একা_তারা_গুনতে_নেই — লামইয়া চৌধুরী। পর্বঃ ১৫

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ১৫
সাল ১৯৯৬। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিতীলতা হল। হলটি বিভিন্ন কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত হল। বছর তিনেক আগেই হলটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় অন্য হলের চাইতে সুযোগ সুবিধা বেশি। চারিদিকে প্রকৃতির সাজসজ্জারও শেষ নেই। শিল্পীর তখনও বিশ্বাস হয়নি সে এই হলে উঠতে পেরেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আর কোনো হলে বারান্দা নেই। কিন্তু এটায় আছে। তার রুম নাম্বার ৪০৩। চারতলার শেষদিকের একটি ঘর। ঘরে চারটে চৌকি। শিল্পীর চৌকিটা দরজা ঘেঁষে ডান পাশে। সাথে ছোট একটা টেবিল। টেবিলে পড়তে পড়তে চেয়ারে দুলছিল ও। হঠাৎ করেই চা খেতে মনটা আনচান করে উঠল। চেয়ার ছেড়ে উঠে চৌকির নীচ থেকে চায়ের ডেকচি বের করল। গুনগুন করতে করতে রান্নাঘরে গেল চা করতে। রান্নাঘরে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থেকে দশ মিনিট পরেই চুলা পেল। কাপে চা ঢেলে ঘরের পাশের ছাদে গিয়ে দাঁড়াল সে। অন্ধকারও বুঝি এত সুন্দর হয়? আকাশে তারা, আশেপাশে কোথাও ছেলেদের গানের আসর। কানে বাজছে,
“চলনা ঘুরে আসি অজানাতে
যেখানে নদী এসে থেমে গেছে…”
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হলের সামনের পাহাড়ে হারিয়ে গেল সে। হারিয়ে গিয়েছিল বলেই পাহাড়ের পাদদেশে রাস্তার উপরে থাকা ইটের তৈরী আসনে স্থির বসে থাকা মঈনকে সেদিন সে দেখতেই পায়নি। দেখতে পায়নি আরো কত কত দিন! এরপর যেদিন প্রথম দেখতে পেল, মঈনের দিকে তাকাল সে। ভয়ে মঈন একদম পাথর বনে গেল। উপর থেকে দেখেও সে ঠিক বুঝেছিল মঈন নিঃশ্বাসটুকুও ফেলছে না আর। শ্বাস রুদ্ধ করে জমে আছে ও। আজো কি নিঃশ্বাস বন্ধ করে জমে আছে মঈন? হাত- পা বরফ শীতল হয়ে যায়নি ত আবার? এসব ভাবতে ভাবতেই গতরাতে শিল্পী হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছুলো। মঈন ঠিক আছে। হাতে পায়ে প্রচুর জখম তবে মারাত্মক কিছু নয়। শিল্পী মঈনের বেডের পাশে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আঁচলে মুখ চেপে অনেক অনেকক্ষণ কাঁদল।

মিলা রান্না-বান্না খুব একটা পারে না, সুহা পারে। সুহার কাছে মোবাইলে শুনে শুনে মিলা যা পারল তাই রাঁধল। মা সব ছেড়ে ছুড়ে সেখানে পড়ে আছেন। দিন দুনিয়ার হুঁশ নেই। খাননি বোধহয়। দুপুরে মিলা খাবার নিয়ে হাসপাতালে ছুটে গেল। কিন্তু মুবিন গেল না। সে সোজা সাইকেল নিয়ে ঈদগাহ মাঠে চলে গেল। আজ একটা ক্রিকেট ম্যাচ আছে ওদের।
.
একটু আগে দীপা আর কাদিনের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। এখন তাদের দুজনকে একসাথে খেতে বসানো হয়েছে। কড়ি দূরে দূরে থাকছিল। রিমা আর অন্যরা কড়িকে ডেকে নিয়ে এল। বলল, “কিরে তুই বসিস না কেন? ওদের শুরু করতে হবে না? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।”
কড়ি মিথ্যে বলল, “আমি খেয়ে নিয়েছি।”
রিমা বলল, “খেলে খেয়েছিস। বসবি না একটু? দশটা না পাঁচটা একটা মাত্র ছোট বোন তুই। একটু বসবি না? কাদিনের ভালো লাগবে এতে। না খেলেও বস।”
কড়ি কাদিনের পাশের চেয়ারটায় বসল। কাদিন নিজের প্লেট থেকে আস্ত মুরগীর অর্ধেকটা অংশ ভেঙে কড়ির প্লেটে তুলে দিলো। থমথম গলায় বলল, “খেয়ে নে।”
রিমা, কায়েস, কাইয়ূম বাকিরাও এতক্ষণে খেতে বসল। অন্য আত্মীয়রা খেলেও বর আর কনের সবচেয়ে কাছের মানুষরা ওদের সাথেই খেতে বসল। নিলয় আর ইমাদও দীপার পাশের চেয়ারেই। দীপার কিছু কাজিনও আছে। দীপার ছোট ভাই মেহেদী শুধু খেতে বসল না। সে এই টেবিলে নজরদারি করছিল। সবাই ঠিকঠাক সব পাচ্ছে কিনা খেয়াল রাখছিল ও। ইমাদ প্লেট রেখে উঠে গেল। মেহেদীর কাছে গিয়ে বলল, “তুমি খেতে বসো আমি দেখছি।”
“ভাইয়া আপনি বসুন। সব ত আপনি আর নিলয় ভাইয়াই দেখছেন। ঝামেলাটা একেবারের জন্য বিদেয় হচ্ছে। ওর বিদায়ে আমার অবদান না থাকলে হবে নাকি!” বলতে বলতে তার চোখ টলমল করে উঠল। লজ্জা পেয়ে গেল সে। ইমাদ ওকে জোর করে খেতে বসাল। তারপর নিজে খাওয়া ছেড়ে দাঁড়িয়ে রইল। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বড় এই টেবিলটা পরখ করছিল। নিলয় মেহেদীকে কানে কানে বলল, “তুমি তোমার দুলাভাইকে হাত ধুয়াবে না? হাত ধুইয়ে টাকা নিতে বোকা ছেলে। তুমি না থাকলে ত আমিই এই কাজে লেগে পড়তাম। আমি ভেবেছিলাম তুমি হাত ধুয়াবে তাই আমি আর মাথা ঘামাইনি।”
মেহেদীর মন খারাপ থাকায় সে হাত ধুয়ানোর কথা ভুলেই গিয়েছিল। এখন আরো মন খারাপ হয়ে গেল তার। নিলয় ফিসফিস করে বলল, “সমস্যা নেই। খাওয়া শেষে ধুয়াবে।”
মেহেদী তড়িঘড়ি করে কাদিনের আগে খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল। তারপর কাদিনের খাওয়া শেষ হতেই হাত ধুয়ালো কাদিনকে। হাসি হাসি মুখ করে হাত পেতে দাঁড়াল সালামির জন্য। কাদিন শেরওয়ানির পকেট থেকে ওয়ালেট বের করছিল। ওর বন্ধু দূর থেকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে ওর হাতটা ধরে ফেলল। বলল, “তোর শালা ত খাওয়ার আগে হাত ধুয়াল না। কিসের টাকা দিস?”
বলেই ওয়ালেটটা খপ করে নিজের হাতে নিয়ে নিলো। ইমাদ, নিলয় আর মেহেদী এক সঙ্গে চমকে তাকাল তাহমিদের দিকে। শুধু দীপাই মন দিয়ে বসে জর্দা খাচ্ছে। সে তাহমিদের দিকে ফিরেও তাকালো না।
.
মিলাকে একা দেখেই শিল্পী প্রশ্ন করল, “মুবিন আসেনি?”
মিলা না – বোধক মাথা নাড়ল। শিল্পী অধীর হয়ে বলল, “মুবিন খেয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
“সকালে কি খেয়েছে?”
“জ্যালি পাউরুটি খেয়েছে।” মিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“আর দুপুরে?”
“এখানে যা আছে সেসবই।”
শিল্পী পার্স থেকে মোবাইল বের করে সাথে সাথে মুবিনকে কল করল। কিন্তু মুবিন কল ধরল না। বরং, মায়ের কল পেয়ে বিরক্ত হলো। মোবাইল বন্ধ করে পকেটে রেখে দিলো সে। রোদে পুড়ে পুড়ে সাইকেলে মস্ত বড় ঈদগাহ মাঠটায় চক্কর দিচ্ছে সে। ক্রিকেট ম্যাচটা আজ হয়নি। খেলতে গিয়ে মহাপ্রলয় ঘটিয়েছে সে। আউট হয়নি সে তবুও বলে কিনা আউট! নোউ- বলে মানুষ আউট হয় কি করে শয়তানগুলাকে আজ হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দিয়েছে।
.
মঈনের কাছে মিলাকে বসিয়ে রেখে শিল্পী হাসপাতালের বিল সেকশনে গেল বিল চেক করতে। মঈনকে এক মুহূর্তের জন্যও একা রাখতে চায় না সে। মিলা থাকতে থাকতে এই কাজগুলো শেষ করে ফেলবে। বিল সেকশনের কাজ মিটিয়ে
বেরুতেই মিসেস রহমানকে দেখল শিল্পী। সাথে তাঁর ছেলে রিফাত। রিফাতের মাথা চুইয়ে রক্ত পড়ছে। মিসেস রহমান দুহাতে ছেলের মাথা চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে ডাক্তার আর নার্সদের খুঁজছেন। রিফাত মুবিনের সাথেই পড়ে। এইটুকু একটা বাচ্চা ছেলে। এত কষ্ট হচ্ছিল শিল্পীর! রিফাতকে এই অবস্থায় দেখে শিল্পী ছুটে গেল ওদের কাছে। শিল্পীকে দেখে মিসেস রহমান তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। ক্ষোভে ফেটে পড়ে বললেন, “আপনি এখানে কি করছেন? বাসায় যান। নিজের ছেলেকে শিক্ষা দিন।”
“মানে? কি বলছেন এসব?” শিল্পী কিছুই বুঝল না।
রিফাত কাঁদতে কাঁদতে বলল, “মুবিন মেরেছে আমায়। ওর ব্যাট দিয়ে মেরেছে।”
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here