You are my property,Part_12,13

You are my property,Part_12,13
M Sonali
Part-12

— আমি ভাবির বড় ভাই রাকিবকে ভালোবেসে ফেলেছি ভাইয়া। আমি ওকে নিজের জীবন সাথী হিসাবে পেতে চাই।

কথাগুলো বলেই আবারও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো রাই। ওর কথায় যেনো বড় সড় একটা ধাক্কা খেলো রাজ। নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,

— তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে রাই? মাত্র দুদিনের পরিচয়ে কখনো কাউকে ভালবাসা যায় না। এটা তোর আবেগ। আর আবেগ দিয়ে কখনো সারাজীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না রাই। তুই সময় নিয়ে একবার ভেবে দেখ তাহলে বুঝতে পাড়বি!

— আমি ওকে এক বছর আগে থেকে ভালবাসি ভাইয়া।

রাইয়ের এমন কথায় ওকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে ওর দিকে বড় বড় করে তাকালো রাজ। তারপর সোজা গিয়ে সোফার উপর ধপ করে বসে পড়ে রাই এর দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো,

— মানে?

রাই গুটি গুটি পায়ে রাজের কাছে এগিয়ে এসে ওর পাশে সোফার উপর বসে মাথা নিচু করে বলতে শুরু করল,

— মানে, আমি ওকে এক বছর আগে থেকে চিনি ভাইয়া। এক বছর আগে সর্ব প্রথম যেদিন ওকে দেখেছিলাম আমি তখনই ওর প্রতি একটা ভালো লাগা কাজ করতে শুরু করে আমার মনে। আমার বান্ধবীর বার্থডে পার্টিতে প্রথম দেখেছিলাম আমি ওকে। ও ওর বন্ধুর সাথে এসেছিল। আর ওর বন্ধু ছিল আমার বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ড। সেদিন হয়তো রাকিব আমাকে ঠিক করে খেয়াল করেনি কিন্তু আমি ঠিকই পুরো পার্টিতে শুধু ওকেই খেয়াল করেছিলাম। ওর প্রতি ভালোলাগাটা সৃষ্টি হওয়ার প্রধান কারণই ছিল মেয়েদেরকে ওর এড়িয়ে চলা। যদিও আমি জানতাম না ও কেন মেয়েদের কে এড়িয়ে চলে। আর সে ভাবে বলতে গেলে ও মেয়েদের কে ভয় পায়। মেয়েদের থেকে সব সময় দূরত্ব বজায় রেখে চলতো। আমি সেই পার্টিতে দেখেছি আমার অনেক বান্ধবী ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ও সব সময় এড়িয়ে চলেছে সবাইকে। তখন থেকেই ওর প্রতি আমার ভালো লাগার সৃষ্টি হয়। আমি ওর ব্যাপারে সকল খোঁজ-খবর নিতে শুরু করি। ধিরে ধিরে ওর পরিবার সম্পর্কে সব কিছু জেনে যাই আমি। আর জানো ভাইয়া তুমি যখন বললে রাকিবের বোন মানে ভাবি কে তুমি ভালোবাসো! তখন সবচাইতে বেশি খুশি হয়েছিলাম আমি। আর সেই খুশির কারণটাও ছিল রাকিব। কারন ও আমার বিয়াই সাব হচ্ছিলো তখন সম্পর্কে।প্লিজ ভাইয়া তুমি কিছু করো!

কথাগুলো একনাগাড়ে বলে রাজের দিকে ফিরে তাকাল রাই। তাকিয়ে দেখল রাক চুপচাপ বসে আছে ওর মুখে কোন কথা নেই। বিস্ময় চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে এভাবে থাকতে দেখে এবার রাই কিছুটা ধাক্কা দিয়ে বলে উঠলো,

— কি হলো ভাইয়া কিছু বলবে না তুমি?

রাই এর প্রশ্নে ওর দিকে ফিরে তাকাল রাজ। তারপর অট্ট সুরে জোরে হাসতে শুরু করল। ওকে এভাবে হাসতে দেখে রাগ এবং অভিমান দুটোই বাসা বাঁধলো রাই এর মাঝে। রাই চুপ করে মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো। তারপর হাসতে হাসতে রাজ বলে উঠল,

— সত্যিই রাই, ইউ আর রিয়েলি মাই সিস্টার। আর তাই তো তুই আমাকেও ছাড়িয়ে গেছিস রে। গত এক বছর হল তুই একটি ছেলেকে ভালবাসিস? আর শুধু ভালবাসিস তাই ই না তার নাম ধাম ঠিকানা পরিবার সম্পর্কে যাবতীয় কিছু খোঁজখবরও নেওয়া শেষ তোর। ও মাই গুডনেস। আমি তো এসব কথা ভেবেই শিহরিত হচ্ছি।

— ভাইয়া তুমি প্লিজ কিছু একটা করো।

এবার হাসি থামিয়ে বেশ কিছুটা সিরিয়াস মুডে আসলো রাজ। তারপর রাই এর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

— তুই এতদিন আমায় এই কথা বলিসনি কেন? আর হঠাৎ আজকে ই কেন বলছিস বলতো?

— অ্যাকচুয়ালি ভাইয়া তোমাকে বলার মত সাহস আমার এতদিন হয়ে উঠেনি। কিন্তু আজকে আর না বলে থাকতে পারলাম না। আমি সত্যিই রাকিবকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি ভাইয়া। কিন্তু রাকিব সবসময় আমাকে এড়িয়ে চলে। যেটা আমি একদমই সহ্য করতে পারছিলাম না আর তাই বাধ্য হয়ে তোমাকে বলতে হলো। প্লিজ ভাইয়া তুমি কিছু একটা করো। আমি রাকিবকে নিজের জীবন সাথী হিসেবে পেতে চাই।

এতোটুকু বললেই আবারো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করলো রাই। রাই কে কান্না করতে দেখে এবার কি বলে ওকে সান্ত্বনা দেবে বুঝতে পারছে না রাজ। কারণ ও ভালো করেই জানে রাই অসম্ভব জেদি এবং রাগী মেয়ে। ও একবার যেটার জেদ ধড়বে সেটা ওর চাই ই চাই। কিন্তু এ কথাটি কে প্রশ্রয় দিলে চলবে না সেটা ভালভাবেই বুঝতে পারছে রাজ। তাই রাজ কিছুটা গম্ভির গলায় বলে উঠলো,

— রাই এখন কান্না থামিয়ে তুই নিজের ঘরে যা। আমি দেখছি কি করা যায়। আর হ্যাঁ এই ব্যাপারে তোর কাছ থেকে আমি আর কোন কথা শুনতে চাই না। তোর জন্য যেটা ভালো হবে আমি সেটাই করব। আর একটা কথা বলে দিচ্ছি তোকে, এসব ব্যাপারে জেদ চলে না। ভুলে যাস না তুই কোন ছেলে নয় তুই একটি মেয়ে। এবার যা রুমে যা আমি দেখছি কি করা যায়।

রাজের কথায় আবারও রাই কিছু বলবে তার আগেই ধমক দিয়ে উঠল রাজ। ওর ধমকে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে দৌড়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল রাই। রাজ খুব ভাল করেই জানে এই দরজা আর সকাল হওয়ার আগে খুলবে না। সারারাত বসে বসে কান্না করবে ও। কিন্তু রাজের কোন উপায় নেই ওকে বোঝানোর। রাজকে এখন যেভাবেই হোক রাকিবের সাথে কথা বলতে হবে। তবে শিওর নয় রাকিব কি বলবে ওকে। বেশ টেনশন কাজ করতে লাগল রাজের মাঝে। হঠাৎ সিড়ি বেয়ে কারো নিচে নামার শব্দ শুনে সে দিকে ফিরে তাকাল রাজ। তাকিয়ে দেখল রাহি ঘুম থেকে উঠে গুটি গুটি পায়ে নিচে নেমে আসছে। চোখ মুখ বেশ কিছুটা ফুলা ফুলা লাগছে তার। হয়তো ঘুমের কারণে হালকা ফুলে গেছে। আর এই হালকা ফলে যাওয়াতে যেন আরও বেশি আকর্ষণীয় লাগছে মুখটা তার। এক নজরে সব ভুলে রাহির দিকেই তাকিয়ে রইল রাজ। রাহি গুটি গুটি পায়ে এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে আস্তে করে বলে উঠলো,

— আমি বাসায় যাব!

রাজের কাছ থেকে বেশ কিছুক্ষণ পরেও কোন উত্তর না পেয়ে এবার কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বলে উঠলো রাহি,

— আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? আমি বাসায় যাব প্লিজ আমায় বাসায় নিয়ে চলুন!

— হুমম ওকে চলো!

এতো সহজেই রাজ রাজি হয়ে যাওয়ায় যেন বেশ কিছুটা অবাক হল রাহি। কিন্তু সেই অবাকতা টা রাজকে বুঝতে না দিয়ে ওর পিছু পিছু গিয়ে গাড়িতে উঠল। পুরো রাস্তায় আর একটাও কথা বলেনি দুজন। সোজা এসে রাহির বাসার সামনে গাড়ি থামলো রাজ। রাত তখন প্রায় নয়টা বাজতে চললো। বাসায় গিয়ে কলিং বেল চাপতেই দরজা খুলে দিল রাকিব।

দরজা খোলার পর রাকিব কিছু বলবে তার আগেই ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো রাজ,

— রাহি তুমি ভেতরে যাও। আমার রাকিবের সাথে কিছু কথা আছে!

ওর কথা শুনে ওর দিকে ফিরে তাকাল রাহি। তারপর কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করল। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ ভাব্বার পরেও কোন কিছু বুঝতে না পেরে সে সোজা নিজের রুমে চলে গেল। ও চলে যেতেই রাকিব রাজের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

— আমি হয়তো জানি রাজ তুমি আমায় কি বলতে চাইছ? আর আমিও তোমার কাছে কিছু বলতে চাই। তো চলো দুজন ছাদে গিয়ে বসি!

রাজ যেন ওর থেকে এই কথাটি শোনার ই অপেক্ষা করছিল।তাই কথাটি শুনে মুখে হাসি ফুটে উঠল তার। তারপর রাকিবের হাত ধরে নিয়ে সোজা ছাদের দিকে এগোলো দুজন। ছাদে উঠে দুটি চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসে পরলো দুজন। তারপর রাজকে কিছু বলতে না বলতে দিয়ে রাকিব বলে উঠল,

— আমার মনে হচ্ছে তুমি আমার সাথে রাই এর বিষয়ে কথা বলতে এসেছ তাই না রাজ?

রাকিবের প্রশ্নে শুধু মাথা নেড়ে সায় দিল রাজ। ওর থেকে সায় পেয়ে আবারো বলতে শুরু করলো রাকিব,

— তাহলে শোনো রাজ, আমিও তোমাকে রাই এর বিষয়েই কিছু বলতে চাই। আমি জানি রাই আমাকে পছন্দ করে। এবং আমি এটাও জানি রাই আমাকে গত এক বছর আগে থেকেই পছন্দ করে। হয়তো সেউ পছন্দ করাটা এখন ভালোবাসার রূপ নিয়েছে। কিন্তু তবুও আমি ওকে এড়িয়ে চলি। এমনটা নয় যে আমি ওকে পছন্দ করি না বা আমার অন্য কোন গার্লফ্রেন্ড আছে। কিন্তু তবুও ওকে এড়িয়ে চলার কিছু কারণ আছে আমার।

— সেই কারন টা কি রাকিব?

— আজ থেকে তিন বছর আগের কথা। তখন আমি অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। সেই সময় আমার একমাত্র প্রাণপ্রিয় আমার ভাইয়ের মতো বন্ধু ছিল তন্ময়। তাকে আমি নিজের থেকেও বেশী ভালবাসতাম। সব সময় মনে হতো আমাদের দুটি দেহ কিন্তু একটি প্রাণ। সেই তন্ময় একটি মেয়েকে ভালোবাসতে শুরু করে। মেয়েটির নাম ছিল তন্নী। মেয়েটিও তন্ময় কে পছন্দ করত। দুজনের রিলেশনশিপ খুব ভালো ভাবেই চলছিল। আমি ওদের দেখতাম এবং মনে মনে খুবই ভালো লাগা কাজ করতো আমার। সবসময় ভাবতাম আমার জীবনে ও যদি এরকম কেউ আসতো যাকে আমি ভালোবাসবো। আর সেও আমায় ভালবাসবে! কিন্তু আমার চোখের সামনে ওদের রিলেশনশিপে ফাটল ধরলো। ওদের রিলেশনশিপের ছয় মাসের মাথায় দেখা গেল তন্ময় কেমন পাগলামি করতে শুরু করল। আমি ওকে হাজার বার বোঝানোর চেষ্টা করতাম কিন্তু ও আমার কথা বুঝনা। আমার সাথে দেখা করতে চাইত না ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করতো না। পড়াশোনা করত না। শুধু পাগলের মত নেশায় ডুবে থাকতো। তখনও ওর পরিবর্তনের কারণ আমি কোন কিছুই জানতাম না। তারপর যখন আমি খোঁজ খবর নেওয়ার চেষ্টা করি তখন জানতে পারি তন্নী ওকে মিথ্যা ভালোবাসার নাটকে ফাসিয়ে শুধুমাত্র পকেটের টাকা খেয়েছে। আর এখন তন্নী অন্য কারো সাথে রিলেশনশিপে জড়িয়ে ওকে ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু তন্ময় সত্যিই ওকে ভালবাসত যে কারণে সেই কষ্টটা সহ্য করতে না পেরে সে নেশা কে আপন করে নেয়। তারপর একদিন হঠাৎ করে,,,,,,।

এতোটুকু বলে কান্না করতে শুরু করে রাকিব। ওকে কান্না করতে দেখে ওর কাঁধে হাত দিয়ে রাজ বলে উঠে,

— তারপর একদিন কী হল রাকিব? বল আমায় তারপর কি হয়েছিল?

— তারপর একদিন সকালবেলা কলেজ থেকে ফোন পেয়ে ঘুম ভেঙে যায় আমার। ফোন রিসিভ করতেই জানতে পারি তন্ময় গলায় রশি দিয়ে সুইসাইড করেছে।কথাটি শুনতেই পাগলের মতো ছুটে যাই আমি। গিয়ে দেখি কলেজের সেই রুমে সেই জায়গায় গলায় ফাঁস লাগিয়ে সুইসাইড করেছে তন্ময়। যেখানে আমরা দুজন বসে ক্লাস করতাম। ওর ঝুলন্ত লাশ দেখে সহ্য করতে পারিনি আমি। হাঁটু গেড়ে নিচে বসে পড়ে পাগলের মতো কান্না করেছিলাম সেদিন। ইচ্ছা করছিলো তন্নী নামের ওই মেয়েটিকে নিজের হাতে শেষ করে ফেলি আমি। কিন্তু সেটা আমার সাধ্যের বাইরে ছিল। তবে সেই সময় থেকে আমি প্রতিটি মেয়েকে ঘৃণা করতে শুরু করি। কারন আমার কাছে মনে হতো সব মেয়েরাই হয়তো এক রকম হয়। মেয়েদের প্রতি আমার ভেতর থেকে একটি ঘৃণা কাজ করতো। ভালোবাসা তো দুরের কথা রিলেশনশিপ নামেরও কোন কিছুতে জড়ানোর কোন ইচ্ছা ছিল না আমার। কিন্তু আমার এই সব কিছুকে ভুল প্রমাণ করে দিল রাই।

এতোটুকু একনাগাড়ে বলে থেমে গেল রাকিব।ওকে থামতে দেখে ওর কাঁধে হাত রেখে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাজ। তারপর বলতে শুরু করল,

— রাকিব আমি বুঝতে পারছি তোমার ফিলিংস টা। তোমার এভাবে প্রতিটি মেয়েকে ঘৃণা করাটা স্বাভাবিক। কেননা তুমি তোমার প্রাণের চাইতে প্রিয় একজন বন্ধুকে হারিয়েছো। কিন্তু তবুও আমি তোমাকে বলবো তুমি তো আমার জীবনে ঘটে যাওয়া সব কিছুই জানো। আর কেউ না জানলেও সেটা আমি তোমার সাথে শেয়ার করেছি। তাহলে এতো কিছুর পরেও আমি যখন তোমার বোন রাহিকে এতটা ভালবাসতে পেরেছি! আপন করে নিতে পেরেছি নিজের জীবনের সাথে। তাহলে তুমি কেন রাই কে ভালবাসতে পারবে না? রাই সত্যিই তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসি রাখিব। তবে আমি তোমাকে জোর করব না আমার বোনকে বিয়ে করার জন্য। সেটা সম্পূর্ণ তোমার ইচ্ছার উপর ডিপেন্ড করে। তুমি ভেবে আমাকে জানিও আমি অপেক্ষা করবো। সাথে রাই ও।

রাজের কথা শুনে মাথা নেড়ে সায় দিলো রাকিব। তারপর দুজনে ছাদ থেকে নেমে নিচে চলে আসলো। রাহির মা বাবা ও রাকিব রাজকে ওদের বাসায় থাকতে বললে রাজ অন্য একদিন আসবে বলে বিদায় নিয়ে নিজের বাসায় ফিরে এলো।

চলবে,,,,,,,,,,

You are my property
Part_13
M Sonali

পুরো বাড়িটা ফুল এবং রংবেরঙের ছোট ছোট টিপটপ বাতিতে সাজানো হয়েছে। নিজের রুমে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে দেখছি আমি। বাড়িটাকে অন্যরকম এক সৌন্দর্য যেন ঘিরে রেখেছে চারিদিকে। ঠিক একই ভাবে সাজানো হয়েছিল কয়েক মাস আগেও আমাদের এই বাড়িটা। সেদিন ছিল আমার বিয়ে। কিন্তু বিয়েটা হয়ে ওঠেনি সেদিন। ঠিক একই ভাবে আজকেও সাজানো হয়েছে বাড়িটাকে। কারণ আজকে আমার ভাইয়ার বিয়ে। হ্যা আজকে রাই এর সাথে ভাইয়ার বিয়ে। সকাল থেকেই বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়েছে বেশ ধুমধাম করে। চারিদিকে আত্মীয়-স্বজন মেহমানে ভর্তি। সবার হৈ-হুল্লোড়ে যেন চারিদিকে মাতিয়ে রেখেছে পরিবেশটা। আমি চুপটি করে নিজের রুমে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সেগুলোই দেখছি। কিন্তু কেন জানিনা আমার ভেতরে কোন অনুভূতি কাজ করছে না। না লাগছে আনন্দ আর না লাগছে কষ্ট। যেন এক অথৈ সমুদ্রের মাঝে ভেসে আছি আমি। যার কোন কূল কিনারা নাই। আমি বুঝতে পারছিনা আমার এমন কেনো লাগছে। ভাইয়ার বিয়েতে আনন্দ করা নিয়ে আগে কত রকম স্বপ্ন দেখতাম আমি। কিন্তু আজকে তার কোনো কিছুই যেন আমার মাথায় কাজ করছে না। বরং নিজেকে সবার থেকে আলাদা করে গুটিয়ে রেখেছি একটি বন্ধু রুমের মাঝে। কিছু ভালো লাগছে না আমার। শুধু বার বার মনে হচ্ছে আমার জীবনটা কেন এমন হলো? হঠাৎ করে একজন ঝড়ের মত আমার জীবনে এসে কেন আমার জীবনটাকে এলোমেলো করে দিল? কিচ্ছু ভালো লাগছে না আমার কিচ্ছু না!

কথাগুলো জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ভাবছি আর নীরবে চোখের জল ফেলেছি আমি। হঠাৎ দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দে ধ্যান ভাঙলো আমার। আমি গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলাম। আর দরজা খোলার আগে নিজের চোখ টাকে ভালো করে মুছে নিলাম। যাতে কেউ বুঝতে না পারে আমি কান্না করেছি। দরজা খুলতেই ভাইয়া হাসিমুখে আমার রুমে ঢুকে পড়লো। তারপর দরজাটা হাল্কা ভিড়িয়ে দিয়ে আমার হাত ধরে নিয়ে এসে বিছানার উপর বসিয়ে দিলো। আমার সামনাসামনি বসিয়ে বলে উঠলো,

— কি রে এভাবে একা একা দরজা বন্ধ করে বসে আছিস কেনো তুই?

— এমনি আসলে মাথাটা একটু ব্যাথা করছিল তাই বসে আছি। তুমি আবার এখন এখানে আসতে গেলে কেন ভাইয়া! একটু পরেই না তোমার গায়ে হলুদ?

— সেজন্যই তো এখানে এসেছি আমার গায়ে হলুদ আর পুচকিটা সেখানে নেই এটা কি করে হয় বল? আচ্ছা তোর আসলে কি হয়েছে বল তো? তুই তো জানিস যে তোকে ছাড়া আমি গায়ে হলুদ করবো না। আমার পুচকি ছাড়া কি আর গায়ে হলুদ করা সম্ভব? চল আমার সাথে।

— আমার এখন ভালো লাগছে না ভাইয়া। প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে। তুমি যাও গায়ে হলুদে না থাকলাম তোমার বিয়ের সময় তো অবশ্যই তোমার পাশে থাকব তাইনা? আমি এখন একটু শুয়ে রেস্টে থাকতে চাই প্লিজ। আমাকে আর ডেকো না তুমি যাও ভাইয়া।

আমার কথা শুনে ভাইয়া বেশ কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর উঠে দরজার কাছে গিয়ে আবারও ফিরে এলো আমার কাছে। তারপর আমার পাশে বসে আমার হাতটা নিজের হাতের মাঝে রেখে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করল,

— আমি জানি রাহি কেন তোর মন খারাপ! আর কেন তুই এভাবে রুমের মাঝে বন্দী হয়ে আছিস। তবে আমি তোর বড় ভাই হিসেবে তোকে একটা কথাই বলতে চাই। মানুষের জীবনে এমন কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে যার জন্য মানুষ প্রস্তুত থাকে না। কিন্তু তাই বলে জীবন টাকে সেখানে থামিয়ে দিলে চলবে না। বরং এই ঘটনাটিকে মেনে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই হবে। তবেই সে বিজয়ী হতে পারবে নিজের জীবনে। আর তাছাড়া আমাদের অজান্তে এমন অনেক ঘটনা থেকে যায় যেটা আমাদের দৃষ্টিগোচর না হলেও আমাদের অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী এবং ভালো হয়ে থাকে। হতেও তো পারে তোর অজান্তে হয়তো এমন কিছু আছে যেটা তোর জন্য অনেক মঙ্গলজনক। আর তাই তুই এমন পরিস্থিতে পড়েছিস। তাই বলবো এভাবে নিজেকে গুটিয়ে না রেখে মুক্ত পাখির মতো নিজেকে উড়তে দে। পিছনের সবকিছু ভুলে গিয়ে নতুন জীবন শুরু কর রাজের সাথে। রাজ অনেক ভালো ছেলে। তুই হয়তো এখনো ওকে মেনে নিতে পারছিস না। তবে এমন যেন না হয় যে যখন ওকে তুই চাইবি তখন ও তোর জীবন থেকে হারিয়ে যায়। তখন কিন্তু আফসোসের সীমা খুঁজে পাবি না। জানিস তো গুরুজনেরা বলে “দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝা যায় না” তোর বেলায় যেন ঠিক এমনটা না হয় রাহি। আমি শুধু এটাই চাই। আমার কথাগুলো ভেবে দেখিস। আসছি,,,

কথাগুলো একনাগাড়ে বলে আমার পাশ থেকে উঠে দাঁড়ালো ভাইয়া। তারপর সোজা দরজা খুলে চলে গেল। আমি সেই আগের মতো একইভাবে বিছানায় বসে থেকে ভাইয়ার কথাগুলো ভাবতে লাগলাম। ভাইয়ার সব কথা ঠিক ভাবে না বুঝলেও কেমন যেন রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি আমি। আমার দৃষ্টির আড়ালে এমন কি ঘটেছে যেটা আমার জন্য ভাল অথচ আমি জানিনা? আর সত্যিই কি আমি রাজকে মেনে না নিয়ে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে রেখে অনেক বড় ভুল করছি? সত্যিই কি এর জন্য আমাকে পরে আফসোস করতে হবে? এসব কথা ভাবতে ভাবতে যেনো আমার মাথা ধরে যাওয়ার অবস্থা হল। আমার সারা পৃথিবী ঘুরতে লাগল চোখের সামনে। আমি নিজের মাথাটা চেপে ধরে চুপ্টি করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বেশ কিছুক্ষণ পর আবারও দরজায় টোকা শব্দে সেদিকে চোখ মেলে তাকালাম আমি। তাকিয়ে দেখলাম আম্মু একটি ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে হাসি মুখে। আমি আম্মুকে দেখে উঠে বসলাম। আম্মু রুমে এসে ব্যাগটি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন,

— রাহি এর মাঝে তোমার জন্য একটি ড্রেস আছে এটা পড়ে রেডি হয়ে নাও। রাকিবের গায়ে হলুদ সম্পন্ন হয়েছে একটু পরে তোমাকে ও বাড়ি যেতে হবে হলুদের বাটি নিয়ে। দেরি করো না তাড়াতাড়ি আসো।

কথাটি বলে ব্যাগটা আমার পাশে রেখে আম্মু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন। বিয়ের ব্যস্ততার কারণে অতিরিক্ত ব্যস্ত আছেন আম্মু। তাই হয়তো আমার কথা শোনার সময় হলো না তার। আমি কিছু না ভেবে ব্যাগটা খুললাম। তার মধ্যে অনেক সুন্দর একটি হলুদ রঙের লাল পাথর ও সুতার কাজ করা গাউন জামা। জামাটা সত্যিই অসম্ভব সুন্দর আর গায়ে হলুদের জন্য একদমই পারফেক্ট। খুবই পছন্দ হলো আমার জামাটা। জামাটা কে হাতে নিয়ে দেখছিলাম হঠাৎ খেয়াল করলাম জামা টার নিচে ম্যাচিং করা কিছু জুয়েলারি। সবগুলো জিনিসই অসম্ভব সুন্দর। আমি আর দেরি না করে হাসিমুখে সেগুলো নিয়ে রেডি হতে চলে গেলাম। সবকিছু পড়ে তারপর আয়নার সামনে বসে মুখে হালকা সাজ দিতে লাগলাম।

চোখে চিকন করে কাজল দিলাম, ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক।গলায় ও কানে ফুলের মালা ও দুল পড়লাম। হাতে ফুলের চুরি কপালে ফুলের টিকলি আর চুলে পড়লাম পুরো একটি ফুলের গাজরা। সবকিছু মিলিয়ে নিজেকে অপরূপ সুন্দরী লাগছে আয়নায়। নিজেকে দেখে যেন নিজের ক্রাশ খাচ্ছি আমি। বেশ কিছুক্ষণ আয়নায় নিজেকে দেখে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লাম আমি।

রুম থেকে বাইরে বের হতেই সবার নজর যেন আমাতেই আটকে গেল। সবাইকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে এবার বেশ লজ্জায় পড়ে গেলাম আমি। তখনই আম্মু আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন,

— বাহ আমার মেয়েটাকে তো আজকে ভীষণ সুন্দর লাগছে! সত্যিই জামা টাতে তোমাকে অসম্ভব সুন্দর মানিয়েছে। এখন যাও দেরি না করে সবকিছু রেডি করে রাখা আছে সেগুলো নিয়ে মেয়ের বাড়িতে যাও।এমনিতেই অনেক লেট হয়ে গেল।

আম্মুর কথায় কোন উত্তর না দিয়ে শুধু মুচকি হাসলাম আমি। তারপরে সবাইকে সাথে নিয়ে ডালায় সাজিয়ে রাখা সবকিছু নিয়ে গাড়িতে উঠে রওনা হলাম রাজের বাসার উদ্দেশ্যে। বাসার সামনে গিয়ে গাড়ি থামতেই সবাই এক এক করে নেমে গেলো বাসার মধ্যে। সবার পিছু পিছু আমিও বিয়ের ডালা হাতে এক পা এক পা করে এগিয়ে যেতে লাগলাম বাসার ভেতর দিকে। কেন জানি না আজকে এ বাসায় আসা তে অনেক বেশি নার্ভাস লাগছে আমার। বুকের মাঝে ধুকপুকানি যেনো প্রতিমুহূর্তে বেড়েই চলেছে। আর বারবার মনে হচ্ছে কেউ আমাকে এক নজরে তাকিয়ে থেকে দেখছে। কিন্তু কই আমি তো আসেপাশে তেমন কাউকে দেখতে পাচ্ছি না? তবে এমন অনুভূতি কেন হচ্ছে আমার? ভীষণ আনইজি ফিল করছি আমি এই মুহুর্তে।

এ সবকিছুর চিন্তাভাবনাকে দূরে ঠেলে রেখে এবার হাসিমুখে বাসার মধ্যে প্রবেশ করলাম আমি। প্রবেশ করতেই দেখি রাই একটি সুন্দর চেয়ারের ওপর হলুদ শাড়ি আর ফুলের গয়না পড়ে সুন্দর করে সেজেগুজে বসে আছে। আমি ওর পাশে গিয়ে দাড়াতেই মুচকি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

— আসতে এত দেরী করলে কেন ভাবি? আমি আর ভাইয়া সেই কখন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি!

রাই এর প্রশ্নে যেনো সব কথা হারিয়ে গেল আমার। কি উত্তর দিব কোন কিছুই খুঁজে পাচ্ছিনা আমি। তবে কেন জানি না চোখটা বারবার তাকে খুঁজছে। আমি আশেপাশে বারবার তাকাতে লাগলাম রাজ কোথায় আছে তাকে দেখার জন্য। কিন্তু ওকে কেন খুঁজছি আমি নিজেও জানিনা। হঠাৎ হাতে টান অনুভব করায় সে দিকে ফিরে তাকালাম আমি। আমার হাত ধরে টেনে দুষ্টু হেসে বলল রাই,

— কি ব্যাপার ভাবি আসার পর থেকে শুধু ভাইয়া কেই খুঁজে চলেছো! বলি ননদিনির দিকেও তো একটু নজর দিবে নাকি? আর আমি তো তাছাড়া তোমার এখন বড় ভাবি হতে চলেছি। বড় ভাবির কাছে থেকে বরকে খুঁজা কিন্তু মোটেও ঠিক নয়।

কথাগুলো বলেই দুষ্টুমি ভরা হাসি হাসতে লাগল রাই। ওর কথায় বেশ লজ্জায় পড়ে গেলাম আমি। সত্যিই তো আমি কেমন বেহায়ার মত ওর পাশে দাঁড়িয়ে থেকে রাজকে খুঁজে চলেছি। আর দুষ্টু টা ঠিক ধরে ফেলেছে। এখন নিজের লজ্জা টাকে যেভাবেই হোক লুকোতে হবে। তাই আমি ওর হাতে একটি চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে বললাম,

— এই ধরো এটা তোমাকে ভাইয়া দিতে বলেছে। তুমি পড়ো আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি।

কথাটি বলে যেন তাড়াতাড়ি পাশ কাটিয়ে ওখান থেকে সরে গেলাম আমি। আমার হাতে থেকে ভাইয়ার দেওয়া চিরকুট পেয়ে খুশিতে যেন গদগদ হয়ে গেল রাই। কিন্তু বেচেরি তো আর জানে না যে ওটা আসলে একটা সাদা কাগজ। যা লজ্জার হাত থেকে বাঁচার জন্যে ওকে মিথ্যে বলে দিয়েছি আমি।

রাই এর কাছ থেকে সবার আড়ালে গিয়ে একটি রুমের মাঝে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। রুমটাতে কেউই নেই। হয়তো এখন এই দিকে কেউ আসবেও না। তাই রুমের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে একা একাই হাসতে লাগলাম আমি। সত্যিই ভীষণ লজ্জা লাগছিল আমার রাই এর কথায়। যদিও জানি না আমার হঠাৎ এত লজ্জা লাগতে শুরু করলো কেন। আর কেনইবা আমি রাজকে এভাবে খুঁজে চলেছি চার দিকে। হঠাৎ রুমের মাঝের আলো নিভে যাওয়ায় ধ্যান ভাঙলো আমার। আমি অনেকটাই চমকে উঠে রুমের ভিতরে চোখ বুলাতে লাগলাম। রুমে এখন অনেকটাই অন্ধকার। দিনের বেলা হলেও জানালা দিয়ে হালকা আলোতে যতটুক আলোকিত হয়েছে ততটুকুই। আমি ভালোভাবে চারিদিকে তাকিয়ে থেকে দেখতেই একটি ছায়ামূর্তি দেখতে পেলাম। যে ছায়ামূর্তিটি ধিরে ধিরে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু আমি এবার ভয় পেয়ে যখন চিৎকার দিতে যাব, তখনি উনি দ্রুত এগিয়ে এসে আমার মুখটা চেপে ধরলেন। আমি চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম এটা আর কেউ নয় এটা হলো রাজ।

চলবে,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here