মায়াবন_বিহারিনী🖤 #পর্ব_৩৫

#মায়াবন_বিহারিনী🖤
#পর্ব_৩৫
#আফিয়া_আফরিন

ইমন নির্বাক হয়ে মায়ার মুখ পানে চেয়ে রয়েছে। না ঠিক নির্বাক নয়, হতবাক। মায়ার কথাটা সে এখনো ক্যাচ করতে পারছে না। সে অবাক হবে, খুশি হবে? না কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। মায়ার বলা কথাটা ঠিক মাথার ১০ গজ উপর দিয়ে গেলো।

তাই আমতা আমতা করে মায়াকে জিজ্ঞেস করল, “কি বললি? আরেকবার বল।”

মায়া কিঞ্চিত লজ্জা পেয়ে বলল, “তুমি বাবা হতে চলেছো।”

“আরেকবার প্লিজ। আমি কি কিছু শুনতে ভুল করছি?” ইমনের কন্ঠে অনুনয়।

“একদম না। তুমি বাবা হতে যাচ্ছো, আর আমি মা। কোন ভুল শুনো নাই।”

ইমন আর নিজের এ’ক্সা’ই’ট’মে’ন্ট ধরে রাখতে পারল না। শরীরের যত শক্তি ছিল, তা দিয়েই মায়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। এই খুশির মুহূর্ত কিভাবে সেলিব্রেশন করা হয়, সে তা জানে না। তবে মায়া কে এরকম বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে নিজের ভেতরের বাঁধ ভা’ঙ্গা ঢেউ সে সামলাতে পারবে।
দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ পর্যন্ত ছিল। কেউ জানে না, কতক্ষণ কেটেছে এমনি করে?

ইমন মৌন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “কবে, কবে জানলি এই ঘটনা?”

“আজকেই। আমি ক্যাম্পাস থেকেই সোজা হাসপাতালে গিয়ে টেস্ট করি। কয়েকদিন ধরে কিছু সি’ম’ট’ম্স থাকায় আমার সন্দেহ হয়। তাই চেকআপ করাতে গেছিলাম। এবং রেজাল্ট পজিটিভ আসে।”

“এই জন্যই এমন ছটফট করছিলি? আগে জানাস নি কেন?”

“লজ্জা লাগছিল!”

ইমন মায়ার মুখটা দুহাতে তুলে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, সারা মুখে অজস্র চুমু এঁকে দিলো।
জিজ্ঞেস করল, “এই খবরটা আর কে কে জানে?”

মায়া ইমনের চোখে চোখ রেখে বলল, “যে নতুন অতিথি আসছে, তার বাবাকেই আগে কথাটা জানালাম।”

“জানিস, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জনটা আজ করে ফেললাম। কিরকম যে অনুভূতি হচ্ছে তা বলে বোঝাতে পারবো না?”

“কিন্তু আমার খুব না’র্ভা’স লাগছে!”

“ধুর পাগলী! না’র্ভা’স কিসের জন্য? আমি আছি তো!”
ইমন মায়ার হাতটা নিজের বুকে রাখলো। মায়া স্পষ্ট টের পেল, হৃদ কম্পন!

ইমন আরেকবার খুব শক্ত করে মায়াকে জড়িয়ে ধরল। উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে আহ্লাদী হয়ে বলল, “আজকে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সুখটা তুই আমার উপহার দিলি!”

ভাবতেই গায়ে অদ্ভুত শি’হ’র’ণ বয়ে গেল। তারাও মা বাবা হবে। মাতৃত্ব পিতৃত্বের অসীম সুখ গ্রহণ করবে।
ছোট ছোট হাত, পায়ের একটা গুলুমুলু বাবু তাদেরও হবে।
.
.
এই পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু সমস্যা হল, মায়া কথাটা কাউকে বলতে পারছে না। কিভাবে বলবে সেটা নিয়ে টেনশনে আছে। শেষে সিদ্ধান্ত নিল, আগে মিমোকে গিয়ে বলবে। মিমো হয়তো প্রথম একটু মজা নেবে, নেক। যা মন চায় করুক। কিন্তু মিমো কেই আগে জানাতে হবে।

মায়া মিমোর ঘরে গিয়ে দেখলো মিমো ঘুমিয়ে আছে‌। তাই আর ডাক দিল না। পরে আবার এল।
মায়াকে দেখে মিমো জিজ্ঞেস করল, “আরে আপুমনি যে?”

“হ্যাঁ, একটা কথা বলতে এলাম।”

“আসো বসো। তারপর এখন বলো।”

মায়া ই’ত’স্ত’ত করছিল। কিছু বলতে পারছিল না। তারপর বললো, “আচ্ছা আমি আসছি একটু। এসে বলছি।”

মিমো কে কিছু বলতে দেওয়ার আগেই মায়া বেরিয়ে গেল।

ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে ভাবলো, কথাটা সবাইকে সহজ ভাবে জানানো যায় কিভাবে? সিনেমাটিক স্টাইলে মায়া মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যায় নাই। যে সবাই তার জন্য ডাক্তার ডেকে আনবে।
এখন মনে হচ্ছে এরকম কিছু হলেই ভালো হতো। অন্তত নিজের মুখের শাশুড়িকে গিয়ে বলতে তো হতো না, “না আমি প্রে’গ’ন্যা’ন্ট!”
ধুর, যা হয় হোক। একবার বলে দিয়ে পালিয়ে গেলেই তো ঝামেলা চু’কে যায়। তারপর আগামী দুই দিন সে আর নিজের ঘর থেকে বের হবে না, এই সিদ্ধান্ত নিয়েই সুহাদার কাছে গেল। তিনি নামাজ পড়ে উঠলেন। মিমো ও ছিল ওখানে।

মায়াকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, “ভেতরে আয়। ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন এভাবে?”

মায়া কিছু বলল না। মিমো বলল, “আপু কি কিছু বলবা? তোমাকে দেখে কেমন মনে হচ্ছে খুব ডি’স্টা’র্ব আর না’র্ভা’স রয়েছো। ভাইয়া কি কিছু বলেছে তোমাকে?”

মা-মেয়ে দুজনের দৃষ্টি মায়ার দিকে।
মায়া শরীরের সবজোর এক জায়গায় এনে বলল, “না আমি কনসিভ করেছি!”
বলেই দৌড়।

সুহাদা আর মিমো দুজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই হেসে ফেললেন।
সুহাদা বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ!”

মিমো দৌড়ে গেল। গিয়ে দেখল মায়া এতক্ষণে ঘরের দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। বাইরে থেকে ধাক্কিয়ে বললো, “আপু দরজা খোলো।”

মায়া উঠে দরজা খুলে দিল। মিমো হেসে থাকে জড়িয়ে ধরলো।
লাফাতে লাফাতে বলল, “আমাদের ঘরে একটা ছোট্ট পুচকি আসছে। মাশাআল্লাহ! কবে যে তার মুখখানি দেখতে পাবো?”

মায়া একটু লজ্জা পেল কি না! চোখ নামিয়ে নীরবতায় ডুব দিল।

দুপুরের পরপর মহুয়া ফোন করলো। মায়া ফোন ধরতেই চেঁচিয়ে উঠে বলল, “কংগ্রাচুলেশন, মাই লিটল সিস্টার!”

মায়া বুঝল খবরটা তাদের কাছেও ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে। মায়া মুচকি হাসলো।

মহুয়া ফের বলল, “শোন, তোর কিন্তু অবশ্যই মেয়ে বাবু হতে হবে। আমার পুত্র জানের সাথে তোমার মেয়ের বিয়ে দেবো আমি।”

মায়া এইবার শব্দ করে হেসে ফেলল। মহুয়া বললো, “মার সাথে কথা বল।”

“ও তুমি আমাদের বাসায়?”

“হ্যাঁ আজকেই আসলাম।”

“আচ্ছা। মাহিদ কেমন আছে?”

“আলহামদুলিল্লাহ। ঠান্ডা লাগছিল বেশ কিছুদিন আগে, এখন সুস্থ আছে।”

তারপর মায়া অনেকক্ষণ যাবৎ মায়ের সাথে কথা বললো। জাহানারা বারবার যে কথাটা বললেন তা হল, “খুব সাবধানে থাকবি। তোকে কিছুদিন পর আমাদের এখানে নিয়ে আসব।”
.
.
কিছুক্ষণ পর ইমন এলো। মায়ার পাশে বসে সে বলল, “আমার বাবুটা কেমন আছে?”

মায়া হেসে বললো, “কিভাবে বলি? ও তো এখন অনেক ছোট। শরীরও তৈরি হয়নি বোধ হয় এখনো।”

“হু। আমার কলিজার টুকরো, দেখে রাখিস কিন্তু।”

তারপর মায়ার হাতে একটা চকলেট দিয়ে বললো, “এটা আমার বাবুর জন্য এনেছি।”

মায়া আহ্লাদী হাসি দিয়ে বলল, “ও এখনো খেতে পারে না।”

“তাহলে রেখে দে। নিজে যেন রাক্ষসের মত একা একা খেয়ে ফেলিস না। বাবু যখন আসবে, তখন তাকে দিয়ে বলবি এটা তার বাবা দিয়েছে।”

ইমনের পাগলামি মার্কা কথাবার্তা শুনে মায়া হাসলো। ইমন মায়ের কোলে আলতো ভাবে মাথা রাখলো। তারপর হাতে হাত রাখল। নিজের কাছেই কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। সবে তো প্রেগনেন্সির মাত্র তিন মাস চলছে।
তাদের অনাগত বাচ্চাটার শরীর ও এখনো পুরোপুরি গড়ে ওঠে নাই।
ইমন এখনই যেন তার নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছে। অদ্ভুত! বাবা হওয়ার অনুভূতিটা প্রকাশ করা যায় না কেন? আবার অপ্রকাশিত তো রাখা যায় না!
ইমন অনেকক্ষণ যাবৎ মায়ার কোলে মুখ গুঁজে মুখ পড়ে রইল। এইতো সে স্পষ্ট ‘বাবা’ ডাক শুনতে পাচ্ছে।
সর্বশেষে মায়া কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। এই দুটো মানুষকে সারা জীবন এভাবেই রাখতে হবে। হ্যাঁ, এই ভাবেই!
.
.
মায়ার যত্ন আত্তির কোন কমতি নাই। ঘরের কোন কাজে শাশুড়ি মা তাকে হাত লাগাতে দেয় না। এখনো তো তেমন কিছুই হয়নি, তাতে যে অবস্থা করছে সবাই। বাবু যখন আরেকটু বড় হতে থাকবে, এখন তো এরা পাগল করে ছাড়বে তাহলে।
মিমো সর্বক্ষণ মায়ার পাশাপাশি ঘুরঘুর করছে। ফুপি হওয়ার এক অদ্ভুত অনুভূতি তার মধ্যেও কাজ করছে।
ভাইয়ের সন্তান তো নিজের সন্তানের মতই।

ইমন যতক্ষণ বাসায় থাকে, মায়ার কাছ থেকে নড়ে না। এমনকি খাবারটা পর্যন্ত নিজ হাতে তুলে খাওয়ায়। এই একই কাজ ইমনের অবর্তমানে সুহাদাও করছেন।
.
.
.
বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে এমন হাতে করে তিনটা টুকটুকে লাল গোলাপ নিয়ে এলো। দুটো প্রস্ফুটিত গোলাপ, আর একটা সদ্য কুঁড়ি।

মায়াকে দেখিয়ে বলল, “এই বাচ্চা গোলাপটা আমাদের বাবু। আর এই দুইটা আমরা।”

মায়া হেসে বলল, “আচ্ছা যত্ন করে রেখে দাও। আর শোনো, সারাদিন যে এত বাবু বাবু করছো; বাবুর মাকে একেবারেই ভুলে গেলে?”

ইমন মায়ার কপালে ঠোঁটের মিষ্টি ছোঁয়া এঁকে দিয়ে বললো, “বাবুর মাকে ভুলে গেলে কি বাবুকে পাবো? বাবুর মাকে তো মনে রেখেছি, এরপর দরকার হলে মাথায় তুলে রাখবো।”

“আচ্ছা এখন বলোতো, তুমি কি হলে বেশি খুশি হবে? ছেলে না মেয়ে?”

“আল্লাহ যা দেয়, তাই নিয়ে সন্তুষ্ট। সেটা ছেলে হোক কিংবা মেয়ে।”

“তবুও মানুষের একটা এক্সপেক্টেশন তো থাকে। কি চাও বলো না!”

“প্রতিটা পুরুষ মানুষ কিন্তু প্রথম বাবা ডাকটা মেয়ের মুখেই শুনতে চায়। আমিও তার ব্যতিক্রম না। এখন বল তোর কি চাই?”

মায়া মিষ্টি করে হেসে বলল, “তোমার চাওয়ায় আমার চাওয়া। তুমি যেটাই খুশি থাকবে, আমিও তাতেই খুশি।”
.
.
রাতে মহুয়া ফোন করলো।
“কিরে কি খবর? ঠিক ঠাক আছিস তো?”

“হ্যাঁ আপু একদম। এইদিকে তো মা আর মিমো মিলে আমার যত্ন আত্তির কোন কমতি রাখছে না। সাথে ইমন নামক এক পাগল তো আছেই।”

মহুয়া হেসে বলল, “সবার ভালোবাসা একসাথে পাচ্ছিস, কি ভাগ্য দেখেছিস। আচ্ছা শোন না, মা বলছিল তোকে এখানে নিয়ে আসবে।”

“আমি যেতে চাচ্ছি না আপু। এখানে তো কোন সমস্যা হচ্ছে না আমার।”

“সমস্যা যে কোনদিন হবে ও না, এটাও আমি জানি। তবে প্রথম প্রেগনেন্সির সময় মেয়েরা কিন্তু বাপের বাড়ি থাকে। এখানে চলে আয়।”

“দেখি আপু। অনেক জার্নির পথ। এত জার্নি করার ইচ্ছা নাই।”

“আচ্ছা ভাবনা চিন্তা করে দেখ। আই শোন, আল্ট্রাসনোগ্রাফি করাইসিস? ছেলে হবে নাকি মেয়ে?”

“করাইনি আপু। ইমন করাতে দেয়নি। ও বলল একেবারে হলেই দেখা যাবে। এখন ছেলে না মেয়ে জানাজনির কোন দরকার নেই।”

“বাহ সারপ্রাইজ থাকলো! যাই হোক ছেলে বাবু চাস নাকি মেয়ে?”

“আল্লাহ খুশি হয়ে যা দেয়।”

মহুয়া হেসে বলল, “নামটা আগেভাগেই ঠিক করে রাখ। ছেলে মেয়ে দুজনের নাম ই ঠিক করে রাখ। আর তুই না আসলেও, বাবু হলে আমিই চলে যাব দেখতে।”

“আচ্ছা আসো। মাহিদ কি করছে?”

“আরাফাত মাত্রই ওকে বাইরে ঘুরতে নিয়ে গেল।”

“ও আচ্ছা। ঘোরাঘুরিও তাহলে হচ্ছে!”

মহুয়া হাসলো।
.
.
.
ইমন এখন আর বাড়ি ফিরতে দেরি করে না। রাত আটটার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসে। এই সময়টুকু মায়ার সাথে, নিজের পরিবারের সাথে কাটায়।

ইমনের হুটহাট এসে জড়িয়ে ধরা মুহূর্ত গুলো আগের তুলনায় আরো অনেক বেড়েছে। ঘরে আসলে মায়ের পেটের কাছে মুখ গুঁজে দুটিতে মিলে গল্প করবে। ইমন বাচ্চা মানুষের মতো এই সেই কত কিছু বলে।

মায়া জিজ্ঞেস করেই বলে, “এখানে আমাদের সিক্রেট কথা হচ্ছে। তোমার এন্ট্রি কোনোভাবেই চলবে না। আমরা একদম মানবো না।”

মায়া হাসে। মনে মনে হাসে, আবার প্রাণ খুলে সশব্দে হাসে।
ইমনের সাথে তাদের অনাগত সন্তানের কথাগুলো শুনলে দম খি’চ’ড়ে হাসি আসে।
বারবার মনে হয়, এই ফাজিলটা এত ভালো কেন, হুম? এত ভালো কেন?”
.
.
.
.

চলবে……

[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here