You are my property,Part_26,27
M Sonali
Part-26
আমি ধীরে ধীরে ফোন কানে ওর পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম,
— আমি তো অনেক আগেই চলে এসেছি রাই। শুধু তোমার অপেক্ষায় ছিলাম।
আমার কথা শুনে যেন ভয়ে কেঁপে উঠল রাই। আর এক ঝটকায় পেছনে ফিরে তাকিয়ে আমাকে দেখে দু পা পিছিয়ে গেলো। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো,
— ত তু তুমি,,, নাহ মানে আপনি এখানে?
ওকে এভাবে কথা বলতে দেখে এবার আমি উচ্চস্বরে হেসে উঠলাম। তারপর হাসি থামিয়ে বললাম,
— আজকেও কি সেদিনের মত আমাকে না চেনার ভান করবে রাই? তবে মনে রেখো আজ কিন্তু তুমি আমার কাছে ধরা খেয়ে গেছো। তাই আমার কাছ থেকে কোন মতেই আর কিছু লুকাতে পারবেনা। তাই বলছি সব সত্যি করে বলো আমায়। তোমরা সবাই কেন এমন আচরণ করছো আমার সাথে? কেন সবাই অপরিচিতোর মতো আচরণ করছো?
— দে দে দেখুন আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে আমি রাই নয় আমার নাম আখি। আর আপনি এসব কি বলছেন আমি তো আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।
রাই এর কথা শুনে এবার প্রচন্ড রাগ হল আমার। আমি ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলে উঠলাম,
— দেখো রাই আমি এখন তোমার সাথে বাজে আচরণ করতে চাচ্ছি না। তবে তুমি এমন কিছু করো না যার কারণে আমি তোমার সাথে রুড বিহেভ করে ফেলি। তাই প্লিজ আর অভিনয় না করে বল এসবের মানে কি? কেনো তোমরা আমার সাথে এমনটা করলে? আর এখনো করে চলেছো। এমনকি আমার নিজের ফ্যামিলির সবাইও আমার সাথে এমন করছে। এর কারণ কি আমি সবকিছু জানতে চাই! আমি জানি সবকিছু তুমি জানো তুমিই একমাত্র বলতে পারবে আমায় সব সত্যিটা।
আমার কথার উত্তর না দিয়ে রাই দ্রুত গাড়িতে ওঠার জন্য পা বাড়ালো। আমি তখনই আবারো ওর হাতটা ধরে নিজের কাছে নিয়ে এসে বেশ রাগী গলায় বলে উঠলাম,
— রাই তোমাকে আমার কসম রইল প্লিজ তুমি এভাবে চলে যেও না। তুমি জানো না আমি প্রতিটা মুহূর্তে এসব চিন্তা করতে করতে ধুকে ধুকে মরছি। আর কত শাস্তি দেবে তোমরা আমায়? কেন এভাবে সবাই মিলে অভিনয় করছ আমার সাথে। আমার আর সহ্য হচ্ছে না প্লিজ দয়া করো আমার উপর। দয়া করে বল এসব এর অর্থ কি? তোমরা সবাই মিলে কেন এমন করছ আমার সাথে?
কথাগুলো একনাগাড়ে বলে ওর দিকে তাকালাম আমি। স্পষ্ট দেখতে পেলাম কান্না করছে রাই। ওর দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে অঝোর ধারায়। ওকে কান্না করতে দেখে এবার আমি ওর হাত ছেড়ে দিয়ে ওর দু গালে হাত রেখে মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,
— কাঁদছো কেন এভাবে? কেঁদো না প্লিজ রাই। আমি জাস্ট সত্যটা জানতে চাই। তুমি বলো আজ আমার সাথে যেসব হচ্ছে সেগুলো যদি তোমার সাথে হতো তাহলে তোমার কেমন লাগতো? আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না। তাই তোমার সাথে খারাপ আচরণ করে ফেলেছি। প্লিজ তুমি রাগ করোনা এভাবে কান্না করো না রাই। আই এম সো সরি। প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দাও।
ওর সামনে হাত জোড় করে কথাগুলো বললাম আমি। সাথে সাথে আমার হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নিলো রাই।তারপর আরও কান্নার গতি বাড়িয়ে দিল। তারপর আমার হাতে চুমু দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— তুমি আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে আমাকে আর দোষী বানিও না ভাবি। আমি তোমার উপরে একটুও রাগ করিনি। তোমার অধিকার আছে আমাকে শাসন করার আমাকে বকার আমাকে মারার। কিন্তু বিশ্বাস করো তোমার সাথে সবাই মিলে এসব কেন করছে এগুলোর কোন কিছুই আমি জানি না। শুধু জানি তোমার সাথে যা হচ্ছে সেসব শুধুমাত্র তোমার ভালোর জন্য হচ্ছে। আর এসব কিছুই হচ্ছে ভাইয়া আর রাকিবের প্লানে। তবে ওরা তোমার খারাপ চায় না বরং তোমার ভালোর জন্যই এমনটা করছে।
রাইয়ের কথা শুনে ধপ করে মাটিতে বসে পড়লাম আমি। তারপর কান্না করতে করতে বললাম,
–তার মানে আমার নিজের ভাইও আমার সাথে এমন করার পেছনে জড়িত? আমি ভাবতে পারছি না ভাইয়া কিভাবে পারলো আমার সাথে এমন টা করতে? আর কি এমন ভালো হবে আমার এতে, আমি তো দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছি? এখানে আমার ভালোর কি দেখলো ওরা? আর তোমার ভাইয়া না আমায় ভালোবাসে রাই? আমি না তার বিবাহিত স্ত্রী? তাহলে সে কিভাবে পারছে আমার চোখের সামনে অন্য একটি মেয়ের সাথে ভালবাসার অভিনয় করতে? আমার থেকে দূরে থাকতে? আমার সাথে কথা না বলতে? এটাই কি তার ভালোবাসার নমুনা? আমাকে দিনে দিনে পাগল বানিয়ে নিজে অন্য জনের সাথে ফুর্তি করে বেড়ানো কি ভালোবাসা বলে?
রাই আমার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পরে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমার হাত নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বলে উঠল,
— প্লিজ ভাবি তুমি এভাবে কান্না করো না। শান্ত হও প্লিজ। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আমি আর তোমার সাথে কোন রকম অভিনয় করব না। বা মিথ্যে বলব না। তুমি তবুও শান্ত হয়ে যাও ভাবী। তোমার সাথে এমন করার পেছনে অবশ্যই কোন না কোন কারণ আছে। নইলে আমি জানি ভাইয়া তোমাকে কতটা পাগলের মতো ভালোবাসে। তোমার ক্ষতি হোক তুমি পাগল হবে এমন কোন কিছু ভাইয়া কোনদিনও করবে না। অন্ততপক্ষে নিজে বেঁচে থাকা পর্যন্ত তোমার সাথে কখনই এত খারাপ আচরণ করতে পারে না। অবশ্যই এর পেছনে এমন কোনো কারণ আছে যার জন্য তোমার সাথে ভাইয়া বাধ্য হয়েই এমন করছে।
তুমি চিন্তা করো না ভাবী। আমি আজকেই বাসায় গিয়ে ভাইয়া কে বলবো এই অভিনয় থেকে তোমাকে মুক্তি দিতে। সব কিছু তোমার কাছে খুলে বলতে। তারা কেন এমন করছে? আর তাছাড়া আমিও জানতে চাই। রাকিব এর কাছে অনেকবার জানতে চেয়েছি কিন্তু রাকিব আমায় সত্যিটা বলে নি। তাই আজ আমি ভাইয়ার কাছ থেকে জেনে তোমাকে জানাবো। তবুও তুমি প্লিজ এমন ভেঙে পরো না।
ওর কথা শুনে এবার উঠে দাঁড়ালাম আমি। আমার সাথে সাথে রাইও উঠে দাঁড়াল। আমি রাই এর হাত ধরে বললাম,
— তুমি আমার কাছে একটি প্রমিস করতে পারবে রাই?
— কি প্রমিজ করতে হবে একবার বলে দেখো ভাবি! আমার জন্য তোমাকে অনেক কষ্ট পেতে হয়েছে। জানি সেদিন শপিংমলে তোমার সাথে আমি অনেক বাজে আচরণ করে ফেলেছি। তবে বিশ্বাস করো তোমার সাথে বাজে আচরণ করার পরে আমি অন্য একটি শপিং মলে গিয়ে পাগলের মত কান্না করেছি। আমি একটুও চাইনি তোমার সাথে ওমন আচরণ করতে। তুমি শুধু আমার ভাবি নও আমার নিজের বোন। আমি কখনোই চাইনা তোমার সাথে বাজে আচরণ করতে। বল আমাকে কি করতে হবে তোমার জন্য? তুমি যা বলবে আমি সেটাই করব প্রমিস।
রাই এর কথা শুনে এবার আমি একটি রহস্যময় হাসি দিলাম। তারপর রাইয়ের হাত নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বলতে শুরু করলাম,
— তুমি এখন আমাকে কথা দেবে আমাদের মাঝে এখন যেসব কথা হলো এগুলো কোন কিছুই তুমি ভাইয়াকে অথবা তোমার ভাইয়াকে কাউকে বলবে না। কেউ জানবে না এখন আমাদের সাথে দেখা হওয়ার যাবতীয় কথাগুলো। আমি ওদের মুখ থেকে বের করে ছাড়বো ওরা কেন আমার সাথে এমন করেছ। আর এর মাঝে যত কিছু হয়ে যাক না কেন। তোমার ভাইয়া যদি আমার জন্য কষ্টও পায় তবুও তুমি কোন কিছু মুখ ফুটে বলবে না। এটা তুমি এখন আমার কাছে প্রমিস করবে। তুমি শুধু দেখে যাও তোমার ভাইয়াকে আমি কিভাবে শিকার করাই তারা কেন এমন করছে আমার সাথে। বলো রাই আমার কথা রাখবে তো? প্রমিস!
আমার কথাগুলো শুনে রাই বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর আমার হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে উঠল,
— প্রমিস ভাবী, তুমি যেটা বলছো সেটাই হবে। আমি তোমার কাছে প্রমিস করলাম আমাদের এখন দেখা হওয়া সব কথা আমি কারো কাছে কোন কিছু বলবো না। এমনকি রাকিব এর কাছে ও না। আর আমি যতটা সম্ভব তোমার সাথে সেই আগের মতো অভিনয় করে যাবো সবার সামনে। তবে তুমি জেনে রাখো আমি কিন্তু তোমার ননদীনি, সাথে তোমার ভাবি ও।
আমি মুচকি হেসে জড়িয়ে ধরলাম রাইকে। সত্যিই খুব শান্তি লাগছে এখন। যেন মস্ত বড় এক বোঝা বুকের উপর থেকে নেমে গেল আমার। তারপর আরো কিছুক্ষণ ওর সাথে গল্প করে ওকে বিদায় করে দিয়ে আমি বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত 11:00 বেজে গেছে। দরজা খুলে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতেই আম্মু এসে সামনে দাঁড়ালো। আম্মুকে দেখে আমি মাথা নীচু করে ফেললাম। আম্মু রাগি গলায় বলে উঠলো,
— রাহি তোমার দিন দিন হয়েছে কি বলতো? তুমি এত রাত অব্দি কোথায় ছিলে? একটি মেয়ে মানুষের এত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকা ঠিক নয় এটা কি তোমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে? আমি জানি তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতি মেয়ে। তাহলে এত রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলে তুমি?
আম্মুর প্রশ্নের উত্তরে আমি আম্মুর চোখে চোখ রেখে বলে উঠলাম,
— আম্মু তুমি চিন্তা করো না। তোমার মেয়ে যেটা করবে অবশ্যই সেটা ভালোই হবে। খারাপ কিছু করবে না। এত টুকু বিশ্বাস তুমি তোমার মেয়ের উপর রাখতে পারো।
কথাটা বলে আম্মুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পাশ কাটিয়ে রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলাম আমি। দরজা লাগিয়ে শুধু বোরকাটা খুলেছি তখনই দরোজায় টোকা পড়লো।। আমি ভেতর থেকে বলে উঠলাম,
— আম্মু প্লিজ এখন আমাকে ডেকোনা আমার প্রচুর ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমাবো।
— রাহি আমি রাকিব দরজা খোল। তোর সাথে আমার কথা আছে।
ভাইয়ার কন্ঠ শুনে ছোট করে নিশ্বাস ছাড়লাম আমি। তারপর গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। কিন্তু ভাইয়ার চোখে আর চোখ রাখলাম না। অন্যদিকে তাকিয়ে সোজা এসে বিছানার উপর বসে পড়লাম। ভাইয়া আমার পিছু পিছু এসে আমার পাশে বসে বলে উঠলো,
— রাহি তুই কি আমার ফোন থেকে আমার সিম খুলে নিয়েছিস? মানে আমার সিম টা কি তোর কাছে?
আমি নিচের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,
— হ্যা ভাইয়া আসলে আমার ফোনটা তো নতুন, তাই নতুন সিম দিয়ে আমার ফোনে কাজ করতে পারছিলাম না। তাই তোমার ফোনটা থেকে সিম খুলে নিয়ে এসে আমার ফোনে লাগিয়েছিলাম। এছাড়া কিছু না। প্লিজ তুমি রাগ করো না। আমি এখনই তোমার সিমটা খুলে দিয়ে দিচ্ছি।
ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
— আরে পাগলি আমি রাগ করবো কেন? তুই আমার ফোনটা নিয়ে এলেও আমি রাগ করবো না। সমস্যা নাই তোর যখন খুশি তখন আমার সিমটা দিস।
আমি কথার উত্তর না দিয়ে ফোন থেকে সিমটা খুলে ভাইয়ার হাতে দিয়ে বললাম,
— আমার সিমট তোমার সময়মতো দিয়ে দিও কেমন?
ভাইয়া পকেট থেকে সিম টা বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল,
–তোর সিমটা আমার আগেই খুলে রেখেছি। এই নে!
তারপর ভাইয়া সিম টা আমার হাতে দিয়ে মুচকি হেসে রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেল। আমি গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলাম। তারপর সেই সিমটা আমার ফোনে তুলে নিলাম। এখন শুরু হবে আমার খেলা। সকলের মুখ থেকে কিভাবে সত্যি টা বের করতে হয় এবার আমি দেখাবো সবাইকে। কেন এমন আচরণ করছে আমার সাথে সব কিছু বের করে ছাড়বো আমি। তাতে যদি সকলকে কষ্ট দিতে হয় তাহলে তাই দিব।
চলবে,,,,,,,,,
You are my property
Part 27
M Sonali
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে কলেজের জন্য দ্রুত রেডি হয়ে নিচ্ছি আমি। আজ যে কলেজে আমার অনেক কাজ আছে। কাজটা তো আজকে থেকেই শুরু করতে হবে আমার।এবার’ই তো শুরু হবে রাহির খেল। মনে মনে এসব কথা ভাবছি আর আনমনে হেসে চলেছি আমি। তারপর তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসলাম আমি। আমাকে একদম কলেজের জন্য রেডি হয়ে বের হতে দেখে আম্মু আমার কাছে এগিয়ে এসে বললো,
— কি ব্যাপার আজ এত সকাল সকাল কলেজের জন্য রেডি হয়েছো যে? কলেজে কোন জরুরী কাজ আছে নাকি?
আম্মুর দিকে তাকিয়ে আমি মুচকি হেসে বললাম,
— আম্মু এখন তো শুধু আজ নয়, প্রতিদিনই আমার কিছু না কিছু জরুরি কাজ থাকবে। তুমি তাড়াতাড়ি আমাকে খেতে দাও আমার কলেজে যেতে হবে।
কথাটা বলেই ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসে পড়লাম আমি। আম্মু একটা ছোট করে নিঃশ্বাস নিয়ে আমার জন্য খাবার রেডি করতে চলে গেল। সকালের খাওয়া শেষ করে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কলেজের জন্য রওনা হলাম আমি। যদিও আম্মু অনেক বার মানা করেছে এত তাড়াতাড়ি কলেজে যেতে কিন্তু আমি শুনি নি। কারণ আমি আজকে কলেজে যাব হেটে হেটে। এটা ভেবেই বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তা ধরে হাটতে লাগলাম আমি। ভীষণ ফুরফুরে লাগছে আজ মনটা। আজ অনেক সুন্দর করে সেজেছি আমি, যদিও বোরকা পরা কিন্তু মুখটা তো বাইরে আছে। তাই ঠোটে লিপস্টিক চোখে গাঢ় কাজল দিয়েছি আমি। জানি আমাকে এখন দেখতে ভালোই লাগছে। একা একা এসব কথা চিন্তা করছি আর রাস্তা দিয়ে হেটে চলেছি। হঠাৎ আমার পাশে এসে একটি কালো রঙের গাড়ি দাঁড়ালো। গাড়িটাকে পাশে দাঁড়াতে দেখে রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল আমার মুখে। কারন আমি এইটার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু আমি সেদিকে এমন ভাব করে তাকালাম যেন আমি এটার জন্য একটুও অপেক্ষায় ছিলাম না। গাড়ির দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে আসলো আরিশা। তারপর আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
— কি ব্যাপার রাহি আজকে হেঁটে হেঁটে কলেজ যাচ্ছো যে? গাড়িতে ওঠো আমি তোমাকে ড্রপ করে দিচ্ছি।
আমি আরিশার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম,
— সমস্যা নেই আরিশা, তুমি যাও আমি আজকে হেটেই কলেজে যাব। আসলে কি বলো তো প্রতিদিনই তো রিক্সায় বা গাড়িতে করেই যাই। তাই আজ ভাবলাম একটু হেঁটে যাই দেখি কেমন লাগে। বেশ ভালই লাগছে। তুমি যাও আমার সমস্যা হবে না।
আমার কথার উত্তরে আরিশা কিছু বলার আগেই গাড়ি থেকে নেমে আসলো আরিয়ান। তারপর আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
— তা বললে কি হয় নাকি রাহি। তোমাদের কলেজের তো এখনো অনেক দেরি। তুমি এত সকাল-সকাল কলেজে যাচ্ছ কেন? চলো আমরা সবাই মিলে আজ কফি খাবো।
আরিয়ানের কথা শুনে ওর দিকে আমি হাসিমুখে তাকিয়ে বলে উঠলাম,
— সমস্যা নাই দুলাভাই, আপনি আরিশাকে সাথে নিয়ে গিয়ে কফি খান। আমি শুধু শুধু আপনাদের মাঝে কাবাবের হাড্ডি হয়ে কী করব বলেন?
আমার মুখে দুলাভাই ডাকটা শুনতেই যেন চোখ বড় হয়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম হল আরিয়ানের। উনি অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— দুলাভাই? কে তোমার দুলাভাই?
— কে আবার হবে আপনি আমার দুলাভাই। আপনি তো আমার বান্ধবী আরিশার বয়ফ্রেন্ড তাই না? তাহলে একদিন যখন আরিশার সাথে আপনার বিয়ে হবে তখন তো আপনি আমার দুলাভাই’ই হবেন। তাহলে এখন তো আপনি আমার হবু দুলাভাই হন সম্পর্কে। সেজন্য দুলাভাই বলে ডাকছিস। কেন আপনার কোন সমস্যা হয়েছে দুলাভাই?
আমার মুখে কথাগুলো শুনে এবার কি বলবে বুঝতে পারছেনা আরিয়ান। শুধু এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আর অসহায় ভঙ্গিতে আরিশার দিকে তাকাচ্ছে। আরিশা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তা সামাল দেওয়ার জন্যে আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে বলল,
— আরে আমরা কি এখনই বিয়ে করেছি নাকি? যে তুমি ওকে দুলাভাই বলে ডাকছো? তুমি ওকে আরিয়ান বা স্যার বলে ডেকো কেমন?
— আরে না না সেটা কি করে হয়। তোমরা বিয়ে করোনি তাতে কি হয়েছে? উনি তো তোমার হবু বর তাই না? তাহলে তোমার হবু বর হলে তো সম্পর্কে আমার দুলাভাই’ই হয়। আমি ওনাকে দুলাভাই বলেই ডাকবো। আর তাছাড়া উনি আমার কলেজের কোনো স্যার নয় যে আমি ওনাকে স্যার বলে ডাকবো। সো দুলাভাই এখন থেকে আপনার জন্য এই দুলাভাই নামটাই ফিক্সড।
আমার কথা শুনে এবার আরিয়ানের যেনো কাঁদো-কাঁদো অবস্থা হয়ে গেল। উনি আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে দ্রুত গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে পরলেন। তারপর আরিশার দিকে তাকিয়ে ইশারায় কিছু একটা বললেন। আরিশা আমার হাত ধরে বলল,
— আচ্ছা ঠিক আছে তুমি ওকে কি বলে ডাকবে সেটা না হয় পরে দেখা যাবে। এখন আমার সাথে আসো, চলো আমরা কফি খাবো।
আরিশার কথায় আমিও আর মানা না করে আরিশার সাথে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। কেননা আমিও তো ঠিক এটাই চেয়েছিলাম। গাড়িতে ওঠার পর আরিয়ান গাড়ি চালিয়ে নিয়ে একটি কফি শপের সামনে যেয়ে দাড়ালেন। তিনজন মিলে গাড়ি থেকে নেমে কফিশপের ভিতরে গেলাম আমরা। তারপর একটি টেবিলে গিয়ে তিনজন পাশাপাশি বসে পড়লাম। আরিয়ান একদম আমার মুখোমুখি বসেছে।
কফি খেতে খেতে তিনজন গল্প করতে লাগলাম। এমন সময় হঠাৎ করে আমি আরিশাকে উদ্যেশ্য করে বলে উঠলাম,
— তা আরিশা তোমরা বিয়ে করছো কবে? মানে অনেকদিন হলো বিয়ের দাওয়াত খাওয়া হচ্ছে না তো তাই বলছি আর কি! কবে বিয়ে করছো তোমরা বল তো?
আমার কথা শুনে এবার চোখ বড় বড় করে আরিয়ান তাকালেন আমার দিকে। আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আরিশার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। ও একবার আমার দিকে আর একবার আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটি ঢোক গিলে বলে উঠল,
— আসলে কি বলো তো, আমার পড়াশোনা তো এখনো শেষ হয়নি রাহি। তাই বিয়ের চিন্তা ভাবনা এখন করছি না। তবে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করবো আর তোমাকে দাওয়াতও দিব।
আমি আর কিছু বললাম না। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। কেন জানিনা ওর কথাটা শুনে বুকের মধ্যে ফাঁকা ফাঁকা লাগছে আমার। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে আরিশা আমার হাতের উপর হাত রেখে বলে উঠলো,
— তা তুমি কাউকে ভালো টালো বাসো না রাহি? মানে আজ পর্যন্ত কি কারো প্রেমে ট্রেমে পরেছ নাকি?
আমি যেন এই প্রশ্নটার অপেক্ষাতেই ছিলাম। আর প্রশ্নটা শুনতেই খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম। আর আরিশার দিকে তাকিয়ে বললাম,
— হুমম বাসি তো। আমিও একজনকে ভালোবাসি। আর তার নাম হলো রাজ।
আমার মুখ থেকে রাজ নামটা শুনতেই আরিশা এবং আরিয়ান দুজনেই হাসিমুখে ফিরে তাকালো আমার দিকে। আরিয়ানের চোখে স্পষ্ট ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছি আমি। অথৈ সমুদ্রের মতো গভীর ভালোবাসা রয়েছে আরিয়ানের চোখে আমার জন্যে। সেটা আমি বুঝতে পারছি কিন্তু সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে আবারো বলতে শুরু করলাম,
— তবে কি বলতো আরিশা! আমি যাকে ভালবাসি তাকে দেখলে না তোমরা একদমই পছন্দ করবে না। তবে তোমাদের পছন্দ দিয়ে আমার কিছু যায় আসে না। আমি তাকে ভালোবাসি আর এটাই সত্যি। সবথেকে মজার কথা কি জানো, আমি না থাকে স্বপ্ন দেখেছিলাম। আর স্বপ্নটা যে এভাবে বাস্তবে রূপ নিবে কখনো ভাবতে পারেনি। সেই স্বপ্নের রাজ আমার জীবনে এসে গেছে তাকে আমি খুজে পেয়েছি। তবে স্বপ্ন যেরকম দেখেছিলাম সেই রকম হয়নি সে বাস্তবে এটাই শুধু আফসোস।
আমার কথা শুনে আরিয়ানের চোখ এবার বেড়িয়ে আসার উপক্রম হলো। তারপর অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ও আমার দিকে। আমি কি বলি সেটা শোনার জন্য। আরিশা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
— এসব তুমি কি বলছো রাহি? যাকে স্বপ্ন দেখেছো তাকে খুঁজে পেয়েছ মানে? কে সে, কার কথা বলছো তুমি?
— কার কথা আবার বলব আরিশা। আমি আমার রাজের কথা বলছি। তবে স্বপ্নে ওর নাম ছিল রাজ আর বাস্তবে ওর নাম রাজু। ও আসলে একজন অটো ড্রাইভার। অটো চালায়। ওর একটা চোখ না হালকা ট্যাড়া। যাকে বলে লক্ষীটেরা। তবে ওকে আমি অনেক ভালবাসি। বুঝলে আরিশা যতই হোক ও তো আমার স্বপ্নে দেখা রাজ কুমার। স্বপ্নে আমার স্বামীও ছিলো ও। আমাকে সত্যিই অনেক ভালবাসে ও। আর আমিও ওকে অনেক ভালবেসে ফেলেছি। আর দুলা ভাই প্লিজ আপনি কিছু মনে করবেন না। আমি প্রথমে আমার স্বপ্নে দেখা রাজ কুমার আপনাকে ভেবেছিলাম। তাই সেদিন রাস্তার মধ্যে আপনাকে ডেকে ঐ কথাগুলো বলে ছিলাম। সেজন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। তবে আমি আমার আসল রাজকে খুঁজে পেয়েছি। যাকে আমি সব সময় খুঁজতে চেয়েছি সে।
রাজ কেবল’ই এক চুমুক কফি মুখে দিয়েছিল আমার বলা কথাগুলো শোনার সাথে সাথে বেচারা কাশতে কাশতে অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। কফিটা মনে হয় মাথায় উঠে গেছে ওনার। আমি আর আরিশা দুজনে গিয়ে ওনার মাথায় ফু দিতে লাগলাম। আর একটি পানির গ্লাস এগিয়ে দিলাম খাওয়ার জন্যে। উনি পানি খেয়ে হালকা শান্ত হতেই আমি আবারো বলে উঠলাম,
— দুলাভাই আসলে কি বলুন তো, আমি রাজুকে এতটাই ভালবাসি যে এখন আপনাদের কাছে না বলে আর থাকতে পারলাম না। কারণ আপনারাই তো আমাদের বিয়ের সাক্ষী হবেন তাই।
কাশি যাও একটু থেমেছিল আমার বলা আবার এই কথাগুলো শুনে আবারও পুনরায় কাশতে শুরু করল উনি। আর আমি ওনাকে এভাবে কাশতে দেখে মনে মনে বেশ মজা পাচ্ছে। তবে সেটা প্রকাশ না করে উনাকে পানি খাওয়ার জন্য এগিয়ে দিচ্ছি। আর মাথায় ফু দিচ্ছি। উনি আবারো একটু শান্ত হয়ে আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি তখন ওনার চোখে চোখ রেখে বললাম,
— কি করবো বলুন তো দুলাভাই! আপনারা ছাড়া তো আমার বাড়ির লোক কেউ একটা অটো ড্রাইভার কে আমার স্বামী হিসেবে মেনে নেবে না। তাই না? তাই আপনাদের দুজনকে একটু আমাদের বিয়ের শাক্ষি হয়ে আমাদের বিয়েটা দিতে হবে। আর সেটাও আগামি ৭ দিনের মধ্যে। আসলে ও খুব তারা দিচ্ছে বিয়ের জন্যে।
আমার বলা কথাগুলো শুনে এবার এক লাফে উঠে দাঁড়ালেন অরিয়ান। তারপর রাগী গলায় চিৎকার করে বলে উঠলেন,
— তুমি নিজেকে কি মনে করো রাহি? যখন যা খুশি তাই করে বেড়াবে? কাকে ভালোবাসার কথা বলছো তুমি তোমার বিয়ে হতে পারেনা কারো সাথে তোমার বিয়ে হতে পারে না।
চিৎকার করে কথাগুলো বলল আরিয়ান। আর উনার চিৎকার শুনে কফিশপে থাকা সব লোক গুলো অবাক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকালো। আমিও বেশ ভয় পেয়ে চেয়ারের উপর ধপ করে বসে পড়লাম। আরিশা ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করার জন্য আরিয়ানের হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করে কিছু বললো। সেটা আমার দৃষ্টি এরালোনা। আমি আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলাম,
— দুলাভাই আপনি এমন রিয়েক্ট করছেন কেন? আমার রাজু একজন অটো ড্রাইভার বলে? আপনি এমন বিহেভ করছেন তাই না? তবে বিশ্বাস করেন দুলাভাই সে অটো ড্রাইভার হলেও আমাকে অনেক সুখে রাখবে। অনেক ভালোবাসবে। আর আমিও তাকে ভালবাসি। আমি বুঝতে পারছি আপনার শালিকা হিসেবে আপনার আমার প্রতি একটা দায়িত্ব আছে। তাই আপনি এমন করছেন। তবে আমি আশা করব শালিকা হিসাবে আমাকে আমার ভালোবাসার কাছে তুলে দেবেন আপনি।
কথাগুলো বলে ওনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ব্যাগ হাতে নিয়ে দৌড়ে কফিশপ থেকে বেরিয়ে আসলাম। কারন আমি জানি এখন এখানে কি হতে চলেছে। আর এই মুহূর্ত টা আমি দেখতে চাই না। কফিশপ থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আর কোন দিকে তাকালাম না। সোজা কলেজের দিকে রওনা হলাম। আর সামনে একটি রিক্সা পেতেই তাতে উঠে কলেজের রাস্তায় রওনা হলাম। আমি এদিকে একা একা আনমনে হেসে চলেছি খল খল করে। কেননা আমি জানি ওখানে আরিয়ানের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। আমার বিয়ের কথা শুনে ও আর নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারব না আমার সামনে। তবে আমি চাইনা ও এত তাড়াতাড়ি আমার কাছে নিজের আসল পরিচয় গুলো দিয়ে দিক। আমিও তো একটু নাচাতে চাই ওকে ঠিক যেভাবে ও আমায় এত দিন নাচিয়ে এসেছে। সে যদি আমাকে ভালোবেসে আমার সাথে এমন করতে পারে তাহলে আমি কেন করব না? এটাই তার শাস্তি।
এসব কথা ভাবতে ভাবতেই কলেজের গেটে পৌঁছে গেলাম আমি। তারপরে রিকশাভাড়া মিটিয়ে কলেজের মধ্যে ঢুকে পরলাম।
চলবে,,,,,,,,,,,,