয়েই করিসনি।
— বাবা?
— কি ব্যা ব্যা করছিস? চুপচাপ খা। আর দিবাকে মারার কথা বলব না একদম।
— আমার ঘাট হয়েছে। মা, ও মা।
— কি হলো? চিল্লাছিস কেন? আমি তো তোর পাশেই দাঁড়িয়ে আছি।
— ও… পাশে দাঁড়িয়ে আছো! তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। আমার ঘরে এসো।
বলেই বেসিনে হাত ধুয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে গেল দ্রোহ। দ্রোহের মা গেলেন তার পিছু পিছু।
— কি হয়েছে বল।
দ্রোহ মায়ের হাত ধরে নিজের বিছানায় বসালো। তারপর নিজে ফ্লোরে বসে নিজের মায়ের দুই হাত নিজের দুই হাত দিয়ে ধরল। কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই দ্রোহের মা বলে উঠলেন,
— কি অকাজ করেছিস এবার?
— বলতে তো দেও। আসলে এক মাস আগে আমি মামা বাড়ি গিয়েছিলাম না?
— হ্যাঁ, গিয়েছিলি। তারপর?
— এক দিন রাতে আমি ভুল করে অন্য একজনের বাসায় চলে গিয়েছিলাম। অপর পাশ থেকে দরজা খোলার সাথে সাথেই পানি চেয়েছিলাম। উনিও দিলেন। পানি নেওয়ার সময় ভালো করে দেখে বুঝলাম আমি অন্য বিল্ডিং এ চলে গিয়েছি। তাই দেরি না করে বের হয়ে যাই। কিন্তু আমি জানতাম না ওই মেয়েটা তখন বাড়িতে একা ছিল। ওর প্রতিবেশীরা বাজে কথা বলে পরের দিন ওকে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করে। এতদিন উনি অন্য জায়গায় ছিলেন। কিন্তু কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণে এই শহরে আসতে হবে। এখানে থাকার জায়গা খুঁজে পাওয়া কঠিন। আমাদের বাড়িতে তো একটা রুম ফাঁকাই থাকে। ওখানে যদি তার থাকার ব্যবস্থা করে দিতে তাহলে…
— বাবু, তোর বাবার কথা কি ঠিক?
— কি ঠিক?
— তুই কি সত্যিই প্রেম করছিস?
— না মা, আমি যা যা বললাম সব সত্য। আমি পরের বার ওখানে গিয়ে সবটা জানতে পারি। ওদিকে থেকেই যাচ্ছিলাম, ভাবলাম সেদিনের জন্য সরি বলা উচিত। পরে মহিলাগুলোর কথা শুনে সব বুঝতে পারলাম। তাই ভাবলাম আমার জন্য যেহেতু বাড়ি ছাড়তে হয়েছে, তাহলে আমি তার থাকার ব্যবস্থা করে দেই। তাই তোমাকে বলছি।
— তাহলে আমাদের বাড়িতেই কেন?
— ঢাকা শহরে উনি একা থাকেন। তার সেফটির বিষয় খেয়াল রাখতে হবে বাড়ি দেওয়ার সময়। তাছাড়া আগের বাড়িতে উনি আরও দুই জন মেয়ের সাথে থাকতেন। এখনও থাকেন আরেকজনের সাথে। আর এখন না হয় জরুরি প্রয়োজনে ইমারজেন্সি ভাবে সুরক্ষিত বাড়ি আমাদের ছাড়া অন্যকারো গ্যারান্টি তো আমি দিতে পারব না। তাই বললাম তোমাকে। তুমি রাজি থাকলেই সামনে আগাবো।
— আচ্ছা। আমি দেখছি।
বলে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বের হয়ে গেলেন দ্রোহের মা। উনি ঘর থেকে বের হতেই দ্রোহ বিছানা থেকে বালিশ নিয়ে উপরে ছুঁড়ে মেরে ধীর স্বরে বলে উঠল,
— ইয়েস।
__________
হঠাৎ নিজের ফোনে অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসতে দেখে স্বাভাবিক ভাবেই ফোন রিসিভ করে সালাম জানাল দ্রোহ। ওপাশ থেকে কেউ সালামের জবাব দিয়ে বলে উঠলেন,
— তুমি গতকাল কেন বলেছিলে যে বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত সাহায্য চাইলে তোমার সাথে কথা বলতে?
— ওহ, অ্যান্টি। আপনি?
— হ্যাঁ। আমি মনোয়ারা খাতুন। আমার প্রশ্নের উত্তর দেও আগে।
— আসলে আমার জন্য মিস রেখাকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল। তাই বলেছিলাম, আমার পক্ষে সম্ভব হলে আমি সাহায্য করব যেকোনো কাজে।
— “বাড়ি ভাড়া” কথাটা আলাদা করে বলার কারণ?
— ওটা তো কথায় কথায় উঠে এসেছিল। অতো খেয়াল করে বলিনি। মিস রেখার কি বাড়ি ভাড়ার দরকার?
— হ্যাঁ। সামনে মাসেই নতুন বাসায় উঠতে হবে।
দ্রোহ অবাক হওয়ার ভান করে বলে উঠল,
— কোন এলাকায়?
মনোয়ারা খাতুন এলাকার নাম বলতেই দ্রোহ বলে উঠল,
— ওহ, ওখানে তো আমারও বাসা। আপনি যদি বিস্তারিত বলেন কেমন বাসা লাগবে, তাহলে আমি সাহায্য করতে পারব।
মনোয়ারা স্কুলের নাম বলতেই দ্রোহ দেরি না করে কথার মাঝেই বলে উঠল,
— স্কুলের কাছেই তো আমার বাসা। আর আমার বাসায় একটা রুম ফাঁকা পড়েই আছে। চাইলে ওখানে ভাড়া নিতে পারেন। তাছাড়া এই এলাকায় বাড়ি ভাড়ার পাশাপাশি অন্যসব কিছুর দাম একটু বেশিই। একা মানুষের জন্য বিশেষ করে মেয়েদের জন্য রিস্কি কিছুটা। আমার বাড়িতে থাকলে সুরিক্ষত থাকতে পারবেন। আমার মা- বাব আর বোন থাকে বাসায়। একটা ভালো পরিবেশে থাকার সুযোগ পাবেন মিস রেখা।
এমন নানান কথা বলে দীর্ঘসময় আলোচনার পর ফোন কেটে দিলেন মনোয়ারা।
চলবে।