টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০৩),০৯,১০
লেখা: ShoheL Rana
পর্ব:-০৯
নিজে যে কক্ষটাতে সুফিয়া থাকতো, সেই কক্ষটাতে এলো৷ চারপাশে নজর দিলো। সবকিছু ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগলো। তারপর কী মনে করে হুট করে বিছানায় বসে গিয়ে মুখটা ঢেকে ‘হু হু’ করে কেঁদে চললো। এ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না রিহান। সুফিয়ার মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে সে শান্ত করার চেষ্টা করলো, ‘সুফিয়া… সুফিয়া, শান্ত হও।’
সুফিয়া আরও জোরে ফুঁপিয়ে ওঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমার কষ্ট হচ্ছে। পুরনো কথাগুলো খুব মনে পড়ছে। বাবার কথা মনে পড়ছে।’
‘শান্ত হও৷ তোমাকে একটা জিনিস দেখায়।’
চোখ মুছতে মুছতে সুফিয়া বললো, ‘কী জিনিস?’
রিহান সুফিয়ার পাশে বসলো। সুফিয়ার হাতটা সরিয়ে সে নিজেই তার চোখ দুটো মুছে দিতে দিতে বললো, ‘কোনো জিনিস না। তোমার কান্না থামাতে এমনিই বলেছি।’
সুফিয়া হেসে উঠে রিহানের বুকে আলতো কিল-ঘুষি চালাতে লাগলো। রিহান বুক চেপে ধরে বিছানায় চিৎ হয়ে পড়ে গেল। সুফিয়ার ঠোঁট থেকে হাসিটা মুছে গেল। রিহান বুকে ব্যথা পেয়েছে মনে করে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হলো?’
‘তোমার মুখে হাসি-আর কান্না একসাথে হলে আমি ফিদা হয়ে যাই। এত সুন্দর লাগে কেন?’ বুকের বাঁপাশে ডানহাতটা রেখে জোরে শ্বাস নিলো রিহান। সুফিয়া আবারও হেসে উঠলো রিহানের কথা শুনে। ভেজা চোখদুটো তার ঝলঝল করে ওঠলো। রিহান উঠে বসলো। একটা ভাজ করা রুমাল বের করে সে সুফিয়ার সামনে ধরলো। দেখেই চিনতে পারলো সুফিয়া রুমালটা, ‘আমার রুমাল এটি!’ সুফিয়ার সারা চেহারায় এবার বিস্ময় ফুটে ওঠলো। হাত বাড়িয়ে সে রুমালটা নিতে গেলে, রিহান তাকে সাবধান করে বললো, ‘এ্যা… এ্যা, দাঁড়াও। আমি খুলে দেখাচ্ছি। ভেতরে আরও একটা জিনিস আছে।’
‘আমার লেখাটা?’
‘না, অন্য জিনিস। দেখাচ্ছি।’ বলেই রিহান রুমালের ভাজ খুলে সুফিয়ার চুলটা বের করেই তার সামনে ধরলো। প্রথমে সুফিয়া খালি চোখে চুলটা ভালো করে দেখতে পাইনি। তাই রিহানের কাণ্ডে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কী?’
‘দেখো ভালো করে, একটা চুল। কার চুল জানো?’
‘আমার?’
‘হুমম… সেই সময়ের চুল। এখানে এসে চুলটা আর রুমালটা খুঁজে পেয়েছিলাম। তোমাকে খুঁজে না পেলে, এইগুলো নিয়েই হয়তো আজীবন বেঁচে থাকতাম, ভাবতাম তুমি আছো আমার সাথে।’
‘আমিও বেঁচে আছি, আপনার দেয়া শেষ অবলম্বনটুকু আঁকড়ে ধরে। আমাদের ইউসুফকে নিয়ে। আপনাকে যে হারিয়ে ফেললাম, কী যে কষ্ট হয়েছিল! আপনি আবারও হারিয়ে যাবেন না তো?’ আচমকা প্রশ্ন করলো সুফিয়া। রিহান কোনো জবাব দিতে পারলো না মুহূর্তেই। কারণ, সে জানে- আবারও সে তার সময়ে ফিরে যাবে। তাকে চুপ দেখে সুফিয়া পুনরায় বললো, ‘আপনি অতীতের অনেককিছুই জানেন। আপনি এখন এসেছেন। আবারও চলে যাবেন তাই না?’
‘হ্যাঁ, তবে কখন সেটা জানা হয়নি। তবে এটা জানি, আমাদের আরও একটা সন্তান হওয়ার পর।’
‘আরেকটা সন্তান?’
‘হুমম, আমাদের ইকবাল হবে।’
‘ইকবাল? আপনি তাকে দেখেছেন নিশ্চয়ই আপনার সময়ে? দেখতে কেমন হবে সে?’
‘সুপুরুষ।’
‘ওরা দুই-ভাইয়ের মাঝে কি ভালো সম্পর্ক থাকবে তখন?’
‘হ্যাঁ, দুই ভাইয়ের মাঝে ভালো সম্পর্ক থাকবে। আচ্ছা, একটা প্রশ্ন ছিল।’
‘কী প্রশ্ন?’
‘ওই সময় তুমি আমার গলা কেটে দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলে কেন?’
কিছুক্ষণ রিহানের মুখের দিকে চুপ করে চেয়ে রইলো সুফিয়া। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়ালো। জানালাটা ভালো করে খুলে দিলো। বাইরে সতেজ হাওয়া বইছে। মেঘমুক্ত আকাশ। সূর্য পশ্চিমদিকে হেলে পড়েছে অনেকটা। গত দুদিন বৃষ্টি হয়নি৷ তাই বাইরেটা শুকনো দেখাচ্ছে। বাচ্চারা বাইরে হৈ-হুল্লোড় করে খেলছে। ওদিকে তাকিয়ে সুফিয়া বললো, ‘ওই সময় আমার আর উপায় ছিল না। কেন জানি মনে হচ্ছিল, জাপানিরা নিয়ে যেতে পারলে, আপনি আর কখনও ফিরতে পারবেন না৷ ওখানেই কেটে যাবে জীবন।’ দম নিয়ে পুনরায় বলতে লাগলো সুফিয়া, ‘তখন বারবার মাথায় আসছিল, এটা আমার করা উচিত। আমি শিওর ছিলাম না, তবুও মনস্থির করলাম আপনার গলা কাটবো৷ শুধু মনে হচ্ছিল, যার জন্ম অনেক পরে, সে এত আগে মরতে পারে না৷ নিয়তি এতটা নিষ্ঠুর হবে না। যে নিয়তি আমাদের দুজনকে এভাবে এক করলো, নিয়তি নিশ্চয়ই আমাদেরকে এত সহজে আলাদা করতে চাইবে না। আমাদের নিয়ে হয়তো আরও বড়ো পরিকল্পনা আছে নিয়তির। সবকিছু ভেবেই আমি ওই সিদ্ধান্তটা নিই৷ জঙ্গলে একজন জাপানিকে একা পেয়ে, পেছন থেকে তাকে বাড়ি মারি গাছের একটা অংশ দিয়ে। সে বেহুশ হয়ে পড়ে যায়, তার কাছে একটা ছোরা ছিল, ওটা নিয়েই আপনার কাছে যাই, গলা কাটি আপনার। তারপরও আমি ভয়ে ছিলাম, আমি কি ঠিক করেছি? আপনি আপনার সময়ে ফিরতে পারছেন তো? এসব ভেবে খুব টেনশন হচ্ছিল।’
‘এরপর তো জাপানিরা তোমার পিছু নিয়েছিল, কীভাবে ওদের থেকে বাঁচলে?’ সুফিয়ার পেছনে এসে দাঁড়ালো রিহান। আলতো করে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো ওকে। সুফিয়া হালকা নড়ে বলতে লাগলো, ‘আমি দৌড়ে জঙ্গলে মিশে যাই। ওরা আমার পিছুপিছু আসে অনেকজন। ওদের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আমি মোটেও ভয় পাই না। আমি নিশ্বাস আটকে একটা ঝোপে লুকিয়ে থাকি। খুঁজতে খুঁজতে একজন আমার অনেকটা কাছে চলে আসে। আমি ছোরাটা আবার শক্ত করে ধরি। লোকটা ভাগ্যিস আমার অন্যদিকে মুখ করা ছিল। আমি পেছন থেকে তার মুখটা চেপে ধরে গলায় ছুরি চালাই৷ কোনো শব্দ ছাড়াই তার মৃত্যু হয়। তার হাত থেকে বন্দুকটা তুলে নিই। কিছুটা দূরে গিয়ে একটা পজিশনে লুকিয়ে ওদের দিকে বন্দুক তাক করি। তারপর গুলি চালাই। একসাথে কয়েকজনকে গুলিবিদ্ধ করি। বাকিরা সতর্ক হয়ে যায়৷ আমি ওখান থেকে সরে আরেকটা ঝোপে লুকিয়ে পড়ি। আমি জানি না ওই সময় আমার এত কনফিডেন্স কী করে হলো। ওদের হাতে ধরা পড়বো, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে এই ভয়টুকু ছিল না আমার। আমি ঝোপে লুকিয়ে ওদেরকে টার্গেটে পরিণত করি। শেষে দুইজন বেঁচে গিয়েছিল ওদের। আর আমার হাতের বন্দুটাতেও গুলি শেষ হয়ে গিয়েছিল। ওরা পাগলের মতো আমাকে খুঁজছিল। সব সঙ্গীদের হারিয়ে ওরা পাগল প্রায়। কে তাদের এতগুলো সঙ্গীকে মারলো? এদিক-ওদিক দৌড়াতে লাগলো ওরা। আমি ওদের নজরে নজরে রাখছিলাম। কিন্তু বাগে পাচ্ছিলাম না। ওদেরকে বাগে আনতে একটা ঝোপের দিকে ঢিল ছুড়ি। ওরা সাবধানে ওদিকে যায় বন্দুক তাক করে। আমি কয়েকটা ঝোপ পার হয়ে ওদের পিছনের ঝোপটা ধীরপায়ে যাই। গাছের অংশটা আমার সাথেই ছিল। ওটা দিয়ে একজনকে জোরে বাড়ি মারি মাথায়, আরেকজনের গলায় ছুরি চালাই। ওরা আমার চেহারাটাও দেখার সুযোগ পাইনি। একজন গলা চেপে ধরে ছটফট করতে থাকে। অন্যজন আগেই বেহুশ হয়ে পড়ে থাকে মাথায় বাড়ি খেয়ে। ওদের একজনের বন্দুক তুলে নিয়ে দুজনের বুকে গুলি চালাই। শরীরের সমস্ত রাগ ওদের উপর ঝাড়ি, যতক্ষণ গুলি শেষ না হয় চালাতে থাকি। তারপর জোরে চিৎকার করে হাঁটুগেড়ে বসে কাঁদতে থাকি। আপনার কথা মনে পড়ে। দৌড়ে যাই সেই গাড়ির দিকে। কিন্তু আপনাকে আর খুঁজে পাইনি। যেখানটায় আপনি বসেছিলেন, ওই সিটটা খালি ছিল।
এরপর আমার দাদা-বাড়িতে আবারও ব্রিটিশরা আসে। আমাকে আর আপনাকে খুঁজে। আমি তখন পালিয়ে আবার এখানে চলে আসি। বেশ কয়েকদিন এখানে কাটাই একা একা।’ থামলো সুফিয়া। রিহান তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘তুমি গলা কাটার পর, আমি নিজেকে আমার সময়ে দেখতে পাই। অবাক করা ব্যাপার কী জানো?’
‘কী?’
‘তোমার সাথে অতীতে এতগুলো দিন কাটিয়েছি, কিন্তু আমার সময় থেকে আমি কেবল বিশ মিনিট হারিয়েছি।’
‘মানে? মাত্র বিশ মিনিট?’
‘হ্যাঁ। আমি যেখান থেকে অতীতে চলে আসি, নিজেকে ওইখানেই খুঁজে পাই।’
‘কী বলেন?’ হাসলো সুফিয়া বিশ্বাসই হচ্ছে না তার।
‘আমি ভেবেছিলাম, পুরোটাই হয়তো স্বপ্ন, কিন্তু আমার কপালে বিমানের অংশ পড়ে যে দাগটা হয়েছিল, সেটা অনুভব করি, তখন বিশ্বাস হয়- যা ঘটেছে সব সত্যি। কিন্তু আরেকটা অবাক করা ব্যাপার কী জানো? আমার গলা কেটেছিলে, তার কোনো চিহ্ন আমার গলায় ছিল না।’
‘কারণ, গলা কাটার পরপরই আপনি অতীত থেকে বর্তমানে চলে এসেছিলেন। ওটা কেবল একটা ধাপ ছিল অতীত থেকে বর্তমানে আসার। তাই হয়তো।’
‘হতে পারে।’ বলেই রিহান সুফিয়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। তারপর কপালে একটা চুমু খেয়ে বললো, ‘যতদিন এখানে আছি, তোমাকে কিছু শ্রেষ্ঠ সময় উপহার দিবো।’
‘সাথে ইকবালকেও উপহার দিয়ে যাবেন?’ লজ্জামাখা মুখ নিয়ে প্রশ্ন করলো সুফিয়া।
‘হুমম…’ মাথা দুলিয়ে সুফিয়াকে বুকে জড়িয়ে নেয় রিহান। সুফিয়া রিহানের বুকে মুখ লুকাই। সূর্যটা ডুবে গেছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে এরইমধ্যে। বাচ্চারা খেলা শেষ করে যার যার ঘরে ফিরতে লাগলো। সুফিয়াদের ঘরে আঁধার নেমে এলো। তখন একটা ল্যাম্প নিয়ে ঘরে ঢুকতে দেখা গেল খুশিকে। খুশিকে দেখেই রিহান সুফিয়াকে ছেড়ে দিলো, কিছুটা লজ্জা পেল দুজন। খুশি বললো, ‘অসময়ে ঢুইকা গেছি। ভাবলাম, আঁধার। তাই ল্যাম্পডা দিবার আইছি।’
‘না, না, ঠিক কাজ করেছেন। ল্যাম্পটা লাগতো আমাদের।’ জবাব দিলো রিহান।
‘আমি সব রান্না কইরা ফেলছি। খিইদা পাইলে আইসেন। আপ্নেরা এহন নিজেদের মতো কইরা একটু সময় কাডান। আমি যাই।’ রিহানের দিকে তাকিয়ে বললো খুশি। হাসলো রিহান। তারপর খুশি ল্যাম্পটা রেখে চলে গেল।
[[চলবে…]]
টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০৩)
লেখা: ShoheL Rana
পর্ব:-১০
আরও অনেকক্ষণ নিজেদের মতো কাটিয়ে রিহান ও সুফিয়া খুশিদের বাড়িতে গেল। ওদের জন্য অনেক পদের খাবার রান্না করেছে খুশি। খাবারের ফাঁকে ফাঁকে সুফিয়া খুশির পরিণতির কথা জেনে নিলো। কেন আজ মেয়েকে নিয়ে তার বাপের বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। খুশির মেয়ে শিউলি ঘরের এককোণে ল্যাম্পের আলোতে বই খুলে পড়ছিল। বাইরে থেকে তখন, একটা মেয়ের গলায় শোনা গেল, ‘শিউলি, তোরে খেলতে ডাকতাছে, খেলবি?’
‘না, ও খেলবো না, পড়তে বইছে। ও পড়বো।’ শিউলির হয়ে ওর মা জবাব দিলো। তখন সুফিয়া বললো, ‘যাক না, একটু খেলুক, অনেকক্ষণ তো পড়লো। ছোটো থাকতে আমরাও কি কম খেলেছি?’
সুফিয়ার সুপারিশ পেয়ে শিউলি তার মায়ের অনুমতি পেল খেলতে। তাড়াতাড়ি করে বইটা বন্ধ করে সে দৌড় দিলো খেলতে। খাবার শেষ করে রিহানরাও বের হলো ওদের খেলা দেখতে। মেঘ না থাকায় আকাশের চাঁদটা উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে। চাঁদের আলোতে কিশোর-কিশোরী সবাই খেলছে। ভাগ হয়ে ওরা হাডুডু আর লুকোচুরি খেলছে। কয়েকটা ছোটো ছোটো বাচ্চা ইচিং-বিচিং খেলছে, কারণ ওরা বড়োদের খেলায় সুযোগ পাইনি। সুফিয়াদের বাড়ির উঠানটা বড়ো, তাই এখনও সবাই এই উঠানটাই ব্যবহার করে খেলতে। সুফিয়া আর রিহান দাওয়াই বসে সবার খেলা দেখতে লাগলো। ফাঁকে ফাঁকে এ-বাড়ি ও-বাড়ি থেকে সুফিয়ার আসার খবর পেয়ে অনেকেই দেখা করতে আসতে লাগলো। এদের মধ্যে বেশিরভাগ সুফিয়ার পুরনো বান্ধবী। রিহান ওদেরকে নিজেদের মতো করে কথা বলতে দিয়ে কাঁচা-সড়কের দিকে হাঁটতে লাগলো। রাস্তা দিয়ে তখন কয়েকজন জেলে কাঁধে জাল ঝুলিয়ে, পরনের লুঙ্গিটা একটু উপর করে পরে হাঁটতে লাগলো। দুয়েকজন আবার সিগারেট ফোঁকতে ফোঁকতে হাঁটছে। কিছুটা দূরেই রয়েছে খাল। ওখানে এরা সারারাত মাছ ধরবে, দিনে ওগুলো বিক্রি করবে বাজারে। এভাবে চলে এদের সংসার। জেলেদের সাথে গল্প করতে করতে রিহান কিছুদূর হেঁটে এলো। ওরা হাঁটতে হাঁটতে কয়েক জায়গায় জাল ফেললো। জালের সাথে খুব বেশি মাছ উঠে আসেনি। এদিকটাতে তেমন মাছ পাওয়া যায় না। তাই দূরের খালেই এরা মাছ ধরতে চলে যায় প্রতিরাতে। তবে রিহান এতদূর যায়নি। পরে দেরি হয়ে গেলে সুফিয়া চিন্তা করবে, তাই ধীর পায়ে চারপাশটা দেখতে দেখতে চলে এলো সে। ততক্ষণে বাচ্চা-কিশোর সবার খেলা শেষ। সুফিয়া দাওয়াই বসে আছে খুশির সাথে। রিহানের জন্য অপেক্ষা করছিল সে। তাকে আসতে দেখে খুশি উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘ভাইসাব, বউরে একা রাইখা কই চইলা গেছিলেন? আপনার বউডা চিন্তা করতাছিল খুব।’
‘ওই তো, জেলেরা মাছ ধরছিল, ওগুলো দেখতে গেছিলাম।’
‘আচ্ছা, এইবার বউরে সামলান।’ বলেই খুশি নিজের ঘরের দিকে গেল। রিহান সুফিয়াকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো। মাথার চুলগুলো খুলতে খুলতে সুফিয়া বললো, ‘আমাকে না বলে এতদূর যাবেন না আর। আমার চিন্তা হচ্ছিল না?’
রিহান জবাব না দিয়ে বিছানায় কাত হয়ে হাতের তালুতে মাথা রেখে শুয়ে সুফিয়ার দিকে এক নজরে চেয়ে রইলো। ল্যাম্পের সোনালি আলো সুফিয়ার মুখে এসে পড়েছে। খোলা চুলে তাকে মনে হচ্ছে যেন কালো পাড়ের নীল শাড়ি পরা কোনো অপ্সরা৷ তাকে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে সুফিয়া পুনরায় বললো, ‘কী হলো, কিছু না বলে এভাবে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছেন যে?’
‘আবারও ফিদা হয়েছি তোমার রূপে। খোলা চুলে তোমার আগেও প্রেমে পড়েছি, আজ আবারও পড়লাম।’
সুফিয়া হেসে বললো, ‘আমি কী বলছি, আর আপনি কী বলছেন? আমাকে চিন্তায় ফেলছিলেন কেন বলুন আগে?’
সুফিয়ার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে রিহান বললো, ‘হাত দাও তোমার।’
সুফিয়া বাঁহাতটা বাড়ালো। রিহান তার হাতটা ধরে পাশে বসিয়ে চুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে বললো, ‘মাঝেমধ্যে বউকে এভাবে চিন্তায় ফেলতে হয়। এতে ভালোবাসা বাড়ে।’ বলেই সুফিয়াকে বুকে জড়িয়ে নিলো রিহান। সুফিয়া নরম কণ্ঠে ফিসফিস করে বললো, ‘আর যাবেন না ওভাবে।’
রিহানও কণ্ঠটা ছোটো করে, ল্যাম্পটা নিভিয়ে দিয়ে বললো, ‘ঠিক আছে, তোমাকে বলেই যাবো সবখানে।’
‘হুমম…’ সুফিয়া রিহানের বুকটা নিজের দখলে নিলো। তার প্রশান্তির স্থান এটা। অন্ধকারে সেও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রিহানকে।
চর আলগীতে যেহেতু রিহান আর সুফিয়া অনেকদিন কাটাবে বলে এসেছে, তাই কিছুটা সাংসারিক হতে হবে। পুরনো হাঁড়ি-পাতিলগুলো বের করে সুফিয়া পুকুরপাড়ে নিয়ে গেল মাজতে। তার আগে রিহানের হাতে কিছু টাকা দিয়ে সে তাকে বাজার করতে পাঠালো। রিহান বাজারে ঘুরে ঘুরে চাউল কিনলো, সবজি কিনলো, পিয়াজ, রসুন, হলুদ, মরিচ আরও প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনলো। গতরাতের পরিচিত এক জেলেকে পেয়ে তার কাছ থেকে সস্তায় মাছও পেয়ে গেল। ফেরার পথে কিছু লালশাক কিনে নিলো। অনেক খুঁজেও সুফিয়ার জন্য একটা মালা পেল না বলে মন খারাপ করে বাজার নিয়ে ফিরলো। সুফিয়া হাঁড়ি-পাতিল মাজা শেষ করে তার জন্য পথে চাতক-পাখির মতো অপেক্ষা করছিল। তাকে আসতে দেখে এগিয়ে গিয়ে নিজ হাতে কিছু বাজার নিলো। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে রিহান বললো, ‘সারা বাজার ঘুরেও একটা মালা খুঁজে পেলাম না। ইচ্ছে ছিল দুইটা মালা কিনে তোমার খোঁপায় নিজহাতে পরাবো।’
‘আগেরবার তো বাবার কাছ থেকে পয়সা নিয়ে কিনছিলেন। এইবার কি বাজারের টাকা থেকে কিনতেন?’ হেসে প্রশ্ন করলো সুফিয়া। বাজারগুলো রান্নাঘরে এনে রাখলো। ইতোমধ্যে সে ঘর পুরোটা ঝেড়ে পরিষ্কার করেছে। চাউলের থলেটা রাখতে রাখতে রিহান বললো, ‘এ্যাহ্ আমার কাছে পয়সা নাই মনে করছো?’
‘পয়সা আছে আপনার কাছে? কোথায় পেয়েছেন?’ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো সুফিয়া।
‘তুমিই দিয়েছো।’
‘আমি কখন দিলাম? আমি তো বাজার করতে দিলাম এখন। আর তো দিইনি।’
‘এখন দাওনি, তবে ভবিষ্যতে তুমি আমাকে দেবে।’ বলেই সুফিয়ার দেয়া বাক্সটা বের করলো রিহান। তারপর বললো, ‘এই বাক্সটা তোমার। আমার হাতে আসে ২০১৮ সালে। এই বাক্সে তুমি পুরনো নোট জমিয়েছ আমার জন্য। মানে এখনও জমাওনি, আমি যখন আবার আমার সময়ে চলে যাবো, তখন থেকে জমাতে শুরু করবে। এই যে এই বক্স থেকে পয়সাগুলো নিয়ে, খালি বাক্সটা তোমার হাতে দিলাম। খুব মজার ব্যাপার কী জানো? আমি এই বাক্স থেকে যত টাকা খরচ করেছি, যে যে পয়সা বা নোট খরচ করেছি, সব আবার তোমার হাত আসবে আমি ভবিষ্যতে ফিরে যাওয়ার পর। তারপর ওই পয়সাগুলো তুমি জমাবে আমার জন্য এই বাক্সে। বাক্সটা আমার হাতে পড়বে ২০১৮ সালে। ভাবতেই কেমন যেন লাগে তাই না?’
‘হুমম…’
রিহান একটা কাগজের নোট সুফিয়ার সামনে ধরে বললো, ‘নোটটা ভালো করে দেখে চিনে নাও। এই নোটের দু কোণায় ছিড়ে গেছে, আর মাঝখানে একটা S অক্ষর লেখা। এই নোটটা আমি খরচ করবো। ভবিষ্যতে এই নোটটা আবার তোমার হাতে আসবে, তুমি আমার জন্য জমাবে, তখন হয়তো আমাকে পাবে না। কী অদ্ভুত না?’
‘আসলেই অদ্ভুত, আপনি আসবেন বলে আমি টাকা জমাবো। অথচ আমি জমানোর আগেই আপনি টাকাগুলো পেয়ে অতীতে চলে আসছেন, সেই টাকাগুলো আমাকে দেখাচ্ছেন, অথচ আমি এখনও জমাইনি। এই যে টাকার বাক্সটা, এটা এখন আমি আপনার কাছে পেয়েছি, আপনি পেয়েছেন আবার আমার মাধ্যমে, তাহলে বাক্সটা আমাদের দুজনের কাছে এলোই বা কী করে? কে বানালো এটা?
‘সব রহস্যের সমাধান নেই সুফিয়া। মাঝেমধ্যে মনে হয় সময় বলতে কিছুই নেই। সব একটা চক্র। নিয়তি হয়তো আমাদের দুজনের জীবনটাকে এভাবেই সাজাতে চেয়েছে। নয়তো পুরনো একটা বাস, যেটা শুধু আমিই দেখি, ওটা কী করে আমার সময়ে গিয়ে আমাকে অতীতে তোমার কাছে নিয়ে আসে? সবকিছুই নিয়তি৷ আমাদের তো পরিচয় না হলেও পারতো, কিন্তু নিয়তি আমাদের দুই মেরুর দুইজনকে এভাবে মিলিয়ে দিলো। যিনি সবকিছুর পরিকল্পনাকারী, তিনি হয়তো এভাবেই পরিকল্পনা করেছেন আমাদের জীবন নিয়ে।’
‘থাক, ওসব ভেবে আর কী হবে। যেভাবে চলছে, চলুক। পেটে কি খিদে লাগেনি? খাবার কি খেতে হবে না? তবে হাত চালান।’ বলতে বলতে কিছু চাউল পাতিলে নিয়ে রিহানের হাতে দিয়ে সুফিয়া বললো, ‘পুকুরে গিয়ে ধুয়ে নিয়ে আসুন। আমি মাছগুলো কাটতে বসি।’
রিহান পুকুর থেকে চাউলগুলো ধুয়ে আনলো। এরপর দুজনে মিলে রান্না করতে লাগলো। তরকারিটা চুলায় বসিয়ে সারা মুখের ঘাম শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে সুফিয়া বললো, ‘এক বালতি পানি এনে দিবেন পুকুর থেকে? একটু গোসল করবো?’
রিহান অভিমানের সুরে বললো, ‘এমনভাবে বলছো যেন তোমার কথা রাখি না আমি।’
‘ঠিক আছে, যান। গোসলখানায় বালতি আছে। খুশিদের বালতিটা এনে রেখেছি। ওটা নিয়ে যান।’
‘আচ্ছা।’
বলেই রিহান খালি বালতিটা নিয়ে পুকুরে গেল পানি আনতে৷ পানি নিয়ে এলে সুফিয়া বললো, ‘চুলোর তরকারিটা দেখবেন, আমি গোসলটা সেরে আসি।’
‘আচ্ছা যাও, দেরি হলে কিন্তু উঁকি মারতে যাবো।
‘মাইর দিবো।’ হাত উঁচিয়ে মাইরের ভঙ্গিমায় দেখালো সুফিয়া। তারপর হেসে গোসল করতে চলে গেল। রিহান চুলোর পাশে বসে তরকারিতে জ্বাল দিতে লাগলো।
[[চলবে…]]