#তুলি_কোথায়,২য়_পর্ব
#Misk_Al_Maruf
পিছনে তাকানোর আগেই অজানা এক শক্তি আমার মুখের পাশ দিয়ে রুমাল জাতীয় কিছু একটির ছোঁয়া দিলো। আমি সেই সত্ত্বাকে দেখার আগেই মূর্ছা গেলাম। এরপর আর কিছু মনে নেই।
আশেপাশে কারো চেচামেচি শুনে আমার ঘুম ভাঙলো। চোখ খুলতেই দেখি আমার চারপাশে বাড়ির সবাই দাঁড়িয়ে আছে এবং কেউ কেউ আমার বিছানার পাশে বসেই ভয়ার্ত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে চোখ খুলতে দেখেই ছোটবোন মিলা খানিকটা উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
“আব্বু! ঐযে ভাইয়ার জ্ঞান ফিরেছে।”
ওর কথা শুনে সবাই আমার দিকে তাকাতেই আমি বিছানা থেকে ওঠার চেষ্টা করি। কিন্তু মনে হলো মাথায় কেউ বোধহয় পঞ্চাশ কেজি ওজনের বস্তা চাপিয়ে মাথাটা ভার করে ফেলেছে। মা আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন,
“থাক! শুয়ে থাক এখন ওঠার দরকার নেই।”
পাশ থেকেই আমার চাচী বলেন,
“দেখছেন? আমি বলছিলাম না এটা সত্যিই জ্বীনের কাজ? তুলির পর এখন ওর উপরেও কুনজর পরেছে জ্বীনের। কিভাবে ঘর থেকে ওকে উঠিয়ে নিয়ে গেলো বুঝতে পারছেন?”
পাশ থেকে মুনিম উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,
“চাচী! মারুফ ভাইয়াকে উঠিয়ে নিয়ে যায় নি বরং মারুফ ভাইয়া নিজেই ঐ জ্বীনকে ধরার জন্য সাহস করে বের হয়েছিল রাতে।”
আমার বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন,
“তুই কিভাবে জানলি যে ও নিজেই জ্বীনকে ধরার জন্য বের হয়েছে?”
মুনিম থতমত খেয়ে বলে,
“আরে কালকে সন্ধ্যায় ভাইয়াকে যখন ঐ জ্বীনের কথা শোনাই তখন তিনি আমাকে বলছিলেন যে ‘আজকে রাতেই দেখবো কোন জ্বীন বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়’ এই কথার মানেতো এটাই যে ভাইয়া হয়তো উঠানে সেরকম কিছু দেখেই ঘর থেকে বের হয়েছে, তাই নাহ?”
মুনিমের কথা শুনেই সবাই সন্দেহ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। তাদের সন্দেহকে সত্যি প্রমাণ করার জন্য আমি নিরবতা ঠেলে বললাম,
“হ্যাঁ! মুনিম ঠিকই বলেছে! আমি নিজ ইচ্ছাতেই বের হয়েছিলাম, কোনো জ্বীন আমাকে বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়নি।”
মা চিন্তিত এবং রাগান্বিত স্বরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তুই জানিস এই বাড়িতে খারাপ জিনিসের কুনজর পরেছে তবুও তুই কোন সাহসে আমাদের কিছু জিজ্ঞেস না করে রাতে বের হলি? এমনিতেই তুলির কোনো খোঁজ পাচ্ছি না তারউপর তোর যদি কিছু হয়ে যেতো তাহলে আমার কি হতো?”
এই বলেই তিনি শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে কেঁদে দিলেন।
এই মুহূর্তে মায়ের প্রতিউত্তরে পাল্টা কিছু বলার সাহসও আমি পাচ্ছি না, কেননা ওটা যে সত্যি ভূত বা জ্বীন জাতীয় কিছু ছিল তা নিয়ে আমার মনে বিস্তর সন্দেহ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। আর এসব যদি ওনাদের বলি ওনারা কখনোই বিশ্বাস করবেন না।
বাবা আর আমি পাশাপাশি একান্তে বসে আছি। মূলত এই মুহূর্তে আমার একমাত্র ভরসার স্থল তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। এই বাড়ির একমাত্র ব্যক্তি হলেন আমার বাবা যিনি ভূতপ্রেতে কম বিশ্বাস করেন। এরমানে এই নয় যে জ্বীন জাতি বলতে কিছু আছে সেটাকে তিনি অস্বীকার করেন।
আমি বেশ সন্দেহভরা মনে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম,
“আচ্ছা আমাকে একটা জিনিস বলোতো, বাড়ির উঠান দিয়ে যে রাতের বেলা এরকম সাদা কাপড় পরা কেউ ঘুরে বেড়ায় এটা কে কে দেখেছে?”
আমার কথা শুনে তিনি নির্লিপ্ত স্বরে বললেন,
“আমি দেখিনি! কিন্তু তোর ছোট ভাই আর চাচা চাচী নাকি দেখছে। আর তোর মাকেতো চিনিসই, সে এসব কথা কারো মুখে শুনলে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে তাই এসব নিয়ে তার এতো মাথাব্যাথা।”
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে তাকে পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম,
“আচ্ছা তোমার কি বিশ্বাস হয় যে ওটা আসলেই অন্য কোনো সত্ত্বা মানে জ্বীন বা ভূত জাতীয় কিছুই হবে?”
এবার তিনি চিন্তিত স্বরে বললেন,
“আমি আসলে কি বলবো, বলতে পারিস মাঝামাঝি অবস্থানে আছি। প্রথমেতো ভাবছিলাম কেউ হয়তো ফাইজলামি করে কিন্তু তুলি আর তোর ঘটনা থেকে কিছুটা হলেও সত্য বলে মনে হচ্ছে।”
বাবার কথা শেষ হতেই আমি হুট করে বলে উঠি,
“তোমার পরের ভাবনাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। মানে ওটা আসলে ভূতটুত কিছুনা।”
তিনি কৌতূহল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন।
“তুই কিভাবে বুঝলি?”
“কারণ জ্বীনের কোনো কাজকাম নেই যে আমাকে ক্লোরোফরম দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে যাবে। জ্বীনের যদি এতোই পাওয়ার থাকে তাহলে এসব ব্যবহার করার কি দরকার?”
“বলিস কি? ঘটনা তাহলে এই?”
“হুম এসব যেনো কারো কানে না যায়। আমি আজ কালকের মধ্যেই ওকে ধরে ফেলবো। তার আগে বলো কারো সাথে আমাদের তেমন শত্রুতা আছে নাকি?”
তিনি কিছুক্ষণ ভেবে বললেন,
“হুম কিছুটা আছে। পাশের পাড়ার কবির বেশ কয়েকমাস ধরে আমাদের জ্বালাতন করছে। ও চায় আমরা যেন এই বাড়িটা ওর কাছে বিক্রি করে অন্যত্র চলে যাই এমনকি মোটা অঙ্কের টাকাও অফার দিয়েছে। কিন্তু আমরা কি এতো সহজেই তোর দাদা দাদীর স্মৃতি ভুলে এখান থেকে চলে যাবো নাকি?”
বাবার কথা শুনে সরাসরি সন্দেহটা আমার ঐ কবিরের উপর গিয়ে পরলো। তবুও প্রমাণ ছাড়া কোনো কাজ করাতো ঠিক নয়। তাই আরো কিছু টুকটাক কথা বলে বাবার থেকে বিদায় নিলাম।
কিছুক্ষণ আগেই বাড়িতে পুলিশ এসেছে। কিন্তু তাদেরকে সবকিছু শেয়ার করার পরও তাদের কথাবার্তার যে অগ্রগতি তাতে মনে হলো না যে আশানুরূপ কোনো ফল পাওয়া যাবে। তাছাড়া তুলি যে হঠাৎ করে রাতের বেলাতে নিখোঁজ হয়ে গেলো সেটা শুনে একজন কনস্টেবল বলেই ফেললেন,
“যদি মেয়ের অন্য কোথাও সম্পর্ক না থাকে তাহলে এটা নিশ্চিত ভৌতিক কাজ। আপনারা কবিরাজ দেখাতে পারেন, আমরাও চেষ্টা করে দেখি কিছু করা যায় কিনা। আপনাদের বাড়িটা বেশ পুরাতন আর এসব বাড়িতে ভূতপ্রেতের উপস্থিতি থাকে অনেক বেশি।”
তার এমন কথা শুনে মুহূর্তেই আমার প্রচন্ড রাগ উঠলেও সরাসরি কিছু বলার সাহস করলাম না। উল্টো পেটভরে নাস্তা খেয়ে প্রস্থান করলেন তারা।
পুকুরের ঘাঁটে একা একা বসে আছি আর মন দিয়ে ভাবছি যে কি করা যায়? কিন্তু সেরকম কোনো আশানুরূপ বুদ্ধিই মাথায় আসছে না। হঠাৎই আমার চেতনা ফিরলো, হ্যাঁ সিসি ক্যামেরা! সিসি ক্যামেরা লাগালেই বুঝা যাবে যে ওটা আসলেই কোনো অলৌকিক সত্ত্বা নাকি ভূতের ভান ধরা কোনো মানুষ? কিন্তু এখনো আমি বুঝতে পারছি না যে ওটার সাথে তুলির নিখোঁজের কোনো যোগসূত্র আছে কিনা?
এসব ভাবতে ভাবতেই চিন্তা করলাম আজকেই তাহলে একটি ওয়্যারলেস সিসি ক্যামেরা কিনে ফেলতে হবে যেনো তারের ঝামেলা ছাড়াই জায়গা মতো সেট করা যায়। ভাবনার শেষে আমি ঘাঁট থেকে উঠে গেলাম।
বহুদিন পর বাড়িতে আসায় বাড়িটা একনজর ঘুরে দেখার ইচ্ছা জাগলো। পুরো দুই একর জায়গার উপর আমাদের বিশাল বাড়িটি, এর মধ্যে রয়েছে বাংলো, বিশাল এক ঘাঁট বাধানো পুকুর তাছাড়াও বাড়ির আশেপাশে রয়েছে প্রচুর গাছপালা এবং বাগান। যে কেউ প্রথমবার আসলে বলবে এটা অ্যামাজন জঙ্গলের থেকে কোনো অংশে কম নয়।
পুরো বাড়ি ঘুরতে ঘুরতে আচমকাই আমি বাড়ির পিছনের দিকটায় চলে আসলাম। বাড়ির পিছনের দিকটায় সচরাচর কারো আসা যাওয়া হয় না, এমনকি অনেকের ভাবতে অবাক লাগলেও জীবনে মনে হয় এই প্রথম আমি পিছনের দিকটায় এসেছি। মূলত এখানে বিষাক্ত সাপ এবং পোকামাকড় এর ঝুঁকি থাকার ফলেই আসা হয়না। কিন্তু আজ কি মনে করে যেনো পিছনের দিকের জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পরলাম। হঠাৎ করেই আমার মনে হলো কেউ খুব সূক্ষ্ম স্বরে চিৎকার করে কাউকে ডাকছে। তিন চারশ মিটার দূর থেকে ডাকলে যেরকম সাউন্ড হয় ঠিক সেরকমই। কিন্তু অবাক করা ব্যপার হলো চিৎকারের আওয়াজটা অনেক দূর থেকে মনে হলেও আমার মন বলছে ডাকটা হয়তো খুব কাছ থেকেই ডাকছে। তার থেকেও অবাক করা ব্যপার গলার স্বরটা অনেকটাই মেয়েলি কণ্ঠস্বরের মতো। কিন্তু বাড়ির শেষ অব্দি গিয়েও ডাকের কোনো উৎস আমি খুঁজে পেলাম না। বেশ কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ ঘোরার পর অনেকটা নিরাশ হয়েই সেখান থেকে চলে এসেছি কিন্তু ডাকের উৎস আর খুঁজে পাইনি। ইতোমধ্যে মেয়েলি কণ্ঠস্বর এর ডাক টাও আস্তে আস্তে নির্জীব হয়ে গেলো।
গভীর রাত…
ঘাঁটের ঠিক পাশ দিয়েই দুই দিকে দুটি ওয়্যারলেস ক্যামেরা লাগিয়ে দিয়েছি। সেই সন্ধ্যা থেকে অপেক্ষা করছি কখন সেই জ্বীনটি ক্যামেরার মধ্যে চলে আসবে, এদিকে আমার উত্তেজনার বশে চোখে ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেই।
অপেক্ষার পালা শেষে আচমকাই রাত তিনটার দিকে আমার হুঁশ ফিরলো যখন দেখতে পেলাম এক মধ্যবয়সী একটি মানুষের মতোই অবয়ব সাদা কাপড় পরে ঘাঁটের ঠিক পশ্চিম দিকটাই চলে যাচ্ছে। আর পশ্চিম দিকের সোজাসুজি আমাদের বাড়ির পেছনটা যেখানে আমি বিকালেই এক মেয়ের চিৎকার শুনেছি। আমি আর একমুহূর্ত দেরী না করে ধীরপায়ে নিজের ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলাম। আজ পূর্ণিমা রাত হওয়ায় সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আজকে আর গতদিনের মতো রিস্ক নিলাম না বরং মুখের মধ্যে একটি গামছা পেঁচিয়ে নিয়েছি। বলা তো যায় না যদি আজকেও আমাকে সেভাবেই অজ্ঞান করার চেষ্টা করে তবে সমস্ত পরিশ্রমই ভেস্তে যাবে।
কোনোরকম বাড়ির দরজাটা খুলেই খুব সাবধানতার সাথে পা ফেলতে ফেলতে ঘাঁটের কাছে চলে এসেছি। কাছাকাছি আসতেই বেশ কিছুটা দূরে পূর্ণিমার আলোতে প্রতিফলিত হওয়া সাদা কাপড় পরিহিত জ্বীনটি আমার দৃষ্টিগোচর হলো। আস্তে আস্তে অবয়বটির পিছু নিয়ে আমি বাড়ির পেছনের দিকটায় চলে এসেছি। অবয়বটি ক্রমেই ঝোপঝাড় পেড়িয়ে এগিয়ে চলছে বাড়ির পেছনের জঙ্গলের দিকে। মনে অজস্র সাহস সঞ্চয় করে এবং ভয়কে জয় করে আমি আর দেরী করলাম না বরং দ্রুতপায়ে দৌড় দিয়ে অবয়বটিকে শক্ত করে ধরেই মাটিতে ঝাপিয়ে পরলাম। হয়তো জ্বীন বাবুজি নিজেও কল্পনা করেনি তার উপর এভাবে কেউ চড়ে বসতে পারে। মুখের ওপর থেকে কাপড়টা যখনি সরাতে যাবো তার আগেই…
(To be continued)