একা_তারা_গুনতে_নেই — লামইয়া চৌধুরী। পর্বঃ ৫৩

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫৩
শিল্পী মিলার সাথে দেখা করতে এসেছে। প্রায়দিনই আসে৷ আজ মিলার বিছানায় শুয়ে নেতিয়ে রইল। বলল, “আর কদিন একা থাকলে আমি মরে যাব৷ একা বাসায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।”
মিলা বলল, “তুমিও কোনো কর্মজীবী হোস্টেলে উঠে যাও।”
শিল্পী বালিশ থেকে মাথাটা তুলে মিলার দিকে তাকাল। মিলা পড়ার টেবিলে। কিছু একটা লিখছে। শিল্পী নরম গলায় বলল, “তবুও বললি না যে মা আমি তোমার সঙ্গে থাকব।”
মিলা লিখতে লিখতেই বলল, “আমার পরীক্ষা যে… বারবার এদিকওদিক হলে পড়ায় মন বসে না।”
“তাহলে এ কদিন নাহয় কষ্ট করি৷ এরপর তুই আমার কাছে চলে আসবি।”
“সম্ভব হবে না, মা। আমি ঢাকা গিয়ে হলিক্রসে ভর্তি হব। কুমিল্লা আর থাকব না।”
শিল্পী উঠে বসল, “আমি বদলি হয়ে তোর সাথে ঢাকা যাব।”
“মুবিনের কি হবে?”
“ওকেও ঢাকার কোনো কলেজে ভর্তি করাব।”
মিলা খাতা বন্ধ করে বলল, “ও রাজি হবে না।”
“নাহলে এখানেই থাকুক। ইমাদ যতদিন আছে সমস্যা হবে না।”
“তুমিও এখানে থাকো।”
শিল্পী বিছানা থেকে উঠে এসে মিলার পাশে দাঁড়াল। মিলার মুখটা দুহাতে তুলে ধরে বলল, “আমার উপর তোর অনেক রাগ, মিলা।”
মিলা মায়ের হাত ধরে হেসে বলল, “কই না তো!”
“তোকে জোর করব না। সবসময় তোকেই জোর করি। কাজটা ঠিক না। আজীবন তোর বাবা, আর মুবিনের কাছ থেকে কষ্ট পেয়ে পেয়ে সেই রাগ আমি তোর উপর ঝেরেছি। লক্ষী ছিলি যাই করতাম, বলতাম বিনা তর্কে মেনে নিতিস।” শিল্পীর গলা ধরে এল।
মিলা বলল, “শুয়ে থাকো, মা। তোমার শরীরটা ভালো না।”
শিল্পী গিয়ে শুয়ে রইল। মিলার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু বইয়ের পাতায় পড়ল। সে অযথাই বই খুলে রেখেছে।
জানালা দিয়ে দল বেঁধে বিকেলের মশাগুলো ঢুকছে। মিলা উঠে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করল। কয়েলের প্যাকেট থেকে কয়েল বের করে ধরিয়ে শিল্পীর পায়ের কাছে রাখল। শিল্পী হঠাৎ বলল, “মুবিন কিছু বলেছে তোকে?”
“কি বলবে?”
“ওর সাথে কথা হয়না?”
“ওকে তো চিনো, মা।”
শিল্পী দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে বলল, “মুবিন আমাকে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখেছে।”
মিলা দাঁড়িয়ে থেকেই জানতে চাইল, “পরে?”
শিল্পী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ও আমাকেও ওর বাবার মত ভেবেছে।”
“তুমি কখনোই বাবার মত না। তুমি একজন অনেক ভালো মা।” মিলার প্রতিক্রিয়া।
শিল্পী অন্যদিকে মুখ করেই ফুঁপিয়ে উঠল।
.
যে ছেলেটা সুহার চিঠি মুবিনকে দিয়ে ঘুষি খেয়েছিল সে ছেলেটিকে দিয়েই মুবিন মিলার ছেঁড়া প্র্যাক্টিকেল খাতাগুলো পাঠিয়েছে। সাথে খাতা থেকে হুট করে ছিঁড়ে নেয়া ছোট একটা এবড়োথেবড়ো সাদা কাগজে বাজে হাতের লেখায় লিখা, “স্টুপিড।”
খাতাগুলো উল্টেপাল্টে দেখে সুহার চোখে পানি চলে এল। এখন এই শেষ মুহূর্তে এসে সে পড়বে নাকি এসব করবে? আর সাইন! দোকান থেকে করিয়ে আনলেও স্যার, ম্যাডামরা কেউ সাইন করবেন না নতুন করে। হাতে পায়ে ধরে করালেও অনেক অনেক বকুনিঝকুনি। মিলা সুহার কাঁধে হাত রাখল। খুবই লজ্জিত হয়ে বলল, “স্যরি, সুহা। আমার খুবই খারাপ লাগছে। আমি তোকে সব লিখে দিব।”
সুহা ধরে আসা গলায় বলল, “আমি মুবিনকে মেরে ফেলব।”
মিলা একইসাথে বিস্মিত ও হতাশ হয়ে বলল, “ও কেন এমন করল?”
সুহা সে উত্তর দিলো না৷ ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল, “ও কোথায়?”
ছেলেটা বলল, “মুবিন খাতাগুলো আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেছে। স্কুল ড্রেস পরে আসেনি৷ বাইরের পোশাক ছিল। গেইট থেকেই চলে গেছে।”
স্কুলের অ্যাসেম্বলি এখনও শুরু হয়নি। সুহা চট করে সিঁড়ি বেয়ে ক্লাসে গেল। ডেস্ক থেকে স্কুল ব্যাগটা টেনে নিয়ে কাঁধে তুলে দৌড়ে নীচে নেমে স্কুল থেকে বেরিয়ে গেল। মিলা পেছন থেকে অনেক ডাকল। সে শুনলই না। বের হয়ে খানিক সামনে হেঁটে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করল। স্কুলে সে লুকিয়ে মোবাইল নিয়ে আসে। কেউ জামে না। মুবিনের নাম্বারে কল করল সে। মুবিন কল হতে না হতেই ধরে ফেলল। বিশ্রী আনন্দে বলল, “অপেক্ষা করছিলাম। এত দেরি কেন?”
সুহা সোজা তুইতোকারি শুরু করল, “তুই কোথায় গিয়ে লুকিয়ে আছিস? সাহস থাকলে আমার সামনে আয়।”
মুবিন মোবাইলটা কাঁধ দিয়ে কানে চেপে ধরে বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, “আমি তোর মত মেয়ের পিছনে ঘুর ঘুর করব কোন দুঃখে? তোর দরকার হলে তুই আমার পেছনে আয়।”
সুহা ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, “আমি তোর নামে মামলা করব।”
মুবিন কায়দা করে বাদাম শূণ্যে উড়িয়ে মুখে নিয়ে বলল, “প্র্যাক্টিকেল খাতা নষ্ট করবার মামলা? ভেরি গুড।”
“নাহ ইভিটিজিং এর মামলা।”
“তোর কোনো চেহারা আছে? তোকে কে করবে ইভটিজিং?”
সুহা হিসহিসিয়ে উঠল, “মোবাইলে বাহাদুরি করা বন্ধ করে সামনে আয়। তোকে আমি নিজ হাতে শায়েস্তা করব।”
মুবিন বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্টে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া বাদামের খোসাগুলো ঝেরে বলল, “মেসের ঠিকানা দিচ্ছি। মরতে মন চাইলে চলে আয়।”

সুহা ঠিক ঠিক মেসে গেল। মেসের সামনে দাঁড়িয়ে মুবিনকে আবার কল করে বলল, “আমি তোর মেসের সামনে। তুই আয়।”
মুবিন কল কেটে দিয়ে হেলেদুলে মেসের গেইট থেকে বেরুলো। মুবিনকে দেখার সাথে সাথে সুহা মুবিনকে মারতে গেল। মুবিন সুহার হাত ধরে মুচড়ে দিলো। ব্যথায় ককিয়ে উঠল সুহা। ইমাদ তখন মেসে ছিল না। সে গিয়েছিল পাউরুটি আর কলা কিনতে পাশের গলির দোকানে। সে পাউরুটি কলা নিয়ে হেঁটে এসে হতভম্ভ হয়ে গেল। হ্যাংলা পাতলা মেয়েটি মুবিনকে ধাক্কা দেয়ার চেষ্টা করতেই মুবিন মেয়েটিকে এক ধাক্কায় নীচে ফেলে দিলো। মেয়েটি রাস্তায় পড়ে কনুই ছিলে ফেলল। মানুষজন হেঁটে যেতে যেতে বারবার তাকাচ্ছে, হাসছে। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে মোবাইলে দৃশ্য ধারণ করছে কিন্তু কেউ এগিয়ে এসে দুজনকে ফেরানোর প্রয়োজন মনে করল না। ইমাদ হাতের পাউরুটি কলা ফেলে দ্রুত গিয়ে মুবিনকে সামনে থেকে জাপটে ধরল, “মুবিন শান্ত হও৷ ভেতরে চলো।”
মুবিন শরীর বাঁকিয়ে ইমাদের হাত থেকে বেরিয়ে যেতে চাইল। বলল, “আপনি সরুন। ছাড়ুন আমাকে।”
সুহা রক্তঝরা কনুই চেপে ধরে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে করতে দেখল তাকে খলনায়ক মুবিন থেকে উদ্ধার করতে স্বয়ং নায়ক ইমাদ স্যার চলে এসেছেন৷ ইমাদ মুবিনকে ঠেলে ভেতরে নিয়ে বাইরে থেকে গেইট আটকে দিলো। সুহার দিকে তাকিয়ে সুহার হাত ধরল। বলল, “রক্ত পড়ছে। চলো আমার সাথে।”
সুহার মনে হলো সে এখনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। হাত থেকে রক্ত ঝরছে এজন্য নয়, ইমাদ তার হাত ধরেছে তাই। মুবিন ভেতর থেকে ষাঁড়ের মতন গেইটে এলোপাথাড়ি লাথি বসাচ্ছে। সুহা সে শব্দে বিরক্ত হলেও মুবিনকে ইমাদের ওয়াস্তে মাফ করে দিলো। ইমাদ তার হাত ধরেছে! এর জন্য আরো হাজারটা প্র্যাক্টিকেল খাতা লিখা যায়, নষ্ট করা যায়, জলে ফেলা যায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here