মায়াবন_বিহারিনী #পর্ব_২১,২২

#মায়াবন_বিহারিনী
#পর্ব_২১,২২
#আফিয়া_আফরিন
২১

মায়া যখন বলেছিল ‘ওই বাড়িতে আমার ও একটা না হওয়া সংসার পড়ে আছে’ তখন নীলার বুকটা খানিকক্ষণের জন্য হলেও কেঁপে উঠেছিল তবে কি ওরা ভালো নেই? নাকি তার জন্য ইমন আর মায়ার মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি এখনো চলে? অনুতাপে পুড়ছে সে। ইমন ফিরে এলে সামনাসামনি কথা বলতে হবে। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে। কেন একটা নিঃস্বার্থ সম্পর্ককে নষ্ট করতে গেলো? নীলা তো আগে থেকেই জানতো সব। ইমন আর মায়া দুজন দুজনকে কতটা ভালোবাসে। তাহলে সে কেন তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে ঢুকলো ওদের মাঝে? যদি কোন কারণে নীলার জন্য তাদের সংসার টা ভেঙে যায়, নিজেকে ক্ষমা করবে কি করে?

নীলা কি মনে করে হঠাৎ ফোন করলো নিলয় কে। সেদিনের পর থেকে কেউ কাউকে ফোন করে নাই।

নীলার ফোন পাওয়ার সাথে সাথে রিসিভ করলো নিলয়। নিলা বলল, “খবর নাই যে তোর? কেমন আছিস?”

নিলয় শ্লেষের হাসি হেসে বললো, “যেমন থাকা যায়।”

“আচ্ছা। একটু দেখা করতে পারবি?”

“হ্যাঁ, না পারার কিছু নাই। বল কোথায়?”

“সেদিনের সেই জায়গাতেই।”

“আচ্ছা, কখন?”

“এখন বের হো। আমিও আসছি।”

“আচ্ছা আয়।”

নীলা ফোন রাখলো।
নিলয় একটু আগে আগেই পৌঁছালো। নীলা এখনো আসে নাই। কিছুক্ষণ বসে অপেক্ষা করতেই নিলা এলো। সাদা থ্রি-পিসে তার ভিতরে এক ধরনের শুভ্রতা এসে ভর করছে। নিলয় কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। এই মেয়েটাকে যদি সারা জীবনের জন্য পাওয়া যেত, তাহলে এই জীবনে কিছুই চাওয়ার থাকতো না। যেটুকু পেয়েছে প্রাপ্তি হিসেবে সেটুকু নিয়ে ভবিষ্যৎ সাজানোর চেষ্টা করতো। কিন্তু নিলয় এসব মেকি ভাবনা কেন ভাবছে? নীলাকে বোধ হয় তার পাওয়া সম্ভব হবে না।
নীলা নিলয় কে সাথে নিয়ে একটা বেঞ্চিতে বসলো। দুজনেই চুপচাপ। নীলা যে কথাটা নিলয় কে বলতে আসছিলো, সেটা কিভাবে শুরু করবে ভেবে পাচ্ছে না। নিলয় ও চুপচাপ রয়েছে। তার তো আর কিছু বলার নেই। যা বলার বলেই তো দিয়েছিল সেদিন। আর কিইবা বলার থাকতে পারে? সে নীলার কথা বলার অপেক্ষায় রইলো। বলুক, আজ নীলাই যা বলার বলুক।

অনেকক্ষণ অতিক্রম হওয়ার পর নীলা মুখ খুললো।
সে আধো স্বরে বললো, “কেমন আছিস?”

“যেমন থাকা যায় আর কি! তুই তো ভালোই আছিস তাই না?”

“কি সুন্দর করে বলে দিলি, আমি ভালো আছি। ভালো তো থাকতেই চেয়েছিলাম। তোরা আমায় ভালো থাকতে দিচ্ছিস কই? তুই তো এদিকে এসে আমার মনটাকে এলোমেলো করে দিলি, তারপর একটাবারও খোঁজ নিলি আমার? এদিকে আমার জন্য মনে হয় ইমন মায়ার সংসারে ঝামেলা হচ্ছে। অশান্তি লাগতেছে আমার। মনের মধ্যে শান্তি পাচ্ছিনা।”

“যা করেছিস তার জন্য ওদের থেকে ক্ষমা চেয়ে নে। তাহলেই তো ব্যাপারটা মিটে যায়। ক্ষমা চাইলে নিশ্চয়ই তোকে ফিরিয়ে দেবেনা!”

নীলা এই কথার উত্তর না দিয়ে সরাসরি নিলয়ের চোখে চোখ রেখে বললো, “ভালবাসিস কেন আমায়?”

এমন প্রশ্নে নিলয় একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। কাউকে ভালবাসলে কি তাকে দেওয়ার মতো কোন কারণ থাকতে পারে?

“স্পেসিফিক কোন কারণ নেই।”

“তবুও বল। মানুষ কাউকে কেন ভালোবাসে? চেহারা দেখে, চুল দেখে, হাসি দেখে, এর মধ্যে তুই কোনটা দেখে আমায় ভালবাসলি?”

“চেহারা, চুল, নাক, মুখ দেখে বড়জোর প্রেমে পড়া যায়। আমি তো ভালোবাসি তোকে! এরমধ্য কোনটা দেখেই তোকে ভালোবাসিনি। ইন্টারে পড়ার সময় থেকে তুই আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলি। আমার এখনো মনে পড়ে তোকে সাইকেলে করে বাড়ি পৌঁছে দিতাম আমি। তখন তোর প্রতি এক ধরনের ভালো লাগা কাজ করতো। তারপর তুই একদিন ইমনকে দেখিয়ে আমায় বলেছিলি, ‘আমি ওই ছেলেটাকে ভালোবাসি’। ততদিনে আমিও তোকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তোকে বলবো বলবো, সেই মুহূর্তেই মনটা ভেঙে গেলো। আমার আর তোকে ভালোবাসার কথা বলা হয়ে উঠলো কই? বুঝলাম, আমার জন্য বিন্দু পরিমান ফিলিংসও নেই। তারপর অনেকদিন পেরিয়ে গেলো। তবুও কিন্তু তোর প্রতি ভালোবাসা কমে নাই। আমাদের ভার্সিটি আলাদা হলো, যোগাযোগ কমলো, দেখা সাক্ষাতের পরিমাণও একদম কমে গেলো, কিন্তু তোর প্রতি আমার ভালোবাসা আজও অক্ষত রয়েছে। সেদিন ইমনের বিয়ের কথাটা শুনলাম তর মুখে, তাই ভাবলাম আমার মনের সুপ্ত কথাটা তোকে বলেই দেই। কোন আশা নিয়ে বলিনি। মনে হল তাই বলেছি।”

নিলয়ের কথা শুনে নীলা অনেকক্ষণ যাবত নিশ্চুপ হয়ে রইল। আসলে কিছু বলার মত ভাষা খুজে পাচ্ছে না। নিলয়ের বলা প্রতিটি কথা ভেতর থেকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করছে।

তারপর বলল, “আমি কতটা খারাপ তুই জানিস? আমি মায়ার ইমনকে কিভাবে আলাদা করতে চেয়েছিলাম? ঘৃণা হচ্ছে নিজের ওপর।”

“দেখ ভালো খারাপ মিলিয়েই মানুষ। আমি নিজে কি খুব ভালো ছিলাম? সব সময় খারাপটাকেই কেন টেনে আনতে হবে আমাদের? আমরা খুব সাধারন মানুষ, ভালোটাকে আঁকড়ে ধরেই তো সুখে থাকতে পারি তাইনা? তুই যেমনই হোস না কেন, আমি তোকে ভালোবাসি।”

“অন্ধভাবে ভালবাসিস?”

“না। ভালোবাসায় বিশ্বাস রাখি, সম্মান করি। আবার তেমন দেখা দিলে শাসনও করতে পারি।”

নীলা আনমনে কিছুক্ষণ হাসলো। তারপর নিজের এক হাত নিলয়ের হাতে রাখল।

ধরা গলায় বলল, “অনেকদিন থেকে অশান্তিতে ছিলাম। নিজের মধ্যে এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করছিল। একটু মানসিক শান্তির খোঁজেই তোর কাছে আসা। আর দেখ, আমি আমার কাঙ্খিত জিনিসটা তোর কাছেই পেলাম। বিশ্বাস কর, ইমন আর মায়া যদি আমায় ক্ষমা নাও করে তাহলেও আমার কোন আক্ষেপ থাকবে না।”

তারপর কিছুক্ষণ থেমে বলল, “আর একটা কথা, তোকে যে সারা জীবনের জন্য আমার পাশে লাগবে। থাকবি তো?”

নিলয় নিজের আরেকটা হাত নীলার হাতের উপর রাখল। তারপর খুব শক্ত করে চেপে ধরল। সে বুঝালো, ‘এই হাত কখনো ছাড়বে না। আজকের এই ধরাটাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ধরা থাকবে।’

তারপর নিলয় বলল, “আশা জিনিসটা অনেকদিন আগেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। তোকে যে ভালোবাসার কথাটা বলেছিলাম, সেটাও নির্জিব ভাবে। ভাবি নাই, এই দিনটা আসবে আমার জীবনে? পাওয়ার থেকেও বড় পাওয়া, বিশাল এক পূর্ণতা!”

নীলা দুচোখ বন্ধ করে তৃপ্তির হাসি হাসলো।
.
.
.
.
মায়ার দিনগুলো কাটছে ভীষণ এলোমেলো ভাবে, হেলাফেলায়। কখনো পড়াশোনা করছে, আবার কখনো টিভি দেখছে। ইমনের সাথে কথা হয়, কিন্তু খুব কম। ইমন ফোন দেয়, কিন্তু মায়া নিজেই ৫ মিনিটের বেশি সময় কথা বলে না। কি দরকার পড়াশোনার মধ্যে ডিস্টার্ব করার?
ইমনের পরীক্ষা শেষ হওয়ার অবশ্য আর বেশি দিন নাই। সেতু আসছে খুব শীঘ্রই। মনের কথাগুলো যান্ত্রিকতার মাধ্যমে প্রকাশ না করে, সে এলে তাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে আরাম করে বলা যাবে।

রাগ তখন দুইটা বেজে পেরিয়েছে। মায়া একটু আগেই ঘুমিয়েছে। এমন সময় তার ফোনটা বেজে উঠলো। ঘুম ঘুম চোখে বালিশের পাশ থেকে হাতড়ে হাতড়ে ফোনটা নিল। ইমন ফোন দিয়েছে? ধড়মড়িয়ে উঠে বসল সে। ইমন কেন এত রাতে ফোন দিল? কোন বিপদ আপদ হয়নি তো আবার? ভাবতে ভাবতেই প্রথমবারে ফোনটা কেটে গেল। এমন আবার ফোন করল।
মায়া ফোন রিসিভ করতেই ও পাশ থেকে ইমন বলল, “অবশেষে ম্যাডামকে পাওয়া গেল। আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম, তুই ঘুমিয়ে কাদা হয়ে আছিস। তবে একটা সিদ্ধান্তো ও নিয়েছিলাম, যতক্ষণ না ফোন ধরবি ফোন দিতেই থাকবো। দেখতাম, কতক্ষণে ফোন তুলিস তুই?”

“এত রাতে ফোন দিলে যে? কোন সমস্যা?”

“হ্যাঁ অনেক সমস্যা।”

“কি হইছে?”

“আই ফিল সো বোরিং! আমার এখন তোকে দরকার।”

“দরকারের সময় যেমন কোন জিনিস খুঁজে পাওয়া যায় না। তেমনি মানুষকেও খুঁজে পাওয়া যায় না।”

“হইছে। থামেন এইবার। ইমোশনাল হয়ে গেলেন কেন? মন খারাপ নাকি?”

“না।”

“কেন?”

“কেন মানে? তুমি কি চাও আমার মন খারাপ থাকুক?”

“হ্যাঁ চাই। আমি নাই, তুই মন ভালো করে বসে থাকিস কি জন্য? আমার অনুপস্থিতিতে তুই সারা বাড়ি কেঁদে কেঁদে মাথায় তুলবি। আমার শোকে পাথর হয়ে বসে থাকবি। তা তো করিস না। সব সময় খিল খিল করে হাসি আসে কোথা থেকে তোর? কাঁদতে পারিস না?”

“কি আজব ধরনের কথা বলছো? আমি কি দুই এক বছরের ছোট খুকি যে স্বামীর বিরহে কাঁদবো?”

“দুই এক বছরের বাচ্চারা কখনো স্বামীর বিরহে কাঁদে না। গাধা মেয়ে কোথাকার!”

“আমি যদি গাধা হই, তাহলে তুমি গাধী।”

“তুই। গাধা গাধি দুটোই। আচ্ছা বাদ দে, কি করছিলি?”

“কেউ যদি রাত দুইটার দিকে ফোন করে জানতে
চায় কি করছি? তাহলে কেমন লাগে? বলি যে, রাত দুটোর দিকে আমি না ঘুমিয়ে কি সারা বাড়িতে পেত্নীর মত ঘুরঘুর করবো?”

“করতেও পারিস। বলা তো যায় না।”

“কাল পরীক্ষা আছে না তোমার? এত রাত ধরে জেগে আছো কেনো? যাও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আর আমাকেও একটু ঘুমাতে দাও।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, যত পারিস ঘুমিয়ে নে। তোরই তো সময় এখন। তারপর আমি আসি, তোর সারারাতের ঘুম হারাম করে ছাড়বো। দেখি, কোন রাতে কেমনে ঘুমাস তুই?”

“হুহ। গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল!”
.
.
মায়া পরদিন সকালে ভার্সিটি থেকে সোজা তার খালামণির বাসায় চলে এলো। বিয়ের পর সে এখানেই ভর্তি হয়েছে। মা বাবার সাথে কয়েকদিন দেখা হয়নাই, তাই মায়া চলে গেল। সেদিন আর ফিরলো না বাসায়। খালামনির বাসায় দুইদিন থেকে তারপর বাড়ি ফিরলো। খালাতো ভাই-বোনদের সাথে অনেক দিন পর দেখা হলো, গল্প গুজব আড্ডা হলো। ইমনের না থাকায় মনটা বেশ খারাপ ছিলো। এখানে এসে সবার মধ্যে থেকে মনটা ভালো হয়ে গেলো।

সেদিন তার খালামনির বাসা থেকে ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত আটটা বেজে গেছিলো। আগের রাতে কাজিনরা সবাই মিলে আড্ডা দিয়েছিলো, বিধায় রাতে কেউ ঘুমাতে পারেনি। ইমনের ফিরে আসতে এখনো ৪-৫ দিন বাকি। তবুও সে একটু আগেই বাড়ি ফিরে এলো। বাড়ি এসেই ঘুম। এক ঘুমে রাত কাবার হবে, এমন অবস্থা।

ঘড়ির কাঁটায় তখন দেড়টা বেজে একটু পার হয়েছে। মায়া ঘুমের মধ্যে গোলাপের কড়া গন্ধ অনুভব করতে পারছে। কিন্তু ঘুম পরী তাকে জাগতে দিচ্ছে না আজ। আবার গোলাপের ঘ্রাণটাও বেশ অস্থির করে তুলছে। সে ঘুমের মধ্যে এপাশ-ওপাশ করছে। বারবার মনে হচ্ছে ঘরের অন্ধকারটাও খুব তীব্র হয়েছে। কিন্তু এটা স্বপ্ন নাকি সত্যি সে ঘুমের ঘোরে ঠাওর করতে পারলো না।

হঠাৎ কপালে কারো ঠোঁটে উষ্ণ স্পর্শে ঘুমটা পুরোপুরি ভাবে ভেঙে গেলো। মায়া উঠে বসে আশেপাশে চোখ বুলালো। সে তো ঘুমের আগে ড্রিম লাইট জালিয়ে দিয়েছিলো, অফ করলো কে? ভূত নাকি? গোলাপের গন্ধটাও থেকে থেকে আরোও তীব্র হচ্ছে!

এমন সময় সামনে আগত মানুষটি বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করলো মায়াকে। মায়া থতমত খেয়ে গেলো। হাতের স্পর্শ, গায়ের গন্ধ স্পষ্ট জানান দিচ্ছে এটা ইমন! কিন্তু সে আসলো কোথা থেকে? জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে?

অবাক বিস্ময় নিয়ে মায়া জিজ্ঞেস করলো, “তুমি?”

“হু।”
ছোট্ট করে জবাব দিল ইমন। তারপর হাতে থাকা দুইটা লাল টুকটুকে গোলাপ মায়ার কানের পিছনে গুঁজে দিলো।

“তোমার তো এখন আসার কথা ছিল না? তুমি তো বলেছিলে আরো কয়েকদিন পর আসবে।”

ইমন মায়ার মুখটা দুহাতের আজলায় এনে কপালে গভীর চুম্বন এঁকে দিলো।

বললো, “এভাবে না এলে তোর অবাক করা মুখখানি দেখতে পেতাম?”

মায়া হাসলো। ইমনের দুহাত ধরে বললো, “আসলেই অনেক বড় সারপ্রাইজ ছিল। আশাই ছিল না। এভাবে হঠাৎ করে আসছো এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া গুলোর মধ্যে একটা। এমনই থেকো তুমি। বিশ্বাস করো, জীবনে আর কিছু চাইনা আমি আমার ইমনকে তো আমি পেয়ে গেছি!”
.
.
.
চলবে…..

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ]

#মায়াবন_বিহারিনী🖤
#পর্ব_২২
#আফিয়া_আফরিন

ইমন ফিরে আসার কথা শুনে নীলা সিদ্ধান্ত নিলো, একবার ও বাড়িতে যাবে। সামনাসামনি বসে দুজনের সাথে কথা বলতে হবে। নীলা ইমন দের বাড়ি যাওয়ার আগে একবার নিলয়ের সাথে দেখা করে এলো। মাঝখানে গত দুইদিন আর তার সাথে দেখা করার সুযোগ হয়ে ওঠে নাই। নিলয়ের সাথে দেখা করে ফিরে যেতে যেতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেলো।
.
.
ইমন আর মায়া ড্রয়িং রুমে বসে গল্প করছিলো। সুহাদা জামান আর মিমো কেউ বাসায় নেই। বাহিরে গেছে, আগামীকাল বিকালের সম্ভবত ফিরবে। ইমন মায়াকে নিজের কোলে বসিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছিলো। মায়ার একটু অস্থির লাগছিলো, সাথে সাথে প্রচন্ড রকম ভালোলাগা ও কাজ করছিলো। সে চুপচাপ বসে ছিলো। ইমন কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিসিয়ে বললো, “আমি ফিরে আসার পর কি জানি কথা ছিলো?”

মায়ার মনে পড়ে গেল, সেই দিনের কথা। ইমন তাকে চুমু খেতে গেলে সে বলে, ‘ফিরে এসো তারপর।’
লজ্জায় গাট হয়ে গেল মায়া। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললো, “কই কোনো কথা ছিল না তো!”

ইমন হেসে ফেললো। তারপর ওর এক হাত ধরে টেনে পাশে বসালো। মায়া একজোড়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ইমন এর দিকে। ইমন সে চাহনিকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে এলো মায়ার কাছে। মায়া স্থির দৃষ্টিতে তাকালো ইমনের দিকে। দুজন দুজনার চোখে চোখ রাখলো। হারিয়ে গেলো এক অজানা অনুভূতিতে। দুজনের চোখের মনির আয়নায় স্পষ্ট লজ্জা দায়ক মুখচ্ছবি ভেসে উঠেছে।
ইমন এই মুহূর্তে আর কিছু ভাবতে পারল না। এক হাতে মায়ার কোমর ধরে আরো কাছে টেনে নিয়ে এলো। দূরত্ব রইলো না আর একটুখানিও। খুব আলতোভাবে সে তার ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো।

ঠিক এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো। মায়া চমকে উঠে দূরে সরে গেলো। ইমন ও থতমত খেয়ে গেছে। সে অসহায় চোখে একবার মায়ার দিকে তাকালো, আরেকবার দরজার দিকে।

মায়া বললো, “এই সময় আবার কে এলো?”

“যা গিয়ে দেখ কে এলো? কোন শত্রু এলো বাঁড়া ভাতে ছাই ফেলতে।”

মায়া উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। নীলা দাড়িয়ে আছে।মায়াকে দেখে একটা চওড়া হাসি দিলো। মায়া এই সময় নিলাকে দেখে বেশ অবাক হল বটে।

ইমন ও নিলাকে দেখলো। বিরক্তি নিয়ে মনে মনে বললো, “কাবাব এর মধ্যে হাড্ডি হওয়ার আর সময় পেল না। কথা নাই বার্তা নাই সময় অসময়ে এসে হাজির। আসলেই ও একটা শনি! নয়তো যখন কিছু ভালো মুহূর্ত শুরু হচ্ছিলো, তখনই এসে হাজির হতে হবে? দুর্ভাগা কপাল আমার।”

নিলা ভিতরে ঢুকে ওদের দিকে তাকিয়ে বললো, “যাক তোমাদের দুজনকে একসাথে পাওয়া গেলো। কথা আছে তোমাদের সাথে।”

মায়া বা ইমন কেউ উত্তর দিলো না। নিলা আশেপাশে তাকিয়ে বললো, “কাকি কই? আর মিমো? কাউকে যে দেখতে পাচ্ছি না?”

মায়া বললো, “আপাতত তারা কেউ বাসায় নেই। ছোট কাকির বাসায় গেছে, আমি আর ইমন আছি।”

“ও আচ্ছা। তাহলে তোমাদের সাথে কিছু কথা বলতাম। আসলে কথাগুলো বলা খুব জরুরী।”

ইমন গম্ভীর গলায় বললো, ” মতোরা যা বলার বল। আমি আসছি।” বলেই ইমন উঠে দাঁড়ালো।

নীলা বললো, “না না। তুমি গেলে তো হবে না। আমি যা বলবো সবই তো তোমাদের দুজনকে নিয়ে। তোমাদের ব্যাপারে। তাই তোমাকেও থাকতে হবে।”

ইমন আর কিছু না বলে, বিরস মুখে ফের বসে পড়লো।

মায়া ভুরু কুঁচকে বললো, “কি বলবে বলো?”

নীলা একটু ইতস্তত করতে লাগলো। কিভাবে কথাগুলো শুরু করবে বুঝতে পারছিল না। মিনিট দুয়েক ভেবে বললো, “তোমরা আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ!”

“হঠাৎ মাফ চাওয়ার কথা কি জন্য বলছো?”

“আগের কথাগুলো আমায় মনে করিয়ে আর লজ্জা দিওনা। বিশ্বাস করো, তোমাদের মধ্যে যা কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে সব আমার জন্য। আমি করেছি সব। আমি মুখে কিছু বলতে পারছি না। কিন্তু সবকিছু আমি করছি আমি। এর জন্য অনুতপ্ত তাই, ক্ষমা চাইতে এসেছি, তোমাদের কাছে। তোমাদের বিয়েটা হয়ে একদিক দিয়ে আমার জন্য ভালই হয়েছে, নিজের ভুলটা বোঝার একটা সুযোগ পেলাম। এখন বলো, ক্ষমা করবে না তোমরা আমায়?”

মায়া হেসে বললো, “ওসব কথা মনে রেখে কি লাভ? তুমিও ভুলে যাও, আমরাও ভুলে যাই। আর ক্ষমা করার কথা উঠছে কেন? তুমি যেটা করেছে সেটা হয়তো তোমার নিজের দিক থেকে ঠিক ছিলো। তাই বলি, মনের মধ্যে এসব আর পুষে রেখো না। ওসব পুরনো দিনে কি হয়েছে না হয়েছে আমরা ভুলে গেছি, তুমিও ভুলে যাও।”

নীলা হাসলো।
ইমন বললো, “কথা শেষ তো? আর কিছু বলার আছে?”

“নাহ।”

“বেশ। তাহলে আমি উঠি।”

“হ্যাঁ। আমিও চলে যাবো এখন।” নীলা বললো।

নীলার কথা শুনে মায়া অবাক হয়ে বললো, “ও মা! চলে যাবে কি? রাত হয়ে গেছে। তোমাকে এত রাতে ছাড়লে তো যাবে?”

“নাহ গো। যেতেই হবে।”

“আজকে রাত টা থেকে যাও।”

মায়া ইমনকে চোখের ইশারায় কিছু বলার ইঙ্গিত দিলো।
ইমন নীলার দিকে তাকিয়ে বললো, “যেতে হবে না। থেকে যা আজকে। এত রাতে একা যাওয়ার কি দরকার?”
তারপর সে নিজের রুমে চলে গেলো।

মায়া এসে নীলার পাশে বসলো। নীলা জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা সেদিন যখন তোমার সাথে দেখা হলো, তুমি ওই কথা কেন বললে যে, ওই বাড়িতে আমার একটা না হওয়ার সংসার আছে?”

“ইমন ছিল না তো এইজন্য বলেছি। কিন্তু হঠাৎ এ কথা কেন?”

“ও আচ্ছা? আর আমি কি নাকি ভাবলাম? ভাবলাম যে আমার জন্য তোমাদের মধ্যে আবার কোনো অশান্তির সৃষ্টি হচ্ছে কিনা?”

“না, এমন কোন ব্যাপার না। সবকিছু ঠিকঠাকই আছে। আচ্ছা ইমনকে যে তুমি ভালোবাসো, ওকে না পাওয়ার জন্য কি তোমার কষ্ট হচ্ছে?”

“এসব কথা আর মুখেও এনো না। তোমার ইমন তোমারি থাক! আমি তাকে ভালবাসতাম না। আসলে মানুষের বয়সের দোষ বলে একটা কথা থাকে না? হুটহাট কাউকে ভালোলাগা। সেই রকম ছিল আমার পরিস্থিতিটা! তারপর যখন জানতে পারলাম, ওর সাথে তোমার সম্পর্কের কথা। তখন তোমার উপর রাগ থেকে আমি এসব করেছি। কিন্তু পরে সব ভুল বুঝতে পেরেছি।”

“কীভাবে বুঝলে?”

“একজন মানুষ এসেছে জীবনে।সে খুব যত্ন করে ভুলগুলো শুধরে দিয়ে, সঠিক গুলো কে স্পষ্টভাবে চোখের সামনে তুলে ধরেছে।”

“ওয়াও দ্যাট’স গ্রেট! তা কে শুনি?”

“নিলয়।”

মায়া অবাক হলো। পর মুহুর্তে সেও খুশি হলো। মায়ার হাসি দেখে নীলা ও হেসে উঠলো। দুজনের হাসির শব্দই ইমনের কান পর্যন্ত পৌঁছালো। সে বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলো, “এই দুই পেত্নী তো দেখি আম দুধের মত মিশে একাকার হয়ে গেলো!”
.
.
সেই রাতে মায়া নীলার সাথে শুয়ে পড়লো। ইমন ভেবেছিলো, মায়া হয়তো নীলার সাথে গল্প গুজব করে ঘরে ফিরে আসবে। কিন্তু ইমন অনেকক্ষণ ওয়েট করার পরও যখন দেখলো, মায়া ফিরছে না তখন সে মেসেজ দিলে ওর ফোনে।

“কি তুই?”

মিনিট পাঁচেক পর রিপ্লাই এলো, “নীলা আপুর সাথে।”

“ওর সাথে কি করিস?”

“গল্প করি।”

“কেন? গল্প করার জন্য আমি নেই? আমার সাথে তো কথা বলিস মেপে মেপে। আর নীলাকে পেয়ে একদম পেটের সব কথা উগলায়া উঠছে, তাইনা?”

“হ্যাঁ। কেন তোমার হিংসে হচ্ছে বুঝি?”

“ফালতু কথা বলবিনা। হিংসে হবে কেনো? তুই তাড়াতাড়ি ঘরে আয়।”

“আমি ঘরেই আছি।”

“তুই আমার কাছে আয়। তোর সাথে দরকার আছে। অনেক বোঝাপড়া আছে।”

“আমি তো তোমাকে চিনি না। তোমার কাছে যাবো কোন দুঃখে?”

“চিনিস না তাই না, দাঁড়া তোকে আমি আজকে চেনাচ্ছি।”

“ছাই!”

“ঘুমাস না? নীলা ঘুমালে তুই ছাদে আসিস। আমি ছাদে যাচ্ছি।”

“আচ্ছা। একটু পর আসছি।”

মেসেজ আদান-প্রদান শেষে মায়া ফোন রাখলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই নীলা ঘুমিয়ে গেলে, মায়া রুম থেকে বেরিয়ে চুপি চুপি ছাদে উঠলো ছাদে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মায়া আশেপাশে তাকালো। ইমনকে কোথাও দেখতে পেল না। তাহলে কি আসে নাই ইমন? সে নিচে চলে যাচ্ছিলো।
এমন সময় ওই কাছ থেকে ইমন তাকে টেনে এক সাইডে নিয়ে এলো। হঠাৎ এমন আক্রমণে হকচকিয়ে গেলো মায়া। ইমন ওকে দেওয়ালের সাথে ঠেসে দুহাতে বেড়ি দিয়ে বললো, “চিনিস না আমাকে?”

“চিনি না তো। কে আপনি?”

“চিনাবো কে আমি?”

“না। চেনাতে হবে না। আমি নিজেই চিনে নিতে পারবো।”

“তাহলে চিনে নে।”

“এখন না। আচ্ছা ডেকেছো কি জন্য?”

ইমন নিজের দুই হাত সরিয়ে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, “ধেই ধেই করে নিত্য করার জন্য ডেকেছি তোকে!”

“তাহলে তুমি নিত্য করো, আমি চেয়ে চেয়ে দেখি।”

ইমন কিছু বললো না।
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর মায়া বললো, “নীলা আপু যে এতগুলো কথা বললো, তুমি কিছু বললে না যে?”

“কি বলতাম? ইচ্ছে তো করছিল থাপড়ায় দাঁতগুলো ফালায় দিতে।”

“সবকিছু সমাধান থাপড়ায়া করা যায় না। ধৈর্য ধরতে হয়। দেখলে তো, নীলা আপু নিজেই নিজের ভুলটা কি রকম বুঝতে পারলো। নিজে এসেই ক্ষমা চেয়ে নিলো।”

“হ্যাঁ, এটা ঠিক বলেছিস।”

“আমি সবকিছু ঠিকঠাকই বলি। তোমরাই উল্টাপাল্টা বোঝো।”

” কিন্তু নীলা আজকে আবার একটা শত্রুতামি করলো আমার সাথে। অসময়ে চলে এলো। সবাই আমার শত্রু? সাথে তুইও!”

“আমি কি করলাম?”

“থাক, সব তো আর মুখে বলা যায় না।”

“আচ্ছা থাকো, আমি ঘুমাতে গেলাম।”

“এত ঘুম কোথা থেকে আসে রে তোর? সকালে ঘুম, দুপুরে ঘুম, বিকালে ঘুম, সন্ধ্যায় ঘুম। শুধু ঘুম আর ঘুম। পারিসও বটে!”

“তুমি দেখছো? আমি এত ঘুমাই।”

“না আমার তো চোখ নাই। যা ভাগ সামনে থেকে।”

“হ্যাঁ যাবোই তো।আমাকে তো আর দেখতে তোমার এখন ভালো লাগবে না।”

মায়া চলে গেলো। ইমন অবাক হয়ে তাকালো। পরক্ষণ এই মাথায় হাত দিয়ে বললো, “পাগল ছাগল নাকি? আজব তো? কোন কথার কোন মানে ধরে বসে থাকে, আল্লাহ ই ভালো জানে!”
.
.
সকালবেলা শোরগোলে ঘুমটা ভেঙে গেল মায়ার।
শুধু মায়ার না, নীলা মায়া ইমন তিনজনেরই। মায়া উঠে ফ্রেশ হয়ে দেখল সুহাদা ফিরে এসেছেন এবং তাদের গ্রামের বাড়ি থেকে অনেক মেহমান আসছে। ছোট্ট ছোট্ট পুচকি বাচ্চারা চিল্লাচিল্লি করছে। ইমন আর মায়ার বিয়েতে যেহেতু কেউ উপস্থিত থাকতে পারে নাই, তাই বিনা নোটিসে সকাল সকাল সবাই এসে হাজির।

সুহাদা নীলাকে দেখে অবাক হলেন। মায়াকে সাইডে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “নীলা কখন আসলো?”

“কাল রাতে আসছে।”

তিনি চোখ মুখ শক্ত করে বললেন, “ওর আসার আবার কি দরকার ছিল?”

“আহা ফুপি, ও আমাদের কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছিল। নিজের ভুলটা সে বুঝতে পেরেছে।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ গো, তুমি চিন্তা করো না।”

“যাক আলহামদুলিল্লাহ। মেয়েটার মাথায় সুবুদ্ধির উদয় হলো এতদিনে।”

মায়া হাসলো।

মায়া নিজের হাতে দুপুরে সবার জন্য রান্না-বান্না করলো। সবকিছু শেষে যখন ঘরে এলো, ইমনকে দেখতে পেল না। আশেপাশে খুজলো, কিন্তু কোথাও নেই। ধরে নিলো হয়তো বাইরে বেরিয়ে গেছে। সে আর কিছু না ভেবে গোসলে ঢুকলো। বের হতে ইমন কে দেখতে পেলো। মায়া ইমনকে দেখে কিছু বলল না। এমনও নিজে থেকে কিছু বলল না।
মায়া ঘর থেকে বের হতে নিলেই, ইমন দৌড়ে গিয়ে ওর হাত ধরলো।
তারপর আস্তে করে দরজাটা চাপিয়ে দিল।

মায়া বললো, “কি হচ্ছেটা কি?”

“এখনো কিছু হয়নি। তবে এখন হবে।”

“কিছু হবে না, ছাড়ো তো।”

“আমার বউ, আমি ধরবো নাকি ছাড়বো সেটা তুই বলে দেওয়ার কে?”

“আমিই তোমার বউ। তাই বলে দেওয়ার অধিকার আমার আছে।”

“হুহ। বউ না ছাই তুই।”
তারপর ইমন মায়ার হাতটা ধরে হাতে একটা চুমু খেলো।

মায়া বললো, “শোনো, ঘরে অনেক মানুষজন আছে। এখন ছাড়ো।”

“সুযোগই তো পাচ্ছি না।”

“সবুরে মেওয়া ফলে!” মায়া ইমনের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো।

“ওই মেওয়ার আমার কোন প্রয়োজন নাই। আমার এখনই চাই।”

“কি?”

“আদর!”

“যাও, অ’স’ভ্য কোথাকার!”

“বারে, বউয়ের সাথে অ’স’ভ্য’তা’মি করবো না তো, কি বাইরের মানুষের সাথে অ’স’ভ্য’তা’মি করবো?”

ইমন মায়ার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এলো। মায়ার চোখ মুখ নিমিষেই লাল বর্ণ ধারণ করলো। গোসল করে আসছে বিধায় ভেজা চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেও কেমন লাগছে। ইমন ওর ঘাড়ের ওপর থেকে চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিল। তারপর যেইনা আরেকটু কাছে এগিয়ে এলো, অমনি দরজাটা ঠাস করে খুলে গেলো। নীলা আর মিমো এসেছে। ওদের দুজনকে এভাবে দেখে সাথে সাথে উল্টো দিক ঘুরে গেল।
ইমন আর মায়া চমকে দুজন দুই দিকে সরে গেল।

মিমো উল্টো দিক ফিরে নীলাকে বলল, “নীলা আপু আমরা বোধহয় ভুল সময় এন্ট্রি নিয়ে ফেললাম। এখানে দুজন নিউলি ম্যারিড কাপল রোমান্স করছিল। বলি যে, দরজাটাও তো মানুষ লাগায় নাকি?”

মায়ার একেবারে লজ্জায় লাল হয়ে গেল। এমন কোনো কথা না বলে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো।

ইমনের চলে যাওয়ার আভাস পেয়ে নীলা মায়ার দিকে এগিয়ে এসে ওর দুহাত ধরে বললো, “সো সরি ভাবিজান! রোমান্সের সময় একদম ডিস্টার্ব করতে চাইনি। কি করব বলো, কাকি ডাকছিল তো। আমরা কি আর জানি তোমরা এমন ভর দুপুরে!”

“উফ নীলা আপু। প্লিজ চুপ করো।”

নীলা আর মিমো দুজনেই মুখ টিপে হেসে ফেললো। মায়া অসহায় চোখ মুখে আশেপাশে তাকালো। ইমনটা তাকে একাই মাঝ সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে পালিয়ে গেছে।
এরা এই ব্যাপারটা নিয়ে এখনই যা শুরু করেছে, ভুলে না গেলে পরে তো আবার ক্ষেপাবে। বিশেষ করে মিমো।

মায়া বলল, “অত্যাচার কি জিনিস বোঝো তোমরা? আগে বিয়ে হোক, হারে হারে টের পাবা। আমায় নিয়ে এখন মজা করছ তো, করো করো? তোমরাও একদিন বুঝবা। স্বামী নামক প্রাণীর জন্মই হয় মাঝ সমুদ্রে এভাবে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য।”

তারপর একটু শব্দ করে ইমনকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, “কেউ একজন বলেছিল আমায়, বিপদে কখনোই নাকি একা ছাড়বে না। আর দেখো না কেন, জীবনের সবচেয়ে বড় বিপদে একা ছেড়ে চলে গেল। এরপর আরেকবার আইসো আমার কাছে, মজা কাকে বলে কত প্রকার ও কি কি বুঝায় দিবো!”

মায়া ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নীলা আর মিমো ওখানে দাঁড়িয়েই খিলখিল করে হাসতে লাগলো।

ইমন মনে মনে বিড়বিড় করে বলল, “সাধে কি আর এদের শত্রু বলি আমি? এতদিন নীলা ছিল, এখন দেখি নিজের বোন টাও শত্রু হয়ে গেল। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, নিজের বউটাও বোধহয় শত্রুর পথে। বউ মানুষ সে, তারে কিছু কইতেও পারি না। আমি পড়ছি, মাইনকার চিপায়!”

সেদিন বিকেল বেলায় নিলা বাড়ি ফিরে গেল। সে যেহেতু শুধরে নিয়েছে নিজেকে, তাই তার ঢাকায় কোন সমস্যা হচ্ছিল না কারো। সবাই অনেক বলাবলি করার পরও নীলা চলেই গেল। এমনকি ইমন পর্যন্ত বলেছিল থেকে যেতে, কিন্তু সে থাকবে না। যাওয়ার আগে সে আরেকবার করজোরে সবার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে।

রাতে ঘুমানোর সময় মায়া বলল, “আমি আজকে মিমোর সাথে থাকবো।”

মিমো অবাক হয়ে বলল, “ওমা! কেন?”

“তোর ভাই একটা বনমানুষ। ওর সাথে আমি থাকবো না।”

মিমো মায়ার কানে ফিসফিসিয়ে বলল, “দুপুরে তো আমাদের জন্য রোমান্স করতে পারো নাই। যাও, যাও এখন যাও। সুযোগ আছে। কেউ আর ডিস্টার্ব করতে যাবে না।”

“তুই চুপ থাক! ফাজিল কোথাকার!”

মায়া মিমোর সাথে থাকবে শুনে সুহাদা তাকে ধমক দিয়ে বললেন, “যা এখান থেকে। আলাদা থাকবি কি আবার? দুটোকে ঘরে তালা দিয়ে রেখে দিব।”

ঝারি খেয়ে মায়া সুড়সড় করে ঘরে চলে এলো। ইমন ওকে দেখে একটা ফিচলে হাসি দিল।

বলল, “শেষ পর্যন্ত ধরা দিতেই তো হলো আমার কাছে। এত কাহিনী করে কি লাভ হলো?”

“দেখো আমি তোমার সাথে একদম থাকবো না। আমি নিচে শুয়ে পড়বো।”

“আমি তোকে নিচে থাকতে দিলে তো?”

মায়া মুখ বাঁকিয়ে খাটের উপর থেকে বালিশ নিতে গেলে, ইমন ওকে দুহাতে কোলে তুলে খাটের উপরে শুয়ে দেয়। মায়া চোখ বড় বড় করে তাকায়।

ইমন বললো, “শুয়ে থাক। আসছি আমি।”

ইমন উঠে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়ে, বাতি নিভিয়ে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দেয়।

তারপর মায়ার পাশে এসে শুয়ে পড়ে। ওর দিকে ফিরে বলে, “এরপর? এরপর কি করবি? পালাবি কোথায়?”

“পালাতে চাচ্ছি না তো।”

ইমন সামান্য ঝুঁকে এলো তার দিকে। চোখে চোখ রেখে বলল, “বরকে বুঝি ভালবাসতে হবে না?”

মায়া চোখ নামিয়ে নেয়। ইমন ওর মুখটা দুহাতে উপরে তুলে কপালে একটা চুমু খায়।
তারপর তাকায় আকাশের দিকে। আজকে অমাবস্যা নাকি? এত অন্ধকার কেন চারিপাশ?

ইমন তাকালো মায়ার দিকে। আজকের এই রাতকে সাক্ষী রেখে, তাদের মধ্যে এক রহস্যময়ী রাত কাটলে সমস্যা কি? আজ হোক কিছু অন্যরকম! কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে চলে গেলে যা হয়। যেই না তাদের মধ্যে আবারো ভালো কিছু শুরু হচ্ছিল, ওমনি বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হলো।

ইমন ধাম করে পাশে শুয়ে পড়লো। মায়া উঠে বসতে চোখ পেট চেপে ধরে হাসতে লাগলো।

ইমন কপালে হাত দিয়ে বলল, “হুদাই কি বলি সবাই আমার শত্রু! প্রমাণ নিজের চোখেই দেখ। ধুর ভালো লাগেনা, জীবনটাই বেদনা। তুই আর আসিস ই না আমার সামনে।”
.
.
.
.

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here