সূর্যের_পারিজাত (পর্ব ১১)

#গল্প১৩৮

#সূর্যের_পারিজাত (পর্ব ১১)

১.
মেহেরুন্নেসার আজ আনন্দের সীমা নেই। ফাতেমাকে নিয়ে নিজেই আজ বহুদিন পর রান্না করছেন। সাধারণত রান্নাটা ফতেমাই করে ফেলে। আজ মেহেরুন্নেসা নিজ হাতে ছেলের জন্য মটর পোলাও, ডিমের কোর্মা, মাংস, কাবাব করছেন। রান্না করতে করতে একটু পর পরই চোখ মুছছেন, কতদিন পর ছেলে খাবে। আজ যেন তার শুন্য বুকটা বহুদিন পর একটা নরম মায়ায় ভরে গেছে।

সূর্য গোসল সেরে একটা মোড়া নিয়ে রান্নাঘরের সামনে এসে বসে। কৌতুহলী চোখে মায়ের রান্না দেখে। কী সুন্দর একটা পরিচিত ঘ্রাণ! মায়ের হাতের পোলাওটা ওর খুব প্রিয়। সূর্য দেখে মা একটু পর পর চোখ মুছছেন সাথে মুখে একটা খুশির আলো, যেটা ও এই ক’টা বছর যতবার মা দেখা করতে গিয়েছে দেখেনি। সূর্য গলা বাড়িয়ে বলে, ‘মা, মনে হচ্ছে তোমার সেই বিখ্যাত পোলাও রান্না করছ? উম, কতদিন এমন পোলাও খাই না।’

ফাতেমা খালা পাশ থেকে বলে, ‘তোমার মায়েও এতদিন পোলাও খায় নাই বাবা। ইদেও পোলাও রান্না করলে খাইত না। আইজ পোলা আইছে তাই তোমার মায়ে পোলাও খাইত।’

সূর্যের বুকটা কেউ খামচে ধরে, এই ক’টা বছর ওর সাথে সাথে যেন প্রিয় মানুষগুলোও শাস্তি ভোগ করেছে। আসলে শাস্তি তো একজন মানুষের হয় না, সাথে তাদের প্রিয় মানুষগুলোরও। নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগে।

মেহেরুন্নেসা ফাতেমাকে একটা ধমক দিয়ে বলে, ‘তোর এত কথা বলতে হবে না। কোর্মাটা নামা এখন।’

একটা কাবাব সূর্যের হাতে দিতে দিতে বলেন, ‘খেয়ে দেখ তো ঠিক আছে কিনা। আর, পারিজাতকে আমার মোবাইল থেকে একটা ফোন দিয়ে দেখ ও পৌঁছাল কিনা। কেন যে মেয়েটাকে দিয়ে আসলি না।’

সূর্য কাবাবটা মুখে দিতেই স্বাদটা টের পায়, এত মজার খাবার কতদিন খায়নি ও। খেতে খেতে মায়ের মোবাইলটা নিয়ে আসে। পারিজাতকে পৌঁছে দিয়ে আসতে চেয়েছিল, ওর বাসাটা মতিঝিলের ওই দিকটায়। পারিজাত নিজেই জোর দিয়ে বলেছে, ‘আজ থাক, তুমি বাসায় গিয়ে আগে ফ্রেশ হয়ে নাও। কিন্তু এরপর প্রতিদিন কিন্তু আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে।’

সূর্য ফোন দিতেই ওপাশ থেকে পারিজাতের গলা পাওয়া যায়, ‘মা, আসসালামু আলাইকুম।’

সূর্য দুষ্টুমির গলায় বলে, ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম মা, তুমি পৌঁছেছ তো?’

পারিজাত একটু ধাক্কা খায়, তারপর হঠাৎ করেই বুঝতে পারে এটা সূর্যের গলা। ইশ, কতদিন পর এই কন্ঠস্বরটা শুনল, কত বছর পর সূর্যের সাথে মোবাইলে কথা হচ্ছে। পারিজাত নরম গলায় বলে, ‘ভালো মায়ের দুষ্ট ছেলে, আমি পৌঁছেছি। তুমি কী করছ?’

সূর্য মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘মায়ের অত্যাচার সহ্য করছি। এত কিছু রান্না করছে, আমাকে নাকি সব খেতে হবে। তোমার সাথে কাল দেখা হচ্ছে তো?’

পারিজাত মন খারাপ গলায় বলে, ‘কাল দিনটা আমাকে একটু সময় দাও, আমার একটা কাজ শেষ করতে হবে। তারপর দিন শুক্রবার, সেদিন সারাদিন তোমার সাথে থাকব।’

সূর্য মাথা নেড়ে বলে, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। শুক্রবার আমাদের বাসায় তোমার দাওয়াত। কী কী খাবে তোমার শাশুড়ি মাকে জিজ্ঞেস করে নাও।’

পারিজাত ঝপ করেই লজ্জা পেয়ে যায়, সাথে ভালো লাগাটাও জড়িয়ে ধরে। আলতো গলায় বলে, ‘তুমি আজ ঘুমাও ভালো করে, কাল ফোন দেব।’

সূর্য বোঝে মেয়েটা লজ্জা পেয়েছে। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘মা, পারিজাত ঠিকঠাক পৌঁছেছে। আমার কিন্তু খুব ক্ষুধা পেয়েছে। জানো তো, জেলখানায় সন্ধ্যার পরেই রাতের খাবার শেষ করতে হয়। তারপর বন্দি। আমি খেয়েই একটা ঘুম দেব, খুব ক্লান্ত লাগছে।’

বন্দি শব্দটা মেহেরুন্নেসার বুকে এসে লাগে। মনে মনে বলেন, আর কখনো আমার ছেলেটাকে বন্দি থাকতে হবে না।

রাতে সূর্য মাকে জোর করে একসাথে খেতে বসায়। নিজেই জোর করে পোলাওটা বেড়ে দেয়। মেহেরুন্নেসার বুকটা কেমন ভারী হয়ে আসে, চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে। এই ক’টা বছর একটা দিনের জন্যও সূর্যের প্রিয় খাবারগুলো খেতে পারেননি। ছেলের মুখটা মনে হলেই বুকটা মুচড়ে ওঠত।

সূর্যা এবার কৃত্রিম রাগের গলায় বলে, ‘মা, আর যদি কান্না করেছ, তাহলে কিন্তু আমি খাব না। নাও, খাওয়া শুরু করো।’

মেহেরুন্নেসা বোকার মতো হেসে খাওয়া শুরু করেন। এবার সূর্যের চোখটা ভিজে আসতে চায়। কোনোমতে সামলে নিয়ে খেতে শুরু করে ও। অনেক দিন পর সূর্য তৃপ্তি করে খায়, মেহেরুন্নেসা শুধু তাকিয়ে থাকেন। আহারে, ছেলেটা খেতে পছন্দ করত।

খাওয়া শেষে সূর্য ওর রুমে আসে। মেহেরুন্নেসা কাল রাতেই ছেলের রুমটা গুছিয়ে রেখেছিলেন। সূর্য বিছানায় শুয়ে এক হাতে মাকে পেচিয়ে ধরে বলে, ‘মা, আজ আমার সাথেই ঘুমাও। কতদিন তোমার ঘ্রাণ পাই না।’

মেহেরুন্নেসা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, চুলের ফাঁকে আঙুল চালিয়ে আদর করেন। এই ক’টা বছর একটা রাত ভালো করে ঘুমোতে পারেননি। আজ থেকে নিশ্চিন্তে ঘুমাবেন। তবে আজকের রাতটা জেগে কাটাবেন। একটা মানত করেছিলেন, ছেলে যেদিন ফিরে আসবে সেদিন সারা রাত নফল নামাজ পড়বেন।

সূর্য একটু পরেই গভীর ঘুমিয়ে তলিয়ে যায়। মেহেরুন্নেসা অপলক ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কেমন শিশুর মতো কোলবালিশ জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে জায়নামাজটা বিছিয়ে নামাজে দাঁড়ান।

২.
পারিজাত বাসায় এসে ভেবেছিল মাকে সূর্যের ফিরে আসার কথাটা বলবে। কিন্তু বলতে গিয়েও বলে না, একটু ভাবে। মাকে এখনই বললে তুলকালাম করবে, নজরদারি বাড়িয়ে দেবে। আগে সূর্যকে বুকশপটাতে বসাতে হবে, কয়েকটা মাস লেগে যাবে ওর মানিয়ে নিতে। তারপর বাবা মাকে ও সূর্যের কথা বলবে। সূর্য যে ভদ্রস্থ কিছু একটা করছে সেটা ওনাদের বোঝাতে হবে। ওর খুনী পরিচয়টা ও মুছে ফেলতে চায় ওনাদের মন থেকে, এই সমাজের মানুষের কাছ থেকে। কিন্তু সেটা আসলেই এত সহজ কিনা ওর জানা নেই।

সেদিন রাতে ঘুমোতে যাবার সময় সূর্যের মুখটা কাছে চলে আসে, পারিজাত ফিসফিস করে কথা বলে, ‘এই ছেলে, আর কতদিন আমাকে দূরে রাখবে?’

একটা কথা ভেবে খুব স্বস্তি হয়, এখন ইচ্ছে করলেই যেকোনো দিন ও সূর্যকে দেখতে পাবে, ওর কাছে যেতে পারবে। এই কয়েকটা বছর ওর সূর্যকে ও ইচ্ছে করলেই দেখতে পেত না। মন খারাপ হলে ছুটে যেতে পারত না। এখন থেকে ওর কষ্ট ভাগ করে নেবার মানুষটা আছে, ইচ্ছে করলেই ছুটে চলে যাওয়া যাবে।

৩.
মা স্কুলে চলে গেছে কিছুক্ষণ। যাবার আগে ওর হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলেছে, ‘এই টাকাটা রাখ, পারিজাতের ওখানে গেলে তো লাগবে।’

সূর্য মায়ের কথাতে হেসে বলেছিল, ‘মা, তুমি এত বেশি ভাবো আমাকে নিয়ে। তুমি সাবধানে যাও, সারারাত তো ঘুমাও নি।’

সূর্যের ঘুমটা ভোরেই ভেঙে গিয়েছিল, কারাগারের এত দিনের অভ্যাস। ঘুম ভেঙেই দেখে মা জায়নামাজে, বুঝতে পেরেছিল মা ঘুমায়নি। নিশ্চয়ই মা ওর জন্য নামাজ মানত করেছিল। সেই ছোটবেলা থেকেই ও দেখে আসছে ওর অসুখ বা পরীক্ষা থাকলেই মা নামাজ বা রোজা রাখত। নাহ, কত কত দায় যে জমা হচ্ছে। মায়ের জন্য যে কিছু করবে তাই তো হচ্ছে না। আজও মায়ের কাছ থেকে টাকা নিতে হয় ওকে।

সকালে পারিজাত ফোন দিয়েছিল, কলেজে পৌঁছেছে। সূর্য ভেবে পাচ্ছিল না পারিজাত আজ দেখা করতে চাইল না কেন। সূর্যের খুব ইচ্ছে হচ্ছে ওর কলেজে চলে যেতে, হাত ধরে রিক্সায় ঘুরে বেড়াতে। কিন্তু পারিজাত তো আগের মতো নেই, একটা চাকরি করে। ওর মতো বেকার তো কেউ নেই। কথাটা মনে হতেই একটা মন খারাপ ওকে ঘিরে ধরে।

বাসাটা কেমন সুনসান, দমটা বন্ধ হয়ে আসতে চায়। ভাবে একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসা যাক।সূর্য রেডি হয়ে ফাতেমা খালাকে বলে বাসা থেকে বের হয়। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে নিচ তলার নীলা ভাবির দেখা হয়ে যায়। উনি বাসা থেকে বের হচ্ছিলেন, কিন্তু সূর্যকে দেখেই ঝট করে আবার বাসার ভেতর ঢুকে পড়েন, দরজাটা বন্ধ করে দেন। সূর্য কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়, নীলা ভাবি কী ওকে চিনতে পারল না? নাকি ইচ্ছে করেই ওকে এড়াতে চাইল? অথচ ভাবি ওকে খুব ভালোবাসত, ভালো কিছু রান্না হলেই বাসায় পাঠিয়ে দিত। মনটা খারাপ হয়ে যায় সূর্যের, এভাবেই হয়তো ওর সামনে অনেক খোলা দরজা বন্ধ হয়ে যাবে অথবা ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও বাইরে আসে। এলাকাটা আগে বেশ ফাঁকা ছিল, এখন অনেক উঁচু দালানকোঠা উঠে গেছে। মোড়ের সেই চায়ের দোকানটা আর নেই, একটা রেস্টুরেন্টে হয়েছে সেখানে। সূর্যের খুব চায়ের তৃষ্ণা পাচ্ছে, ও আনমনে রেস্টুরেন্টের দিকে এগোয়।

চায়ের অর্ডার দিয়ে ও চুপচাপ বসেছিল, ভাবছিল কোথায় কোথায় ও যাবে, একটা কাজ তো চাই। ভাবনার এই সময় হঠাৎ কিছু ছেলে ওর টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়, সূর্য মুখ তুলে তাকাতেই ছেলেগুলো অমায়িক গলায় বলে, ‘বস, আপনি জেল থেকে ছাড়া পাইছেন?’

সূর্য ছেলেগুলোর দিকে ভালো করে তাকায়, চিনতে পারে, এই এলাকার কিছু চিহ্নিত মাস্তান। এদের সাথে এর আগে কখনোই কথা হয়নি, ওকে আগে পাত্তাই দিত না। অথচ এখন বস বলে ডাকছে।

সূর্য ইতঃস্তত গলায় বলে, ‘এই তো কাল।’

ছেলেগুলার মধ্যে নেতা টাইপের যে ছেলেটা সে বলে, ‘বস, এখন থেকে কিন্তু আমাগো ক্লাবে প্রতিদিন বসতে হইব।’

একজন বেয়ারা চা দিয়ে যেতেই, ও চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে, ‘আচ্ছা, দেখা যাবে।’

ছেলেগুলো যাবার সময় ক্যাশিয়ারে বসে থাকা লোকটাকে বলে যায় চায়ের বিল যেন না নেয়।

চা টা এখন বিস্বাদ লাগছে। চা শেষ করে ও ক্যাশিয়ারে জোর করেই টাকা দিয়ে বের হয়ে আসে। নাহ, বাইরে থাকার চেয়ে বাসায় থাকা ভালো। সূর্য ভাবে, এই ছেলেগুলো ওকে বস বলল, তার মানে ওর খুনী পরিচয়টাই এখন অনেক বড়। ও একজন উঁচুমানের অপরাধী, তাই হয়তো ওরা ওকে বস বলে ডেকেছে। সমাজের কাছে ওর খুনী পরিচয়টা ও কী কোনোদিন মুছে ফেলতে পারবে?

৪.
আজ শুক্রবার, সূর্য সকাল থেকেই অস্থির হয়ে আছে, পারিজাত আসবে। ওর যে কত কথা জমে আছে, কত কিছু জানার আছে পারিজাতের কাছ থেকে। কেমন করে এই মেয়েটা আজও ওর জন্যই অপেক্ষা করে আছে?

মা সকাল থেকেই কী কী যেন রান্না করছে। মা তো পারিজাত বলতেই অজ্ঞান, সকালে যে কতবার করে বলল, ‘শোন, তুই কিন্তু কোনোদিন এই মেয়েটাকে কষ্ট দিবি না। শুধু তোর জন্য ও এতটা দিন অপেক্ষা করে বসেছিল। আর আমার খোঁজ পাওয়ার পর তো প্রতিদিন ফোন করে খবর নিত। মাসে একটা দিন আমার সাথে থেকে যেত। এর মাঝে একবার তো মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম, পরে পারিজাতই তো ডাক্তার হাসপাতাল করল। তাই বাবা, ওকে কিন্তু তুই দেখে রাখিস। এখন তোর দায়িত্ব অনেক। আর বিয়েটা করে ফেল তাড়াতাড়ি, আমি আর দেরি করব না।’

সূর্য একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, ওর আসলে অনেক দায়। মা, পারিজাত শুধু ওর জন্য কত যে আত্মত্যাগ করেছে তার ঋণ ও শোধ করবে কী করে? ওর এই খুনী পরিচয়টা যে ওকে নতুন করে কিছু শুরু করতে অনেকটাই বাধা হয়ে দাঁড়াবে তা ও বেশ বুঝতে পারে।

দুপুরের আগে আগেই পারিজাত আসে। মেহেরুন্নেসা ওকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘এত দেরি করলি, আর ওদিকে সূর্য অস্থির হয়ে আছে।’

পাশ থেকে সূর্য বলে, ‘আমি অস্থির হয়ে আছি না তুমি? বাপরে, সকাল থেকে পারিজাত পারিজাত নাম শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। আমার চেয়ে তো তোমাকেই বেশি ভালোবাসে। এই দেখো আজ কত পদ করেছে তোমার জন্য।’

পারিজাত হেসে বলে, ‘জ্বি, একদম ঠিক করেছে মা। আমাকেই বেশি ভালোবাসে, তাই এখন তোমার হিংসা হচ্ছে তাই না?’

মেহেরুন্নেসা হাসেন, শুদ্ধ দুটো প্রাণ, কী যে ভালো লাগছে। সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করেন এমন সুন্দর মুহুর্ত উপহার দেবার জন্য। মেহেরুন্নেসা আদর গলায় বলে, ‘তোরা একটু গল্প কর, আমি এদিকটা একটু সামলে নেই।’

পারিজাত মনে মনে খুশি হয়, ওর যে অনেক কথা বলার আছে। ওরা দু’জনে ব্যালকনিতে বসে। ছোট ছোট টবে সুন্দর সব ফুলের গাছ, মানিপ্লান্টের গাছ। পারিজাত একটা ফুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘সূর্য, অনেক কষ্ট হয়েছে তোমার, শুধু আমার জন্যই এমন শাস্তি পেলে।’

সূর্য পারিজাতের একটা হাত ধরে, দৃঢ় গলায় বলে, ‘পারিজাত, তোমার জন্য এর চেয়েও কঠিন শাস্তি আমি হাসিমুখে মেনে নিতে পারি। আমার পারিজাতের চোখে একটা বালুর কণাও পড়ে কষ্ট পাক সেটা আমি হতে দেব না কখনো। জানো পারিজাত, জেলে আমার কোনো কষ্ট হতো না। তোমার কথা ভাবতাম, আমাদের গল্প লিখতাম।।তাতেই কেমন করে সময়টা কেটে যেত, কোনো কষ্টকে কষ্ট মনে হতো না।’

পারিজাত ভেজা গলায় বলে, ‘হ্যাঁ, সূর্য, আমি জানি। তোমার গল্প পড়েই না তোমার খোঁজ পেলাম।’

সূর্য অবাক গলায় বলে, ‘সেটা কী করে!’

এরপর পারিজাত হুমায়ুন সাহেবের পুরো ঘটনাটা খুলে বলে। সূর্যের গল্পটা নিজের নামে পোস্ট করা, তারপর পারিজাতের সাথে সাক্ষাৎ, সব ও বলে।

সূর্য বিস্মিত গলায় বলে, ‘ওরে বাবা, এত দেখছি পুরোই থ্রিলার কাহিনি। এজন্যই বুঝি লোকটা আমাকে লিখতে দিয়েছিল। কী সাংঘাতিক!’

পারিজাত হেসে বলে, ‘তারপরও আমি লোকটার কাছে কৃতজ্ঞ, ওনার জন্যই না তোমাকে খুঁজে পেলাম। আর উনি ওনার কথা রেখেছেন, চার পর্বের পর আর পোস্ট করেননি। পরে সেগুলো ডিলিট করেও দিয়েছে। আর উনি ক্ষমা চেয়ে লিখেছিল গল্পটা ওনার না, তারপর ওই লেখালেখির গ্রুপটা থেকেও লিভ নিয়েছে। যাক সেসব কথা, তুমি এরপর আর কয়টা পর্ব লিখেছিলে?’

সূর্য মনে মনে হিসেব করে, বলে, ‘উম, দশ পর্ব। উনি তো মেইল করার কথা। দেখি, একবার চেক করতে হবে। কিন্তু উনি যদি না দেয়?’

পারিজাত আশ্বাস দেয়, ‘উনি দেবে, কারণ না দিলে ওনারই সমস্যা। এটা নিয়ে তুমি ভেব না।’

সূর্য মাথা নাড়ে, তারপর গভীর গলায় বলে, ‘পারিজাত, আমি না হয় গল্প নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, কিন্তু তোমার সময় কী করে কেটেছে? আর মা বাবকে সামলেছ কী করে, ওনারা নিশ্চয়ই এটা ভালোভাবে নেননি যে তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করছ?’

পারিজাত বিষন্ন হেসে বলে, ‘না নেননি, কিন্তু তাতে কী, আমার যে সূর্যকেই লাগবে। আমার চাওয়াটা সত্যি ছিল তাই ওনারা পারেননি। তবে তোমার জন্য ভীষণ কষ্ট নিয়ে সময় কাটত। মনে হতো এই পৃথিবীতে আপন বলে কেউ নেই। যেদিন তোমার খোঁজ পেলাম, মায়ের খোঁজ পেলাম সেদিন আমি একটু শান্তি পেয়েছিলাম। আমার দিন কেটেছে তোমার জন্য একটা কিছু করার চিন্তায়, আর সেটা আমি করেছি, আজই দেখতে পাবে।’

সূর্য কথাটা বুঝতে পারে না, অনিশ্চিত গলায় বলে, ‘আমার জন্য কী করেছ? বুঝিনি।’

পারিজাত চোখ মেরে বলে, ‘ধীরে বৎস, একটু ধৈর্য ধরেন, লাঞ্চের পর বাধ্য বালকের মতো একটা জায়গায় যেতে হবে। তাহলেই দেখতে পাবেন।’

এরপর সূর্য যতই জানতে চায় পারিজাত ততই হেসে গড়িয়ে পড়ে, কিন্তু বলে না।

দুপুরে খাওয়া শেষে পারিজাত মাকে বলে, ‘মা, আপনার ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছি। সন্ধ্যার মধ্যেই বাসায় দিয়ে যাব।’

মেহেরুন্নেসা ওকে কাছে টেনে কপালে চুমু খেয়ে বলেন, ‘ওর দায়িত্ব তো এখন তোমার। যাও তোমরা।’

বাসা থেকে বের হয়ে একটা সিএনজি নেয় ওরা। পারিজাত ড্রাইভারকে বলে, ‘শাহবাগ চলো।’

সূর্য জানতে চেয়েছিল শাহবাগ কেন, পারিজাত একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বলেছিল, ‘গেলেই দেখতে পাবে, বললাম না সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য।’

শাহবাগের মোড়ে বড় বিল্ডিংটার দোতলায় একটা সুন্দর দোকানের মতো সামনে এসে দাঁড়ায় ওরা। সূর্য অবাক হয়ে খেয়াল করে, দোকানটার উপরে লেখা, ‘সূর্যের পারিজাত বুক শপ’।

সূর্য ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, পারিজাতের হাতটা চেপে ধরতেই ও বলে, ‘সূর্য, এটা আমাদের বুক শপ। মনে আছে, তুমি আর আমি মিলে একবার ঠিক করেছিলাম সুন্দর একটা বইয়ের দোকান দেব। দেশি বিদেশি বিখ্যাত সব বইগুলো রাখব। এক কোণে একটা ছোট্ট কফি মেকার থাকবে। কেউ ইচ্ছে করলে বসেও বই পড়তে পারবে। দেখো, আমাদের স্বপ্ন আজ সত্যি হয়েছে সূর্য। ভেতরে যাবে না?’

সূর্যের বুকের ভেতর কোথায় যেন একটা ভালোবাসার সুশীতল বাতাস বয়ে যায়, পারিজাত ওর জন্য এতটা করে বসে আছে?

পারিজাত ওর হাত ধরে বুক শপটায় ঢোকে। ভেতরে ঢুকতেই একটা চশমা পরা লম্বামতো ছেলে এগিয়ে আসতেই পারিজাত হেসে বলে, ‘সূর্য, উনি ধ্রুব, আমার কলিগ। ওনার জন্যই এত সুন্দর একটা জায়াগা পেয়েছি। বইয়ের দোকানটা করতেও অনেক সাহায্য করেছেন।’

সূর্য হেসে হাত মেলায়, ধ্রুব আন্তরিক গলায় বলে, ‘খুব ভালো লাগছে আপনার সাথে পরিচয় হয়ে। পারিজাত তো সারাক্ষণ আপনার কথাই বলে।’

পারিজাত একটু লজ্জা পেয়ে যায়। সূর্য আন্তরিকতার সাথে ধ্রুবর হাতটা চেপে ধরে, বলে, ‘অনেক ধন্যবাদ ভাই, এত সুন্দর একটা জায়গায় বুকশপের জন্য দোকান পাওয়া আসলেই অনেক কঠিন।’

এরপর সূর্য পুরো বুকশপটা ভালো করে দেখে, বেশ পরিপাটি করে সাজানো। কয়েকটা আরামদায়ক সিঙ্গেল সোফা, যাতে বই পড়তে সুবিধে হয়। বইয়ের সংগ্রহও চমৎকার। সূর্য আগ্রহ নিয়ে বইগুলো দেখে, আহ, কতদিন পর নতুন বইয়ে ঘ্রাণ নিল।

কফি খেতে খেতে পারিজাত ওর প্ল্যান শেয়ার করে, বলে, ‘রাজু নামের একটা ছেলে এখন দেখাশোন করে। কাল থেকে তুমি বসবে এখানে। সূর্যের পারিজাত নামে একটা অনলাইন বুকস্টোর আছে। মূলত ওখানেই অর্ডার বেশি হয়। তবে অনেকে সরাসরি এসেও কিনতে চায়। আমি চাই তুমি এগুলো বুঝে নাও। আর বইয়ের ব্যাপারে তোমার টেস্ট তো বরাবরই ভালো।’

সূর্যের মাথাতে সব কথা ঢুকছিল না, ও শুধু ভাবছিল ঢাকা শহরের এমন একটা জায়গায় এত বড় একটা দোকানের ভাড়া কত? আর এর এডভ্যানসেই তো অনেক টাকা খরচ হয়ে যাবার কথা। ও মনে মনে খুব সংকুচিত বোধ করে, এই পৃথিবীতে ও এতটাই পিছিয়ে পড়া মানুষ যে ওর জন্য পারিজাতকে সর্বস্ব দিয়ে বাজি ধরতে হলো। মনের ভেতর একটা চাপ অনুভব করে সূর্য। বুঝতে পারে, পারিজাত ওকে এই পৃথিবীতে একটু এগিয়ে দিতে চায়, ওর খুনী পরিচয়টা মুছে দিতে চায়।
ও পারবে তো পারিজাতের স্বপ্ন পূরণ করতে? পারবে তো পারিজাতের প্রত্যাশা পূরণ করতে? এতদিন কারাগারের ভেতরে বসে ভাবত কবে মুক্তি পাবে, কবে মায়ের কাছে, পারিজাতের কাছে আসবে। এখন নতুন একটা চাওয়া, যে প্রিয় মানুষেরা ওর জন্য সব বাজি রাখল, তাদের জন্য করার পালা। সূর্য মনের ভেতর জোরটা পায় না, কোথায় যেন আত্মবিশ্বাসটা নড়ে গেছে।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
০৪/০৩/২০২২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here