টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০৩),১১,১২
লেখা: ShoheL Rana
পর্ব:-১১
সুফিয়া গোসল সেরে আসতে আসতে রিহান চুলো থেকে তরকারির হাঁড়িটা নামিয়ে রাখলো, ভাত তো সুফিয়া গোসল করার আগেই রেঁধে গেছে। এবার দু’জনের খাবার পালা। রিহান ভাত তরকারি বেড়ে সুফিয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। সুফিয়া গোসল সেরে ভেজা কাপড়গুলো শুকাতে দিয়ে মাথার চুলগুলো ঝাড়তে ঝাড়তে ঘরে ঢুকলো। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইলো রিহান। সুফিয়া কালো পাড়ের নীল শাড়ির সাথে ফুলহাতা একটা কালো ব্লাউজ পরেছে। সদ্য গোসল সেরে আসায় তার চেহারার সব ক্লান্তি মুছে গেছে, চেহারা থেকে উজ্জ্বল এক দ্যুতি ছড়াচ্ছে। ভেজা চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে মাথা নেড়ে সুফিয়া প্রশ্ন করলো, ‘কী? এভাবে চেয়ে আছেন কেন?’
রিহান জবাব দিলো, ‘তুমি আমাকে পাগল করেই ছাড়বে। হুট করে যেন বয়স তোমার অর্ধেকে নেমে এসেছে।’
‘এ্যাহ্, বেশি বেশি।’ হাসলো সুফিয়া।
‘মোটেও বেশি না।’ বলার সাথে সাথেই ‘আহ্’ বলে চিৎকার করে ওঠলো রিহান। সুফিয়ার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে অজান্তে হাত দিয়ে ফেলেছে সে গরম তরকারির ঝোলে। দৌড়ে এলো সুফিয়া। রিহানের হাতটা ধরে জোরে জোরে ফুঁ দিতে লাগলো।
‘বেশি পুড়েছে?’ জিজ্ঞেস করলো সুফিয়া।
‘না, তোমার হাতের শীতল স্পর্শে সেরে গেছে।
‘ইয়ার্কি করবেন না। বলুন…’
‘সত্যি, কিচ্ছু হয়নি। বসো, একসাথে খাবো।’
‘মাথাটা মুছে আসি?’ যেন অনুমতি চাইলো সুফিয়া। মাথাটা কাত করে সায় দিলো রিহান। ভাতে চুল পড়বে বলে সুফিয়া দরজার চৌকাঠের কাছে গিয়ে মাথাটা ভালো করে মুছে নিলো। তারপর যখন খোপা করতে গেল রিহান বলে উঠলো, ‘খোলা থাকুক, খেতে এসো। সবকিছু ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।’
‘এভাবে এলোমেলো চুলে খেতে বসবো?’
‘সমস্যা নেই। খাওয়ার পর আমি নিজ হাতে চুল আঁচড়ায় দিবো।’
মৃদু হেসে রিহানের পাশে খেতে বসলো সুফিয়া। রিহান তার ভাতের প্লেইটটা এগিয়ে দিয়ে তরকারি তুলে দিলো প্লেইটে।
‘খাও।’ বললো রিহান।
সুফিয়া মুখে একগ্রাস ভাত তুলে দিয়ে চিবোতে চিবোতে বললো, ‘চুল আঁচড়ায় দিবেন কী দিয়ে? চিরুনি তো আনিনি।’
কয়েকমুহূর্ত রিহান সুফিয়ার দিকে চেয়ে থেকে ভাতে ঝোল মাখতে মাখতে নরম কণ্ঠে বললো, ‘খাওয়ার পর শিউলির মা’র চিরুনিটা খুঁজে এনো।’
‘যাহ্, চিরুনি খুঁজতে যেতে পারবো না আমি।’
‘কেন? খুঁজলে কী হয়ছে। একটুর জন্যই তো।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, যাবো। এখন খেয়ে নিন তো।’
এরপর দুজন খাওয়া শেষ করলো। সুফিয়া খুশিদের ঘরের দিকে যেতে চাইলে রিহান পেছন থেকে ডাকলো, ‘সুফিয়া…’
‘কী?’ ঘুরে তাকালো সুফিয়া।
‘বলছি, ওদের কাছে তেল থাকলে একটু তেলও নিয়ে এসো তোমার চুলে মাখানোর জন্য।’
হেসে চলে গেল সুফিয়া। কিছুক্ষণ পর নারকেল তেলের বোতল আর চিরুনি এনে রিহানের হাতে দিয়ে বললো, ‘নেন।’
ওগুলো নিতে নিতে রিহান জিজ্ঞেস করলো, ‘শিউলির মা কিছু বলেছে না-কি?’
‘না, কী বলবে?’
‘আচ্ছা, আসো এবার চুল আঁচড়ায় দিই।’
খাটের উপর বসালো সুফিয়াকে। জানালাটা ভালো করে খুলে দিলো দুপাশে। রুমটা আলোকিত হয়ে উঠলো। রিহান সুফিয়ার পেছনে খাটে একপা তুলে বসলো। তারপর হাতে তেল নিয়ে সুফিয়ার চুলে মেখে চিরুনি দিয়ে আঁচড়াতে লাগলো। সুফিয়া তখন বলে উঠলো, ‘জানেন, শ্রীপুরে আমাদের ঘরের পাশে একটা লোক থাকে। লোকটা বুড়ো হয়ে গেছে, তাও তার বউকে অনেক ভালোবাসতো। প্রতিদিন এভাবে চুল আঁচড়ায় দিতো।’
‘এখন দেয় না?’
‘এখন কীভাবে দেবে? লোকটা একা থাকে এখন।’
‘কেন? বউ মারা গেছে?’
‘না। লোকটা ছিল হিন্দু। গতবছরের শেষের দিকে কাশ্মীরের একটা মসজিদ থেকে আমাদের মহানবী (স.)-এর একটা চুল মোবারক চুরি গেয়ে গেছিল বলে গুজব রটেছিল। এটাকে কেন্দ্র করে হিন্দু মুসলিম দ্বন্দ্ব লাগে। পাকিস্তান আর ভারতের মধ্যে যুদ্ধ হয়। তখন এখানে অনেক হিন্দুর ঘরবাড়ি ভেঙে দেয়া হয়। অনেক হিন্দু কলকাতায় চলে যায়। ওই বৃদ্ধের পরিবারও চলে যায়। কিন্তু উনি যাননি পৈতৃক ভিটা ছেড়ে। ভাঙা ঘরটা মেরামত করে উনি ওখানে থাকেন। মাঝেমধ্যে কলকাতায় বেড়াতে যান উনার স্ত্রী সন্তানের কাছে।
‘শ্রীপুর গেলে লোকটাকে দেখিয়ে দিয়ো তো। দেখবো উনাকে।’
‘আচ্ছা।’
রিহান সুফিয়ার চুল আঁচড়িয়ে সুন্দর করে খোপা করে দিলো। এরপর সুফিয়া খুশিকে চিরুনি আর তেলের বোতলটা ফেরত দিতে গেল।
বিকেলে সুফিয়াদের উঠানে খেলার আসর জমলো। সুফিয়াও বাচ্চাদের সাথে খেলতে শুরু করে দিলো। বয়স বাড়লেও তার মনটা যেন এখনও বাচ্চা-ই রয়ে গেছে। রিহান সুফিয়াকে বলে বাইরে হাঁটতে গেল। আর সুফিয়া পুরনো দিনের মতো শাড়ির আঁচলটা কোমরে প্যাঁচিয়ে খেলতে লাগলো। তার প্রিয় খেলা ইচিং-বিচিং। বাচ্চারাও তাকে পেয়ে খুশিমতো খেলতে লাগলো। খেলতে খেলতে সময় গড়িয়ে যেতে লাগলো। ওদিকে রিহান ঘুরে চলে এলো বাহির থেকে। তার দিকে তাকিয়ে একবার হাসলো সুফিয়া। রিহান জিজ্ঞেস করলো, ‘এখনও শেষ হয়নি খেলা?’
‘এই তো শেষ করছি।’ ঘাম মুছতে মুছতে বললো সুফিয়া।
‘তাড়াতাড়ি শেষ করো, তোমার জন্য জিনিস নিয়ে এসেছি।’
‘কী আনছেন?’ খেলা থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো সুফিয়া।
‘আগে খেলা শেষ করো।’
‘খেলা শেষ। বলুন কী আনছেন?’ রিহানের দিকে এগিয়ে এসে পেছনে ফিরলো সুফিয়া। বাচ্চাদের উদ্দেশ্যে বললো, ‘বাচ্চারা, তোমরা খেলো।’
বাচ্চাদের মন খারাপ হয়ে গেল। সুফিয়ার বদলে আরেকজন পার্টনার খুঁজতে লাগলো ওরা। সুফিয়া রিহানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কী আনছেন? দেন। মালা আনছেন?’
‘মালা আনছি। আরও দুইটা জিনিস আনছি।’
‘আর কী আনছেন?’ নির্মল হাসি ফুটে ওঠলো সুফিয়ার মুখে।
‘চিরুনি আর তেলের বোতল আনছি।’
‘চিরুনি আর তেল?’ ‘হিহিহি’ করে হাসলো সুফিয়া। ‘আপনিও না, পাগল একটা।’
‘তোমার পাগল আমি। নাও এগুলো।’ বলেই সুফিয়ার জন্য আনা জিনিসগুলো ওর হাতে দিলো রিহান। ছোটো ছোটো এই ব্যাপারগুলো সুফিয়া অনেক খুশি হয়। তাকে খুশি করতে বড়ো কোনো গিফট দিতে হয় না। বড়ো কোনো আয়োজন করতে হয় না।
কয়েকদিন কোনো বৃষ্টি হয়নি। আকাশ ছিল পরিষ্কার। কিন্তু এরপর একদিন সকাল থেকেই আকাশে গুড়ুম গুড়ুম বৃষ্টি হতে শুরু করলো। রিহানের ইচ্ছে হলো দাদা-বাড়িতে গিয়ে তার দাদা-দাদির নতুন সংসারটা কেমন চলছে একটু দেখে আসতে। বৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা আছে বলে সুফিয়া তাকে বাধা দিয়ে বললো, ‘এখন যেতে হবে না। শুনছেন না কেমন গুড়ুম গুড়ুম শব্দ হচ্ছে?’
‘বৃষ্টি আসতে দেরি হতে পারে। আমি একটু গিয়ে দাদা-দাদিকে দেখে আসি।’
‘বৃষ্টি আসলে কী করবেন? বৃষ্টিতে ভিজে অসুখ বাঁধাবেন?’
রিহান সুফিয়ার দিকে চেয়ে হাসলো। সুফিয়াও হেসে জিজ্ঞেস করলো, ‘আশ্চর্য! এভাবে হাসছেন কেন?’
‘শিউলির মা থেকে একটা ছাতা এনে দাও না?’ নাক কুঁচকে সুফিয়ার হাত ধরে বললো রিহান।
‘তাও আপনার যেতে হবে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে?’
‘প্লিজ, যাও না?’ নাকটা আরেকটু কুঁচকালো।
‘আচ্ছা, দেখি পাই কি-না।’ বলেই সুফিয়া খুশিদের বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর একটা ছাতা এনে দিলো রিহানের হাতে। রিহান ছাতাটা নিয়ে বেরিয়ে গেল।
গরুর গাড়িতে করে দাদা-বাড়ির ওদিকে যাওয়ার পথে হঠাৎ তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। রিহান মনে মনে সুফিয়াকে ধন্যবাদ দিলো ছাতাটা এনে দেয়ায়। দাদা-বাড়ির কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বৃষ্টির বেগ আরও বাড়লো। রিহান গাড়োয়ানকে ভাড়াটা দিয়ে ছাতাট খুলে গাড়ি থেকে নামলো। পরনের প্যান্টটা হালকা উপরে তুলে দাদা বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো। তখন সে তার যুবক বয়সের দাদা ইউসুফকে দেখতে পেল। টিনের ছাউনি বেয়ে বৃষ্টির পানি পড়ছিল। ইউসুফ কলসিতে ভরে বৃষ্টির পানি নিচ্ছে। হঠাৎ পেছন থেকে তার নববধূ সাহারা এসে ধাক্কা দিলো। ইউসুফ বাইরে বৃষ্টিতে এসে পড়লো, সাহারা বৃষ্টির শব্দের সাথে মিলিয়ে জোরে হেসে ওঠলো। ইউসুফ গিয়ে সাহারাকে ধরে কোলে তুলে নিয়ে বৃষ্টিতে আনলো। ভিজতে লাগলো দুজন বৃষ্টিতে। রিহান কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সব দেখতে লাগলো। এইবার অতীতে আসার আগে দাদির সাথে যখন কথা হচ্ছিল তার, তখন তাহলে এই ঘটনার কথা-ই বলছিল দাদি। একটা লোককে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল, তারমানে ওটা রিহান নিজেই। রিহান দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাদা-দাদিকে দেখে দাদার জন্য আফসোস করলো, ‘আহ দাদা, এখন তো খুব মজা নিচ্ছো, একটু পর যে ধাক্কাটা খাবা, কয়েকদিন বিছানায় পড়ে থাকতে হবে।’
হঠাৎ রিহান দেখলো, তার দাদি সাহারা তার দিকে নজর দিছে। তারপর স্বামীর কোল থেকে ধাক্কা দিয়ে নেমে ভেজা শরীরে ঘরে ঢুকে গেল। ইউসুফ উঠানে চিত হয়ে পড়ে কাতরাতে লাগলো। রিহান গিয়ে সাহায্য করবে কি-না চিন্তা করেও আর এগিয়ে গেল না। ওখান থেকে দাদা-দাদির খুনসুটি দেখে সে ঘুরে চলে এলো।
[[চলবে…]]
টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০৩)
লেখা: ShoheL Rana
পর্ব:-১২
চর আলগী গ্রামে বেশ কিছুদিন কাটালো রিহান আর সুফিয়া। সময়টা বেশ ভালোই কেটেছে দুজনের। ঘরের চারপাশে আগের মতো বেড়া দিয়ে ঘেরা হয়েছে। পুকুর থেকে শ্যাওলাগুলো পরিষ্কার করেছে লোক লাগিয়ে৷ পুকুরপাড়ে বসেই তাদের বিকেলের সময়টা কেটেছে বেশিরভাগ। জ্যোৎস্না রাতগুলো দুজন কাটিয়েছে এখানে পাশাপাশি বসে গল্প করতে করতে। সবকিছু যেন সেই আগের মতোই, শুধু একটা মানুষের অভাব ছিল, জাফর মাস্টারের।
মাঝখানে কয়েকদিন ইউসুফও এসে থেকে গেছে বাবা-মার সাথে। অনেকদিন এখানে কাটিয়ে আজ ওরা ফিরে যাচ্ছে আবার শ্রীপুরে। চর আলগী থেকে ওরা গরুর গাড়িতে করে গফরগাঁও যাওয়ার পথে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলো। রিহান মনে মনে ভাবছিল যাওয়ার পথে যেন তার দাদা বা দাদি কেউ একজনকে অন্তত দেখতে পায়। কিন্তু দাদাবাড়ির কাছাকাছি এসে মনে হলো, এ যেন মেঘ না চায়তে বৃষ্টি। দাদা-দাদি দুজনই রাস্তার সাইডে গাড়ির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। রিহানরা যে গরুর গাড়িটাতে ওঠলো, সেই গাড়িটাকে থামানোর জন্য সিগন্যাল দিলো। গাড়ি থামিয়ে গাড়োয়ান জিজ্ঞেস করলো, ‘কই যাইবেন?’
‘গফরগাঁও স্টেশনে যাবো।’ বউয়ের হাত ধরে বললো ইউসুফ।
‘ওঠেন।’
ইউসুফ বউয়ের হাত ধরে প্রথমে তুললো তাকে, তারপর নিজে ওঠলো। রিহান এবং সুফিয়া একপাশে সরে ওদেরকে জায়গা করে দিলো বসতে। ওদেরকে দেখে মিটমিট করে হাসতে লাগলো রিহান। বেশ কয়েকবার রিহানের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো ইউসুফ। রিহানও কিছু বললো না৷ তারপর একসময় ইউসুফ-ই বলে উঠলো, ‘আপনাকে চেনা চেনা লাগছে, কোথায় যেন দেখেছি।’
‘গতমাসে আপনাদের বিয়ে গেছে না? আপনাদের বিয়েতেই তো আমরা এসেছিলাম।’ বললো রিহান।
‘না, তখন না৷ আরও আগে, কোথায় যেন দেখেছি, মনে করতে পারছি না।’ মাথা চুলকালো ইউসুফ। রিহান এবং সুফিয়া পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসলো। বিষয়টাতে তারা বেশ মজা পাচ্ছে।
রিহান জিজ্ঞেস করলো, ‘ছোটোবেলায় দেখেননি তো?’
ইউসুফ কী যেন ভেবে বললো, ‘হতে পারে, কিন্তু আপনার বয়সের সাথে মিলছে না। আমার ছোটোবেলা মানে তো আপনিও ছোটো ছিলেন তখন। কিন্তু আমি আপনার এই চেহারাটাই দেখেছি।’
‘ভালো করে মনে করুন তবে।’
‘নাহ্, মনে করতে পারছি না আসলে।’
‘তাহলে আর কী করা। আপনাদের কোলে যখন রহমান আসবে, তখন জানাবো আমি কে?’
‘রহমান মানে? আমাদের কোলে রহমান কোথা থেকে আসবে?’
‘বিয়ে হয়ছে না? আপনাদের বাচ্চা তো হবে, সেই বাচ্চার নাম রহমান।’
এবার পাশ থেকে সাহারা ইউসুফের কানে কানে ফিসফিস করলো, ‘লোকটা মনে হয় পাগল।’
ফিসফিস করে বললেও রিহান কথাটা শুনে ফেলে। সে প্রতিবাদ করে বললো, ‘না, না, দাদি তুমি এটা কী বললা? আমি মোটেও পাগল না।’
নিজের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে সাহারার মুখটা হা হয়ে গেল। কিছুক্ষণ কথা-ই বের হলো না তার মুখ দিয়ে। তারপর বললো, ‘কী অসভ্য লোকটা! আমাকে দেখে কি বুড়ি মনে হয়? আমাকে দাদি বলছেন কেন? আপনি কিছু বলছেন না কেন লোকটাকে?’ ইউসুফের গা ধরে নাড়া দিলো সাহারা।
‘এই মিয়া আপনি তো ভারি অসভ্য!’ চ্যাতে ওঠলো ইউসুফ। আপনাকে চেনা চেনা লাগে বলে কথা বলছি, আর আপনি আমার স্ত্রীকে দাদি বলে অপমান করছেন?’
‘দাদা, আপনি শুধু শুধু রেগে যাচ্ছেন। উনি আসলেই আমার দাদি।’ রিহান আরেকটু রাগানোর চেষ্টা করলো। অবশ্য সে তো আর মিথ্যা বলছে না।
ইউসুফের রাগটা বেড়ে গেল, যখন রিহান তাকেও ‘দাদা’ বলতে বাদ রাখেনি। ‘ও আচ্ছা, আমি দাদা, আর আমার স্ত্রী তোমার দাদি? অসভ্য লোক, কোথা থেকে যে আসে।’
রিহান আরও কিছু বলতে গেলে, পাশ থেকে সুফিয়া তাকে নিষেধ করে বলতে। গাড়ি গফরগাঁও স্টেশনে এসে থামলে দুই দম্পতি নেমে গিয়ে ভাড়া মিটিয়ে দিলো গাড়োয়ানকে। রিহান-সুফিয়া দম্পতি একটা ট্যাক্সিতে উঠলো শ্রীপুরে যাওয়ার জন্য। ইউসুফ-সাহারা দম্পতি দাঁড়িয়ে থাকলো ট্যাক্সির জন্য। ইউসুফ একহাতে সাহারাকে ধরে আছে, অন্য হাতে একটা ভারী ব্যাগ। তাদেরকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় ট্যাক্সি থেকে রিহান মুখটা বের করে বললো, ‘দাদা-দাদি, ভালো থাকবেন। আর শীঘ্রই যেন কোল জুড়ে রহমান আসে।’
ইউসুফ ধমক দিয়ে কী যেন বললো, বোঝা গেল না। ধমক দেয়ার সময় হাত থেকে তার ব্যাগটা পড়ে গেল, ওটা তুলতেই ব্যস্ত হয়ে গেল সে। আর রিহানদের ট্যাক্সিটা ছুটে চললো শ্রীপুরের দিকে। সুফিয়া গাড়িতে মন্তব্য করলো, ‘দাদা-শ্বশুরকে এতটা না রাগালেও পারতেন।’
সুফিয়ার কথা শুনে রিহানের ভাবটা যেন মনে হলো, গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা এড়িয়ে গেছে সে। ‘উফ সুফিয়া! তুমি দাদার সামনেই কেন শব্দটা উচ্চারণ করোনি?’
‘কোন শব্দ?’
‘এই যে ‘দাদা-শ্বশুর’ শব্দটা। দাদার সামনে এটা বললে চেহারাটা তার বাঁধিয়ে রাখার মতো হতো।’
‘আপনিও না…’ মুখে হাত চেপে হাসতে লাগলো সুফিয়া।
ফাউগান গ্রামে ফিরে এলো রিহান আর সুফিয়া। গ্রামের দরিদ্ররা সুফিয়ার ফেরার অপেক্ষায় চাতক পাখির মতো বসেছিল গেইটের সামনে। তাকে গাড়ি থেকে থেকে নামতে দেখে সবার মাঝে একটা প্রতিযোগিতা চললো, কার আগে কে সুফিয়ার সামনে আসতে পারে। ধাক্কাধাক্কি করতে লাগলো একজন আরেকজনকে। গেইট থেকে রহিম মিয়া দৌড়ে এসে তাদেরকে আটকানোর চেষ্টা করেও কিছুতে আটকাতে পারছে না। সুফিয়া দু’হাত তুলে তাদেরকে থামানোর চেষ্টা করে আওয়াজ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনারা শান্ত হোন, আমাকে বলুন আপনাদের কী সমস্যা?’
একসাথে অনেকজন চিৎকার করে ওঠলো তখন। সুফিয়া চিৎকারের মাঝখান থেকে তাদের উদ্দেশ্যটা জেনে নিলো। মূলত নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এরা ঠিকমতো বাজার করতে পারছে না, খেতে পারছে না। তাই তাদের আহাজারি। প্রত্যেকদিন তারা গেইটের কাছে এসে খোঁজ নিতো সুফিয়া ফিরছে কি না। আজ তার ফেরার কথা জানতে পেরেই সবাই সকাল থেকে অপেক্ষা করে আছে। কারণ তারা জানে, আশেপাশে সাত গ্রামের বিত্তবানরা তাদের খালিহাতে ফিরিয়ে দিলেও এই একটি দুয়ারে এসে তাদের কখনও মুখ কালো করে ফিরতে হয় না। সুফিয়া সবাইকে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড় করিয়ে ভেতরে গেল টাকা আনতে। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে সবাইকে খুশি করলো। বেশ কিছুদিন ধরে বাজারে অস্থিরতা চলছে। সকল পণ্যের দাম অতিরিক্ত হারে বেড়ে গেছে, কারণ সরকার পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের উপর ভ্যাট বাড়িয়ে দিয়েছে। কিছুদিন পরপর এভাবে পণ্যের দাম বাড়তেই থাকে। এখানকার মুদ্রা বাজারটা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকেই। গফরগাঁও থেকে ফেরার পথে বেশ কয়েক জায়গায় অন্দোলনরত মানুষের মিছিল চোখে পড়েছিল পণ্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে। আরও অনেক অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে জনগণের।
ফ্রেশ হয়ে নিজের কক্ষে এসে বসলো সুফিয়া। ইউসুফ এসে মায়ের সাথে দেখা করলো। ছেলেকে বসিয়ে আদর করে জিজ্ঞেস করলো, ‘দুপুরে খেয়েছিস বাপ?’
‘হ্যাঁ খেয়েছি। তোমাদের ট্রিপটা কেমন হলো?’
‘অসাধারণ হয়েছে, অসাধারণ। আমি জীবনে এত খুশি হইনি।’
‘তুমি যে মা এতগুলো লোককে এখন সাহায্য করলে, তুমি কি ভুলে গেছ এদের অনেকেই তোমাকে আর বাবাকে নিয়ে কানাঘুষা করেছিল?’
‘ওরা অকৃতজ্ঞ, তাই বলে তাদের অসহায়ের মুহূর্তে আমি তো মুখ ফিরিয়ে নিতে পারি না, তাই না বাপ?’
‘কী নিয়ে কথা হচ্ছে?’ ফ্রেশ হয়ে তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে ঢুকলো রিহান।
‘আসো বাবা, বসো।’ রিহানকে বসার জন্য জায়গা করে দিলো ইউসুফ। রিহান বসলো। সুফিয়া তখন রিহানের উদ্দেশ্যে বললো, ‘আচ্ছা, আপনি তো বলেছিলেন দেশটা ৪৭ সালে এসে ব্রিটিশমুক্ত হবে। হয়েছেও তাই। আপনি আবার বলেছিলেন এই দেশটা বাংলাদেশ নামে পরিচিত হবে, সেটা যেন কখন?’
‘১৯৭১ সালে।’
‘আরও অনেক দেরি। আহহ্, মানুষ এতগুলো বছর আরও কীভাবে এই জুলুম সহ্য করবে পাকিস্তান সরকারের। আজকে আমাদের ছোট্ট ফাউগান গ্রামের এই অবস্থা দেখলেন, পুরো পূর্ব পাকিস্তানের কী অবস্থা একবার ভাবুন তো? ওরা এখানকার সব অর্থ-সম্পদ নিজেদের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। এখানকার বাজারটা ওরা নিয়ন্ত্রণ করছে। মুদ্রা সব নিয়ে গিয়ে ওদের নিজেদের দেশটার উন্নয়ন করছে, আর আমাদের পূর্ব পাকিস্তানে দেখেন, একটা ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই, রাস্তাঘাট ভাঙা, স্কুল কলেজ খুব একটা নেই। যেগুলো আছে, ওগুলোতে কেবল সাহেবদের ছেলেমেয়েরা মোটা বেতন দিয়ে পড়তে পারে। পূর্ব পাকিস্তানের বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে নিরক্ষর থেকে যাচ্ছে। আর কত এভাবে? আর কত?’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে থামলো সুফিয়া, জমে থাকা সকল রাগ যেন এক নিশ্বাসে উগড়ে দিলো। সুফিয়া থামতেই রিহান বললো, ‘মানুষ ধীরে ধীরে নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেতন হবে এখন। মানুষ যখন তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে, তখন যুদ্ধে নামবে। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করবে, নয়মাস চলবে এ যুদ্ধ, তারপর বাংলাদেশের সৃষ্টি হবে, আমাদের নিজস্ব একটা ভূখণ্ড হবে। যুদ্ধ যখন শুরু হবে, আমি থাকবো কি না জানি না সুফিয়া, তুমি কিন্তু আমাদের ইউসুফকে যুদ্ধে পাঠাবে।’ বলতে বলতে সুফিয়ার হাত ধরলো রিহান। সুফিয়া বললো, ‘যুদ্ধে পাঠাবো। আমারও ইচ্ছে আমাদের ছেলে যুদ্ধ করবে দেশের হয়ে। কিন্তু, আপনিও না থাকলে, ইউসুফেরও যদি কিছু হয়ে যায় যুদ্ধে, আমি কাকে নিয়ে বাঁচবো? কাকে আঁকড়ে ধরে আমার দিন কাটবে?’
‘ইউসুফের কিচ্ছু হবে না। তুমি তাকে যুদ্ধে পাঠাবে। ইউসুফ, তুমি দেশের হয়ে যুদ্ধ করবা না বাবা?’ ইউসুফের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো রিহান।
‘হ্যাঁ, অবশ্যই আমি দেশের জন্য যুদ্ধ করবো, দোশের জন্য আমার প্রাণটা গেলেও আফসোস থাকবে না।’
‘আমার সাহসী ছেলে।’ বলেই ছেলেকে জড়িয়ে ধরলো রিহান।
রাতের বেলা ডিনার সেরে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো রিহান। সুফিয়া এক কাপ চা এনে বললো, ‘নেন, চা খান।’
‘এখন চা খেলে ঘুম চলে যাবে। খুব টায়ার্ড লাগছে, আর ঘুম পাচ্ছে।’
‘ঘুম চলে যাওয়ার জন্যই তো চা আনছি। আমাদের ইকবালের কথা ভাববেন না?’ ফিসফিস করলো সুফিয়া। দুষ্টামি করে বলেছে সে কথাটা। রিহান হেসে চা’টা নেয়ার জন্য হাত বাড়ালে, সুফিয়া নিজেই চুমুক বসালো কাপে। তারপর বললো, ‘যান, ঘুমিয়ে পড়ুন। আমিও আসছি একটু পর।’
‘আচ্ছা। ভোরে ডেকে দিয়ো। দুজন বাইরে হাঁটতে বের হবো।’
‘ঠিক আছে, ডাকবো।’ মৃদু হাসলো সুফিয়া। রিহান তার গালটা আলতো করে টেনে দিয়ে ঘুমোতে গেল। সুফিয়াও বেশি দেরি করলো না। সারাদিনের ব্যস্ততায় সেও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তারও ঘুম পাচ্ছে।
ভোরে রিহানের আগেই ঘুম ভেঙেছে সুফিয়ার। উঠে ফ্রেশ হয়ে সে রিহানকে ডাকতে লাগলো, ‘এই উঠেন, ইউসুফের বাবা, এই ইউসুফের বাবা, উঠেন… এই, কী হলো? উঠেন? ইউসুফের বাবা…’ রিহানের গা ধরে নাড়া দিলো। রিহান ঘুমঘুম চোখে উঠে বসলো। কিছুক্ষণ বসে ঝিমোতে লাগলো। সুফিয়া জিজ্ঞেস করলো, ‘হাঁটতে যাবেন না? আমি রেডি।’
‘হুমম… যাবো তো ইউসুফের মা। তোমার ইউসুফের বাবাকে ডেকে তোলার জন্য ধন্যবাদ।’
সুফিয়া হেসে লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে বললো, ‘নতুন শিখেছি নামটা। আপনার পছন্দ হয়েছে ইউসুফের বাবা?’
‘হুমম, খুব পছন্দ।’
‘নামুন তো এবার।’ জোর করে রিহানকে বিছানা থেকে নামিয়ে ফ্রেশ হতে পাঠালো সুফিয়া।
[[চলবে…]]