অগত্যা_তুলকালাম,পর্ব_১৩,১৪

#অগত্যা_তুলকালাম,পর্ব_১৩,১৪
নাফীছাহ ইফফাত
#পর্ব_১৩

বাসায় আসতেই যথারীতি তুমুল চেঁচামেচি শুনতে পাই। বাবা-মা কি নিয়ে যেন ঝগড়া করছে। ভেতরে ঢুকে দেখি ছোটফুফি ও নাকীব সোফায় বসে আছে। আর বাবা-মা ডাইনিং স্পেসে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করছে। আমি ঢুকেই জিজ্ঞেস করলাম,
”কি নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে আবার?”
ছোটফুফির নির্লিপ্ত জবাব, “তোকে নিয়ে।”
“আমাকে নিয়ে? আমি কি করলাম?”
“গিয়ে জিজ্ঞেস কর।”

আমি ঠোঁট উল্টে বাবা-মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বললাম, “কি হয়েছে?”

মা একটা জামা দেখিয়ে বললেন,
“দেখ তোর জন্য আমি জামাটা কিনে এনেছি। তোর বাবার নাকি পছন্দ হচ্ছে না।”
বাবাও অন্য একটা জামা দেখিয়ে বললেন,
“আর আমি এটা কিনে এনেছি। এটা আবার তোর মায়ের পছন্দ না।”

আমি খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললাম,
“কি আশ্চর্য! জামা পরবো আমি, তোমাদের পছন্দ-অপছন্দে কি এসে যায়? দুজন দুটো পছন্দ করেছো, এবার ঐ দুটো আমার পছন্দ হলেই তো হলো। এটা নিয়ে তুলকালাম বাঁধিয়ে ফেলার কি আছে?”

“আছে আছে অনেককিছু আছে। এই যে জুতোজোড়া, এগুলো আমি কিনেছি, স্বভাবত তোর মা পছন্দ করছে না। ও গিয়ে আরেকজোড়া কিনে এনেছে।” বাবা বললেন।

“আজব তো! তোমরা কি আজীবন আমার জন্য ডাবল জিনিস কিনে যাবে। এমনও অনেক মানুষ আছে যারা বছরে একটা জামাও পায় না। আর তোমাদের ঝগড়ার কারণে আমি মিনিটে দুটো পেয়ে যাচ্ছি। তোমরা কি আমার বিয়েও দুজনের সাথে দিবে? দুজন দুইটা ছেলে পছন্দ করে আনবে। আর আমি দুজনকে বিয়ে করবো তাই না?’ এসব কোন ধরণের ঝগড়া?”

আমার কথার রেশ ধরে ছোটফুফি বললেন,
“হৃদিতা একদম ঠিক কথা বলেছে। তোমরা ঝগড়া করো ঠিক আছে। তাই বলে ঝগড়ার নাম করে অপচয় করবে তা তো হয় না। রাসূল (সাঃ) কি করতেন জানো? বিশ্বের সেরা নবী হয়েও তিনি আগামীকালের খাবার আজকে মজুদ রাখতেন না। অথচ তিনি চাইলেই পাহাড় সোনায় রূপ নিতো। এরপরও কতটা সাশ্রয়ী থাকার চেষ্টা করেছেন চিন্তা করো। আর তোমরা সেই নবীর উম্মত হয়ে এভাবে অপচয় করছো? জেদ করে সবকিছু দুটো করে নিয়ে আসছো?”

নাকীব বললো, “আমাদের কোনোকিছুরই অভাব নেই। কারণ আমাদের প্রত্যেকটা জিনিস দুটো করে। একটা বাবার দেয়া, একটা মায়ের দেয়া। বাবার সাথে শপিং করে এলে ওগুলো মায়ের পছন্দ হয় না। তাই মা আবার শপিংয়ে নিয়ে যায়। বাবা ফোন, জামা-কাপড় যা-ই দেয় মায়ের পছন্দ হয় না বলে মা-ও আবার কিনে দেয়। শুধু অভাব কেন, আমাদের সব জিনিস প্রয়োজনের চেয়েও অতিরিক্ত আছে। সবকিছু ডাবল।”

মা বললেন, “আমরা ছোটবেলায় চাইতাম, পেতাম না। আর তোরা পাচ্ছিস বলে এত অভিযোগ? তোদেরকে যদি আর কিছু কিনে দিই…”
বাবা বললেন, “আমিও আর কিছু কিনে দিবো না। এবার তোরা কি করবি ভাব।”
“তুমি আবার কিনে দিবে না বলছো কেন? এখন আরও বেশি করে কিনে দাও। আমি তো কিনে দিবো না।” মা বললেন।

“তোমার কথা কেন শুনবো আমি?”
“আমাকেই তো ফলো করছো। যে-ই আমি বলেছি কিনে দিবো না অমনি তুমিও।”
“ঠিক আছে, ঠিক আছে আমার ছেলেমেয়েদের আমি কিনে দিবো।”
“তুমি একা কিনবে কেন? আমিও কিনবো। আমারও ছেলেমেয়ে।”

আমি রেগে গিয়ে বললাম,
‘তোমরা দুজন দু মেরুর মানুষ কেন বিয়ে করেছিলে বলতো? আমাদের জীবনটা পুরো তেজপাতা বানিয়ে দিলে। ডিজগাস্টিং!‘

বাবা-মা দুজন একসাথে তাকালেন আমার দিকে। ছোটফুফি এক ধমকে আমাকে থামালেন।
“এটা কি ধরনের অসভ্যতা হৃদিতা? গুরুজন না তোর? জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে সবই আল্লাহর হাতে। সবার জীবনের নিয়ন্ত্রক একমাত্র আল্লাহ। তুই এভাবে বলার কে? আর রাসূল (সাঃ) বলেছেন, বাবা মায়ের সাথে সর্বদা সদাচরণ করতে। তুই এটা কি ব্যবহার করলি?”

“স্যরি ফুফি। বাবা-মা অলওয়েজ ঝগড়া করে। সবসময়ই মেজাজ ঠিক রাখতে পারি না।”

“স্যরি আমাকে না, বাবা-মাকে বল।”

আমি বাবা-মায়ের দিকে তাকাতেই বাবা বললেন,
“স্যরি বলতে হবে না। আসলে আমাদেরও উচিত না সবকিছু নিয়ে ঝগড়া করা। ওদের সামনেই তো প্রতিনিয়ত ঝগড়া করছি। ওরা কতবার থামানোর চেষ্টা করেছে আমরাই বরং শুনিনি কখনো। ওদেরও তো দোষ দেওয়া যায় না। যাদের বাবা-মা প্রতিমুহুর্তে ঝগড়া করে তারা এতটা শান্ত আছে সেটাও তো অনেক। থাক দিশা, আজ বাদ দে। ওদের আর কিছু বলিস না।”

“আমিও তোমাদের ভালোর জন্যই বলেছি ভাইয়া। যাইহোক, তোমরাই যখন মীমাংসা করে নিলে তখন আমি আর কিছু বলবো না। হৃদিতা ও নাকীব দুজনকেই আমি ভরসা করি। ওরা যথেষ্ট বুঝে। কোনোকিছু বোঝালেই মানার চেষ্টা করে।” ছোটফুফি বললেন।

“তাই তো বলছি।”

.

হঠাৎ করেই বাতাসে জানালার পর্দাগুলো উড়তে লাগলো। ঘরে নেমে এলো অন্ধকার। আমি ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। তুমুল বাতাস বইছে। পাখিদের কলতানও হঠাৎ বেড়ে গেল। নাকীব আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে আকাশপানে তাকিয়ে হঠাৎ বললো,
“একি বৃষ্টি নামার অবকাশ নাকি সন্ধ্যা নামার অবকাশ?”

আমি ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম,
“সন্ধ্যায় বৃষ্টি নামার অবকাশ।”
“দারুণ ওয়েদার না, আপু?”
“হুম। আরেকটু আগে যদি এমন ওয়েদার থাকতো।”
“থাকলে কি হতো?”
“তখন কাশবনে ছিলাম আমি। কাশবনে এমন ওয়েদার জোশ লাগে।”
“রাফিন ভাইয়ার সাথে ছিলে নাকি?”

রাফিনের কথা বলাতেই আমার কিছুক্ষণ আগের কথা মনে পড়ে গেল। আমি নাকীবকে বলতে গিয়েও বললাম না, আজকে রাফিনের বিহেভিয়ার ছিল অন্যরকম। ওকে বললাম ছোটফুফির বলা কথাগুলো।
“ব্রো, ছোটফুফি বলছে ছেলেদের সাথে মেলামেশা করা হারাম। এসব বন্ধ করতে।”
“তুমি ছেলেদের সাথে কই মেলামেশা করো?” ভ্রু কুঁচকে বললো নাকীব।

“ফুফি রাফিনের কথা বলেছে স্পেশালি।”
“ভাইয়ার কথা ছোটফুফি কিভাবে জানলো?”
“জানেনি। আন্দাজে বলেছে।”
“ভাইয়ার সাথে মেলামেশা বন্ধ মানে? পারবে তুমি?” অবাক হলো নাকীব।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,
“মেলামেশা বন্ধ মানে একেবারে সবকিছু শেষ করে দেওয়া বুঝিয়েছে।”

“একেবারেই বন্ধ? মানে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার কথা বলছো? আপু!” নাকীব ভীষণ অবাক হলো।
“হুম, সবকিছু চিরতরে শেষ করে আল্লাহর ওপর ভরসা করা।”

“তুমি কি সিদ্ধান্ত নিলে?”
“এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। আফটারঅল, আমি রাফিনকে ছাড়ার কথা ভাবতেও পারি না। বাট এজ আ মুসলিম, আল্লাহকে ভয় করে আমার ওকে ত্যাগ করা উচিত।”

“যা করবে ভেবেচিন্তে করো আপু। ছোটফুফির কথা রাখতে গিয়ে নিজের প্রিয় মানুষটাকে আবার হারিও না।” বিড়বিড় করে বললো নাকীব।

আমি ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললাম, “কি বললি?”
“কিছু না। আল্লাহর ওপর ভরসা মানে কিন্তু পুরোপুরি আল্লাহর ওপর ভরসা করতে হবে আপু। তোমার ভরসায় যদি সামান্য ফাঁকও থাকে তাহলে কিন্তু সব শেষ হয়ে যাবে। আর আমি শুনেছি, আল্লাহর ওপর ভরসা করে যে ধৈর্য ধারণ করে তার ভরসা আল্লাহ রাখেই রাখে। আর যে আল্লাহর জন্য কোনোকিছু ত্যাগ করে তাকে আল্লাহ তার চেয়েও উত্তম কিছু দান করে। সো, সিদ্ধান্ত তোমার এখন। যা-ই সিদ্ধান্ত নাও না কেন ভেবেচিন্তে নিও।”

“হুম। ইদানীং তোকে আমার বড়ভাই মনে হয়। কত্ত বড় বড় কথা বলিস তুই। জ্ঞানীদের মতো সব কথা। যেন অনেককিছুই জানা তোর।” নাকীবের গাল টেনে দিয়ে বললাম।

ও গম্ভীর হওয়ার ভান করে মজার ছলে খুবই উপকারী একটা কথা বলে বসলো।
“জ্ঞান হলো এমন জিনিস এটা তুমি যত খরচ করবে তত বাড়বে।”

“বাহ! খুব ভালো বললি তো। এখন তো আরও বড় ভাইয়ের মতো মনে হচ্ছে। আর মনে হচ্ছে তুই আমার গার্জিয়ান।”

ও কলারটা হালকা নেড়ে বললো, “বাবা-মায়ের অবর্তমানে এই বাড়ির গার্জিয়ান তো আমিই।”
“তাই না?” ধুম করে একটা কিল দিলাম ওর পিঠে। ও ছিটকে দূরে সরে গেল। আমিও এগিয়ে গেলাম। ততক্ষণে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে।

রাতের বেলা রাফিন টেক্সট করলো।
“ফ্রী আছো? কল দিবো?”
আমিও যথারীতি রিপ্লাই দিলাম,
“আ’ম অলওয়েজ ফ্রী ফর ইউ।”

রাফিন কল করলো সাথে সাথে। কুশলাদি জানতে চাওয়ার পর বললো,
“আজকে মিট করবো বলেও করতে পারিনি অথচ তুমি এটা নিয়ে কোনো রিয়্যাক্ট করলে না তো? উল্টো আরও সুন্দর করে কথা বলছো।”

“মানে? আজকে মিট করলাম না আমরা?” ভীষণ অবাক হয়ে বললাম আমি।

“না, আমি তো আজকে যেতেই পারিনি। হঠাৎ আম্মুকে নিয়ে আপুর বাসায় যেতে হলো। ফোন করেও জানাতে পারিনি তোমাকে। এজন্যই তো এখন ফোন দিলাম।”

“হোয়াট? আজকে আমি তোমার সাথে কথা বলেছি, মিট করেছি। বাট..”
“নো বললাম তো। আমি আজকে আপুর বাসায় ছিলাম। কিসব বলছো তুমি? মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে?”

আমি খানিকক্ষণ চুপ মেরে রইলাম। তারপর ধীরে ধীরে বললাম,
“তুমি সত্যিই আসোনি?”
রাফিন রেগে গেল খুব।
“বললাম তো আসিনি। বারবার এক কথা বলে মেজাজটা কেন খারাপ করছো? আচ্ছা, তুমি ঠিক কয়টা পর্যন্ত কাশবনে ছিলে?”
“পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত।”
“ওকে ওয়েট…”

খট করে লাইন কেটে দিয়ে তিনটা ছবি পাঠালো ইনবক্সে। ছবির ডিটেইলসসহ। ছবিতে রাফিন ওর ভাগ্নীকে কোলে নিয়ে মুচকি হাসছে। আর ডিটেইলসে সময় দেখাচ্ছে পাঁচটা পনেরো। আশ্চর্য! তখন রাফিন আমার সাথেই ছিল। আর আমি ওর দোষ খুঁজতে ব্যস্ত তখন।

রাফিন আবার কল করলো। রিসিভ করে বললাম,
“শোনো, আজকে সত্যিই আমি তোমার সাথে মিট করেছি। বাট একটু গন্ডগোল…”

“তুমি আবার একি কথা বলছো। আমি কিন্তু এবার ফোন রেখে দিবো।”
“আগে তুমি আমার পুরো কথা তো শোনো। আমাকে বলতে দাও৷
“কি বলবে শুনি একটু?”
“বলছি তো, আমার দিক থেকে আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিউর যে মিট করেছি। আর তুমিও শিউর তুমি মিট করোনি। তাহলে আমি কার সাথে মিট করেছি বলো?”
“সেটা আমি কিভাবে বলবো? জ্বীন-টিন ভর করলো নাকি তোমার ওপর? নাকি মাথার স্ক্রু একটা ঢিলে হয়ে গেছে। এসে ঠিক করে দিবো?”

গম্ভীর হয়ে বললাম, “আমি সিরিয়াসলি বলছি।”
রাফিন হো হো করে হেসে বললো,
“আ’ম অলসো সিরিয়াস। হা হা!”

আমার মেজাজ এমন চটে গেল যে আমি তৎক্ষনাৎ ফোন কেটে দিলাম। শুধু কাটলামই না, সুইচড অফ করে দিলাম। এমন আজগুবি মানুষের সাথে ফালতু বকবক করার কোনো মানে নেই। আমাকে বিষয়টা এক্সপ্লেইনই করতে দিচ্ছে না। করবো না এক্সপ্লেইন। নিজের মাথার স্ক্রু ঢিলা, আবার আমাকে বলতে আসে।

সারারাত ধরে ভাবলাম, রাফিন আসেনি মিট করতে। তাহলে কে এলো? কাল কার সাথে ছিলাম আমি? রাফিনই তো। ও কি সব ভুলে গেছে? কোনো অসুখ হয়নি তো ওর? আরে ধুর! অসুখ হবে কেন? ও তো প্রুভ দিলোই। যে দেখা করতে এসেছে তার আচরণও ছিল উল্টাপাল্টা। রাফিনের মতো না সে। চুল ছিল কোঁকড়া, চোখ ছিল ঘোলাটে। রাফিন যে না সেটা তো শিউর। তাহলে কে? কার সাথে মিট করেছি আমি? ওহ শিট!

#Be_Continued__In_Sha_Allah ❣️

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ_ইফফাত

পর্ব ১৪

পরপর দুদিন আমি রাফিনের সাথে কোনো যোগাযোগই করলাম না। বাসা থেকেও বের হইনি। বাসায়ও শান্তি পাচ্ছিলাম না। প্রতিনিয়ত বাবা-মায়ের ঝগড়া অসহ্য লাগছিলো। বাবা-মা আজও বুয়াকে নিয়ে ঝগড়া করছে।

আজকে সকালের ঘটনা।
বুয়া রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। ছোটফুফি অবাক হয়ে বললেন,
“উনি কে ভাবী?”
“আমার হেল্পিং হেন্ড।” মা বলেন।

ফুফি মাকে একপাশে নিয়ে এসে বললেন,
“ভাবী, রাসূল সা. এর সেই তাসবীহ কি তোমার জানা নেই? ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার…”
“আমি জানি দিশা। এই কথা তোমরা সবাই জনে জনে বলেছো আমাকে।”

দূর্ভাগ্যবশত কথাটা বাবা শুনে নেয়। ছোটফুফি কিছু বলার আগেই বাবা বললেন,
“ওকে ওসব বলতে যাস না। যারা জেনেও মানে না তাদেরকে কিছু বুঝিয়েও লাভ নেই।”

“তোমার তো আমার সুখ সহ্য হয় না।” মা বললেন।

আমি রুমে বসে ‘প্রিয়তমা’ বইটা পড়ছিলাম। আর ওদের এসব কথা শুনছিলাম। কথাটা শোনামাত্রই বই হাতে বেরিয়ে গেলাম। বাবা-মাকে বইটা দিয়ে বললাম,
“এটা আমার না তোমাদের দুজনের পড়া উচিত। রাসূল সা. উম্মুল মুমিনীনদের সাথে কিরকম বিহেইভ করতেন আর উম্মুল মুমিনীনগণ কিরকম বিহেইভ করতেন সবটা তোমাদের দুজনের জানা উচিত। আর হ্যাঁ, শুধু জানলেই হবে না মানতেও হবে।”

ছোটফুফি মুচকি হেসে বললেন,
“এটা তুই এক্কেবারে খাঁটি কথা বলেছিস। তবে হ্যাঁ, তোর পড়া হলে তবেই ওদেরকে দিস।”

“দিবো তো ঠিক আছে। দেখা যাবে, বইটা কে আগে পড়বে সেটা নিয়েও ঝগড়া লেগে যাবে।” মুখ বাঁকা করে বললাম আমি।

সাথে সাথে মা বললেন, “অবশ্যই আমি আগে পড়বো।”
“তুমি কেন? তোমার তো বই পড়ার অভ্যাস নেই। আমি আগে পড়বো।” বাবা বললেন।

ফুফির দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বললাম,
“ব্যস! হয়ে গেল।”
”তুই যা, আমি হ্যান্ডেল করছি।” ফুফির সরল উক্তি।

আমিও চলে এলাম রুমে। ডুবে গেলাম “প্রিয়তমার” অতল গহ্বরে। বইটা যত পড়ছি তত অবাক হচ্ছি৷ রাসূল সা.এর স্ত্রী ছিলেন ১১ জন। অথচ তিনি কারো মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করতেন না। সমতা বজায় রেখে সমান ভালোবাসতেন। একজন উম্মুল মুমিনীনের কাহিনী পড়লে মনে হয় প্রিয়নবী হয়তো ওনাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। উনিই হয়তো প্রিয়নবীর একমাত্র স্ত্রী। পরক্ষনেই পরবর্তী স্ত্রীর কাহিনী পড়তে গেলেও সেইম কথা মনে হয়। কি আশ্চর্য! কত মহান হৃদয়ের মানুষ তিনি। একটা হৃদয় দিয়ে সবাইকে কত সুন্দরভাবে, সমতা বজায় রেখে, কারো মনে কষ্ট না দিয়ে, কোনো ভেদাভেদ না করে কি অপরূপ জীবন কাটিয়েছেন। আর উম্মুল ম
মুমিনীনগণও রাসূল বলতেই পাগল ছিলেন। কত সুন্দর তাঁদের ভালোবাসা। কত পবিত্র।
বইটা পড়তে পড়তে আমি রাসূলের প্রেমে মশগুল হয়ে যাচ্ছিলাম। রাসূল সা. কে ভালোবাসি বলে বলে মুখে ফেনা তুলেছি। বাট অন্তর দিয়ে কতটা ভালোবাসি তা কখনো অনুভব করা হয়নি। কেন ভালোবাসি বলি তাও অনুভব করিনি। এখন ভাবছি, কত দূর্বল ঈমান আমার। বইটা পড়তে গিয়ে মনে হলো, এই মানুষটাকে ভালো না বেসে পারা যায় না। মানুষটাকে শুধু মুখে ভালোবাসি বললেই হবে না। অন্তরের অন্তস্তল দিয়ে অনুভব করতে হবে। আমি দিনরাত বইয়ে ডুবে রইলাম। দুনিয়াদারী ভুলে গেলাম। বইটা পড়ার পর রাসূল সা. যেভাবে দিন কাটাতেন সেভাবে দিন কাটানোর চেষ্টা করলাম। বই পড়ার ফাঁকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আগে মিসওয়াক করলাম, ওযু করলাম উত্তমরূপে। দিল লাগিয়ে নামাজ পড়লাম। আগে কখনো এভাবে নামাজ পড়া হয়নি। জাস্ট পড়তে হবে বলে পড়েছি। হুটহাট দুটো সিজদাহ দিয়ে উঠে পড়েছি। সিজদাহর মর্ম কি তাও হয়তো বুঝিনি।

একরাতে বইটি পড়তে পড়তে একপর্যায়ে বইয়ের ওপর ঘুমিয়ে পড়লাম। আমি রাসূলের প্রেমে এতটাই মজে গেলাম যে রাসূল সা. কে বই পড়ার সময় যেভাবে কল্পনা করছিলাম ঠিক সেভাবে স্বপ্ন দেখতে লাগলাম।

স্বপ্নটা ছিল এমন, মসজিদে নববীর চারপাশে ছোট ছোট বেশ কয়েকটা কুঠির। একেকবার একেক কুঠিরে স্ত্রীদের সাথে খোশ গল্পে মশগুল প্রিয় রাসূল। হেসে হেসে কথা বলছেন স্ত্রীদের সাথে। কি সুন্দর দৃশ্য!

ছোট স্বপ্ন ছিল। ঘুম ভামতেই আমি ছুটে গিয়ে ছোটফুফিকে স্বপ্নটা বললাম। ফুফি সাথে সাথে বললেন,
“আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ তোমাকে হেদায়াত দান করুক।”

আমি ফুফির দিকে তাকিয়ে রইলাম। ফুফি মাথায় হাত রেখে বললেন,
“হেদায়েত পাওয়া কোনো সহজ বিষয় না। যে কেউ চাইলেই হেদায়েত পায় না। আবার অনেকে পেয়েও হারিয়ে ফেলে। আমার আশা আছে তোমাকে নিয়ে। হালকা গাইড পেলেই ইন শা আল্লাহ তুমি সফল হবে। হবেই। তবে হ্যাঁ, হেদায়েত পাওয়ার পর আবার হারিয়ে ফেলো না যেন। তাহলে এরচেয়ে চরম হতাশার আর কোনোকিছুই হবে না।”

আমি মুচকি হেসে বললাম, “আমি আমার প্রিয় রাসূলকে পুরোপুরি অনুসরণ করবো ফুফি। যিনি আমাদের ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করতে এতকিছু করেছেন তাঁকে তো ভালোবাসতেই হবে। তাঁর কথা তো রাখতেই হবে।”
“ইন শা আল্লাহ।”

“আচ্ছা ফুফি, আমাকে আরও কিছু বই দিও তো এরকম। পড়তে খুব ভালো লাগছে।”
“খুব বেশি বই তো সাথে করে আনিনি। তবে আরেকটা বই নিয়ে এসেছি। ”মুহস্বানাত” নাম। মেয়েদের জন্য খুবই উপকারী একটা বই। ওটা পড় আপাতত। আমি বাড়ি গিয়ে আরও কিছু বই তোকে পাঠিয়ে দিবো ইন শা আল্লাহ।”

“আচ্ছা।”

ফুফি খুশিমনে চলে গেলেন। আমিও খুশি হয়ে চলে গেলাম নিজের রুমে। মনের মধ্যে কেমন যেন শান্তি কাজ করছে। ইসলামিক বইয়েও এত আনন্দ পাওয়া যায়? জানতামই না!

বিকেলে নাকীব জোর করে ওর ফোনটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
“ধরো তো আপু। তোমার জিনিস তুমি সামলাও। এত প্যারা আর ভাল্লাগে না।” বলেই সে চলে গেল।

রাফিন ফোন করেছে। অথচ রাফিনের সাথে এই মুহুর্তে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। বারবার মনে হচ্ছে, ও আমার জন্য বৈধ না। ওর সাথে কথা বললে রাসূল সা. অসন্তুষ্ট হবেন। আর আল্লাহও অসন্তুষ্ট হবেন। আমার স্রষ্টাকে অসন্তুষ্ট করার রাইট আমার নেই।

রাফিন ফোন করেই যাচ্ছে। ও কখনো দুবারের বেশি ফোন করে না। বাধ্য হয়ে রিসিভ করলাম। সাথে সাথে ধমক।
“কি সমস্যা তোমার? এত দাম বেড়ে গেছে? কি মনে হয় তোমার সাথে কথা বলার জন্য আমি কান পেতে আছি? আমার টাইমের ভ্যালু নেই?”
“কি আশ্চর্য! আমি বলেছি তোমাকে ফোন করতে? আর একজন স্ক্রু ঢিলা মানুষের সাথে তোমার মতো ভালো মানুষ কেন কথা বলবে? হোয়াই? নো নিড!”

রাফিন কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। এরপর মোলায়েম কন্ঠে বললো,
“স্যরি!”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, “ইটস ওকে।”

কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো,
“কাশবনে এসো, কথা আছে।”
আমার তখন কি হলো জানি না। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
“আমি বেরুতে পারবো না।”
“কেন পারবে না? নাকীব তো বললো তুমি ফ্রী আছো। সারাদিন ঘরে বসে থাকো।”

“হুম বাট ছোটফুফি আছে বাসায়।”
“নো প্রবলেম। নাকীবের সাথে বেরিয়ে এসো কিছু একটা বলে।”
“আমি মিথ্যে বলতে পারবো না। এটা রাসূলের সুন্নত বিরোধী।”

রাফিন বেশ খানিকক্ষণ কোনো কথা বললো না। তারপর বললো,
“এখন যে আমার সাথে কথা বলছো এটা কি রাসূলের সুন্নত বিরোধী না?”

এবার আমি চুপ করে রইলাম। ও বললো,
“লিসেন আরোহী, ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে। কথাটা শেষ করতে দাও। এরপর তুমি না চাইলে আর কোনো সুন্নত বিরোধী, আল্লাহর বিরুদ্ধে যায়, আল্লাহর নিষেধ আছে এমন কোনো কাজ আমি করবো না। এটলিস্ট, তোমার সাথে তো না-ই।”

আমি ঠোঁট কাঁমড়ে বললাম, “আমি আসছি।”

আমি আসলে এখনো প্রিপেইড না রাফিনকে ছাড়ার জন্য। হঠাৎ আমার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। আরে আশ্চর্য! আমি রাফিনকে ছাড়ার কথা ভাবছি কেন? ওকে বিয়ে করে নিলেই তো হয়। আল্লাহ বলেন, প্রাপ্ত বয়স্ক হলেই বিয়ে করে নিতে। রিযিকের ব্যবস্থা স্বয়ং আল্লাহ তায়া’লা করবেন। তবে আর বাঁধা কিসের? রাফিনকে বিয়ে করে নিবো।
কথাটা ভেবে খুশি হতে গিয়েও ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলাম। রাফিন রাজি হবে তো বিয়ে করতে? আর বাবা-মা? বাবা-মা যদিও কোনো ব্যাপার না আমার কাছে। রাফিনকে রাজি করাতে পারলে বাবা-মাকে রাজি করানো দু’সেকেণ্ডের ব্যাপার। তাছাড়া নাকীব ও ছোটফুফি তো আছেই ম্যানেজ করার জন্য। বহু আশা নিয়ে কাশবনে ছুটলাম। না জানি কি বলে রাফিন? আল্লাহ রক্ষা করো আমাকে।

#Be_Continued__In_Sha_Allah ❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here