#গল্প১৩৮
#সূর্যের_পারিজাত (পর্ব ১২)
১.
সূর্য আজ কয়েকটা দিন ধরে বসছে পারিজাতের বুকশপটায়। সকাল দশটাতেই ও চলে আসে, থাকে রাত দশটা পর্যন্ত। বিকেলে পারিজাত আসে। সারাদিন শেষে এই মুখটার জন্যই যেন ও অপেক্ষা করে। পারিজাত ওকে কী করে অনলাইনে অর্ডার নিতে হয়, তারপর বইগুলো ডেলিভারি করার ব্যবস্থা করতে হয়, সব শিখিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে ওরা সব ধরনের বই রাখা শুরু করেছে। সূর্যের খুব ভালো লাগে কাজটা, মনে মনে ভাবে একটা মানুষ কতটা ভালোবাসলে ওর জন্য এমন একটা পছন্দের কাজের ব্যবস্থা করে রেখেছে।
সন্ধ্যে হলেই দু’জনে একসাথে নাস্তা করে, সেই আগের দিনের মতো খুনসুটি চলতে থাকে। তবে পারিজাত থাকতে চাইলেও সূর্য সন্ধ্যের পর বেশিক্ষণ থাকতে দেয় না। পারিজাতেরও বাসায় যাবার তাড়া থাকে। ইদানীং ওর প্রায়ই দেরি হচ্ছে বাসায় ফিরতে, মা তো সন্দেহ করছেন যে ও হয়তো ধ্রুবর সাথেই সময় কাটাচ্ছে। পারিজাত ভুলটা ভাঙায় না। আর ক’টা দিন যাক, সূর্য একটু সামলে নিক, তারপর বিয়ের কথা তুলবে। কিন্তু একটা জিনিস ওকে খুব অবাক করছে, সূর্য নিজে থেকে কেন বিয়ের কথা বলছে না? অবশ্য ও আসছেই মাত্র সাতদিন। নাহ, ও আসলে অস্থির হয়ে গেছে, লজ্জা পায় পারিজাত।
আজ সূর্যের আসতে একটু দেরি হয়ে গেছে। ঘুমটা কেন জানি ছাড়ছিলই না। তাতেই মা পারিজাতের পক্ষ নিয়ে কথা শুনিয়ে দিল, ‘ইশ, কী ভালো একটা মেয়ে জুটেছে তোর কপালে! আজকাল কেউ এমন করে? শুধু তোর জন্য মেয়েটা সারাদিন কলেজ করে, ব্যাচ পড়িয়ে টাকা জমিয়েছে। আর এমন সুন্দর একটা বুকশপ করেছে, শুধু তোর জন্য। তুই কিন্তু বাবা মন দিয়ে কাজটা করিস, ও কিন্তু তোকে নিয়েই বাঁচতে চায়।’
সূর্য বুঝতে পারে ঠিকই, কিন্তু ও নিজে যে কিছু করতে পারছে না, এটাই মনে খোঁচায়। পারিজাত সব সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে ওর জন্য। এখানে সূর্যের নিজস্ব কোনো অবদান নেই। একটা হীনমন্যতা ঘিরে ধরতে চায় ওকে। ও যদি নিজে কিছু করে দেখাতে না পারে তাতে যে ও নিজেই নিজের কাছে ছোট হয়ে থাকবে। একসময় হয়তো পারিজাতও কিছু বলে ফেলতে পারে! সেদিন ও এই মুখটা লুকাবে কোথায়? ভাবতেই একটা ভয় ওকে ঘিরে ধরে, নাহ, একটা কিছু করতেই হবে।
কী করা যায় ভাবতে ভাবতে ও হঠাৎ ইমেইলটা চেক করে। এতদিনে হুমায়ুন ভাইয়ের কথাটা ও ভুলেই গেছিল। মেইলটা খুলতেই ইনবক্সের প্রথম দিকেই সেই কাঙ্ক্ষিত মেইলটা দেখতে পায়। সূর্য কাঁপা হাতে মেইলটা খুলে, পুরো ফাইলটাতে দ্রুত চোখ বোলায়। নাহ, সব ঠিক আছে, দশটা পর্বই আছে। আচ্ছা, এটা তো ও ইচ্ছে করলেই বই করে বের করতে পারে। এমন জীবন থেকে নেওয়া গল্প নিশ্চয়ই অনেক ভালো হবে। শুধু আর একটা পর্ব লিখলেই গল্পটা শেষ হয়। ওর মুক্তি পাবার দিনটার কথা, মা, পারিজাতের সাথে দেখা, ওদের অনুভূতি। এগুলো নিয়েই লেখাটা শেষ করা যায়। সূর্য হিসেব করে, বইমেলার আরো দুটো মাসের বেশি বাকি আছে। এর মাঝে যদি একটা ভালো প্রকাশক পাওয়া যায়! ভাবতেই সূর্য একটা উত্তেজনা টের পায়, পারিজাত নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে। আর বইটা যদি ভালো চলে তাহলে তো কথাই নেই। সূর্য তখনই কম্পিউটারে লিখতে বসে যায়।
২.
সূর্য একটা অস্বস্তি নিয়ে একটা প্রকাশনী অফিসে বসে আছে। কয়েকদিন আগেই ওর পান্ডুলিপিটা শেষ হয়েছে, পারিজাতকে ইচ্ছে করেই বলেনি। ভেবেছিল ওকে একটা সারপ্রাইজ দেবে। এই প্রকাশনী সংস্থা অনেক আগে একবার ওর সাথে যোগাযোগ করেছিল, যখন ও জেলে যায়নি। তখন ওর অনলাইন অনেক পাঠকও ছিল। সেই সূত্রেই আসা।
অনেকক্ষণ পর ওর ডাক পড়ে, প্রকাশক সাজ্জাদ সৌরভ একজন সজ্জন মানুষ। দেরি হবার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘বোঝেন তো, বইমেলা চলে আসছে। কাজের ভীষণ চাপ। আচ্ছা, দেখি আপনার পান্ডুলিপিটা।’
সুর্য পান্ডুলিপিটা হাত বাড়িয়ে দিতেই উনি নিয়ে উল্টেপাল্টে একটু দেখেন। প্রথম দুটো পৃষ্ঠা পড়েন। তারপর মুখ তুলে বলেন, ‘আপনার লেখার স্টাইল তো চমৎকার, এতদিন কোথায় ছিলেন? যাই হোক, আসলে আপনাদের মতো নতুন লেখকদের পাঠকের কাছে পরিচয় করে দেওয়াটা আমাদের দায়িত্ব। তবে বোঝেন তো, মানুষ অপরিচিত লেখকের লেখা কিনতে চায় না। তাও আমি ছাপাব, কিছু খরচাপাতি আছে সেটা পেলেই মেলার আগেই বই উঠে যাবে।’
সূর্য একটু অবাক হয়, লোকটা খরচাপাতি বলতে কী বোঝাচ্ছে! ওকে টাকা দিয়ে ছাপতে হবে? ব্যাপারটা বোঝার জন্য ও গলা খাকড়ি দিয়ে বলে, ‘ভাই, খরচাপাতি কত লাগবে?’
সাজ্জাদ চোখটা বন্ধ করে হিসেব করে, তারপর বলে, ‘এই ধরেন এক লাখ টাকার মতো। আপনি পান্ডুলিপিটা ভালোমতো আরেকবার প্রুফ দেখেন, আর এর মধ্যে আমি একটা প্রচ্ছদ করে ফেলব।’
সূর্য ঢোক গিলে, এক লাখ টাকা! ও ইতঃস্তত করে বলে, ‘আচ্ছা, আমাকে কয়েকটা দিন সময় দিন।’
সাজ্জাদ ব্যাপারট বোঝে, হেসে বলে, ‘ভাই, এর কমে কোথাও বই ছাপতে পারবেন না। আর এখন তো বইমেলা চলেই এসেছে। হাবিজাবি লোকের কাছ থেকে ছাপবেন, দেখবেন প্রিন্ট ভালো হয় নাই, বাঁধাই ভালো হয় নাই। ভেবে দেখবেন ব্যাপারটা।’
সূর্য অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বের হয়ে আসে। মনটা খারাপ হয়ে যায়, ও নিজে একটা কিছু করতে চেয়েছিল, পারিজাতকে খুশি হতে দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু এখানেও যে বাধা, আর এই বাধাটুকু পেরোতে ওর আবার মায়ের কাছে নয়তো পারিজাতের কাছেই হাত পাততে হবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও পকেট থেকে মোবাইলটা বের করতেই দেখে পারিজাতের পাঁচটা মিস কল। প্রকাশকের রুমে যাবার আগে ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছিল। কী হলো আবার, কোনো বিপদ না তো! বুকটা কেঁপে ওঠে, তাড়াহুড়ো করে ফোন দিতেই ওপাশ থেকে পারিজাতের উদবিঘ্ন গলা পাওয়া যায়, ‘এই তুমি কোথায়?’
সূর্য এড়িয়ে যায়, বলে, ‘এই একটা কাজে বাইরে এসেছিলাম, ফোনটা সাইলেন্ট ছিল। তুমি ঠিক তো?’
পারিজাত একটু বিরক্ত গলায় বলে, ‘আমি ঠিক আছি। কিন্তু তুমি এমন সময়টাতেই বুকশপটাতে নেই। এদিকে একটা বড় ক্লায়েন্ট এসেছিল, বুকশপটাতে যেতে চায়। তাই তোমাকে ফোন করে জানাতে চাচ্ছিলাম। পরে রাজুকে বলে দিয়েছি সব ঘুরিয়ে দেখাতে। সূর্য, তোমাকে একটু সিরিয়াস হতে হবে কিন্তু।’
সূর্যের এমনিতেই মনটা খারাপ তার উপর পারিজাতের এমন করে বলাটা ওকে ভীষণ আঘাত করে। মন খারাপ গলায় বলে, ‘আর এমন হবে না পারিজাত।’
ফোনটা রেখে সূর্য একটা রিক্সা নেয়, যত তাড়াতাড়ি পারা যায় বুকশপটায় পৌঁছাতে হবে।
এদিকে সূর্য ফোনটা রাখতেই পারিজাত বুঝতে পারে ও একটু জোরেই বলে ফেলেছে কথাটা। আসলে এই ক্লায়েন্টটা প্রায় একশ বইয়ের একটা বড় অর্ডার নিয়ে এসেছিল। ও এতটাই উত্তেজিত ছিল যে পারলে ও নিজেই নিয়ে যায় ওনাকে। কিন্তু ও কিছুতেই বের হতে পারছিল না তখন। আর লোকটাও বুকশপটা দেখবেই। তাই সূর্যকে ও পাগলের মতো খুঁজছিল। কিন্তু তাই বলে ও সূর্যকে এমন করে বলতে পারল! পারিজাতেরও মনটা খারাপ হয়ে যায়। আসলে সূর্যকে প্রতিষ্ঠিত করতেই ওর এমন তাড়াহুড়ো। নাহ, বড্ড ভুল হয়ে গেল!
৩.
পারিজাত বিকেলে যখন আসে দেখে সূর্য একজন বই ক্রেতার সাথে কথা বলছে। বইটা সম্পর্কে লোকটাকে বেশ করে বোঝাচ্ছে। পারিজাতের দিকে তাকিয়ে একটা কাষ্ঠ হাসি দেয়। পারিজাত হাত নাড়ে, ইশ, মুখটা কেমন অন্ধকার হয়ে আছে!
লোকটা বই কিনে চলে যেতেই পারিজাত পায়ে পায়ে সূর্যের কাছে এসে দাঁড়ায়। সূর্য একটা ফাইল নিয়ে এসে বলে, ‘পারিজাত, আজ সতেরটা বই বিক্রি হয়েছে এ পর্যন্ত। আর অনলাইনে পঁয়ত্রিশটার মতো অর্ডার এসেছে আর ডেলিভারি হয়েছে একুশটা বই। ওহ হো, তোমার ওই ভিআইপি লোকটার সাথে কথা হয়েছে। উনি একশ বই কনফার্ম করেছেন। আর কাল..’
কথার এই পর্যায়ে পারিজাত সূর্যের হাত ধরে মন খারাপ গলায় বলে, ‘সরি।’
সূর্য হঠাৎ করেই থেমে যায়, একটা অভিমান দলা পেকে গলাটা বুজে আসতে চায়, কষ্টটা গিলে ফেলে বলে, ‘আরে সরি বলছ কেন। আসলেই তো তোমাকে না বলে বাইরে যাওয়া ঠিক হয়নি। অমন দামি কাস্টমার, এরাই তো ব্যবসার লক্ষ্মী।’
পারিজাত এবার আকুল গলায় বলে, ‘না, তুমি আমার লক্ষ্মী। তুমি থাকলেই হবে শুধু। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিও।’
এবার সূর্যের মনের ক্ষতে একটু যেন মায়ার ছোঁয়া পড়ে। নরম গলায় বলে, ‘আমার পারিজাত কখনো ভুল বলে না। লক্ষ্মী একটা মেয়ে। এখন চলো তো, নিচে যেয়ে আরাম করে এক কাপ চা খেয়ে নেই।’
পারিজাতের মনের মেঘ কেটে যায়, বাচ্চাদের মতো হাততালি দিয়ে বলে, ‘এই রাজু, এদিকে খেয়াল রাখিস, আমরা চা খেয়ে আসি।’
রাজু হাসে, এই আপাটা এমনি খুব গম্ভীর, কিন্তু সূর্য ভাই কাছে থাকলেই কেমন ছোট মানুষ হয়ে যায়।
সন্ধ্যা নামছে, ওরা দু’জন একটা বেঞ্চিতে বসে সেই ইউনিভার্সিটি লাইফের মতো পাশাপাশি বসে চা খেতে থাকে। পারিজাত চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে, ‘আচ্ছা, তুমি তখন কোথায় গিয়েছিলে, বললে না তো?’
সূর্য একটু বোকার মতো হাসে, তারপর বলবে না ভেবেও বলে ফেলে, ‘ওই হুমায়ুন লোকটা ক’দিন আগেই আমার লেখা গল্পটা মেইল করেছিল।’
পারিজাত বিস্ময়ের সাথে বলে, ‘সে কী, আমাকে বলোনি তো!’
সূর্য লজ্জা পাওয়া গলায় বলে, ‘একটা পর্ব লেখা বাকি ছিল, সেটা লিখে ভাবলাম এটার বই বের করব। প্রকাশক ঠিক হলেই তোমাকে সারপ্রাইজ দিতাম। সেজন্যই আজ একজনের কাছে গিয়েছিলাম।’
পারিজাতের চোখ গোল হয়ে যায়, ‘কী বলছ! বই বের করবা, এ তো দারুণ খবর। তা কী বলল উনি?’
সূর্য মন খারাপ গলায় বলে, ‘নাহ, হবে না। একে তো মাত্র দুই মাস আছে বইমেলার, তার উপর আবার টাকাও লাগে অনেক।’
পারিজাতের বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে, আহারে, সূর্য এজন্য আজ বের হয়েছিল। আর ও নাকি এমন করে ওকে বলল! পারিজাত ওর আরো কাছে সরে বসে, একটা হাত ধরে বলে, ‘সূর্য, তুমি ভেব না। আমি ঠিক একটা ভালো প্রকাশক ধরে তোমার বইটা বের করবই।’
সূর্যের মনের কালো মেঘটা এবার সত্যিই কেটে যায়, সেখানে এখন ঝলমলে রোদ্দুর।
চা টা শেষ করে সূর্য এবার গম্ভীরমুখে বলে, ‘আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা, বইটা যদি বের হয় তবে বইমেলা শেষেই কাজটা করে ফেলব।’
পারিজাত বুঝতে না পেরে বলে, ‘কোন কাজ।’
সূর্য একটা হাত পেছন দিক থেকে পেচিয়ে ওকে আলতো করে ধরে বলে, ‘বিয়ে করতে হবে না?’
হেমন্তের সন্ধ্যাটা আজ খুব মায়াময়, বাতাসে হালকা ঠান্ডার পরশ। সূর্য পশ্চিম আকাশে লাল লালিমা ছড়িয়ে কেমন একটা লাজুক ভঙ্গিতে মেঘের আড়ালে মুখ লুকাচ্ছে। পারিজাতের ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে সূর্যের বুকের ভেতর ঢুকে যেতে। এমন করে কেউ বিয়ের কথা বলে! ও যে কোথায় মুখ লুকায়।
সূর্য বুঝতে পারে পারিজাত লজ্জা পেয়েছে৷ তাই ও কথা ঘুরাতে বলে, ‘শোন, আমি কিন্তু বইটা নিয়ে সিরিয়াস। আমি এর মাঝে ভালো করে পান্ডুলিপিটার প্রুফ দেখে ফেলব।’
পারিজাত নরম গলায় বলে, ‘আচ্ছা। তুমি ভেব না, আমি ঠিক একজন ভালো প্রকাশক খুঁজে পাব। গল্পটা তো শুধু তোমার না, আমারও।’
সেদিন সূর্য পারিজাতকে বাসায় পৌঁছে দেবার জন্য একটা রিক্সা নেয়। অনেক দিনের একটা পুরনো স্মৃতির পুনরাবৃত্তি হয়, পারিজাত আলতো করে সূর্যের গালে ঠোঁট ছুঁইয়েই মুখ নামিয়ে ফেলে। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে লাজুক হাসি হাসতে থাকে। আর সূর্যের বুকটার ভেতর লক্ষ কোটি আলোর বিচ্ছুরণ হতে থাকে তাতে জীবনের সব মালিন্য যেন এক নিমিষেই দূর হয়ে যায়।
(চলবে)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
০৬/০৩/২০২২