#মায়াবন_বিহারিনী 🖤
#পর্ব_২৩,২৪
#আফিয়া_আফরিন
২৩
সকালবেলা ঘুমটা তাড়াতাড়ি ভেঙে গেলো। মায়া উঠে ফ্রেশ হয়ে গেল রান্নাঘরে। প্রতিদিন তো শাশুড়ি মা ই রান্নাবান্না কমপ্লিট করে। আজ না হয় সেই করুক।
আটা মাখিয়ে নিয়ে পরোটা বেলছে। এমন সময় হাই তুলতে তুলতে ইমনও এলো।
বললো, “কি ব্যাপার এত সকালে?”
“ঘুম ভেঙে গেছে। তুমি এত সকাল সকাল?”
“আমার ঘুম ভেঙে গেছে।”
“ও আচ্ছা।”
“তো কি করছিস?”
“পরোটা ভাজবো। এখন যাও তুমি, ফ্রেশ হয়ে বরং খেতে আসো।”
ইমন গেলো না। দরজার সাথে হেলান দিয়ে বুকে দুই হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে রইলো।
মায়ার পরোটা বেলা শেষ হলে ইমন বললো, “তুই সর আমি ভেজে দেই।”
মায়া অবাক হয়ে বললো, “তুমি? তুমি পারবে?”
“তুই পারলে আমি পারবো না কেন?”
“আমি তো আমাদের বাসায় থাকতেও করছি। আমার অভ্যাস আছে। তুমি কি করেছো কখনো?”
“করি নাই। তবে করবো এখন থেকে। তুই যা।”
মায়া সরে দাঁড়ালো। ইমন ঝড়ের গতিতে গিয়ে পরোটা বাজতে শুরু করলো। মায়া পাশে থেকে দাঁড়িয়ে টুপটাক সাহায্য করছিলো।
একটু সাইট থেকে ছেলে বউয়ের এমন মধুময় দৃশ্য দেখে মুচকি হাসলেন সুহাদা। তারমানে ওদের মধ্যে সবকিছু ঠিকঠাক। ভুল বোঝাবুঝি মিটেছে। অবশেষে তিনি তৃপ্তির হাসি হাসলেন।
.
.
সকালে নাস্তা শেষে ইমন মায়া আর মিমোকে ক্যাম্পাসে পৌঁছে দিয়ে, নিজেও চলে গেলো। জানালো, সে তাদের নিতে আসবে ক্লাস শেষে। মিমো আজ একটা ক্লাসও করলো না। ক্যাম্পাসের মধ্যেই ঘুরে বেড়ালো ঋদ্ধর সাথে। মায়া ও দেখা পাইনি তার। কই গিয়ে ঘুরছে দুজন কে জানে?
ভার্সিটি ক্লাস শেষ হওয়ার ১০ মিনিট আগেই ইমন গেটে দাঁড়ালো। মায়া নিচে নেমে ইমনকে দেখলো, দাঁড়িয়ে থাকতে। কিন্তু মিমো কে আশেপাশে কোথাও দেখতে পেল না। ফোন দিলো।
ফোন রিসিভ করতেই মায়া বললো, “কোথায় তুই? ইমন আসছে আমাদের নিতে।”
“আপু আমি বাইরে আসছি। আমি পৌছাচ্ছি এখনই।”
“মানে? বাহিরে মানে? ক্লাসের মধ্যে বাইরে যাওয়া মানা তো। কেমনে গেলি?”
“পেছনের দেওয়াল টপকে!”
“আল্লাহ মালুম! তোর ভাই জানলে শেষ। তুইও শেষ, সাথে আমিও।”
“আসছি আপু। ১০-১৫ মিনিট লাগবে পৌঁছাতে।”
“আচ্ছা আয়। আমি পেছনের গেটে অপেক্ষা করছি। যেভাবে গিয়েছিস, সেভাবে আসবি।”
“আচ্ছা।”
মায়া ফোন রাখতেই ইমন ফোন দিলো। প্রথমবার সে ফোন তুললো না। ইমন পরবর্তী কয়েকবার ফোন দিলো, তবুও মায়া ফোন ধরলো না। কিছুক্ষণ পর নিজেই কল ব্যাক করলো।
বললো, ” হ্যাঁ বলো কেন ফোন দিয়েছিলে?”
“ফোন কেন দিচ্ছিলাম মানে? কোথায় তোরা? দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসতে হবে নাকি তোদের?”
“আরে না। মিমোর একটা এক্সট্রা ক্লাস আছে, সেখানেই আমি। তুমি চলে যাও না, একটু দেরি হতে পারে।”
“না না আসছি যখন চলে যাব কেন? আর মিমোর কিসের এক্সট্রা ক্লাস? ওর ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়েগুলোকে দেখলাম বাইরে বের হতে।”
“ওর সাইন্স প্রজেক্ট এর কি যেন ক্লাস আছে।”
“ওহ। আমি পাশের চায়ের দোকানে অপেক্ষা করছি।”
মায়া ফোন রাখলো। পেছনে গেটে গিয়ে দাঁড়ালো। মিমো এইখান দিয়েই আসবে। ২০ মিনিট পার হয়ে গেলেও মিমো এলো না। মায়া আবার ফোন দিলো ওকে।
মিমো ফোন ধরে বললো, “আপু আর দশ মিনিট।”
মায়া ফোন রেখে দিলো। অপেক্ষা করতে লাগলো। একটা গাছের ছায়ায়। কিছুক্ষণ পর মিমোকে দেখতে পেলো দেওয়াল টোপকে আসতে। মিমো দৌড়ে এসে হাঁপিয়ে বললো, “চলো। ভাইয়া তো ওই চায়ের দোকানে। আমি ওখান দিয়ে আসছিলাম, ভাইয়াকে দেখে ঘুরে আসছি।”
“ঠিক হইছে। ক্লাস বাদ দিয়ে মেয়ে গেছে প্রেম করতে! আর জীবনেও এসব করবি? কত মিথ্যে বলতে হলো আমায়। এরপর দেখিস আর তোর পক্ষ নিবো না। ক্লাস বাদ দিয়ে আবার কিসের ঘোরাঘুরি? কই না কই গেছে আল্লাহ ভালো জানে?”
“আচ্ছা সরি সরি, আর হবে না এমন। প্লিজ চলো এখন।”
মায়া আর মিমো যেতেই ইমন কড়া চোখে তাকালো। ইমনের এমন চাহনিতে ভোড়কে গেলো দুজনেই। তারপর ইমন আর কিছু না বলে সামনে এগোতে লাগলো। মায়া আর মিমো ও ওর পিছু পিছু হাঁটতে লাগলো।
মায়া মিমো কে ফিসফিসিয়ে বললো, “দেখলি, তোর ভাইয়ের মেজাজ টা কেমন চটে আছে!”
“তাই তো দেখছি।”
.
.
বিকেলবেলা আকাশটা কেমন কালো হয়ে আসলো। বৃষ্টি হবে সম্ভবত। মায়া বেলকনি থেকে দাঁড়িয়ে ইমনকে দেখল চৌরাস্তার মোড়ে, বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে। ডাক দিতে গিয়েও ডাকলো না। ভেতরে চলে এলো। বই নিয়ে বসলো পড়ার জন্য। এমন সময় জানালা দিয়ে বৃষ্টির ঝাপটা আসতে লাগলো। অলরেডি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। মায়া উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করলো। তারপর আবার গেল বেলকনির দিকে। দেখলো ইমন ফিরে আসছে।
ইমন বাড়ি ফিরলো ভিজে চুপচুপে হয়ে। কাপড় বদলে এসে বসলো।
মায়াকে উদ্দেশ্য করে বললো, “আমার এক কাপ চা বানিয়ে দে তো।”
মায়া তার কথা মতো গিয়ে চা বানিয়ে নিয়ে এলো। এসেই দেখল ইমনের চোখ মুখ লাল হয়ে আসছে। মায়া ওর কপালে হাত দিয়ে দেখলো গা হালকা গরম। তারমানে জ্বর আসবে!
“তোমার তো জ্বর আসছে মনে হয়।”
“তেমন কিছুই না। হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজলাম তো, এইজন্য গা টা গরম হয়ে আসছে। দেখবি, একটু পরে ঠিক হয়ে যাবো।”
“আচ্ছা, আমি তোমায় ও
ঔষুধ দেই। খেয়ে বরং ঘুমাও।”
ইমন ঘুমিয়ে গেলে মায়া অনেকক্ষণ পর্যন্ত তার মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিলো। ইমনের কথাই সত্যি হলো, জ্বর বেশিক্ষণ থাকলো না। সন্ধ্যার পরপরই জ্বর নেমে গেলো।
মায়া ইমন এর কাছে গিয়ে আহ্লাদি কণ্ঠে বললো, “নাও, এখন আমায় জড়িয়ে ধরো!”
“খবরদার না। তোর কাছে গেলে, তোকে জড়িয়ে ধরতে গেলে, একটু চুমু খেতে গেলেই বিপত্তি। হয় একবার নীলা চলে আসে, না হয় মিমো। আর না হয়তো কারেন্ট চলে যায়। খুব রিস্কি ব্যাপার!
মায়া বিস্মিত নয়নে তাকালো ইমনের দিকে। তারপরই হেসে দিলো।
“ওরা তোমার শত্রু?”
“একদম। ঘোর শত্রু যাকে বলে! আমি সত্যিই বুঝি না, আমার সাথে এমন হয় কেন বারবার? আমি তাদের কোন পাকা ধানে মই দিলাম?”
মায়া হেসে বলল, “ওরা বোধহয় তোমায় পছন্দ করে না। কিন্তু আমায় করে। দাঁড়াও, প্রমাণ দেখবে? দেখাচ্ছি!”
মায়া নিজে গিয়েই ইমনকে জড়িয়ে ধরলো। বুকে মাথা রেখে বলল, “দেখলে কিছু হলো? কেউ এলো এখন?”
ইমন ও পাল্টা ওকে জড়িয়ে ধরে বললো, “তাহলে তুই ই বারবার আসিস।”
মায়া মুখ তুলে ইমনের দিকে তাকিয়ে বলল, “আচ্ছা আসবো। কিন্তু একটা কথা?”
“কি কথা?”
“আমায় তুমি এখনো কেন তুই তুই করে বলো? আগে না হয় বলছো, ঠিক আছে। তাই বলে এখনো তুই তুই করেই বলবে?”
“তো কি বলবো?”
“আমি যেমন তোমায় তুমি তুমি করে বলি, তেমনি তুমিও আমি তুমি তুমি করে বলবে।”
“আচ্ছা। তাহলে এখন থেকেই শুরু করি, ‘তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো, ছেড়ে দেবো না!’ কেমন লাগলো শুনতে?”
“ধুর, একদম ভালো লাগে নাই। যদিও এটা গান ছিলো, তবুও আমাকে উদ্দেশ্য করে বলছো বিধায় কেমন একটা খাপ ছাড়া ভাব চলে এসেছে। কেমন জানি পর পর লাগলো শুনতে। তুই তুই করে ডাকলে যেমন একটা আপন আপন ফিল আসে, তুমি তে সেই ফিল টা এলোনা। আচ্ছা থাক, তুমি আমায় তুই করে বলো। তোমার মুখে তুমি ডাকটা ঠিক মানাচ্ছে না। ওইটা আমার জন্যই ঠিক আছে।”
ইমন হেসে ওকে এক হাতে জড়িয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বললো, “তুই আমার তুমি, আপনি, তুই সবই তো! ডাকলেই হলো একটা ডাকে!”
.
.
.
সকালবেলায় ইমন বাইরে বের হওয়ার আগে মায়া কে বললো, “বিকালে রেডি থাকিস, ঘুরতে বের হবো।”
“আচ্ছা।”
তারপর ইমন মায়ার কপালে ছোট্ট একটা চুমু একে চলে যায়।
বিকেলবেলা দুজনই ঘুরতে বের হয়। মায়া হঠাৎ করেই একটা ছেলেকে দেখে বললো, “ওয়াও! ছেলেটা কি কিউট। পুরা টাইটানিক মুভির নায়কের মতো দেখতে। সিরিয়াসলি, হি ইজ ড্যাম কিউট!”
ইমন ভুরু কুঁচকে তাকালো ওর দিকে। কিন্তু কিছু বললো না। এমনকি এতক্ষণ যাবত একসাথে ঘুরলো একটা কথাও বললো না সে। মায়া কিছুই বুঝলো না, সে নিজেই আবোল তাবোল বকে গেলো।
কিছুক্ষণের মধ্যে তারা বাড়ি ফিরে এলো। এমন কোন কথার কোন রেসপন্স করছিলো না, তাই মায়া নিজেই চলে এলো। এমন নিরামিষ মার্কা মানুষ নিয়েই কেউ কোথাও ঘুরতে যায়? হুটহাট এমন করে কেন ছেলেটা? একটু আগে পর্যন্ত ও তো ঠিক ছিল!
ইমন সম্ভবত রাগ করেছে। রাগ যে করেছে এইটা মায়া স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে। কিন্তু রাগের কারণটা কি, সেটা সে বুঝতে পারছে না।
সে ইমনের হাত জড়িয়ে ধরে বললো, “তুমি রাগ করে আছো নাকি?”
এমন এবারও কোন কথা বললো না। মুখ ঘুরিয়ে নিলো। মায়া ইমন এর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললো, “আমি কোন দোষ করেছি, বলো?”
ইমন এবারেও কিছু বললো না। মায়া হাল ছেড়ে দিয়ে বললো, “কিছু তো বলো নাকি? এমন চুপ করে বসে থাকলে, বুঝবো কি করে যে কি হয়েছে?”
মায়া ইমনের গলা জড়িয়ে ধরে, ঠোঁটে বেশ কয়েকটা চুমু খেলো।
তারপর পুনরায় বললো, “আমি যদি কোন দোষ করে থাকি, তাহলে সো সরি! তবুও কথা বলো, প্লিজ।”
“না ভুল তুই কেন করবি? তুই বরং যা, তোর টাইটানিকের সেই নায়কের কাছে।”
এইবার ব্যাপারটা মায়ার কাছে বোধগম্য হলো। সে ব্যাপারটা বুঝতে পারা মাত্রই হেসে বলল, “ও তুমি এই সাধারণ ব্যাপার নিয়ে এমন রাগ করে আছো?”
“এটা অবশ্যই কোন সাধারণ ব্যাপার না। পাশে নিজের স্বামী থাকতে আরেকজনের দিকে নজর দেয়। তাও আবার যে সে নজর না, টাইটানিকের নায়কের মত নাকি দেখতে?”
“আচ্ছা শোনো, আমি তো ফাজলামি করছি। আসলে ওই ছেলেটার চেহারার সাথে মিল আছে তো তাই।”
“সর, সামনে থেকে।”
বলেই ইমন উঠে চলে গেল। মায়া মাথায় হাত দিয়ে বলল, “হায় আল্লাহ! রাগ করার আর কোন কারণ পেল না। এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে কেউ এত সিরিয়াস হয়?”
ইমন রাগ করেই ছিলো। মায়া অনেক ভাবেই ইমনের রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু, ইমন নিজের জেদ ধরেই বসে রইলো। মায়ার নিজের মেজাজটাই এবার প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেল। এটা কোন রাগ করার বিষয়বস্তু হলো? আজব ব্যাপার! এটা বাচ্চাদের মতো আজগুবি ধরনের হিংসামি হয়ে গেল না?
মায়া ইমনের সামনে গিয়ে কড়া গলায় বললো, “অভ্যাস হয়ে গেছে, তাই না? প্রতিবার রাগ কর তুমি, আর তেল মাইরা মাইরা সেই রাগ আমার ভাঙ্গানো লাগবে? পাইছো তো একটা ফালতু এক্সকিউজ, সেটা ধরেই বসে আছো। আমি অনেক বুঝালাম, বুঝলা না তো তুমি। ঠিক আছে, থাকো তুমি তোমার রাগ নিয়ে। আমি আর আসছি না তোমার রাগ ভাঙাতে!”
কথাটা বলেই মায়া চলে যাচ্ছিলো। ইমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো। তারপর হাত ধরে টেনে বললো, “আমি রাগ করেছি, তুই ভালোমতো আমার রাগ না ভাঙ্গিয়ে উল্টো আমার সাথে রাগ দেখাচ্ছিস? কম্পিটিশন লাগাস তুই, আমার সাথে? কম্পিটিশন? টিউবলাইট কোথাকার একটা!”
.
.
.
.
চলবে……..
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
#মায়াবন_বিহারিনী🖤
#পর্ব_২৪
#আফিয়া_আফরিন
সূর্য ডুবছে। ঘরের কাচের দেওয়ার ভেদ করে গোধূলির আলো আছড়ে পড়ছে। কেমন জানি, চারিপাশ অদ্ভুত মায়াবী লাগছে! পুরো ঘর, বিছানা, আশেপাশের সবকিছুতে গোধূলি আলোর বিচরণ চলছে।
ইমন ঘুমের মধ্যে মায়াকে কখন জড়িয়ে ধরেছে, নিজেও জানে না।
আজ দুপুর নাগাদ তারা কক্সবাজারে এসে পৌঁছেছে। এখানে বেশ কিছু বছর আগে থেকে এপার্টমেন্টের মালিকরা তাদের ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া দেন। ফরেইনার অথবা বাঙালি যে কারো জন্যই বরাদ্দ। ফুল ফার্নিশড ফ্ল্যাট যাকে বলে। ইমন আর মায়া সেই ফ্ল্যাট গুলোর একটাতেই এসে উঠেছে। এই ফ্ল্যাটের সামনে বীচ। সমুদ্রের পানির অদ্ভুত এক ঘ্রাণ থাকে। ঘুমের মধ্যেও যেটা স্পষ্ট টের পাচ্ছে ইমন আর মায়া!
সন্ধ্যা নামার মুহূর্তেই মায়ার ঘুমটা ভেঙে গেল। আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসলো সে। ইমনের দিকে চেয়ে দেখলো, বেঘোরে ঘুমাচ্ছে ছেলেটা। মায়া আস্তে করে আলতো হাতে কপালের উপরে লেপটে থাকা চুলগুলো সরিয়ে, কপালে একটা চুমু খেলো। ইমন সাথে সাথেই চোখ খুলে তাকিয়ে, জড়িয়ে ধরলো। তারপর মায়ার গালে একটা চুমু খেয়ে বললো, “কি করা হচ্ছিলো, শুনি?”
“কিছু না। চুলগুলো এলোমেলো হয়েছিলো, তাই ঠিক করে দিলাম।”
ইমন মায়াকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে বললো, “আচ্ছা, তাই?”
“জি জনাব।”
“ঠিক আছে। এখন তো ঘুম ভেঙেছে, চল তাহলে। সমুদ্র দেখে আসি, খুব কাছ থেকে।”
“আচ্ছা চলো।”
ইমন উঠে বসলো। মায়াকেও টেনে তুললো। তারপর মুখোমুখি বসে নাকে নাক ঘষে বললো, “তার আগে দুই কাপ চা খেয়ে নেওয়া যাক।”
“ওখানে গিয়েই খাবো। তুমি যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।”
“আচ্ছা তুই দুই মিনিট বস, আমি পাঁচ মিনিটে আসছি!”
ইমন চলে গেলে মায়া সেই বিশাল কাচের জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়। এই জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। সন্ধ্যা নামছে, তবুও সমুদ্রের পানি কি স্পষ্ট! মায়া আস্তে করে জানালার একদিক থেকে একটুখানি খুলে দিলো। সাথে সাথে সমুদ্রের লোনা বাতাস হু হু করে রুমের ভেতর ঢুকে গেলো। মায়া চোখ বন্ধ করে সেই লোনা পানির ঘ্রাণ অনুভব করছিলো। থেকে থেকে সমুদ্র কেমন গর্জন করে উঠছে। বেশ অদ্ভুত লাগছে শুনতে। মায়া চোখ খুললো, হঠাৎই কেমন মনে হলো সমুদ্রটায় কেমন যেন, বিষন্নতা ভর করেছে! সমুদ্র টা মনে হচ্ছে কাঁদছে! কি আশ্চর্য? সমুদ্র কেন কাঁদবে? এই বিশাল সমুদ্রের আবার কিসের এত দুঃখ?
ইমন এসে পেছন থেকে ওর কোমর দুহাতে আঁকড়ে ধরলো। তারপর ঘাড়ে মুখ গুজে দিয়ে বললো, “যাবি না? দাঁড়িয়ে থাকবি এভাবে?”
“তুমি যদি এভাবে অক্টোপাসের মতো ধরে থাকো, যাবো কিভাবে?”
ইমন মায়া কে ছেড়ে হাত ধরে বললো, “চল।”
দুজনে নিচে নামলো। সম্ভবত সমুদ্রে জোয়ার ভাটার প্রকোপ রয়েছে। যদিও এখন পানির অবস্থা স্বাভাবিক। মায়া আর ইমন এক কিনারে গিয়ে বসলো। সমুদ্রের একেবারে কাছে এসে সমুদ্রের গর্জন টা কেমন যেন আরও বেশি জোরালো হয়ে আসছে! এমন শব্দে গায়ের মধ্যে কাঁটা দিয়ে ওঠে, হাত পায়ের লোম শিউরে ওঠে।
.
.
মায়া আরো একটু এগিয়ে গিয়ে পানিতে পা ভেজালো। ইমন ও ওর পিছু পিছু এলো। একা এখানে ছাড়া যাবে না। বারবার বিশাল বড় বড় ঢেউ আসছে। তারমধ্যে সামনে বালু, ঢেউ গুলো সরে যেতেই পায়ের নিচের স্তুপ আকারে থাকা বালুকণা গুলো ভেঙ্গে পড়েছিলো।
মায়া যখন আরেকটু সামনে এগোলো, একটা বড়ো ঢেউ এসে কোমড় পর্যন্ত ভিজিয়ে দিয়ে চলে গেলো। ঢেউ সরে যাওয়ার পর মায়ার পায়ের নিচে থাকা বালুকণা গুলো ভেঙ্গে পড়লো।
সে টাল সামলাতে না পেরে ইমনের টি-শার্ট খামছে ধরলো। ইমনের অবস্থাও মায়ার মতনই হয়েছিলো। দুজনেই হুমড়ি খেয়ে পানির মধ্যে পড়ে গেলো। ইমন পড়ে গিয়েও হাসতে লাগলো। মায়া এক পলক আশেপাশে তাকালো মানুষজনের সংখ্যা কম বললেই চলে। বিশেষ করে, তারা যে দিকটা আছে সেই দিকে তেমন কেউ নাই।
মায়া ইমনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো, “তুমি হাসছো কেন এভাবে? ওঠো।”
“না। মজা লাগছে এভাবে থাকতে। আজকে সারা রাতটা এখানে কাটিয়ে দিবো।”
মায়া উঠে দাঁড়ালো। আর ইমন সেই পানি আর বালুর মধ্যে শুয়ে রইলো। ইমন এক হাতে মায়াকে টেনে আবার বসালো।
তারপর বললো, ” আজ সারা রাতটা এখানেই থাকি। আমার বুকের উপর শুয়ে থেকে রাতের চাঁদ দেখিস। সমুদ্রের লোনা পানির ঘ্রাণ গায়ে মাখিস।”
“শোনো, তোমার মত আমি পাগল হয়ে যাইনি। ওঠো তো, মানুষজন আছে।”
“থাকুক। তারা তো আর দেখছে না, আর দেখলেই বা কি?”
মায়া কিছু বললো না। পানির মধ্যে বসে থেকেই সামনের দিকে তাকালো। যতদূর পর্যন্ত চোখ যায় শুধু ঢেউ খেলানো পানি আর পানি!
আজ মনে হয় পূর্ণিমার রাত। ঢেউগুলো বারবার আছড়ে পড়ছে তীরে। তখন চাঁদের আলো সাদা ফেনা গুলোকে হীরের এক একটা টুকরো মনে হচ্ছিলো। হীরের টুকরোর মতই জ্বলজ্বল করছিলো।
মায়া ইমনকে বললো, “অনেক তো হলো, এবার ফিরবে না? এতো ভিজছো যে, ঠান্ডা লাগলে? জ্বর আসলে, তখন?”
ইমন কিছু বললো না। মাথার নিচ থেকে এক হাত বের করে মায়া কে টেনে বুকের ভেতর নিয়ে এলো।
বললো, “তুই থাক। কিছুই হবে না।”
“ছিঃ, এটা তোমার প্রেম করার জায়গা!”
ইমন আবারো কিছু না বলে দু’হাতে মায়ার মুখটা তুলে চুমু খেলো, অনেকক্ষণ পর্যন্ত।
.
.
তারা যখন নিজেদের ফ্ল্যাটে ফিরে এলো, তখন রাত এগারোটা বাজে। বীচে থাকতে খাওয়া-দাওয়া করেছিল বিধায় এখন আর কোন কিছু না খেয়ে রুমে ফিরে এলো। দুজনেই একদম ভিজে চুপচুপে।
ঘরে এসে কাপড় পাল্টে নিলো। ওরা ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই মায়া জানালা খুলে রেখেছিলো, যে কারণে পুরা ঘরে ঠান্ডা বাতাসের বিচরণ চলছে। মায়া এগিয়ে জানালা বন্ধ করে দিলো। দুজনেই ঠান্ডায় কাঁপছিলো।
ইমন মায়ার কাছে এগিয়ে গেলো। আলতো হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো, “আচ্ছা, কেউ কাউকে এত ভালবাসতে পারে কি করে?”
তারপর কানের লতিতে চুমু খেলো।
মায়া অস্পুট স্বরে বললো, “জানিনা!”
এরপর ইমন আস্তে করে মায়ার ঘাড়ে চুমু দিতে দিতে বললো, “হ্যাঁ থাক, সব কথা জানতে হয় না। কিছু কথা না জানাই ভালো।”
তারপর তাকালো মায়ার দিকে। অদ্ভুত নেশা ধরা দৃষ্টিতে। এই দৃষ্টির দিকে চোখ মেলে তাকানো মায়ার কাম্য নয়। তাই সে চোখ নামিয়ে নিলো।
ইমন দুষ্টু হাসি হেসে বললো, “তাকা, আমার দিকে!”
মায়া তাকালো না। ইমন ওর মুখ তুলে চোখে চোখ রাখলো। মায়া এই চোখের দৃষ্টির দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না। আবারো দৃষ্টি নামিয়ে নিলো, দ্বিতীয়বারের মতো। ইমনের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এক সাইডে গিয়ে দাঁড়ালো।
“তুই অমন সরে সরে যাচ্ছিস কেনো বারবার?”
“তুমি অমন কাছে কাছে আসছো কেন বারবার?”
“বারে, আসবোনা? এখন ডিস্টার্ব করার মতো কেউ নাই। শুধু তুই আর আমি। হুটহাট তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে গেলে, কলিং বেল বেজে উঠবে না। নীলা অথবা মিমো কেউ আসবে না। এমনকি কারেন্টও যাবে না, এখানে আইপিএস আছে।”
মায়া হাসলো। বললো, “শত্রুদের হাত থেকে রেহাই পেলে অবশেষে।”
“হ্যাঁ তাতো আমি পেলাম। তবে এবার আমার হাত থেকে তো তোর রেহাই নেই। এখন থেকে তোকে চালানোর মিশন শুরু।”
“আচ্ছা? দেখবো আমি, কতো জ্বালাতে পারো?”
“তুই কি আমাকে চ্যালেঞ্জ করছিস?”
মায়া মাথা নেড়ে বললো, “জি জনাব!”
“আচ্ছা।” ফিচলে হাসি দিয়ে বললো ইমন।
বলেই মায়ার দিকে এগিয়ে এলো। মায়া এক হাতে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে হাসতে হাসতে দৌড় দিলো। পিছন পিছন ইমন ও দৌড় দিলো। দৌড়াতে দৌড়াতে সারা ঘর চক্কর খেলো কয়েকবার।
মায়া হাসতে হাসতে বললো, “পারলে না তো আমায় ধরতে?”
কিন্তু কতক্ষণ? একসময় ইমন এর কাছে ঠিকই ধরা দিতে হলো। এমন তাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিয়ে বললো, ” এতো ছোটালি যে আমায়, এইবার এর খেসারত দিতে পারবি তো?”
মায়া কিছু বললো না। শুধু চোখ বড় বড় করে তাকালো ইমনের দিকে। ইমন আচমকা মায়াকে কোলে তুলে নিলো। ওকে কোলে নিয়েই রুমের লাইট অফ করলো।
আবছা আলোয় মায়ার দিকে তাকালো। ইমন স্পষ্ট দেখলো, ওর ঠোঁটের কোণে হাসি চিক চিক করছে। আশ্চর্য! হাসবে কেনো মেয়েটা? তবে এটাই বোধহয় তার দীর্ঘদিনের বাসনা ছিলো।
.
.
.
.
সকালবেলা ইমনের ঘুমটা আগেই ভেঙে গেলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সাতটা বাজে। মায়াকে না জাগিয়ে এমন উঠে ফ্রেশ হয়ে, নিচে নামলো। সমুদ্রের ধারে গিয়ে দেখলো, পানিতে ভাটা উঠছে। সামনেই একটা লাল ফ্লাগ টানানো আছে।
সকাল সকাল প্রচন্ড রোদ। একেবারে খা খা রোদ যাকে বলে। আর বিচেও এখন প্রচন্ড ভিড়। ইমন কিছুক্ষণ ওখানে থেকে উপরে উঠলো। গিয়ে দেখলো, মায়া ঘরে নেই। সারা ঘর খুজলো, কিন্তু কোথাও পেলো না। আজব? এতোটুকু সময়ের মধ্যে মেয়েটা গেলো কই?
অগত্যা আবার নিচে নেমে এলো। এত বড় জায়গায় কোথায় খুঁজবে তাকে ইমন? ফোন করলো, ফোনটা পরপর কয়েকবার বেজে গেল কিন্তু কেউ রিসিভ করলো না।
ইমন ফোন রেখে আশেপাশে চোখ বুলালো। তাদের ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে কিছুটা দূরে সুগন্ধা বীচ, সেই বীচ পার হয়ে লাবনী বীচ। ইমন বহুদূর পর্যন্ত খুঁজলো মায়াকে। কিন্তু, পেলো না। এর মধ্যে আবারো কয়েকবার ফোন করলো। কিন্তু কোন হদিস পাওয়া গেলো না।
এইবার ইমনের ভয় হতে শুরু করলো। মায়া কোথায় গেলো? সম্পূর্ণ অচেনা অজানা একটা জায়গা? অজানা আশঙ্কায় তার বুকের মধ্যে দুরু দুরু শব্দ হতে লাগলো। কপালের দুই পাশের রগ গুলো ও কেমন টকবক করতে লাগলো।
খুঁজতে খুঁজতে ফিরে এলো। এসে দেখতে পেলো মায়াকে। একটা ছোট ১০-১১ বছরের বাচ্চার সাথে বালু নিয়ে খেলছে। শুকনো বালি পানি দিয়ে ভিজিয়ে ঘর বানাচ্ছে।
ইমন ফোস করে একটা নিশ্বাস নিয়ে হাঁটু গেড়ে বালির উপর বসে পড়লো। মনে হচ্ছে, ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়লো। মিনিট দুয়েক ওখানে বসে থেকে মায়ার সামনে গিয়ে কোমরে হাত দিয়ে রাগি চোখে তাকালো।
মায়া চোখ তুলে তাকিয়ে ইমনকে দেখলো।
দেখামাত্রই হেসে জিজ্ঞেস করলো, “ও তুমি? কতক্ষণ ধরে খুঁজছি তোমায়! কোথায় ছিলে?”
“কি করছিস তুই এখানে? আর তো ফোন সাথে রাখতে পারিস না?”
“ফোন তো ঘরে রেখে এসেছি। এই দেখোনা, এই পিচ্চিটার সাথে আলাপ হলো। কত কিউট, তাইনা? ওর নাম অঞ্জু, এখানে শামুক কুড়াচ্ছিলো। ওকে দেখতে পেয়ে, ওর সাথে গল্প করতে আসলাম।”
ইমন মনে মনে বললো, “দুনিয়ার সব মানুষের সাথে ভাব না জমালে তার আবার শান্তি হয় না!”
কিন্তু মুখে বললো, “এখানেই থাকবি। দূরে যাবি না, খবরদার! আমি সামনেই আছি।”
মায়া হেসে উত্তর দিলো, “আচ্ছা, ঠিক আছে।”
বেলা বারোটার পর যখন রোদটা একটু হালকা নেমে গেলো, তখন মায়া এলো ইমন এর কাছে। সে সমুদ্রের ধারেই বসে ছিলো। এইদিকে তাও বালুর উপর খালি পায়ে হাটা যায়। ঐ দিকটায় যথেষ্ট গরম বালু, পা দিলেই ছ্যানছ্যান করে ওঠে।
ইমন উঠে দাঁড়ালো। পকেটে হাত খুঁজে বললো, “পানিতে নামবি না?”
“কাল রাতেই তো পানির মধ্যে নাকানি চুবানি খাওয়াইছো, আজকে আবার?”
ইমন একটা হুংকার দিয়ে বললো, “পানিতে না নামলে সমুদ্রে এসেছিস কেন?”
তারপর নিজের শার্ট খুলে মায়ার হাতে দিয়ে বললো, “নে ধর। তুই গেলে চল, না গেলে থাক। আমি যাচ্ছি।”
ইমন গেলো, কিন্তু মায়া ওখানেই বসে পড়লো। সমুদ্র জিনিসটা তার ভয় লাগে। প্রথমত, সে ভালোমতো সাঁতার কাটতে পারে না। দ্বিতীয়ত, ইমনের সাথে পানিতে নামলেই সে কয়েকটা নাকানি-চুবানি খাওয়াই ছাড়বে।
কিছুক্ষণ বাদে ইমন নিজেই উঠে এলো। মায়াকে বললো, “একবার এসেই দেখ, পানির মধ্যে কত্ত মজা।”
“না তুমি যাও। এখন পানিতে জোয়ার উঠছে। কাল রাতে তোর স্বাভাবিক ছিলো, তাই নামছি। কিন্তু আজকে আর নামবো না।”
“আচ্ছা আমি আছি তো। আমি ধরে থাকবো তোকে, আয়।”
মায়া শত অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইমনের হাত ধরে ভয়ে ভয়ে পানির দিকে এগিয়ে গেলো। বড় বড় ঢেউ এসে তীরে আছড়ে পড়ছে। ঢেউ গুলো এসে তাদের ভিজিয়ে দিচ্ছিলো। সেই ঢেউ গুলো ফিরে যাওয়ার সময় পায়ের নিচ থেকে বালু সরিয়ে নিলে, তখন পায়ে কেমন সুরসুরি লাগতে থাকে! মায়া হি হি করে হাসতে লাগলো।
ইমন ওর হাত ধরে আরেকটু সামনের দিকে নিয়ে গেলো বললো, “আরো যাবি?”
মায়া রাজি হলো। ইমনের হাতে নিজের হাত রেখে খুব সাবধানে গোড়ালি পানি থেকে হাঁটু পানি পর্যন্ত, হাঁটু পানি থেকে কোমর পানি পর্যন্ত, কোমর পানি থেকে বুক অব্দি পানি পর্যন্ত নেমে এলো।
অনেকক্ষণ পর্যন্ত তারা পানিতে ভিজলো।
এমন সময় ইমনের পায়ের নিচে কি যেন একটা নড়ে উঠলো। সে দেখার জন্য নিচে নামলো অর্থাৎ উবু হলো।
মায়ার হাতটা ছেড়েই সেই নিচু হয়েছিলো। ওই সময় কোথা থেকে বিশাল একটা ঢেউ এসে মায়ার মাথার উপর দিয়ে তাকে, ভাসিয়ে নিয়ে সোজা তীরে নিয়ে ফেললো। ইমন সাথে সাথে দৌড়ে এলো। তার হাতে তারা মাছ।
মায়ার কাছে এসে বললো, “ঠিক আছিস?”
ততক্ষণে মায়ার নাকে মুখে পানি ঢুকে বেহাল অবস্থা। সে কাশতে কাশতে বললো, “হ্যাঁ ঠিক আছে।”
ইমন মায়ার পিঠে কয়েকটা চাপড় দিলো। তারপর ঠিক হলো। ইমন আবার পানিতে নামতে বললো, কিন্তু মায়া নাকচ করে দিলো, সে আর পানিতে নামার সাহস পেলো না।
.
.
বালুর মাঝে অনেকক্ষণ পর্যন্ত বসে রইলো। মায়া পানিতে নামলো না, তাই দেখে এমন ওর সাথে ওখানেই বসে পড়লো।
বালুর মাঝেও কত কি দেখার আছে! কত রকম ঝিনুক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তার মধ্যে একটা তারা মাছ তিরতির করে কাঁপছে। ছোট ছোট কয়েকটা লাল কাঁকড়া মাথা বের করে উঁকি দিচ্ছে। আবার নিজে থেকেই গর্তে ঢুকে যাচ্ছে।
এভাবে বেশ কয়েক ঘন্টা কেটে গেলো। ইমন আর মায়া ফিরে যাওয়ার আগে আরেকবার পানিতে নামলো। এবার মায়মায়জ থেকেই নেমেছে। সে এক সেকেন্ডের জন্যও ইমনের হাত ছাড়ে নাই।
বিকেল হয়ে আসছে, তাই একটু একটু ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। পানিতে ভিজে দুজনের চোখ লাল টুকটুকে বর্ণ ধারণ করেছে। আঙ্গুল শুকনো কিসমিসের মত হয়ে গেছে।
ইমন বললো, “চল ভেতরে চল কাপড় চোপড় পাল্টাতে হবে কিভাবে বেশিক্ষণ ভিজে বসে থাকলে জ্বর আসবে, ঘরে ফিরে রেস্ট নিয়ে তারপর সূর্যাস্ত দেখতে আবার আসবো।”
“আচ্ছা চলো।”
মায়া আর ইমন দুজনে ঘরে এলো। কাপড় পাল্টে দম নেওয়ার জন্য কিছুক্ষণ বসলো। সারাদিন কম তো আর দাপাদাপি হলো না।
মায়ের কাছে এগিয়ে এলো মায়াকে আরো কাছে এগিয়ে নিয়ে এসে, ঠোঁটে চুমু খেতে শুরু করলো।
মায়া উঠে সরে দাঁড়ালো। গিয়ে দরজা খুলে বাইরে বের হতে নিলেই, ইমন পেছন থেকে তাকে টেনে দরজায় ঠেকিয়ে আবার চুমু খেলো।
মায়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ” কি হচ্ছে কি এসব?”
“দেখতে পাচ্ছিস না, কি হচ্ছে!”
“উফ! সব সময় জালাও।”
“জ্বালানোর চ্যালেঞ্জ নিয়েছে যে।”
“তাই বলে সময় অসময়ের জ্ঞান থাকবে না? আজব? আচ্ছা চলো, এখন নিচে। ক্ষুধা লাগছে আমার। সব সময় তোমার মাথায় যে কি ভূত চাপে আল্লাহ ভালো জানে।”
ইমন মায়ার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললো, “আপনার ভূত!”
.
.
.
সন্ধ্যায় তারা হালকা নাস্তা করার পর, আবার সমুদ্র তীরে ফিরে এলো। সূর্য তখন ঢলে পড়েছে। দুপুরের তুলনায় এখন মানুষ অনেক বেশি। সবার মধ্যেই কেমন অন্যরকম উত্তেজনা! কয়েকজন আবার এই ভর সন্ধ্যায়ও পানিতে নেমেছে।
সূর্য আস্তে আস্তে আরো নিচে নামতে থাকে, সিদ্ধ ডিমের কুসুমের মতো দেখাচ্ছে। মায়া আর ইমন নিজেদের সহ সেই মুহূর্তটাকে ফোনের ক্যামেরায় বন্দী করলো!
তারপরও তারা আরও অনেকক্ষণ পর্যন্ত ওখানে ছিলো। রাতের বেলা একেবারে ডিনার শেষে রুমে ফিরে এলো।
রুমে ঢুকেই মায়া দরজা লাগাতে লাগাতে বললো, “তোমার সাথে থাকাটা ও রিস্ক! কখন যে কি করে বসো।”
ইমন এসেই শুয়ে পড়েছিলো। মায়ার কথা শুনে উঠে ওর দিকে এগিয়ে এলো।
মায়া বলে উঠলো, “খবরদার! কাছে আসবে না।”
ইমন এগিয়ে গিয়ে দু’হাত দিয়ে ওকে আঁকড়ে ধরলো। মায়ার আবারও অদ্ভুত লাগতে শুরু করলো। ইমন কাছে এলেই কেমন অদ্ভুত এক ধরনের অনুভূতি হয়।
ইমন মায়ার ঘাড়ের উপর থেকে চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দেয়। তারপর ঘাড়ে মুখ গুঁজে দেয়। মায়া আর কিছু বলার অবকাশ পে লোনা। শুধুমাত্র ইমন এর শার্ট খাঁমচে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো।
বেশ কিছুক্ষণ পর ইমন ওকে ছাড়লে মায়া নিজের কোমরে হাত দিয়ে বলে, “আমি কিন্তু খুব রেগে যাচ্ছি বলে দিলাম।”
ইমন হাসলো। মায়ার কানে কানে ফিসফিসিয়ে কিছু একটা বললো, যা শুনেই মায়ার মুখ লজ্জায় লাল রাঙা হয়ে গেলো। সে ইমনকে এক হাতে সরিয়ে দিয়ে বলে, “যাহ অসভ্য কোথাকার!”
মায়া লজ্জা পেয়ে সরে যাচ্ছিলো। ইমন তাকে যেতে দিল না, টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো। এই চার দেয়ালের সংসারে সমুদ্রের সাক্ষী রেখে অদ্ভুত প্রেমে বাঁধা পড়ে থাকা দুটি মানব মানবী মাতোয়ারা হয়ে উঠলো তাদের প্রেমের বাঁধ ভাঙ্গা বাঁধনে। হারিয়ে যেতে লাগলো দুজনের মধ্যে থাকা সব রাগ, অভিমান, দুঃখ। বহু প্রতীক্ষিত রহস্যময়ী একরাত্রি কেটে গেলো।
.
.
.
.
চলবে…..
[ কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ ]