#মায়াবন_বিহারিনী🖤
#পর্ব_১৭,১৮
#আফিয়া_আফরিন
১৭
মায়া আর ইমন অবাক হয়ে দুজন দুজনার দিকে তাকিয়ে আছে। এত অবাক বোধ হয় তারা বহু বছর হয় নাই। ‘আজ তোদের বিয়ে’ কথাটা এখনো হজম হচ্ছে না। কথাটা কি সত্যি? সত্যি কি আজ তাদের বিয়ে? এটা স্বপ্ন নাকি সত্যি? এতদিন ধরে যে মানুষটাকে শুধুমাত্র কল্পনায় নিজের করে পেয়েছিল, সত্যিই এই মানুষটা বাস্তবে আসবে?
সত্যিই কি তবে শেষ পর্যন্ত বিয়ে হবে? অদ্ভুত এক শিহরন বয়ে গেল দুজনের শরীর বেয়ে।
অবশেষে নীলার সকল চক্রান্ত বিফলে গিয়ে মায়া আর ইমনের বিয়ে ঘোষণা করা হলো।
নীলার মাথা প্রচন্ডভাবে বিগড়ে আছে। সে কোন দিক দিয়ে শান্তি পাচ্ছে না। নীলার কথাটা সবাই জেনে গিয়েছে, তাই বিয়ের কাজকর্ম থেকে সুহাদা তাকে দূরে থাকতে বলেছেন। নিলাও মেনেছে, সে দূরে দূরে আছে। তার প্রচন্ড খারাপ লাগছে। ইমনের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বলে তার খারাপ লাগছে না, খারাপ লাগছে এই ভেবে যে সে হেরে যাচ্ছে।
তাহলে এখানে ভালোবাসাটা কোথায় নীলার? সবটাই মোহ, মায়ার উপর চরম রাগ।
.
.
এমনিতেই শেষ সময় নীলার মনে পড়ে গেল সেই ছবিগুলোর কথা। ফোন হাতে নিয়ে গ্যালারিতে ঢুকলো। দেখলো ছবিগুলো এখনো অক্ষত রয়েছে। ঠোটের কোন সূক্ষ্ম হাসির রেখা দেখা দিল। শরীরে এক ধরনের ফুরফুরে আমেজ এসে ভর করল।
ইমন আর মায়ার বিয়েটা যেহেতু হঠাৎ করেই হয়েছে তাই সেভাবে ব্যবস্থা করা হয় নাই। অর্থাৎ সম্ভব হয়ে ওঠে নাই। তবুও আয়োজনের কোন কমতি রাখা হয় নাই।
সবাই যখন বাড়ির কাজে ব্যস্ত, ইমন মায়ার বিয়ে নিয়ে যখন তোর জোর চলছে; তখন নীলা ইমনের ঘরে গেল। ইমন নিজে তখন রেডি হচ্ছিল। নীলাকে দেখে অটোমেটিকলি মেজাজটা বিগড়ে গেল। কিন্তু মুখে কিছু বলল না।
নীলা বলল, “তোমার সাথে কিছু কথা আছে।”
“তাড়াতাড়ি বলে বিদায় হো।”
নীলা ফোন বের করে ছবিগুলো বের করল। তারপর ইমনকে দেখালো। ছবিগুলো দেখে ইমন ভুরু কুঁচকালো। তারপর বলল, “কী?”
“কি সেটা বোঝনা কেন? দেখো মায়া আর একটা ছেলে।”
ইমন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিগুলো অনেকক্ষণ ধরে দেখলো। তারপর ওর কি মনে হলো, কে জানে? নীলার হাতে ফোনটা দিয়ে হাতের উল্টো দিক দিয়ে একটা চড় বসালো তার গালে।
নীলা সিনেমাটিক স্টাইলে গিয়ে দরজার চৌকাঠে বাড়ি খেলো।
ইমন ওর সামনে গিয়ে বলল, “আজ বা অতীতে যা কিছু ঘটে গেছে, তা সব তোর জন্য। এসব করে তুই কি পাচ্ছিস? এ সব করে কি ফায়দা তোর? দয়া করে রেহাই দে আমায়। তোর পায়ে ধরি।”
নীলা অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে আছে ইমনের দিকে। ইমন যে তাকে থাপ্পর মারতে পারে এটা ধারণার বাহিরে ছিল। ইমনের বলা প্রতিটা কথা বারবার রিপিট হচ্ছে মস্তিষ্কে। বিশেষ করে ‘সব কিছুর মূলে তুই আছিস’ এই কথাটা।
নীলা আদো উচ্চারণে বললো, “ছবিগুলো মিথ্যা ছিল না!”
ইমন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সোজা ছাদে উঠল। রাগ লাগছে তার প্রচন্ড। রাগটা কার উপর লাগছে সে নিজেও জানেনা। খোলা বাতাসে যদি মনটাকে সামান্য শান্ত করা যায়, সেই জন্য ছাদে আসা। নীলার কথাগুলো বারবার মনে পড়ছে, আর রাগের শরীর জ্বলে যাচ্ছে। এই রাগ নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে কি করে সে? শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হবে তো?
মায়াকে মিমো সাজাচ্ছিল। মাএই মহুয়ার সাথে কথা বলা শেষ করল মায়া। এভাবেই হুট করে বিয়েটা হয়ে যাচ্ছে বলে সে একটু মান করেছে। যত যাই হোক নিজের বোন, ছোট বোনের বিয়ে বলে কথা।
সবকিছু ছাপিয়ে রাত ঠিক দশটা একচল্লিশ মিনিট ইমন আর মায়ার বিয়েটা হয়েই গেল। একটা ভালোবাসা বোধ হয় বিয়ের মাধ্যমে পূর্ণতা পায়।
সাধারণত মেয়ে মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন গুলোর মধ্যে একটা হলো বিয়ে। সবাই চায় তাদের বিয়েটা যেন সুন্দর সাবলীল ভাবে হয়। মায়ারও তাই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সব পরিস্থিতিতে সবকিছু সম্ভব হয় না। তাও যে বিয়েটা হয়েছে, এটাই একমাত্র ভরসা।
মায়া এক পলক তাকালো ইমনের দিকে। কেমন যেন মুখ শক্ত করে বসে আছে। মনে হচ্ছে একে কেউ জোর করে নিম পাতার জুস খাইয়ে দিয়েছে।
সেই সময় মিমো এসে বলল, “মায়া আপু চলো।”
“কোথায় যাব?”
“কোথায় আবার? তোমার বাসর ঘরে। দেখো না কি সুন্দর করে সাজিয়েছি তোমাদের ঘরটা।”
মায়া খানিক লজ্জা পেল। তারপরেই উঠে চলে গেল।
নিলা নিরব দর্শক হয়ে দেখছিল সবকিছু। ছবিগুলো দেখার পর ইমন যে বিয়েটা করে নিবে, এটা সে ভাবতেই পারছে না।
মিমো মায়াকে ঘরে নিয়ে এলো। মায়া চারিপাশে একবার চোখ বুলালো। খুব সুন্দর হয়েছে সাজানোটা। এত কম সময়ের মধ্যে ওরা কিভাবে এত কিছু করলো, ভাবাই মুশকিল।
নীরবতা ভেঙ্গে মিমো বললো, “লক্ষী মেয়ের মতো চুপ করে বসে থাকো আপু থুক্কু ভাবি। তোমার বড় মশাইকে কিছুক্ষণের মধ্যেই পাঠাচ্ছি।”
.
.
.
.
স্বপ্নপূরণ হলে কেমন জানি অদ্ভুত লাগে। নিজেকে হয়তো পাগল পাগলও লাগে। মায়ার এমন মনে হচ্ছে। আজ জীবনের নতুন এক অধ্যায় পা দিয়ে কেমন কেমন জানি লাগছে!
অথচ কাল পর্যন্তও কেউ জানতো না তাদের ভালোবাসাটা এভাবে বিয়ের মাধ্যমে পরিপূর্ণতা পেতে চলেছে।
মায়া অনেকক্ষণ যাবত বসে আছে। কিন্তু ইমনের আসার কোন নাম গন্ধ নাই। বাইরের ঘর থেকেও কোন আওয়াজ আসছে না। সম্ভবত সবাই ঘুমোতে চলে গেছে। কিন্তু ইমন আসছে না কেন এখনো? কোথায় সে?
মায়া উঠে গিয়ে দরজা খুলে মিমোর রুমে উঁকি দিলো। সবাই ঘুম। সে ডাইনিং রু,ম ড্রয়িং রুম, বেলকনি সব জায়গায় ইমনকে খুঁজলো। কিন্তু কোথাও নেই। এত রাতে নিশ্চয়ই বাহিরে যাবে না।
তারপর মনে পরলো ছাদে থাকতে পারে। মায়া দরজা খুলে আস্তে করে ছাদে উঠলো। হ্যাঁ, ইমন এখানেই আছে।
এই রাত বিরাতে ঘরে বউ রেখে সাহেব আসছে বাতাস খেতে। মায়ার মেজাজ টাই গরম হয়ে গেল।
তবুও সে ঠান্ডা মাথায় বলল, “তুমি এখানে কেন?”
ইমন চমকালো না। যেন সে আগে থেকেই জানতো, মায়া আসবে।
ইমন এর উত্তর না পেয়ে মায়া আবার জিজ্ঞাসা করলো, “কি হলো কথা বলছো না কেন? কতক্ষণ যাবৎ অপেক্ষা করছি তোমার জন্য।”
ইমন মায়ার দিকে ফিরে বললো, “কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।”
“কিছু হইছে?”
“নাহ।”
“নীলা আপু নিশ্চয়ই মাথাটা আবার বিগড়ে দিছে। আমি ড্যাম শিওর। ও কিছু বলছে। ও যাই বলুক না কেন, আমার উপর তোমার বিশ্বাস রাখা উচিত।”
“আছেই তো।”
“তাহলে ঘরে আসছো না কেন?”
“নিজের রাগটাকে কন্ট্রোলে আনার চেষ্টায় আছি। কেন জানিনা খুব রাগ লাগতেছে!”
“আচ্ছা, আমাদের বিয়েতে কি তুমি খুশি নও?”
“তোর তাই মনে হলো? এভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে বিয়েটা হয়ে গেল, সেটা কোন ব্যাপার না। তাই বলে এটা মনে করিস না যে, আমি খুশি নই।”
“হুমম।”
“আচ্ছা যা। ঘরে যা গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। এভাবে রাতে ছাদে থাকা ঠিক না।”
মায়া মুখ কালো করে নিচে নেমে এলো। ভেবেছিল ইমন কে সাথে নিয়ে ফিরবে। কিন্তু ইমন তো তাকে একাই পাঠিয়ে দিল। বন্ধু-বান্ধবের কাছে বাসর রাত সম্পর্কে কত ইন্টারেস্টিং গল্প শুনেছিল। অথচ তার বাসর রাত তাই হলো এমন নিরামিষ মার্কা পান্তা ভাত। রাগে দুঃখে তার চোখে পানি চলে এলো। ইমন কি তবে বিয়ের পর পাল্টে গেল?.
.
ইমন কখন ঘরে এসেছিল কে জানে? মায়া সকালে ঘুম থেকে উঠে ইমনকে পাশে আবিষ্কার করলো। ওকে ডাক না দিয়ে নিজে ঘর থেকে বের হলো।
মিমো মায়া কে দেখা মাত্রই জিজ্ঞেস করলো, “কিগো আপামনি, বাসর রাত কেমন কাটলো?”
“ধুর তোর ভাই আস্ত একটা পাজি। রাতে তো ঘরেই ছিল না।”
“ছিলো না মানে? কোথায় ছিলো?”
“ছাদে উঠে বসে ছিলো।”
মিমো হা হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ কথা বললো না। তারপর মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে পড়লো।
মনে মনে বললো, “মা কি এদেরকে আলাদা থাকার জন্য বিয়ে দিয়েছিল?”
তারপর মায়া কে জিজ্ঞেস করলো, ” ভাইয়া কোথায় এখন?”
“ঘুমাচ্ছে।”
“ও।”
“আচ্ছা আমার মা বাবা কোথায় গেছে? দেখতেছি না কাউকে?”
“মামা মামি তোমার খালামনির বাসায় গেছে সকাল সকাল।”
“ওহ আচ্ছা।”
“আচ্ছা আপু তুমি যেয়ে ভাইয়াকে ডেকে নিয়ে আসো। ভাইয়ার এমনি অসুস্থ শরীর। হাতের কাটা দাগও এখনো শুকায়নি। খেয়ে নিক আগে। ডাক্তার আবার একগাদা ওষুধ দিয়ে গেছে।”
“আচ্ছা, আমি ওকে ডেকে নিয়ে আসছি।”
মায়া ইমন কে ডাকতে গেলো। সে ফজরের নামাজ পড়ে একেবারে ঘুমিয়েছে। তাই এখন মরার মত ঘুমাচ্ছে।
মায়া অনেকক্ষণ যাবৎ ডাকার পরও কোন সাড়া শব্দ করলো না ইমন। বিরক্তি নিয়ে সে বসে রইলো কিছুক্ষন।
“একে নিয়ে তো ভারী বিপদ। এমন কুম্ভকর্মের মতো ঘুমাচ্ছে। এত করে ডাকছি ওঠার নামগন্ধ নাই। শেষ পর্যন্ত এমন কুম্ভকর্ণ বর জুটলো আমার কপালে? কপালটাই খারাপ।”
তারপর মায়া পুনরায় চিৎকার করে বললো, “উঠলে না তো। ঠিক আছে আমি নীলা আপুকে ডেকে দিচ্ছি। সে এসেই উঠাক তোমায়। আমার কথা তো তোমার আবার গায়ে লাগে না।”
কথাটা বলেই মায়া উঠে যেতে নিলে, পেছন থেকে হাতে টান পড়ে। সে পিছন ফিরে তাকায়। দেখলো ইমন জেগে আছে।
মায়া ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, “তুমি জেগে ছিলে এতক্ষন?”
ইমন মাথা নাড়লো।
“তাহলে ডাকছিলাম সাড়া দাওনি কেন?”
“দেখছিলাম তুই কি কি করিস?”
“দেখছিলে না ছাই! এখন ছাড়ো। আর তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে দয়া করে খাইতে আসো।”
ইমন ছাড়লো না মায়াকে। উল্টো এগিয়ে এলো তার দিকে।
চলবে……..
[ কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ ]
#মায়াবন_বিহারিনী🖤
#পর্ব_১৮
#আফিয়া_আফরিন
মিমো বসে বসে প্ল্যান করছে, ইমন আর মায়াকে কাছে পিঠে কোথাও হানিমুনে পাঠাবে। এই নিয়ে শুহাদার সাথে অনেকক্ষণ ধরে আলোচনা করছে। কথা বলতে বলতেই কোনো এক ফাঁকে মিমো মুখ ফসকে বলে ফেললো, “ভাইয়া কাল তো ঘরেই ছিলো না। ছাদে উঠে নাকি বসে ছিলো। বলোতো এসবের কোনো মানে হয়?”
সুহাদা ভীষণ রাগ করলেন ছেলের উপর।
তিনি বললেন, “আজকে বাড়ি ফিরুক, এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। কি শুরু করছে ইমন? দুইদিন পর পর ওর এসব নাটক আমার সহ্য হচ্ছে না। বাড়ি ফিরুক আজকে, কপালে দুঃখ আছে ওর!”
তিনি গিয়ে মায়াকে ধমকে বললেন, “ইমন কাল ঘরে ছিলো না, তুই আমায় বলিস নি কেন?”
“তেমন কোনো ব্যাপার না তো, পরে আসছিলো ঘরে।”
“পরে আসা আর তখন যাওয়া কি এক হলো?”
এমন সময় ইমন বাহির থেকে ফিরলো।
ইমনকে দেখা মাত্রই তিনি কড়া ধমক দিলেন। ইমন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। কিছুই বুঝলো না।
সুহাদা আবার বললেন, “তোকে বিয়ে করাইছিলাম কি জন্য? চাইছিলাম তোদের মধ্যকার মান অভিমান গুলো মিটে যাক। কিন্ত, দুজনে সেই আলাদাই রইলি? তোদের নিজেদের জেদ ধরে বসে রইলি? বলি যে, বিয়ে করলি কি জন্য তুই?”
এইবার ইমন ব্যাপার টা ধরতে পারলো। বাতাসের আগে কথাটা ছড়িয়ে গেছে, তাহলে।
ইমন উত্তরে হাসতে হাসতে বললো, “বিয়ে করেছি বউকে শোকেসে সাজিয়ে রাখার জন্য!”
ইমনের রসিকতায় মায়া আর মিমো দুজনে হেসে উঠলো।
সুহাদা রাগে ফোস ফোস করতে করতে বললেন, “এত বড় বড় দা’ম’ড়া পোলাপান, এখনো নিজের ভালো-মন্দের দিকটা বোঝেনা। যা মন চায় কর। আমি কিছুই বলবো না। আমি তোদের কোন কাহিনীর মধ্যেই নাই।”
তিনি চলে যাওয়ার পর ইমন মায়াকে বলল, “ঘরে আয়, কথা আছে তোর সাথে।”
মিমো মায়াকে কোনুইতে ধাক্কা দিয়ে বলল, “যাও যাও। গিয়ে শোনো তোমার বর কি আবদার করে!”
“তুই না দিন দিন খুব অ’শ্লী’ল হয়ে যাচ্ছিস!”
“ছি ভাবি জান, এসব বলতে হয় না। আমি তোমাদেরকে সেটিং করানোর ব্যবস্থা করছি। মানে ব্যাপারটা দাঁড়ালো, যার জন্য করলাম চুরি সেই বলে চোর।”
“ভাগ।”
মায়া ঘরে ঢুকলে ইমন ওকে মুখোমুখি বসিয়ে বলল, “তোর সাথে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আছে।”
“হ্যাঁ বলো।”
“শোন, এখন যে কথাগুলো বলব মন দিয়ে শুনবি। মনে করিস না যে আমি তোকে সন্দেহ করছি, বা ভুল বুঝছি। আমি জাস্ট জানতে চাচ্ছি।”
“আচ্ছা বলো।”
“নীলা আমাকে একটা ছেলের সাথে তোর কয়েকটা ছবি দেখিয়েছি। সেই ছেলেটা কে?”
মায়া অবাক হল। নীলা আবার কার সাথে তার ছবি দেখালো?
মায়া বলল, “আমি জানিনা। ছবিগুলো দেখলে হয়তো বলতে পারতাম, কে সেই ছেলেটা।”
“আচ্ছা। কিন্তু ওই ছেলেটাকে আমি দেখেছি।”
“কে? আর কোথায় দেখেছো তাকে?”
“নাম তো আমি জানিনা। তবে সেদিন রাতে তুই আর মিমো আইসক্রিম খাওয়ার জন্য বাইরে গেছিলি, তখন ওই ছেলের সাথে তোদেরকে কথা বলতে দেখছিলাম অনেকক্ষণ পর্যন্ত।”
“আবির!”
“হবে হয়তো। ওর বাসায়ই গেছিল সেদিন?”
“হুমমম।”
“কে সেই ছেলেটা? তোর সাথে পরিচয় হলো কিভাবে?”
মায়া চুপ করে গেল। বলাটা ঠিক হবে কি? অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলো বলেই দিবে। কিন্তু আবিরের ব্যাপারটা বলতে গেলে তো মিমোর কথা উঠবে। আর মিমো তো কথাটা আপাতত কাউকে বলতে মানা করছে।
“বলবো। তার আগে একটা শর্ত আছে।”
“কি শর্ত?”
“মিমোকে এসব ব্যাপারে কিছু বলবে না।”
“মিমো কি এসবে কোন ভাবে জড়িত?”
“মিমো যেমন তোমার বোন, ঠিক সেরকম সে আমারও বোন। ওর ভালো মন্দের দায়িত্ব দেখার ব্যাপারটা আমার মাথায় ও আছে। তুমি ওকে নিয়ে ভেবো না।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। এখন আবিরের ব্যাপারটা বল।”
“সব বলছি। তবে আবিরের ব্যাপারটা তোমায় আমি বলবো না। সরাসরি দেখা করাবো আজকে তোমার সাথে আবিরের। ওখানে গিয়েই তুমি ওর সাথে কথা বলে সব কনফিউশন দূর করে এসো।”
“দেখা করাবি?”
“হ্যাঁ। না হলে সব কিছু বুঝবে না। এভাবে আমি বললে পুরো ব্যাপারটা ধরতে পারবা না।”
“আচ্ছা।”
.
.
.
বিকেলের একটু আগে আগে মায়া আবিরকে ফোন করে জানালো দেখা করার কথা। খুব জরুরী কথা আছে। আবির রাজি হল।
বলল, “পাঁচটার পর একদম ফ্রি আছি। তারপর যেকোনো সময়, যেখানে দেখা করতে বলবা সেখানেই দেখা করতে পারবো।”
“আচ্ছা, ওই লেকের পাড়েই আসো।”
“ওকে আপু। আমি সাড়ে পাঁচটায় থাকবো ওখানে। খুব কি জরুরী কথা আছে?”
“বলতে পারো। আচ্ছা রাখছি, দেখা হলে কথা হবে।”
সকাল থেকেই মায়া নীলাকে দেখেনি। ব্যস্ততার মধ্যে নীলার খোঁজ নেওয়ার সময় হয়নি। কাল রাতেও তো সে বাসায় ছিল। তবে কি সকাল সকাল বাড়ি ফিরে গেল নাকি? বাড়ি গিয়ে থাকলে তো মায়ার সাথে দেখা করে যাওয়ার কথা। কিন্তু একবারও দেখা হলো না ওর সাথে!
মায়া আপাতত নীলার কথাটা কাউকে জিজ্ঞেস করল না। সবার মাথা এখন ঠান্ডা আছে, নীলার কথা উঠলে একেকজন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবে। তার চেয়ে থাকুক সবাই শান্তিতে! অশান্তি বাড়িয়ে কোন লাভ নেই।
বিকেলবেলা মায়া ইমনকে নিয়ে লেকের পাড়ে এলো। দেখালো আবির আগেই এসেছে।
মায়া ইমন এর সাথে আবিরের পরিচয় পরিয়ে দিল। আবির কে বলল, “এই মহাশয় আমার জামাই!”
আবির সোজা আকাশ থেকে টুপ করে মাটিতে পড়ল। কোনমতে তুতলিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তু-তুমি বিয়ে করেছ কবে আপু?”
“গতকাল।”
“সিরিয়াসলি? বিশ্বাস হচ্ছে না আমার।”
“হ্যাঁ সত্যি। একটা কারণে হঠাৎ করেই বিয়েটা করে নিতে হলো।”
আবির ইমনের দিকে তাকিয়ে হাসলো। ইমন ও উত্তরে পাল্টা হাসি দিলো।
আবির বলল, “তুমি যেন কি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চেয়েছিলে?”
“এমনিতেই। ওর সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দিতে এলাম।”
মায়া তো আর বাইরের কারো সামনে ইমনকে ছোট করতে পারেনা। সে যে সন্দেহের খাতিরে এসেছে, সেটা তো আর আবির কে বলা যায় না।
আবির বলল, “ভালো করেছো। ভাইয়ার সাথে পরিচয় হয়ে ভালো লাগলো। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বিয়েতে দাওয়াতটা পাইলাম না।”
মায়া কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই ইমন বললো, “সমস্যা নাই। আবার যখন বিয়ে করবো তখন ইনশাআল্লাহ দাওয়াত পাবা।”
আবির আর মায়া দুজনেই ইমনের দিকে অবাক হয়ে তাকালো।
ইমন থতমতো খেয়ে মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “না মানে, এটা তো কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া বিয়ে। পরে যখন আবার ধুমধাম করে বিয়ে করবো, আমি তখনকার কথা বলছি।”
মায়া মুখ তাকিয়ে বলল, “ইশশশ, সেগুড়ে বালি!”
তারপরে তারা আরও অনেকক্ষণ গল্পগুজব করল। আবির চলে যাওয়ার পর ও মায়া আর ইমন বেশ কিছুক্ষণ লেকের পাড়ে বসে গল্প করেছে। পানিতে পা ভিজিয়েছে।
তারপর সূর্য ডোবার মুহূর্তে বাড়ি ফিরে এসেছে।
.
.
বাড়ি ফিরে এসে নাস্তা করে কিছুক্ষণ সবাই মিলে গল্প করলো। তারপর যে যার ঘরে নিজের কাজে চলে গেল।
মায়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ টা দেখছিল। সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে। অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু অন্যরকম! আবহাওয়া টাও খুব ভালো। ঠান্ডা ঠান্ডা একটা ভাব আছে। আশেপাশে কোথাও সম্ভবত গোলাপ ফুলের গাছ আছে, মিষ্টি একটা ঘ্রাণ বাতাসে ভেসে ভেসে নাকে আসতেছে। মায়া চোখ বন্ধ করে সেই ফুলের ঘ্রাণটাই উপভোগ করছিল। অদ্ভুত সুন্দর!
এমন সময় ইমন এসে তার পাশে বসলো। মায়া চোখ খুলে তার দিকে তাকালো। প্রথমত দুজনের কেউ কথা বলল না। মায়ার মতো ইমন ও রাতের আকাশটাকে দেখছিল। অজস্র তারায় ভরপুর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে মন্দ লাগছে না!
ধ্যান ভেঙে মায়া বলল, “কি এইবার সব কনফিউশন দূর হলো তো? এতদিন তো কত কথা শুনতে হল এর জন্য।”
ইমন নিজের কানে ধরে বলল, “সরি।”
“আচ্ছা, সরি বলতে হবে কেন? সবকিছুকে পিছনে ফেলে আমরা তো এক হতে পেরেছি।”
“আচ্ছা তুই তখন মিমো কে কি বলতে মানা করছিলি?”
মায়া এক মুহূর্তের জন্য থমকালো। মিমোর প্রসঙ্গ যখন আসে নাই, তখন তো এই বিষয়ে কথা বলে লাভ নেই।
“বাদ দাও এখন এই কথা। মিমোর বিষয়টা আমি সময় এলে তোমাকে জানাবো। এখন জানালেও কোন সমস্যা নাই, কিন্তু সেটা মিমো হয়তো মাইন্ডে নিবে।”
“আচ্ছা, ব্যাপার না। তোদের ননদ ভাবির ব্যাপারে আমি না হয় নাক নাই গলালাম!”
“হ্যাঁ সেটাই বেটার হবে। আচ্ছা নীলা আপু কি চলে গেছে?”
“হ্যাঁ। ভালো হইছে আপদ বিদায় হয়েছে। বাবারে বাবা, এই কয়দিন কি নাটক গুলো দেখাইলো? এখন শান্তি শান্তি লাগতেছে। ওর জন্য তোকে কত কথা শুনালাম, কত ভুল বুঝলাম। অথচ আমাদের এত বছরের সম্পর্কে কখনোই এমন হয় নাই।”
“তবুও শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসটা তো রাখতে পারছো, এটাই অনেক।”
“বিশ্বাস রাখার যোগ্য হলে, শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস তো থাকতেই হবে। আচ্ছা এখন যা, গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।”
বলেই
ইমন উঠলো।
মায়া ক্ষোভে গাল ফুলালো। সে চেয়েছিল একবার ইমন কে জড়িয়ে ধরতে। অনেকক্ষণ যাবৎ মনের ভিতর এই ইচ্ছাটা পোষণ করে রেখেছিলো। কিন্তু কেমন জানি লজ্জা লজ্জা লাগছিল। বিয়ের পর থেকে ইমনের দিকে তাকাতেও কেমন জানি লজ্জা লাগে! বারবার কাছে যেতেও সংকোচ বোধ হয়। অথচ, এই মানুষটা এখন তার স্বামী!
আর ইমনটাও কেমন হয়ে গেল? বিয়ের আগে তো বাড়াবাড়ি বেশি ছিল। আর এখন? বোধহয় তার খেয়ালই নাই তার একটা বউ আছে।
মায়া মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “মানুষের যখন অধিকার থাকে না, তখন না থাকা অধিকারের জন্য কত অভিযোগ করে। অথচ সেই অধিকারটা চলে এলে তার প্রতি কেমন উদাসীনতা দেখায়!
.
.
নীলা জানালার গ্রিল চেপে ধরে বসে আছে। তার খারাপ লাগছে না, কিন্তু কেমন জানি একটা অদ্ভুত রকমের অনুভূতি হচ্ছে। ইমন তো তার জন্য কখনোই ছিল না। তবে কি সে ইমনের দিকে এগিয়ে ভুল করেছে? তবে এখন কি মায়া আর ইমনের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়ানোটা ঠিক হবে না? শুধু ঠিক হবে নাকি, ওদের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে তো আর কোন লাভ নেই। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক হলে একটা কথা ছিল, কিন্তু তারা এখন বিবাহিত।
একরকম দোটানোর মধ্যে পড়ে গেল নীলা। কেমন জানি খুব অসহায় অসহায় লাগছে। সব কিছু তো তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
শুধু মনে হচ্ছে, “এখন কি করা উচিত আমার?”
.
.
ইমন বসে বসে ওয়ানডে ম্যাচ দেখছিল টিভিতে। রাত একটা বেজে পার হয়েছে। সবাই ঘুমাচ্ছে, তাই মায়া একা বসে বসে বোর হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, ডিসের লাইনের তারটা কেটে দিয়ে আসে!
একবার ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করছে, আরেকটা খাটে হেলান দিয়ে বসে বই পড়ছে। কিন্তু কিছুতেই সময় যেন কাটছিল না, অদ্ভুত ব্যাপার! ঘড়ির কাটাও মাঝে মাঝে মনে হয় বেইমানি করে। যখন সময়ের চলে যাওয়া লাগে, তখন কিছুতেই যেতে চায় না। আর যখন আমরা কিছু সময় আটকে রাখতে চাই, তখন চোখের পলকেই হাওয়া!
কিছুক্ষণের মধ্যেই ইমন এসে ঘরে ঢুকলো। মায়া তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর হুট করেই দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল।
বলল, “কতক্ষণ ধরে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, জানো?”
ইমনও ওকে জড়িয়ে ধরলো, খুব শক্ত করে।
তারপর ওর কি মনে হলো কে জানে?
আহ্লাদি কণ্ঠে বলে উঠলো,
“তুই আমার কালনাগিনী,
আমি তোর রাজনাগ!
এভাবেই জাপটে ধরে,
সারা জীবন থাক!”
.
.
.
.
চলবে…..
[কাটেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]