#ওগো_প্রণয়ের_নিমন্ত্রণ🌼
#লেখিকা:- Nowshin Nishi Chowdhury
#২য়_পর্ব
ফালাকের এমন কথায় মুহূর্তেই পুরো ড্রয়িং রুম নীরবতায় ছেয়ে গেল। সম্মান হারানোর ভয়ে ও আতঙ্কে খান বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্যের মুখে যেন রক্তশূন্য হয়ে গেল।আর সেখানে ফালাক ভাবলসহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
মিথিলার বাবা ও মা ফালাকের মা-বাবার দিকে তাকালেন, লজ্জায় তারা মাথা নিচু করে নিয়েছে। ছেলে যে এভাবে মিথিলার মা বাবার সামনে এমন আচরণ করে বসবে সেটা তারা কল্পনাও করতে পারেননি।
সকলের নীরবতাই যেন মিথিলার মা-বাবাকে তাদের মনের সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিল। তারপরেও কিছু উত্তর মুখ থেকে জেনে নেওয়া দরকার তাই
এই ভয়ংকর নিস্তব্ধতা পেরিয়ে মিথিলার আব্বু উঠে দাঁড়িয়ে ফালাকের সামনে এসে বলল,
— কি বলতে চাইছো তুমি? পরিষ্কার করে বল আমি জানি তুমি ঠাট্টা মশকরা করার মত ছেলে নও। তোমাকে আমি চিনি ফালাক। শুধু মেয়ের কথাতে আমি এখানে আসিনি।
বেশ কিছুদিন যাবৎ তোমার ব্যাপারে অনেক খোঁজ খবর নিয়েছি এবং ফলাফল সন্তোষজনক হওয়ায় আজ আমি এখানে এসেছি নিজের একমাত্র মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য।
কিন্তু কিছুক্ষণ আগে তুমি এটা কি বললে, তুমি বিবাহিত! যা বলছ ভেবে বলছো তো। আমার একমাত্র মেয়ে মিথিলা। তাকে কখনোই এমন অসুস্থ পরিবেশে আমি বিয়ে দেবো না।
ফালাকের ঠোঁটে এখনো স্মিত হাসি লেগে আছে। চশমা ভেদ করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে উত্তর দিল,
— জ্বী আঙ্কেল। আমি বিবাহিত। ছয় বছর আগে একটা অ্যাক্সিডেন্টাল বিয়ে হয়েছিল আমাদের। হঠাৎ বিয়ে যাকে বলে। প্রথমে বিয়েটা কে মেনে নিতে না পারলে বিগত পাঁচ বছর ১১ মাস ধরে এই বিয়েটাকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে চলছি।
মিথিলার বাবা একদৃষ্টিতে ফালাতে চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি বেশ বুঝতে পেরেছেন ফালাকের একটা কথাও মিথ্যে নয় কারণ মানুষের মুখ মিথ্যে বলতে পারলেও কিন্তু চোখের ভাষা মিথ্যা হতে পারে না।
এমন সময় পেছন থেকে খান বাড়ির সবচেয়ে বয়জ্যেষ্ঠ ব্যক্তি অর্থাৎ ফালাকের দাদি মিথিলার বাবার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
— কিছু মনে করো না বাবা। তোমার কাছে এই ব্যাপারটা আমরা লুকিয়েছি বলে। এই কারণে আমরা সবাই তোমার কাছে লজ্জিত।
আমি তো তোমার মায়ের মত তারপরও আমি হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছি তোমার কাছে। তোমাদের কাছ থেকে কথাটা লুকিয়ে গেলেও আমি কিন্তু তোমাকে মিথ্যে কথা বলিনি।
আর এর পরবর্তীতে তোমাকে যে কথাগুলো বলব তার এক বর্ণও মিথ্যে না। কিন্তু আমার একান্ত অনুরোধ এই কথাটা তুমি পুরোপুরি শোনো বাবা।
মিথিলার বাবা নিঃশব্দে ফালাকের দাদীর দিকে চেয়ে আছেন। তার চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই যে আদও কতটুকু বিশ্বাস করবে না কথাগুলো কিন্তু তার চেহারায় কৌতুহল স্পষ্ট।
ফালাকের দাদি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
— ফালাক যে বিয়ের কথা বলছে , সেটা আদৌ কোন বিয়ে ছিল না। সেই বিয়েতে পরিবারের কেউই উপস্থিত ছিল না। একটা ভুল বোঝাবুঝির কারণে ওই বিয়েটা হয়েছিল হঠাৎ করে। তারপর ফালাক যখন মেয়েটিকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসে তখন বাড়িতে ফারিহার বিয়ের আয়োজন চলছিল।
তাই তাদের ব্যাপারটা ফারিহার বিয়ের পরেই আলোচনা করতে চেয়েছিলাম ২ পরিবারের উপস্থিতিতে আলোচনা করে পরবর্তীতে তাদের দুজনের ভালোভাবে বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু ফারিহার বিয়ের দিন সেই মেয়েটা চলে যায় এই বাড়ি ছেড়ে ।
না তারা সংসার করেছিল, না তারা এক রুমে থেকেছে আর না তাদের মধ্যে কোন সম্পর্ক ছিল তুমি বলো বাবা এটাকে কি আদৌ কোন বিয়ে বলে?
কথা শেষ করে ফালাকের দাদি লাঠি ভর দিয়ে উঠে এসে মিথিলার বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,
— ওই মেয়েটা একটা ঝড়ের মতো এসেছিল এই বাড়িতে তারপর আমার পরিবারের সব সুখ শান্তি তছনছ করে দিয়ে ২০ দিনের মাথায় বাড়ি ছেড়ে চলে গেল।
মাঝখানে দিয়ে গেল কিছু বিষাক্ত স্মৃতি। যা আমার নাতি বয়ে বেড়াচ্ছে এই বিগত ছয় বছর ধরে।
আর ও যে বারবার বলছে বিবাহিত। হ্যাঁ ঠিক আছে ও বিয়ে করেছে কিন্তু ওই বিয়েটা ছিল মৌখিকভাবে । মেয়েটা যাওয়ার সময় মৌখিকভাবে তালাক দেওয়া হয়ে গিয়েছিল।
ফালাক যেন নিজেকে ধরে রাখতে পারল না । কন্ঠে কাঠিন্য ভাব ফুটিয়ে তুলে বললো,
— তুমি ভুল বলছো দাদি। ওটাকে তালাক বলে না। এখানে আমাদের দুজনের কারোরই কোন মতামত ছিল না। এক প্রকার জোড় করে…
দাদি ফালাকের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে তাচ্ছিল্য কন্ঠে বললো,
— জোর করে হোক বা স্বইচ্ছায় তালাক তো হয়েছিল তাই না। এখন আর সেই মেয়ের সাথে তোর কোন সম্পর্ক নেই।
— আহারে না হইল ঠিকমতন বিয়ের অনুষ্ঠান আর না পাইলে বিবাহিত জীবনের স্বাদ। শুধু বিবাহিত তকমা গায়ে জরাইয়া ঘুরে বেড়াইতেছে আমার নাতি। তাছাড়া কি আছে আর এই সম্পর্কে,
কিছু নাই।
মিথিলার বাবার উদ্দেশ্যে দাদি আবার বলে উঠলেন,
— সবকিছু তোমারে বললাম বাবা। এর একটা বর্ণ মিথ্যা না। যা যা হইছে প্রথম থেকেই তোমারে বললাম সবকিছু। আমি তোমাকে কথা দিতে পারি তুমি আমার উপরে ভরসা করলে ঠকবা না।
তোমার মেয়েকে দেখার পরে বুঝতে পারছিলাম মিথিলা যদি আমার নাতির জীবনে আসে তাহলে আমার নাতিটা সুখী হবে। অতীত জীবনের সকল দুঃখ কষ্ট ভুলে আমার নাতিটা আবার সামনে জীবনে এগিয়ে যেতে পারবে।
মিথিলাকে হারানোর ভয়ে এই কথাগুলো আমি চেপে গেছি তোমার কাছে আর ওদেরকেও বলে দিয়েছি যাতে তোমাকে না জানায়। এতে এ বাড়ির কারোর দোষ নেই বাবা। আমি তাদেরকে নিষেধ করেছিলাম। এখন আমি তোমাকে সব কিছু খুলে বললাম।
এরপরে বাকিটা তোমার সিদ্ধান্ত তুমি কি করবে। কিন্তু এই বুড়িমা হিসাবে তোমার কাছে একটা অনুরোধ করবো আমার নাতিটার জীবনে তুমি একটা সুযোগ দাও। তারও ভালো থাকার অধিকার আছে।
আর আমার নাতিটা এখন এমন কথা বলছে ঠিকই কিন্তু একবার বিয়ে হয়ে গেলে আমার বিশ্বাস ধীরে ধীরে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। মিথিলায় আমার নাতির জীবনটাকে ঠিক আগের মত করে দেবে।
মিথিলার বাবা বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন মায়ের বয়সে একজন বয়জ্জ্যেষ্ঠ মহিলার এমন আকুল আবেদন কিভাবে অগ্রাহ্য করতে পারেন। তিনি অসহায় ভাবে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। মিথিলার মা ও দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেছেন।
স্ত্রীর দিক থেকে নজর সরিয়ে ফালাকের দাদিকে কিছু বলতে যাবে তৎক্ষণাৎ
মিথিলা বাবাকে থামিয়ে দিয়ে ফালাকের দিকে তাকিয়ে বললো,
— আব্বু ফালাকের অতীত নিয়ে আমার কোন সমস্যা নেই। আমি ফালাকের বর্তমান হতে চাই। যে গেছে সে তার ভাগ্য নিয়ে চলে গেছে। অতীত ঘাটতে গিয়ে আমি আমার বর্তমান নষ্ট করতে পারিনা। আমি বিয়ে করতে চাই ফালাককে।এই বিয়েতে আমার কোন আপত্তি নেই।
ফালাকের দাদি উচ্চস্বরে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলেন। মিথিলার কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর ঝলমল কন্ঠে বললেন,
— আলহামদুলিল্লাহ ।আল্লাহ এতদিন আমার মনের কথা শুনেছেন। এই খান বাড়ির উপযুক্ত বউ হবে তুমি। ইনশাল্লাহ ফালাকের মনেও তোমার জন্য ধীরে ধীরে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে।
মিথিলার মা-বাবা নিঃশব্দ সব কিছু মেনে নিলেন। তাদের আর কি করার আছে, যেখানে মেয়ে সবকিছু জানার পরেও বিয়ে করতে ইচ্ছুক। আর সংসার যেহেতু সে করবে সেহেতু সবকিছু তার মন মত হওয়ায় শ্রেয়।
খান বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিন্তু ফালাকের আম্মু স্বস্তি পেলেন না। তার মনের মধ্যে খচখচ রয়ে গেল। ছেলের চেহারার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তিনি। ছেলের চেহারা একেবারে নিস্তব্ধ নির্জীব । এ যেন ঝড় আসার পূর্বাভাস। ভয়ে ওনার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
মনে মনে বলছেন,
— ফালাক কথা বলছে না কেন? কথার প্রতিবাদ কেন করছেনা সে? মনে মনে কি পরিকল্পনা করছে ও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো? তখন আমি কি নিয়ে থাকবো?
স্বামীর হাত ধরে টেনে এক কোনায় নিয়ে গিয়ে বললেন,
— প্লিজ ফরহাদ মাকে বলো এসব আলোচনা বন্ধ করতে। এসব কিছুই আমার দরকার নেই। আমার ছেলেটা আমার কাছে থাকুক এটাই আমার একমাত্র চাওয়া। তুমি ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখো কিভাবে নির্জীব ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আমি জানিনা ও মনে মনে কি পরিকল্পনা করছে।
কিন্তু আমার ছেলে যদি আমাকে ছেড়ে চলে যায়। আমার ওই একটা মাত্র ছেলে । ফরহাদ। ওর কিছু হয়ে গেলে বা আমাকে ছেড়ে চলে গেলে আমি কিন্তু মরে যাব। আমার ছেলের কষ্ট আমার আর মোটেও সহ্য হয় না।
এর মধ্যে ফালাকের দাদি বেশ হাস্যজ্জল চেহারা ও ঝলমলে কন্ঠ নিয়ে বললেন,
— যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি আমার এই নাত বউকে এই খান বাড়িতে তুলতে চাই। আমি আর দেরি করতে চাই না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বিয়েটা হয়ে যাক আর এইখান বাড়িটা আগের মত ঝলমল করে উঠুক।
এতক্ষণ ফালাক নিরবতার ভূমিকা পালন করলেও এবার সে মুখ খুলল কিন্তু ভিন্নভাবে। হাসি হাসি মুখে বলল,
— তাহলে আর কি এই বিয়ের আয়োজন করে ফেলো তোমরা। আমারও এই বিয়েতে কোন আপত্তি নেই যদি আমার মাত্র দুটো শর্ত পূরণ করা হয়।
— আর এই শর্ত আমি আপনাকে দিতে চাই আঙ্কেল।
মিথিলার বাবার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো ফালাক সাথে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিকে
আরো একবার পুরো খান পরিবার উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে পড়লো ফালাকের দিকে।
— কি এমন শর্ত দিতে চায় ফালাক মিথিলার বাবাকে..!
চলবে…!
[ গল্পটা যারা যারা পড়বেন তারা সবাই রেসপন্স করবেন।সাথে সবাই গল্প সম্পর্কে তাদের মূল্যবান মন্তব্য জানিয়ে যাবেন অবশ্যই।]