একা_তারা_গুনতে_নেই — লামইয়া চৌধুরী। পর্ব: ৬৬

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্ব: ৬৬
হাওয়ায় হাওয়ায় চন্দ্রমল্লিকা দুলে ছাদ-বাগানে। গোলাপ হেসে উঠে হঠাৎ। নীলকণ্ঠ কাঁধ এলিয়ে দেয়। পাতাদের নাচন তালে লয়ে। সন্ধ্যার পর দীপার ছাদে বসে থাকতেই ভালো লাগে। এক কোণে একটা দোলনা আছে৷ সে দোলনায় পা তুলে বসল। পালা করে ফুল আর আকাশ দেখে উদাস হলো। তারপর উঠে এসে চন্দ্রমল্লিকার টবের কাছে দাঁড়াল। উবু হয়ে চন্দ্রমল্লিকাটা ধরে মুগ্ধ হয়ে দেখল। মুখটা আরো কাছে নিয়ে চন্দ্রমল্লিকায় নাক ঘঁষল। চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস ভরে ঘ্রাণ নিলো। চন্দ্রমল্লিকাও তাকে আদর করে দিলো। সোহাগ করল তার গালে, চোখে, ঠোঁটে। দীপা চোখ মেলে দেখল চন্দ্রমল্লিকা কাদিনের হাতের মুঠোয়। কাদিনই এতক্ষণ দীপার গালে চন্দ্রমল্লিকা বুলাচ্ছিল৷ দীপা ঝা করে কাদিনের হাতটা সরিয়ে দিলো। চন্দ্রমল্লিকা ছিটকে পড়ল আশেপাশেই। দীপা রুঢ়ভাবে বলল, “সরো। এইসব নাটক আমার ভালো লাগেনা।”
কাদিনের চেহারা রক্তবর্ণ ধারণ করল,”এত কঠিন ত তুমি নও দীপা।”
“তোমারো তো এত প্রেম নেই।”
কাদিন ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে, “ব্যাগ গুছাও তো দীপা। আমার আর এসব ভালো লাগছে না৷”
“কখনো শুনেছ যমের বাড়ি যেতে কেউ ব্যাগ গুছোয়!”
“এভাবে বললে!”
“যা সত্য তাই বললাম।”
“এখন তুমি আমায় মানসিকভাবে অত্যাচার করছো, দীপা।”
“বাহ্! কখনো বিরক্ত, কখনো মানসিকভাবে অত্যাচারিত। আমাকে নিয়ে এতই যখন অভিযোগ কি দরকার আমাকে? বাদ দিয়ে দাও।”
কাদিন আহত হলো, “আমি এভাবে বলিনি। আমি বলতে চেয়েছি তোমার জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে।”
“আমার জন্য কারো কখনো কষ্ট হয়না। আমার এই কপাল নেই।” আর দাঁড়াল না। নেমে গেল ছাদ থেকে। কাদিনও নামল পিছু পিছু। ড্রয়িংরুমে রাখা অফিসের ব্যাগটা নিয়ে নিঃশব্দে চলে গেল। দীপা অনেকক্ষণ পরে ছাদে গিয়ে ফুলটা তুলে এনে ধুলো ঝেড়ে যত্ন করে রেখে দিলো।
“থাকোগো ফুল, থাকো কাছে।
মোর সখা হৃদয়ে যেথায় আছে।
প্রিয়তমেষুর পুষ্প সোহাগে
ছুঁলো বলে কিযে দমবন্ধ লাগে!”
কাদিন দীপাদের বাসা থেকে বেরিয়ে রিকশায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল উদ্দেশ্যহীনভাবে। যেন তাড়া নেই বাড়ি ফেরার। যেন অসহ্য বাসা। যেন থাকা যায় না ও ঘরে৷ যেন অফিস ছুটিই মিছিমিছি। কতক্ষণ থম মেরে বসে থেকে এখানে ওখানে ঘুরে কাদিন রিকশাওয়ালাকে বলল, রিকশা ঘুরাতে। সে বাসায় যাবে। যে বাসায় তার বউ আছে। সে যেখান থেকে এসেছে সেখানেই ফিরে যাবে। দীপার কাছে।
“মন যে ভাঙতে জানে।
মানও তো সেই ভাঙাবে।
বিদায় দিলেও, ফিরে ফিরে যাবে।
ফুলের বেদনায়, ফের ভালোবাসা হবে।”
.
মুবিন একা একা বসে কেরাম খেলছিল। রানা হুড়োহুড়ি করে ঘরে ঢুকতে গিয়ে কেরাম এর সাথে সংঘর্ষে মুবিনের সব গুটি নাড়িয়ে ফেলল। মুবিন চটে গেল, “কি সমস্যা আপনার? চোখ পকেটে নিয়ে ঘুরেন?”
রানা বলল, “তুমি এখানে ঘরের মাঝখানে কেরাম নিয়ে বসলে কেন?”
“আমার ইচ্ছা।”
রানা মুবিনের দিকে চোখ গরম করে তাকাল। মুবিন রানার দিকে তাকাল চোখ বড় বড় করে। রানার এত রাগ হলো, তবু সে এই মুহূর্তে কোনো তর্কে না গিয়ে চট জলদি নিজের ব্যাগ গোছালো। তারপর মুখ কালো করে পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। প্রায় সাথেই সাথেই আবার চার্জার, চার্জার করতে করতে ফিরে এল। রানা যখন চার্জারটা খুঁজছিল মুবিন দেখল সেটা কোথায় আছে। চার্জার রানার টেবিলের পাশে এক কোণায় পড়েছিল। রানা যখন হন্য হয়ে চার্জারটা খুঁজছিল, মুবিন এক ফাঁকে পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে টেবিলের নীচে ঠেলে দিলো। রানা আর পায় না চার্জার। ওদিকে ওর দেরি হয়ে যাচ্ছে। মুবিন বসে বসে আরামসে কেরাম খেলছে। পাশের ঘরের অনেকেই এসে একটু পর জড়ো হয়ে গেল, “রানা ভাই, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
“আরে মিঞা চার্জার পাই না।”
একজন বলল, “লাগবে না। পাওয়ারব্যাঙ্ক আছে। চলেন, চলেন।”
রানা বলল, “দাঁড়াও আরেকটু খুঁজি।”
এইবার ইমাদ আর নিলয়ও এসে দাঁড়াল, “হলো?”
রানা বলল, “থাক পাই না। চলো।”
মুবিন জটলার দিকে তাকিয়ে দেখল, মেসের সবাই এখানে। সবার কাঁধে, পিঠে ব্যাগ। ওর ভ্রু কুঁচকে গেল, “আপনারা সবাই কোথায় যাচ্ছেন?”
ভিড়ের মাঝে কেউ একজন ব্যস্ত হয়ে উত্তর দিলো, “ট্যুরে যাচ্ছি।”
“কিসের ট্যুর?”
“এমনি ট্যুর।”
“কোথায় যাচ্ছেন?”
“সুন্দরবন।”
মুবিন উঠে দাঁড়াল, “আমিও যাব।”
“তুমি কীভাবে যাবে?”
মুবিন দৃঢ়তার সাথে বলল, “যেভাবে আপনারা যাচ্ছেন। আমিও তো এই মেসে থাকি। আমাকে ফেলে যাওয়া যাবে না।”
“তুমি ছোট মানুষ। তুমি যেতে পারবে না।”
যে কথাটা বলল তার নাম রওনক। মুবিন তার দিকে এগিয়ে গেল। হাত দিয়ে হাইট মেপে দেখাল, “আপনার চেয়ে বড়।”
আরেকজন বলল, “দেখো, বাবু তোমাকে নেয়া যাবে না।”
“কেন?”
“আমরা যে যার মত ঘুরব। তোমাকে দেখবে কে? তুমি হারিয়ে গেলে?”
মুবিনের মাথা গরম হয়ে গেল। তাকে আবার দেখবে কে? সে কেন হারাবে? মনে মনে বলল, “একবার ট্যুরে যেতে দে, তোকেই ফেলে আসব।” কিন্তু, রাগটা সে পরে উসুল করবে বলে রেখে দিলো। আঙুল তুলে ইমাদকে দেখিয়ে বলল, “ঐযে, ইমাদ স্যার আমার গার্জিয়ান। স্যার দেখবেন আমাকে।”
সবাই একসাথে ইমাদের দিকে তাকাল। ইমাদ ভাবলেশহীন। কোনোপ্রকার প্রতিক্রিয়া নেই। নিলয়ের চারিদিক অন্ধকার হয়ে এল, “এই মুসিবত সঙ্গে যাবে নাকি! তসর উপর আবার তার আর ইমাদের সাথে থাকবে! অসম্ভব।”
কেউ রাজি নয়। পাল্টাপাল্টি যুক্তিতর্ক। মুবিন একটা বললে, ওরা আরেকটা বলে। ওরা দুইটা বললে, মুবিন পাঁচটা বলে। জান দিয়ে মুবিনের যাওয়া ঠেকাতে চেষ্টা করল যে দুজন তারা হলো রানা, আর নিলয়। অন্যরাও চেষ্টা করল। তবে রানা, আর নিলয়ের যেন জীবন-মরণের এটা প্রশ্ন। তবে শেষ পর্যন্ত মুবিনকে না নিয়ে ওরা এক পাও নড়তে পারল না। মুখ কালো করে সবার মুবিনকে সঙ্গে নিয়েই বেরোতে হলো। বাসে উঠে মুবিন কার পাশে বসবে তা নিয়ে আরেক গ্যাঞ্জাম। রানার রুমমেট বলে রানার পাশে মুবিনের সিট বরাদ্দ করতেই রানা দু’হাত তুলে সাফ সাফ জানিয়ে দিলো, “না, না। রুমমেট টুমমেট বুঝিনা। যার খোকা তাকে সঙ্গে নিতে বলো। যাও যাও মুবিন, তুমি তোমার গার্জিয়ান ইমাদ স্যারের পাশে বসো।”
নিলয় প্রতিবাদ করল, “আরে আমি কেন উঠব? আমি আর ইমাদ একসাথে যাচ্ছি।”
রানা নিলয়কে সাইডে ডেকে এনে বুঝাল, “ঝামেলা করিস না। এই বাচ্চা খতরনাক। বেশি বাড়াবাড়ি করলে পরে বলবে তোর সাথে বসবে। তারপর হোটেলেও তোর তার সাথে রুম ভাগ করতে হবে। আমার রুমমেট। আমি জানি এই বেদনা।” রানা নিজের বুকে হাত দিয়ে বড় কাতর হয়ে আরো বলল, “আমার কলিজাটা প্রতিদিন নুনমরিচ লাগিয়ে খায়।”
নিলয় আর একটা কথাও বলল না। চুপচাপ অন্য সিটে গিয়ে বসল। পেছন থেকে কেউ একজন সান্ত্বনা দেয়ার ভঙ্গিতে টিটকারি দিয়ে বলল, “ধরে নিন আপনার বন্ধুর পাশে তার গার্লফ্রেন্ডকে বসতে দিচ্ছেন।”
বাসের সবাই হো হো করে বাস কাঁপিয়ে হেসে উঠল। সেই থেকে মুবিনের নাম পড়ল, “ইমাদের খোকা।”
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here