টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০৩),০৭,০৮

টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০৩),০৭,০৮
লেখা: ShoheL Rana
পর্ব:-০৭

বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে রিহান বললো, ‘দেখো ইউসুফ, বাস্তবতা বড়ো কঠিন আমিও জানি। তুমি, আমি, আমরা সবাই জানি, যা ঘটেছে সেটা পরিবর্তন করার ক্ষমতা আমাদের নেই। এই যে তোমার জন্য যা বর্তমান, আমার জন্য কিন্তু তা অতীত। কারণ, আমি ভবিষ্যতের লোক। তোমাদের সাথে কী কী ঘটেছে, সেটা আমি ভবিষ্যত থেকে জেনে এসেছি। আমি চাইলেও পারবো না সেটার পরিবর্তন করতে। কারণ, এখন কিছু পরিবর্তন করতে চাইলে, আমার সাথে ওই সময়ে, মানে আমার সময়ে যা যা ঘটেছে তার কী হবে? তারমানে যা ঘটার তা ঘটবেই। তুমি, আমি সময়ের আগে পিছে গিয়ে সেটা পরিবর্তন করতে পারবো না। আর আজ আমি এখানে, এটা কি আমি নিজ ইচ্ছায় এসেছি? না, আমার হাত নেই এখানে। নিয়তি আমাকে এখানে এনেছে। চাইলেও আমি যেতে পারবো না, যদি নিয়তি আমাকে না নিয়ে যায়। তাই, আমাদের উচিত- যা হচ্ছে আমাদের সাথে, তা মেনে নিই।’

‘কিন্তু আপনি তো কিছুদিন আমাদের সাথে কাটিয়ে, মায়া বাড়িয়ে, আবারও চলে যাবেন। তখন কী হবে? আমরা কি সেই কষ্টটা সহ্য করতে পারবো?’

‘এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো আমারও জানা নেই। তবে এইটুকু বলতে পারি, তোমার সাথে আমার আবারও দেখা হবে আমার সময়ে। সেই সময় তুমি আর আমি সুন্দর কিছু মুহূর্ত কাটাবো একসাথে।’

‘শুধু, আমি আর আপনি? আমার মা থাকবে না?’

রিহান ইউসুফের প্রশ্নের জবাবে কিছু বলতে পারলো না। কারণ, জবাবটা তার জানা থাকলেও বলতে পারবে না সে। কী করে বলবে সে, তখন সুফিয়া আর বেঁচে থাকবে না। সুফিয়ার মৃত্যুর পর তারা দুই-বাপ ছেলে বছর তিনেক ভালোই সময় কাটায়। তারপর একদিন ইউসুফেরও মৃত্যু হয় হার্ট-অ্যাটাকে।

‘কী ভাবছেন বাবা? মা কি তখন থাকবে না?’ ইউসুফ আবার প্রশ্ন করে।

‘সেই সময় আসতে আসতে তো তুমিও বুড়ো হয়ে যাবে ইউসুফ। মা কি আর বেঁচে থাকবে বলো? তবে সুফিয়া দীর্ঘায়ু পাবে।’

‘ওহ্।’

সেই মুহূর্ত সুফিয়া ভেতরে ঢুকলো। হাতে দুইটা প্লেটে করে কয়েক ধরনের মৌসুমি ফল কেটে এনেছে। ঢুকতে ঢুকতে সে হাসিমুখে প্রশ্ন করলো, ‘বাপ-ছেলের কী নিয়ে কথা হচ্ছে?’

‘বাপ-ছেলে প্রথমবারের মতো মিলিত হলাম। তাই কিছু সুখ-দুঃখের আলাপ করছি।’ বলেই রিহান ছেলেকে একহাতে কোমর ধরে কাছে টানলো। ইউসুফও মৃদু হেসে অস্ফুটে শব্দ করলো, ‘হুমম…’

সুফিয়ার হাত থেকে একটা আমের টুকরো নিয়ে খেতে খেতে রিহান বললো, ‘তুমিও বসো সুফিয়া৷ আমাদের তিনজনের পরিবার প্রথমবারের মতো একসাথে বসে একটু গল্প করি।’

‘কিন্তু, আমার যে কিছু কাজ আছে। আপনি এসেছেন, আপনার জন্য কিছু খাবারের আয়োজন করতে হবে তো।’

‘আরে আমার জন্য কিছু করতে হবে না। তুমি বসো তো।’

‘তা হয় না-কি?’

‘আর কেউ নেই কাজ করার মতো?’

‘আছে তো, দুইটা মেয়ে আছে। ওরা বাসার কাজ করে। আচ্ছা, আমি ওদেরকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আসতেছি।’ বলেই দ্রুত বের হয়ে গেল সুফিয়া। ওরা বাপ-ছেলে প্লেইট থেকে ফল খেতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর সুফিয়া পরনের শাড়িতে ভেজা হাত মুছতে মুছতে হাসিমুখে এসে রিহানের একপাশে বসলো। রিহানের অন্যপাশে ইউসুফ। দুজনকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে রিহান মন্তব্য করলো, ‘আজ আমি খুব খুশি। আমার একপাশে আমার স্ত্রী, অন্যপাশে আমার সন্তান। এই অনুভূতিটুকু ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না আমি।’

সুফিয়া রিহানের কাঁধে মাথা রাখলো। ইউসুফ বলে উঠলো, ‘কাল আমি পুরো গ্রামে ঘোষণা করবো, আগামী তিনদিন তারা আমাদের বাড়িতে খাবে। আমাদের বাড়িতে গ্রামবাসীর জন্য আগামী তিনদিন খাবারের আয়োজন করা হবে আমার বাবার আগমন উপলক্ষে। মা তুমি কী বলো?’ সুফিয়ার মতামত চাইলো ইউসুফ। সুফিয়া মাথা নেড়ে সায় দিলো, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’
তারপর পুরোরাত চলতে লাগলো তাদের এই গল্প।

পরের তিনি তাদের বাড়িতে খাবারের আয়োজন চললো। তিনদিন ধরে যাদের ইচ্ছে তারা এসে খেয়ে যাচ্ছে প্রতিবেলা। রিহানের সাথে পরিচিত হলো, কথা বললো, আড্ডা দিলো। কেউ কেউ আবার খেয়ে যাওয়ার সময় আড়ালে কটু মন্তব্য করতেও ভুললো না। ‘সুফিয়ার এইটা কেমন স্বামী? সুফিয়ার চেয়ে অনেক ছোটো। ইউসুফের চেয়েও খুব একটা বড়ো না। এই লোকটা ইউসুফের বাবা হয় কী করে?’ এরকম কানাঘুষা চলতে লাগলো একটা দলের মাঝে৷ এরকম একটা দল সব জায়গায়, সব অবস্থাতেই থাকে। তারা পুরো গ্রামে এটা নিয়ে আলোচনা করতে লাগলো এখানে সেখানে। তাদের থেকে শুনে আরও অনেকেই এটা নিয়ে কথা বলতে লাগলো৷ ‘রিহান যদি সুফিয়ার স্বামী হয়, তবে এতদিন কোথায় ছিল? এই গ্রামে আসার পর থেকেই রিহানকে দেখেনি ওরা। হয়তো সুফিয়া তার চেয়ে বয়সে কম একটা ছেলেকে বিয়ে করে নিয়েছে, আর ইউসুফের বাবা বলে চালাচ্ছে। ইউসুফ ছেলেটাও কেমন ছেলে? নিজের মায়ের চেয়ে ছোটো একটা ছেলেকে বাবা হিসেবে মেনে নিলো? ছি! ছি!’

এই কানাঘুষাগুলো এ-কান-ও-কান হয়ে সুফিয়াদের কানেও এলো। তারা একটু কষ্ট পেয়েছে ঠিকই, তবে মুখ ফুটে কেউ কিছু বললো না।

কয়েকদিন ফাউগান গ্রামে কাটালো রিহান। তারপর একদিন সুফিয়াকে নিয়ে গফরগাঁওয়ে এলো। ইউসুফ আসেনি। ইউসুফ ওখানে জমিদারি দেখবে। তাছাড়া সে চেয়েছিল বাবা-মা এতদিন পর এক হয়েছে। নিজেদের মতো করে একটু সময় কাটাক।

গফরগাঁও থেকে অনেকটা ভেতরে যেতে হয় সুফিয়াদের পুরনো সেই বাড়িতে যেতে হলে। গফরগাঁওয়ে এসে একটা গরুর গাড়িতে উঠলো ওরা দুজন। যাওয়ার পথে পড়ে রিহানের দাদা-বাড়িটা। কয়েকদিন আগে এই বাড়িতে জাকারিয়া সাহেবের শোকে ছেয়ে গেছিল। আজ পুরো বাড়িটা ফুলে সজ্জিত হয়ে আছে। বাড়ি থেকে সড়ক পর্যন্ত ছোট্ট পথটাও ফুলে-ফুলে সাজানো। কী ব্যাপার? কোনো উৎসব না-তো? গরুর-গাড়িটা থামিয়ে রিহান একজন লোককে প্রশ্ন করলো, ‘ভাই, এই বাড়িতে কি কোনো উৎসব চলছে?’

‘বিয়ে হবে এই বাড়িতে। তাই সাজানো হয়েছে।’ জবাব দিলো লোকটা।

‘কার বিয়ে?’

‘এই বাড়ির ছেলে ইউসুফ। তার বিয়ে।’

‘আর কনে কোথা থেকে আনবে?’

‘কনেও এই বাড়ির মেয়ে, সাহারা৷ নিজেদের ঘরেই বিয়ে হচ্ছে।’

‘বিয়ে কি আজ?’

‘হ্যাঁ, আজকেই বিয়ে।’

রিহান তখন সুফিয়ার দিকে তাকালো। চোখে চোখে কথা হলো নিজেদের মধ্যে। তারপর গারোনয়ানকে তার ভাড়াটা দিয়ে ওরা নেমে গেল গাড়ি থেকে। বিনা দাওয়াতে ওরা আজ বিয়ের ভোজন খাবে। রিহানই হয়তো একমাত্র ব্যক্তি যে নিজের দাদার বিয়ে দেখবে। সুফিয়ার দিকে তাকিয়ে হাসলো রিহান। তারপর এগিয়ে গেল বিয়ে-বাড়ির দিকে।

[[চলবে…]]

টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০৩)
লেখা: ShoheL Rana
পর্ব:-০৮

বিয়ে বাড়িতে নানা ধরনের লোকের সমাগম ঘটছে। একেকজন একেক স্টাইলে সেজে বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত হচ্ছে। তরুণ বয়সের ছেলেরা তাদের বয়সী মেয়েদের দেখে এমন সব পোজ দিচ্ছে, যেসব দেখে রিহানের হাসি পেল। খাবার খেয়ে কয়েকজন যুবক ছেলে ক্যামেরায় নিজেদের ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে গেল। কিন্তু দলীয় একটা ছবি তোলার জন্য ওরা ক্যামেরায় ক্লিক করার মতো কাউকে পাচ্ছিল না, তখন রিহান এগিয়ে গিয়ে বললো, ‘আমি ক্লিক করে দিবো?’

ওরা রিহানের আপাদমস্তক দেখে নিলো। ওদের একজন জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি পারবেন?’ যেন রিহানকে দেখে ওরা বিশ্বাস করতে পারছে না। রিহানের ড্রেসআপ দেখে হয়তো ওরা তাকে ভিনগ্রহের প্রাণী ভেবেছে।

‘হ্যাঁ, পারবো।’ বলে রিহান ক্যামেরাটা হাতে নিলো। তারপর ছবি তোলার জন্য ক্যামেরাটা ধরলো। ওরা কয়েকজন একজনের পেছনের পকেটে আরেকজন হাত ঢুকিয়ে ক্যামেরার দিকে মুখ ঘুরালো। তাদের এই পোজটা দেখে রিহানের হাসি পেলেও, অনেক কষ্টে হাসি আটকালো রিহান। তারপর ওদের কয়েকটা ছবি তুলে দিয়ে ক্যামেরাটা ফেরত দিলো। সুফিয়া রিহানের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। রিহানের বামপাশের বাহুটা আঁকড়ে ধরে বললো, ‘খাবার দিচ্ছে, চলুন খেয়ে আসি।’

‘চলো, দাদার বিয়ের খাবার পেট ভরে খাবো। আর আমার দাদিকে বউ সাজলে কেমন লাগে দেখবো।’

‘হিহিহি’ করে হাসলো সুফিয়া। তারপর যেখানটায় খাবার দেয়া হচ্ছে, ওখানে গিয়ে বসে পড়লো দুজন। কেউ কিছু বললো না ওদের। তবে মাঝেমধ্যে একটা লোক ওদেরকে ঘুরেফিরে দেখে যাচ্ছে। এভাবে কয়েকবার দেখে গেল। খেয়ে উঠার আগে লোকটা আবারও এসে ওদের দিকে নজর দিলো। সুফিয়া ফিসফিস করে বললো, ‘লোকটা আবার এসেছে, আমাদের দিকে ঘুরছে।’

রিহান পানি পান করে হাত ধুতে-ধুতে বললো, ‘তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠে যাও।’

আড়চোখে একবার লোকটা দেখে নিয়ে সুফিয়া জিজ্ঞেস করলো, ‘কে এই লোকটা? আপনি চিনেন?’

‘হ্যাঁ, চিনি। আমার দাদার বাবা, ইউনুস। মানে আমার প্রপিতামহ।’

‘আপনাকে চিনতে পারছে মনে হয়।’

‘কী জানি। হয়তো কনফিউশানে আছে। অনেকবছর পর দেখছে আবার, এতদিনে হয়তো চেহারা ভুলে গেছে আমার।’

সুফিয়াও খাবার শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। মাথা নিচু করে ওখান থেকে সরে এলো ওরা। ঘরের ভেতরে লোকের ভিড়ে মিশে গেল। ওখানে বর-কনেকে পাশাপাশি বসানো হয়েছে। রিহান সুফিয়ার কানের পাশে মুখটা নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো, ‘কেমন লাগছে আমার দাদা-দাদিকে?’

‘হুমম, অনেক সুন্দর।’ হাসলো সুফিয়া।

‘আমার দাদি কিন্তু তরুণ বয়সে অনেক সুন্দরী। তাই না?’

‘হুমম, আপনি যদি এখন গিয়ে বলেন যে, তাদের সংসারে যে ছেলে হবে, ওই ছেলে বড়ো হয়ে বিয়ে করে যে সংসার করবে, আপনি সেই সংসারের ছেলে। এটা শুনে ওদের কী প্রতিক্রিয়া হবে।’

‘না, না। এত তাড়াতাড়ি মজাটা শেষ করতে চাই না। পরে দেখা যাবে, বিয়ের উৎসবের চেয়ে আমাদের দুজনকে নিয়ে মজা শুরু করে দিবে সবাই মিলে।

‘হিহিহি’ মুখ চেপে হাসলো সুফিয়া। কয়েকজন লোক এসে বরের কানেকানে কী যেন বললো। বর তখন কনেকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বাকিরা তাদেরকে জায়গা করে দিলো যাওয়ার জন্য। ওরা রিহানদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় রিহান বরের হাতটা আলতো করে ছুয়ে দিলো। কনের দিকে তাকিয়ে সুফিয়া হাত নেড়ে বললো, ‘হাই…’

জবাবে কনে কিছু বললো না। বাইরে একটা পালকি রাখা হয়েছে। ওটাতে উঠে বসলো কনে। কয়েকজন মিলে পালকিটা কাঁধে তুলে নিলো৷ এখন পুরো গ্রাম ঘুরাবে এভাবে কনেকে। পালকি নিয়ে ওরা হাঁটতে লাগলো। পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো বর। পালকির দরজা দিয়ে এক হাত বাড়িয়ে দিয়েছে কনে, সেই হাতটা ধরে হাঁটছে বর।

পিছুপিছু পরস্পরের হাত ধরাধরি করে হাঁটতে লাগলো রিহান ও সুফিয়া। হঠাৎ সামনে পড়ে গেল ইউনুস সাহেব। রিহানের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কারা তোমরা? অনেকক্ষণ ধরে তোমাদের লক্ষ করছি।’

রিহান প্রথমে কিছুটা থতমত খেয়ে গেছিল। পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, ‘সত্যি, আমাকে চিনতে পারছেন না চাচা?’

ইউনুস সাহেব রিহানকে খুঁটিয়ে দেখে নিয়ে বললো, ‘চেনা চেনাই তো লাগছে। কোথায় যেন দেখেছি তোমাকে।’

‘একুশ বছর আগের কথা একটু মনে করে দেখুন। আপনাদের বাড়িতে একটা অপরিচিত ছেলে এসে থাকতো৷ ভবিষ্যত থেকে এসেছিল সে। মনে আছে?’

‘তুমি!’ যেন রিহানের কথা শুনে চমকে উঠলো ইউনুস সাহেব। ‘এই তোমাকে না সেইসময় বলেছি আমাকে চাচা না ডাকতে। আমরা সমবয়সী বলেছিলাম না?’

রিহান হেসে বললো, ‘আমাদের দুজনের দিকে আরেকবার তাকান। বয়সটা আরেকটু দেখে নিন। আপনার চুলে হালকা পাক ধরেছে। আমাকে দেখুন, এখনও যুবক। বলুন তো, আপনাকে কী করে আমি চাচা না বলে ভাই বলি?’

‘আরে তাই তো!’ একবার নিজের দিকে, আরেকবার রিহানের সারা শরীরের দিকে তাকাতে লাগলো ইউনুস সাহেব। ‘এটা কীভাবে সম্ভব? তুমি দেখি এখনও সেই আগের মতোই। বয়স একটুও বাড়েনি। এটা কী করে? আমার ছেলে ইউসুফও বড়ো হয়ে আজ বিয়ে করে নিচ্ছে। কিন্তু, তুমি দেখি বিশ বছর আগের সেই তুমিই থেকে গেছো।’

‘আপনার ছেলে ইউসুফ শুধু বড়ো হয়নি, আমার ছেলে ইউসুফও বড়ো হয়ে গেছে।’ মজা করলো রিহান।

‘মানে?’ ভ্রু কুঁচকালো ইউনুস সাহেব। ‘ইউসুফ তোমার ছেলে হতে যাবে কেন? ও আমার ছেলে।’

‘ইউসুফ বুঝি আর কারও ছেলের নাম হতে পারে না?’ আমার ছেলের নামও ইউসুফ।

‘ঝগড়া করার স্বভাব তোমার এখনও যায়নি।’ কথায় আর না পেরে ওখান থেকে সরে গেল ইউনুস সাহেব। রিহান হাসতে হাসতে সুফিয়ার উদ্দেশ্যে বললো, ‘ইউনুস চাচা এখনও আগের মতোই ঝগড়াটে থেকে গেছে। আগেও চাচা বললে রেগে যেত।’

রিহান থামলে সুফিয়া বলে উঠলো, ‘একটা সত্যি কথা কী জানেন?’

‘কী?’ হাসির শেষ রেখাটা ধীরে ধীরে মুছে গেল রিহানের ঠোঁট থেকে।

‘আমাদের ইউসুফের নামটা আমি আপনার দাদার নামেই রেখেছি। ওর যখন জন্ম হয়, তখন ভাবছিলাম কী নাম রাখা যায়। আপনার সাথে সম্পর্কিত কেউ একজনের নামে ওর নাম রাখতে চেয়েছিলাম। তখন মনে পড়ে আপনার দাদা ইউসুফের কথা। উনার নামেই তখন আমাদের ছেলের নামটা রাখি।’

‘আমিও সেটাই আন্দাজ করেছিলাম।’

‘হুমম, দাদার বিয়ে তো খেলেন। এবার কী করবেন?’

‘এবার তোমার বান্ধবী খুশিকে সারপ্রাইজ দিবো। সে তোমাকে দেখে খুব খুশি হবে নিশ্চয়ই।’

‘হ্যাঁ, আমিও কতদিন ওদের দেখি না। খুশি, মিনু, পুতুল আরও অনেকে।’

‘তবে, এবার সবার সাথে দেখা করেই যেয়ো।’

‘সবার সাথে কি আর দেখা হবে? সবাই হয়তো যার যার মতো সংসার নিয়ে ব্যস্ত। অনেকের দূরে বিয়ে হয়ে গেছে।’

একটা গরুর গাড়িতে ডাকলো রিহান। গারোয়ান জিজ্ঞেস করলো, ‘কই যাবেন?’

‘সামনে, চর আলগীতে।’

‘উঠুন।’

দুজন ওরা ওঠে পড়লো। গ্রামীণ রাস্তায় হেলেদুলে চলতে লাগলো গাড়ি। সুফিয়া দুহাতে রিহানকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখলো। এখনও তার সবকিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে। এই বুঝি স্বপ্নটা ভেঙে যাবে। হারিয়ে যাবে রিহান আবারও।

চর আলগীতে এসে সুফিয়ার চোখ দুটো ভিজে ওঠলো। এই গ্রামের সাথে তার কত স্মৃতি মিশে আছে। এখানেই সে বেড়ে উঠেছে। তার বাবার কবরটাও এখানে। সে কী করে পেরেছে এতদিন এখানে না আসতে? বাবার সাথে কাটানো এত স্মৃতিগুলো কী করে পেছনে ফেলে রেখে গেছে সে? নিজের বাড়ির দিকে পা বাড়ালো সে। বেড়াহীন বাড়িটাকে কেমন যেন আলগা আলগা মনে হচ্ছে। ওদের বাড়ির একপাশে খুশিদের বাড়ি। বাড়ির উঠানে একটা রশি টাঙিয়ে কাপড় শুকাতে দিচ্ছিল খুশি। সুফিয়াকে দেখেই সে চিৎকার করে উঠলো, ‘সুফিয়া!’

দৌড়ে এসে সুফিয়াকে জড়িয়ে ধরলো। কিছুক্ষণ কান্নাপর্ব চললো দুজনের মাঝে। তারপর খুশি বললো, ‘এতটা স্বার্থপর হইয়া গেলি তুই সুফিয়া? আমগোর কথা ভুইলা গেলি?’

চোখ মুছতে মুছতে সুফিয়া বললো, ‘ভুলিনি রে। তোদের কারও কথা ভুলিনি। এখানে থাকলে স্মৃতিগুলো আমাকে কষ্ট দিতো, আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যেত। তাই সব ফেলে চলে গেছিলাম।’

‘এইবার থাকবি তো কয়েকডা দিন? না-কি চইলা যাবি?’

‘না, এবার অনেকদিন থাকবো।’

রিহানের দিকে তাকালো খুশি। তারপর রিহানকে দেখিয়ে খুশি বললো, ‘রিহান ভাইয়ের লগে কয়েকদিন আগে দ্যাহা অইছিল। উনি আইছিলেন এইহানে। যাওয়ার সময় কইছিলেন তোরে এইহানে খুঁইজা আনবো। সত্যি সত্যি আনলো।’ হাসলো খুশি। চোখের নিচে তার একফোঁটা অশ্রুবিন্দু জমে আছে। ‘আচ্ছা সুফিয়া, তোর বর কি আর ফিইরা আইছিল? গতবার তোরে দ্যাখছিলাম পেটে বাচ্চা আছিলো। কইছিলি, বিয়া করছোস। তোর বররে জাপানিরা ধইরা নিয়া গেছিল। জাপানিরা ধইরা নিয়া গেলে আর ফিইরা আইতে পারবো না জানি। হেরপর তুই কি আর বিয়া করছিলি?’

‘করছি তো।’

‘বর আহেনি লগে? বর তোরে রিহান ভাইয়ের লগে আইতে দিলো?’

‘বরের সাথেই তো এসেছি।’ হাসলো সুফিয়া।

‘মানে?’ কিছুই যেন বুঝতে পারলো খুশি।

সুফিয়া রিহানকে দেখিয়ে বললো, ‘এটাই আমার বর।’

‘কী কস? তোরা এরই মধ্যে বিয়া কইরা ফেলছস?’

‘আমাদের বিয়া হয়েছিল আজ থেকে একুশ বছর আগে। এটাই আমার সেই বর, যাকে জাপানিরা ধরে নিয়ে গেছিল।’

‘কী কস রে সুফিয়া? এতদিন পর রিহান ভাই কি তয় জাপানিদের কাছ থেইকা পলাইয়া আইলো?’

রিহান সুফিয়ার দিকে তাকালো। সুফিয়া ঘটনাটা সামলে নিলো, ‘না, ও আরও আগে ফিরে এসেছিল। কিন্তু আমাকে খুঁজে পাইনি এতদিন।’

খুশি কী বুঝলো কে জানে। মাথা নেড়ে বললো, ‘ওহ্।’

‘আচ্ছা খুশি আমরা একটু রেস্ট নিই। দূর থেকে আসছি তো, টায়ার্ড লাগছে। থাকবো তো অনেকদিন, অনেক কথা হবে।’

‘আচ্ছা, রেস্ট ল তয়।’ রাতে আমার এইহানে খাইতে হইবো কিন্তু। আমি রান্না করমু তোদের লাইগা।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’ হাসলো সুফিয়া। তারপর রিহানকে নিয়ে নিজের পুরনো ঘরটার দিকে পা বাড়ালো। ঘরে ঢুকতেই কেমন যেন শরীরটা কেঁপে ওঠলো তার। একটা মায়া কাজ করছে পুরো শরীরে। ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে সুফিয়া অস্ফুটে প্রশ্ন করলো, ‘তুমি পরিষ্কার করেছিলে ঘরটা?’

মাথা নাড়লো রিহান, ‘হুমম… অনেক ধুলো আর মাকড়সার জাল জমেছিল।’

আলতো করে ঘরের দেয়ালে হাত বুলালো সুফিয়া। প্রতিটা দেয়ালের জন্যও তার মায়া হচ্ছে এখন।

[[চলবে…]]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here