টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০৩),১৭,১৮
লেখা: ShoheL Rana শামী
পর্ব:-১৭
সঙ্গীর রক্তাক্ত হাত দেখে আরেকজন মিলিটারি হাতের লাঠিটা বগলে ধরে সঙ্গীকে হেল্প করতে ছুটে এলো। তাকে ধরে গাড়িতে তুলতে চাইলে উত্তেজিত জনতার ভিড় থেকে আরও কতগুলো ঢিল এসে পড়লো তাদের উপর। দ্রুত ওরা আহত মিলিটারিকে গাড়িতে তুলে নিলো। বর্ম পরা বেশ কয়েকজন মিলিটারি এবার লাঠি হাতে রিহানদের দিকে ছুটে এলো। লাঠিচার্জ করতে লাগলো। পিছিয়ে এলো রিহান ইউসুফকে নিয়ে। এ মুহূর্তে কিছু করতে গেলে বিপদ বাড়বে। পরিস্থিতি শান্ত হওয়া প্রয়োজন। মিলিটারিরা কয়েকটা ভাগ হয়ে লাঠিচার্জ চালিয়ে যেতে লাগলো। তাড়া খেয়ে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। রাস্তাটা সাফ করে দিলো ওরা কয়েক মিনিটেই। একটা মহিলা তখন পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এলো। মিলিটারির গাড়ির দিকে এগোতে চাইলে দুজন মিলিটারি তার দুহাত ধরে আটকে রাখলো। মহিলাটা চিৎকার করতে লাগলো, ‘আমার পোলা কই? আমার পোলা কই? আপনেরা ওরে মাইরা ফেলছেন। লাশডা দিয়া যান।’
মহিলাকে ছুটে যেতে দেখে বাকি যারা স্বজন হারিয়েছে, তারাও সাহস পেল লাশের কাছে যেতে। কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসছিল ওরা। ওদেরকে ছুটে আসতে দেখে একজন মিলিটারি মহিলার পায়ের গোড়ালিতে লাঠির বাড়ি মারতে মারতে চলে যেতে বললো উর্দুতে। আরেকজন আকাশের দিকে ফাঁকা গুলি ছুড়ে ভয় দেখালো। গুলির আওয়াজ শুনে মাঝপথেই থেমে গেল ছুটে আসা স্বজনরা। মহিলাটা রাস্তায় হাঁটুগেড়ে বসে কাঁদতে লাগলো ছেলের জন্য। মিলিটারির গাড়িটা লাশ নিয়ে চলে গেল। রিহান এবার সাহস করে এগিয়ে গেল মহিলাটার দিকে। হাত ধরে তুলতে চাইলে মহিলাটা হাতের ইশারায় সামনে দেখিয়ে বললো, ‘আমার পোলাডার লাশটাও নিয়া গেল ওরা। বাবা, আমার পোলাডার লাশডা ফিরায় দিতে কও।’
রিহান বললো, ‘চাচি, আপনি উঠেন। শক্ত হোন।’
মহিলাটা কপাল চাপড়ে কাঁদতে লাগলো। একজন মিলিটারি তাকে উর্দুতে গালি দিয়ে রিহানের উদ্দেশ্যে বললো, ‘লে যা উসকু, শালা…’ রিহানকেও একটা খারাপ গালি দিয়ে উঠলো। রিহান তার দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থাকলে, মিলিটারিটা হাতের লাঠি দিয়ে মারার ইঙ্গিত দিয়ে মহিলাটাকে নিয়ে যেতে বললো। মহিলাটার হাত ধরে তুললো রিহান। তারপর শান্ত কণ্ঠ তাকে ভরসা দিলো, ‘চাচি, এভাবে আমরা আরও অনেক অনেক জীবন বিসর্জন দিবো ওদের হাতে। কিন্তু আমাদের ভেঙে পড়লে চলবে না। একদিন পরাধীনতার এই শিকলটাই ছিড়ে দেবো আমরা।’
মহিলাটাকে ধরে নিয়ে আসতে লাগলো রিহান। ইউসুফও এগিয়ে গিয়ে মহিলার অন্যপাশে দাঁড়ালো। মহিলাটার কান্নায় তখন আকাশটাই যেন ভেঙে পড়বে একটু পর।
ধীরে ধীরে যখন পরিস্থিতি শান্ত হলো, রিহান ছেলেকে নিয়ে ঘরে ফিরতে লাগলো। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে আধার নেমে এল। সুফিয়া তখন গেইটের পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল ওদের ফেরার আশায়। রহিম মিয়াকে কয়েকবার পাঠিয়েছে ওদের খোঁজ করতে। প্রতিবারই রহিম মিয়া ফিরে এসেছে কোনো খোঁজ না পেয়ে। শেষে যখন আবারও ওকে একটা টর্চ হাতে পাঠাতে চাইলো, তখন বাপ-ছেলে ফিরে এলো। অস্থিরতায় পুরো ঘেমে গিয়েছিল সুফিয়া। ওদেরকে ফিরে আসতে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো, ‘যাক, আল্লাহ আপনাদের ফিরিয়ে আনলো। আমার কত চিন্তা হচ্ছিল আপনাদের জন্য।’
‘আরে, মিলিটারির কারণে আসতে পারছিলাম না। পুরো রাস্তা ব্লক করে দিয়েছিল। গুলি করে চারজনকে মেরেও ফেলেছে।’ সুফিয়াকে আলতো করে ধরে সাবধানে হাঁটলো রিহান পেটের বাচ্চার যেন কোনো ক্ষতি না হয়। সাবধানে হাঁটতে হাঁটতে সুফিয়া বললো, ‘এজন্যই তো আমার আরও বেশি করে চিন্তা হচ্ছিল।’
‘ঘরেই থাকতে আমাদের ফেরার অপেক্ষায়। গেইট পর্যন্ত আসার কী দরকার ছিল এই অবস্থায়?’ সুযোগ পেয়ে নরম সুরে একটু শাসিয়ে দিলো রিহান। সুফিয়া বললো, ‘এ্যাহ, আপনাদের খোঁজ না জেনে আমি ঘরে কী করে থাকবো? রহিমও কোনো খোঁজ এনে দিতে পারছিল না। আমার চিন্তা হচ্ছিল খুব।’
এবার ইউসুফ বলে উঠলো, ‘আমার রাগ কমছে না মা। একটা মিলিটারি বাবাকে খুব খারাপ ভাষায় গালি দিয়েছে।’
‘গালি দিয়েছে। ওর জিভ কেটে নিসনি কেন ওখানেই?’ রিহানের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ইউসুফের দিকে তাকিয়ে বললো সুফিয়া।
‘একা পেলে ঠিকই তার জিভটা ছিড়ে নিতাম। আমার এখনও রাগে রি-রি করছে শরীর। চোখের সামনে দিয়েই ওরা লাশগুলো নিয়ে গেল মেরে। একটা মহিলা কত করে বললো ছেলের লাশটা ফিরিয়ে দিতে, ওরা দিলো না। কতবড়ো অমানুষ ওরা।’ নিজের রাগ প্রকাশ করলো ইউসুফ। রিহান জিজ্ঞেস করলো, ‘ইউসুফ, এখানে মিলিটারির কোনো ক্যাম্প আছে আশেপাশে?’
‘আছে। তবে কিছুটা দূরে।’
‘আজ রাতে তুমি আর আমি যাবো।’
সুফিয়া এবং ইউসুফ অবাক হয়ে তাকালো রিহানের দিকে। রিহানের পরবর্তী কথা শুনতে আগ্রহী হলো ওরা। রহিম মিয়াও এগিয়ে এলো শুনতে। রিহান বললো, ‘আজ রাতে পেট্রোল বো*মা মেরে ওদের ক্যাম্প জ্বালিয়ে দেবো।’
রহিম মিয়া সাথে সাথে বলে উঠলো, ‘স্যার, আমারেও লইয়েন লগে। শালারা, আমার পাছাডা লাল কইরা দিছিল মেরে। মনে আছে আমার। টানা চাইরদিন চুলকাইছিল ওই জায়গাডায়।’
এই পরিস্থিতিতেও হেসে উঠলো ওরা রহিম মিয়ার কথা শুনে। হাসি থামিয়ে রিহান রহিম মিয়ার উদ্দেশ্যে বললো, ‘ঠিক আছে রহিম, তোকে একটা কাজ করতে হবে। বেশ কয়েকটা মাঝারি সাইজের কাচের বোতল যোগাড় কর। বোতলে কেরোসিন বা পেট্রোল ভরবি, আর আগুন ধরানোর জন্য একটা ব্যবস্থা রাখবি মুখে।’
‘স্যার, হেইডা আমার উপর ছাইড়া দ্যান। আমি সব ব্যবস্থা কইরা আপনেরে দ্যাহামু।’
‘ঠিক আছে, তুই এখনই লেগে পড় কাজে। রাতের খাবার খেয়েই কিন্তু আমরা বের হবো।’
‘আচ্ছা।’
অন্ধকার চারপাশে ঘুট-ঘুট করছে। বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে ওরা তিনজন এসেছে মিলিটারি ক্যাম্পের পাশে। রহিম মিয়াকেই বেশি উত্তেজিত দেখা যাচ্ছে বাকি দুজনের চেয়ে। কবে পেট্রোল বোমা মেরে মিলিটারি ক্যাম্প উড়াবে, এ চিন্তায় রাতে পেটভরে ভাতও খায়নি সে। ভাত খাওয়ার সময় প্রতিগ্রাস তাকে মনে করিয়ে দিয়েছিল পাশ্চাৎদেশের সেই আঘাতের কথা। দ্রুত কয়েকগ্রাস মুখে পুরেই সে পেট্রোল বো*মার বোতলগুলো একটা বস্তায় ভরে রেডি হয়ে বলে, ‘স্যার চলেন… আজ শালাগোরে খাইছি।’
পেট্রোল বো*মার বস্তাটা রহিম মিয়ার হাতেই। সে সবার পেছনে। তার সামনে ইউসুফ। সবার সামনে রিহান। রিহানের হাতে একটা টর্চলাইট। প্রয়োজন হলেই সে টর্চলাইটটা জ্বালাচ্ছে। অনেকটা রাত করে তারা এসেছে বলে লোকজন তেমন নেই। গাড়িও নেই। নিস্তব্ধ পরিবেশ। গাড়ি পাবে না, তাই ওরা ঘরের কোচগাড়িটা সাথে করে নিয়ে এসেছে। নয়তো পালাতে পারবে না। মিলিটারির হাতে ধরা পড়ে যাবে। মিলিটারি ক্যাম্পটা একটা পাহাড়ের নিচে। পাহাড়ের ওপাশের রাস্তায় রাখা আছে কোচগাড়িটা। এপাশে রাখেনি ধরা পড়ার ভয়ে। পাহাড়ে ঠিক ক্যাম্পের উপরে তিনজন ওরা নিজেদের পজিশন ঠিক করলো। ক্যাম্পে ক্ষীণ আলো জ্বলছে। একটু পর পুরো ক্যাম্পটা আলোকিত হয়ে যাবে আগুনের শিখায়। দাউদাউ করে জ্বলবে ক্যাম্প। বস্তা থেকে একটা একটা করে পেট্রোলভর্তি কাচের বোতল বের করতে করতে রহিম মিয়া রিহানের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো, ‘স্যার, শুধু কি ক্যাম্প জ্বালাইবেন? যে আপনেরে গালি দিছিলো, তারে কিছু করবেন না?’
‘তারে কী করে খুঁজবো? আপাতত ক্যাম্প জ্বালিয়ে পাকিস্তানিদের একটা ঘাঁটি চুরমার করি।’
‘তয় স্যার, আমার পাছায় যে মারছিল তারে পাইলে ভালা হইতো। এইহান থেইকা পুরা একডা পেট্রোল বো*মা আমি তার পেছনডায় মারতাম।’
‘দোয়া কর, তুই যেন আবার তার সামনে পড়ে না যাস। তাহলে তিনজনকে ওই জ্বলন্ত ক্যাম্পে জ্বালাবে।’
‘শুভ সময়ে অলক্ষুণে কথা কইয়েন না স্যার। বোতল সব বের করছি, এবার কী করবো কন।’
‘মোট দশটা না? একজনে তিনটা করে নিয়ে আমাকে চারটা দে। তোমরা দুইজন দুদিকে গিয়ে পজিশন নাও, আর আমি এইখান থেকে ছুড়বো। ঠিক দুইমিনিট পর তিনজন একসাথে ছুড়বো। ছোড়ার পরপরই তোমরা এই জায়গায় চলে আসবে। তারপর একসাথে এখান থেকে পাহাড়ের ওপাশে চলে যাবো। বুঝছো?’
দুজন মাথা ঝাকালো ওরা। তারপর পজিশনে গিয়ে দাঁড়ালো। ঠিক দুইমিনিট পর ওরা একসাথে পেট্রোল বো*মা ছুড়লো বোতলের মুখে আগুন ধরিয়ে। আগুন ধরানোর জন্য রহিম মিয়া ছেড়া কাপড় দিয়ে বোতলের মুখে লম্বা করে ছিপি এঁটেছে। একটু পরপর সবগুলো বোতল গিয়ে ক্যাম্পে আঘাত হানতে লাগলো, তারপর ছোটোখাটো একটা বিস্ফোরণ হয়ে আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। ক্যাম্প থেকে মিলিটারিরা বাইরে বেরিয়ে এলো চিৎকার করতে করতে। আগুনের শিখা বাড়তে লাগলো ওখানে। নিজেদের কাজ শেষ করে রিহানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ইউসুফ আর রহিম মিয়া। ক্যাম্পে মিলিটারি চিৎকার করে পানি খোঁজার চেষ্টা করছে। একটা ইউনিট বের হয়ে গেল যারা এ কাজ করেছে তাদের খুঁজতে। রিহান টর্চের লাইট নিভিয়ে দিলো। তারপর একজন আরেকজনের হাত ধরে সাবধানে হাঁটতে লাগলো অন্ধকারে পাহাড়ের উপর। হঠাৎ মিলিটারিদের কিছু আওয়াজ কাছে শোনা গেল। সর্বনাশ! কয়েকজন মিলিটারি পাহাড়ের দিকেই ছুটে আসছে। এই মূহুর্তে টর্চ জ্বালিয়ে পালাতে গেলে নিশ্চিত ধরা পড়বে। তার চেয়ে এখানে কোথাও আত্মগোপন করতে হবে। রিহান টর্চের মুখে হাত লাগিয়ে টর্চটা জ্বালালো, যাতে আলোটা মিলিটারিদের নজরে না যায়। ক্ষীণ আলোতে ওরা একটা ঝোপ খুঁজে নিয়ে লুকিয়ে পড়লো ওখানে। মিলিটারিরা আরও কাছে চলে আসছে।
[[চলবে…]]
টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০৩)
লেখা: ShoheL Rana শামী
পর্ব:-১৮
ঝোপের আড়ালে তিনজন ওরা আড়ষ্ট হয়ে লুকিয়ে রইলো। নিজেদের টর্চটা অফ করে রেখেছে। মিলিটারির দলটা আশেপাশের সব ঝোপে খুঁজতে লাগলো ওদের। রহিম মিয়া ফিসফিস করে উঠলো, ‘স্যার, ওরা সব জায়গায় খুঁজতাছে। কী হইবো এহন?’
‘শান্ত থাক রহিম। কিচ্ছু হবে না।’
‘আপনে কইলেই হইবো? আমার কলিজা শুকাই যাইতাছে।’
‘আরেকটা কথা বললে তোকে ধাক্কা দিয়ে ওদের সামনে ফেলে দেবো।’
রহিম মিয়া চুপ হয়ে গেল। নিশ্বাসটাও ফেলছে চেপে চেপে। মিলটারিরা টর্চলাইটের আলো ফেলে তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলো। কিছুটা দূরের আকাশটাও আলোকিত হয়ে উঠলো আগুনের শিখায়। ক্যাম্পের আগুন ওরা নেভাতে পারেনি। পুড়ে ছাই হতে লাগলো ক্যাম্প। চিৎকার চেঁচামেচিটাও বেড়ে চললো ওদিকে। এদিকের মিলিটারিরাও চিৎকার করে করে গালি দিচ্ছে রিহানদের উদ্দেশ্য করে। একজনকে দেখা গেল টর্চের আলো ফেলে এদিকেই এগিয়ে আসছে। রহিম মিয়া ঘনঘন ঢোক গিলতে লাগলো। রিহান তার মুখটা চেপে ধরলো। ঝোপের পাশে এসে মিলিটারি লোকটা কয়েকবার লাঠি দিয়ে বাড়ি মারলো ঝোপে। তারপর ঘুরে এসে আলো ফেললো ঠিক রহিম মিয়ার মুখে। তিনজনই ধরা পড়ে গেল ওরা। হা করে চেয়ে রইলো তিনজন একসাথে। এখনই হয়তো মিলিটারি লোকটা চিৎকার করে ডাকবে তার বাকি সঙ্গীদের। তারপর তিনজনকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে গিয়ে পাহাড় থেকে ফেলে দেবে, অথবা তাদেরই জ্বলন্ত ক্যাম্পে নিক্ষেপ করবে। কিন্তু, অবাক হলো ওরা, এসবের কিছুই ঘটলো না। মিলিটারি লোকটা মুখে আঙুল চেপে ওদেরকে শান্ত থাকার নির্দেশ দিলো। ঘটনা বুঝতে না পেরে ওরা পরস্পরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করলো। মিলিটারিটা তখন ফিসফিস করে বললো, ‘আমি বাঙালি। চুপচাপ এখানে থাকুন। ওদের হাতে ধরা পড়লে ওই আগুনে আপনাদেরই জ্বালাবে।’
‘আমাদেরকে একটা হেল্প করুন।’
‘কী হেল্প?’
রিহান পেট্রোল ভর্তি একটা কাচের বোতল দেখালো। চারটা থেকে সে তিনটা ছুড়তে পেরেছে। একটা থেকে গেছে। ওটার পেট্রোল সব ফেলে দিয়ে বললো, ‘এই কাচের বোতলটা উলটো দিকে ছুড়ে মেরে ওদের দিকভ্রান্ত করে দিন। ওরা ওদিকে আমাদের খুঁজতে যাবে, আর আমরা এদিক দিয়ে পালাবো।’
‘বেশ! বোতলটা আমাকে দিন।’
রিহান এগিয়ে দিলো বোতলটা। ওটা নিতে নিতে সে তার সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে আওয়াজ বাড়িয়ে বললো, ‘ইধার কই নেহি…’ বোতলটা লুকিয়ে নিলো সে পেছনে। তারপর একফাঁকে সে সবার নজর এড়িয়ে বোতলটা একদিকে ছুড়ে মারলো। ওখানে কেউ নড়াচড়া করছে মনে করে মিলিটারিরা ওদিকেই ছুটে গেল। এতক্ষণে যেন ধড়ে প্রাণ এলো রিহানদের। রহিম মিয়া হাসলো। হেসে বললো, ‘শালাদের বোকা বানাইয়া মজা পাইছি স্যার।’
‘মজা বের হবে যদি আবারও ওরা এদিকে আসে। দ্রুত ওঠো।’ পালানোর কথা মনে করিয়ে দিলো রিহান। তারপর তিনজনে সাবধানে ওখান থেকে পালিয়ে পাহাড়ের অন্যপাশে চলে এলো। গাড়িটা ওখানেই ছিল। তিনজনে কোচে উঠে বসলো। রহিম মিয়া সামনে বসে ঘোড়ার পিঠে একটা বাড়ি মারলো।ছুটতে লাগলো তখন কোচগাড়িটা। ইউসুফ এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। এবার সে মন্তব্য করলো, ‘ভাগ্যিস, লোকটা বাঙালি ছিল। নয়তো আজ কী যে হতো।’
রিহান বললো, ‘রহিম মিয়ার কী হতো জানি না, তবে তুমি আর আমি বেঁচে যেতাম। জানোই তো ভবিষ্যতে আমরা একসাথে সময় কাটাবো।’
রহিম মিয়া মুখটা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘ক্যান স্যার, খালি একা আমারেই ক্যান মারবো?’
‘কারণ, তুই বানিয়েছিস সবগুলো পেট্রোলবো*মা।’
‘আমি তো আপনের কথাতেই বানাইছি।’
‘এখন তো বেঁচে ফিরতে পারছিস। খুশি হোসনি এখন।’
‘খুশি হইছি স্যার। পেটে চাপ আইছিল। খুশিতে চইলা গ্যাছে।’ বলেই হা হা হা করে হাসলো রহিম মিয়া। রিহান এবং ইউসুফও হেসে উঠলো তার কথা শুনে। খুশিমনে ওরা ঘরে ফিরলো। সুফিয়া তাদের ফেরার আশায় বারান্দায় বসে ছিল না ঘুমিয়ে। তারপর যখন ফিরলো, তখন বিস্তারিত জিজ্ঞেস করলো। রহিম মিয়া তখন রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করতে লাগলো পুরো ঘটনা। বলার সময় ক্যাম্প পুড়ানোর প্রায় সব ক্রেডিট নিজেই নিয়ে নিলো। তবে মিলিটারিদের উপর যে প্রতিশোধ নিতে পেরেছে এতেই এরা খুশি।
পরদিন ওরা মিলিটারিদের সেই ক্যাম্পে আবারও গেল। গিয়ে দেখে পুরো ক্যাম্প পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ওদের মতো আরও অনেকে দেখতে এসেছে৷ মিলিটারিরা জায়গাটা পরিষ্কার করছে। শুধু ক্যাম্পটারই ক্ষতি হয়েছে। কারও জানের কোনো ক্ষতি হয়নি৷ সেই বাঙালি মিলিটারিকে দেখতে পেল ওরা। মৃদু হেসে সবার নজর এড়িয়ে রিহান হাত নাড়লো ওর উদ্দেশ্যে। সেও মৃদু হাসলো। তারপর নিজের কাজ করতে লাগলো।
পরবর্তীতে এই ক্যাম্পটা নতুন করে সংস্কার করতে করতে তাদের কয়েকমাস লেগে গেল। সেই সময় তাদের ক্যাম্পটা পুড়ে ছাই হলেও, তাদের অত্যাচার কিন্তু কমেনি। এই কয়েকমাসে তারা আরও বেশ কয়েক জায়গায় নিরীহ লোকদের উপর গুলি চালিয়েছে সরকারের নির্দেশে। অনেক মায়ের বুক খালি করেছে। ওদের দোষ- ওরা সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছে, মিছিল করেছে। এসব অত্যাচারের কথা রিহান ইতিহাসেই পড়েছিল, এখন নিজচোখে অবলোকন করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর কয়েকটা বছর কেবল। তারপর বাঙালি রুখে দেবে এই অত্যাচার, যুদ্ধ হবে, আর সূচনা হবে স্বাধীন বাংলাদেশের। আফসোস যুদ্ধটা নিজচোখে দেখে যেতে পারবে না রিহান। তার ইচ্ছে ছিল নিজেই যেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। কিন্তু, তার সময় এখানে প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ইউসুফের কাছেই সে একদিন জেনেছিল, ৬৬সালের পহেলা মে রিহান পুনরায় তার বর্তমানে ফিরে যায়। তারমানে আর বেশি দিন নেই। আজ ৯ই এপ্রিল। রিহান কখন তার বর্তমানে ফিরে যাবে সেটা সে জানলেও, সুফিয়া বা অন্য কাউকে এখনও জানায়নি। জানলে হয়তো সুফিয়া অনেক কষ্ট পাবে। ইউসুফও কম কষ্ট পাবে না। এই প্রায় দুবছরে এরা বাপ-ছেলে পরস্পরের সাথে খুব মিশে গেছে। তবে যত দিন যাচ্ছে, ততই রিহানের ভেতরটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। নিজের সাথে কী ঘটবে, তা আগে থেকে জেনে যাওয়াটা মোটেও ভালো নয়। সবসময় একটা অস্থিরতা কাজ করে। অনেক সময় পীড়া দেয় নিজেকে। সুফিয়ার মৃত্যুদিনের কথা ভাবলো রিহান। দিনটার কথা সে বায়ান্ন বছর আগে থেকেই জেনেছিল রিহানের কাছে। তার মানে এই সময়টাতে। কিন্তু এখানে এসে দুই বছর হতে চললো রিহানের, এখনও সে ওই ব্যাপারে কিছুই বলেনি। হয়তো যে কয়দিন সে আর আছে এখানে, এই কয়েকদিনেই কথাগুলো বলবে সুফিয়াকে। একজন তার মৃত্যু কখন হবে, কীভাবে হবে সব আগে থেকেই জেনে গেলে মৃত্যুর আগের দিনগুলোতে তার ভেতরের অবস্থাটা হয়তো অবর্ননীয়। সুফিয়াও হয়তো মৃত্যুর দিনটা যত ঘনিয়ে এসেছিল, খুব ভয়ে ছিল সেই সময়।
জানালার পাশে বসে এসব ভাবছিল রিহান। সুফিয়া পেছন থেকে এসে তার কাঁধে হাত রাখলো। জিজ্ঞেস করলো, ‘কী ভাবছেন?’
সুফিয়ার দিকে ঘুরে তাকালো রিহান। সুফিয়ার কোলে সাড়ে সাতমাস বয়সী ইকবাল নিজের ছোটো ছোটো আঙুলগুলো মুখে ঢুকিয়ে চুষতে ব্যস্ত ছিল। হাত বাড়িয়ে ওর কোল থেকে ইকবালকে নিতে নিতে রিহান বললো, ‘কিছু ভাবছি না।’
ইকবালের সারা গালে-কপালে চুমু খেল রিহান। মুখ থেকে ছোটো আঙুলগুলো বের করতে করতে আদরের সুরে বললো, ‘বাবা, মুখে হাত দেয় না বাবা।’
বাবা কী বলছে তা না বুঝলেও বাবার দিকে তাকিয়ে মাড়ি বের করে হাসলো ইকবাল। সুফিয়া রিহানের কাঁধে মাথা রেখে বসলো। বাঁহাত দিয়ে আলতো করে সে রিহানের কোমরটা জড়িয়ে ধরেছে। তারপর বাপ-ছেলের কাণ্ড দেখতে লাগলো। রিহান নানান ভঙ্গিমায় ইকবালকে হাসাতে চাইছে। ইকবালও হাত-পা ছুড়ে হাসতে হাসতে বুঝিয়ে দিলো সে বেশ মজা পাচ্ছে। রিহান তার ছোট্ট গালে নিজের গাল ঘষলো। এই আদুরে মুখটা সে আর অল্প কয়েকদিন দেখতে পাবে। কী করে ছেড়ে যাবে সে এই আদুরে মুখটা? আর কয়েকমাস পর ইকবাল হয়তো কথা বলতে শিখবে। বাবা ডাকটা হয়তো শিখেও সে বলার মতো কাউকে পাবে না। সে ডাক শোনার মানুষটা আর থাকবে না৷ চলে যাবে পেছনে শত আফসোসের গ্লানি ছড়িয়ে।
‘আজ আপনাকে কেমন যেন দেখাচ্ছে। কী হয়ছে বলেন তো?’ রিহানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো সুফিয়া।
‘কই? কিছু হয়নি তো।’
সুফিয়া ঠিকই বুঝে ফেলে কিছু একটা হয়েছে। ‘আপনার চোখ দুটো বলছে, কিছু একটা হয়েছে।’
‘পরে একসময় বলবো।’ জোর করে হাসার চেষ্টা করলো রিহান। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো সে। রহিম মিয়াকে দেখা গেল গেইট খুলে হকার থেকে পত্রিকা কিনতে। সে পত্রিকাটা কিনে দুহাতে মেলে ধরে চোখ বুলাতে বুলাতে এগিয়ে আসছে। পড়তে জানে না সে। হয়তো নিউজের পাশে ছবি দেখেই বাকি খবরটা বোঝার চেষ্টা করে। রহিম মিয়া পত্রিকাটা জানালা দিয়ে রিহানের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললো, ‘স্যার, মুজিব সাবের ছবি দ্যাছে। কী লেখছে একটু কন তো?’
রিহান পত্রিকাটা হাতে নিয়ে, শেখ মুজিবের ছবির উপরে বড়ো করে লেখা শিরোনামটা বিড়বিড় করলো, ‘বিরোধীরা শতকরা ৩০ ভাগ ভোট পাইলে রাজনীতি ত্যাগ করিবো-শেখ মুজিব।’
‘স্যার কোন বিরোধী? কীসের ভোটের কথা কইতাছে?’
‘দাঁড়া, পুরোটা পড়ে নিই।’ বলেই ইকবালকে সুফিয়ার কোলে দিয়ে নিউজটা পড়তে লাগলো রিহান। সুফিয়াও পাশ থেকে মাথাটা হালকা ঢুকিয়ে মনে মনে পড়তে লাগলো। পড়া শেষ হলে রিহান এবার রহিম মিয়াকে বোঝাতে শুরু করলো, ‘নিউজটা কী জানিস?’
‘হ্যাঁ, কন…’ জানালার গ্রিল ধরে ওপাশে দাঁড়িয়ে শোনার জন্য আগ্রহ দেখালো রহিম মিয়া। রিহান বলতে লাগলো, ‘গতকাল মুজিব সাহেব পাবনায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ওখানে তিনি কিছু লোককে চ্যালেঞ্জ করেছেন, যারা তাঁর ছয় দফার বিরোধীতা করছে। তিনি ওইসব বিরোধীদের চ্যালেঞ্জ করেছেন- গণভোট করা হোক, যদি গণভোটে ওরা মোট ভোটের ৩০ভাগ ভোট পায়, তবে তিনি রাজনীতি ছেড়ে দেবেন।’
রহিম মিয়া একটা প্রশান্তির হাসি হেসে বুকে চাপড় দিয়ে বললো, ‘কলিজা আছে মুজিব সাবের। সোহরাওয়ার্দী সাব মরার পর আমরা আরেকডা ভালা নেতা পাইছি।’
‘হ্যাঁ, আমরা উনার হাত ধরেই আমাদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনবো। তুই জানিস, এই ছয়দফা কেন মেনে নিচ্ছে না৷ সরকার?’
‘ক্যান?’
‘কারণ, এই ছয়দফা মেনে নিলে এরই ধারাবাহিকতায় পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন একটা৷ রাষ্ট্র হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
‘শালারা মাইনা নিলেই পারে।’ আফসোস করলো রহিম মিয়া।
‘তুই জানিস, এই ছয়দফা-ই হবে আমাদের মুক্তির সনদ।’
‘স্যার আমরা কি সত্যি মুক্তি পামু?’ মুখটা বিবর্ণ ধারণ করলো রহিম মিয়ার।
‘হ্যাঁ, পাবো ইনশাআল্লাহ। তবে অনেক জীবন হারাতে হবে।
‘জীবন আমিও৷ দিমু স্যার। তয়, দেশ যেন স্বাধীন হয়।’ বুকে আরেকটা চাপড় মেরে চলে যেতে লাগলো রহিম মিয়া। সুফিয়া জিজ্ঞেস করে উঠলো, ‘সত্যি কি এটা আমাদের মুক্তির সনদ হবে?’
‘হ্যাঁ। ৭ই জুন সারাদেশে হরতাল হবে। ওইদিন হরতালে পুলিশের গুলিতে এগারোজন নিহত হবে। দিনটাকে প্রতিবছর ছয়দফা দিবস হিসবে পালন করে হবে।’
‘শুধু ইতিহাসে পড়েছেন দিনটার ব্যাপারে, এবার নিজেও হরতালটা পালন করতে পারবেন সশরীরে।’
রিহান চুপ হয়ে গেল। কী করে বলবে সে সুফিয়াকে, দিনটা আসার আগেই সে তার বর্তমানে ফিরে যাবে? মাথা নিচু করে সে পত্রিকার আরেকটা শিরোনাম পড়লো, ‘আমির মিয়ার আত্মহত্যা।’
নিউজটা কয়েকলাইন পড়েই সে প্রসঙ্গ পালটানোর সুযোগ পেল, ‘দেখো৷ সুফিয়া, আমির মিয়া নামে এক বেকার লোক অভাবের তাড়নায় আত্মহত্যা করেছে।’
‘কী করে অভাব মেটাবে? এক মন চাউল যদি সাড়ে সাইত্রিশ টাকায় কিনতে হয়। আলাদা করে এক কেজি কিনতে গেলে একটাকা-দেড়টাকায় কিনতে হয়, তাহলে গরিবরা তো না খেয়ে এমনিতেই মরবে।’
‘আমির মিয়ার চার সন্তান। তার স্ত্রী আবারও সন্তান-সম্ভাবা। অভাবগ্রস্থ পরিবারে আরেকটা সন্তান মানে বোঝার উপর শাকের আঁটি। বেচারা জীবিকার জন্য অনেক চেষ্টা করেও একটা চাকরি পাইনি।’
‘কী করে পাবে? দেশের বড়ো বড়ো সব পোস্ট তো পশ্চিম পাকিস্তানিদের দখলে। আমাদের কয়জন লোক বড়ো পোস্টে আছে?’
‘সব অন্যায়ের জবাব দেবো আমরা একাত্তর সালে।’
[[চলবে…]]