#স্বর্ণাভ সুখানুভূতি দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ,(পর্ব-২০)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
এ নিয়ে দশবার কল দিল তারিফ। জাওয়াদ ডেস্কটপ কি-বোর্ডে অফিসিয়াল মেইল টাইপ করছে। মাঝে ফোনের স্ক্রিনে। এক ঝলক দেখেই আবার দৃষ্টি ফেরাচ্ছে। সাইলেন্ট করা ফোনটা ভাইব্রেট হয়ে কেটে যাচ্ছে একের পর এক। না সে ধরছে, আর না সে কাটছে। অন্যের ফোন ধরে কথা বলাটা অভদ্রতা। তাই সাইলেন্ট করেই রেখে দিয়েছে। কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে না পেয়ে ওপাশেরজন এবার ম্যাসেজ পাঠাল,
‘হেই, দিস ইজ তারিফ। ইওর ব্রাদার। প্লিজ পিক আপ দ্যা ফোন। ‘
ম্যাসেজটায় চোখ বুলিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিল জাওয়াদ। ‘ভাই! এতদিনে মনে পড়ল আপনি ওর ভাই? আগে মনে পড়লে দৃশ্যপট অন্যরকম হতো। ‘
ফিরতি কল এলো। জাওয়াদ এবার ফোন সুইচ অফ করে ডেস্কে রেখে দিল। কাজের চাপে ফোন কিংবা তারিফ কেউ রইল না স্মরণে।
•
অফিস শেষে বাজার হাতে বাসায় ফিরেছে জাওয়াদ। দরজার কাছে বাজারের ব্যাগ রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কলিংবেল চাপতে গিয়ে অস্বস্তিবোধ হলো। কাকন দরজা খুললে পাশ কাটার ব্যাপারে নিজেকে প্রস্তুতি করল। মনে মনে দোয়া করল, আল্লাহ, আজ যেন ভাবি দরজা না খুলে। ‘বিসমিল্লাহ’ বলে কলিংবেল চাপল। ওর কপালের চিন্তার ভাজ সরাতেই বোধহয় দরজা খুলল মুশরাফা। হেসে সালাম দিল,
‘আসসালামু আলাইকুম। ‘
তারপর হাতে থাকা খুন্তি উঁচিয়ে তাক করল ওর দিকে। ‘দাঁড়ান ওখানেই।’
জাওয়াদ সালাম নিয়ে কিছুটা পিছু গিয়ে বলল,
‘ অ/স্ত্র নিয়ে যু/দ্ধে নেমেছো না কি? ‘
মুশরাফা খোশমেজাজে বলল, ‘হ্যাঁ রন্ধনযু/দ্ধে নেমেছি। ‘
জাওয়াদ ও হেসে বলল, ‘তা দুর্গ জয় করতে পেরেছো না কি শ/ত্রু হাতে ব/ধ হয়ে এসেছো?’
মুশরাফা বিজয়ী ভঙিমায় বলল, ‘ আমি নারী,
আমি সুযোগ বুঝে অ/স্ত্র তুলতে পারি,
আমি হিং’স্র হয়ে শ/ত্রু বি/নাশ করতে পারি।
আমি নারী,
আমার একা হাতেই মা/রতে পারি এক’শ প্রা/ণী। ‘
থেমে বলল, ‘এক’শ প্রাণী মে/রে দুর্গ জয় করে ফেলেছি সেই কবে।’
জাওয়াদ শব্দ করেই হেসে ফেলল। ভ্রু উঁচিয়ে বলল, ‘ এক’শ প্রাণী মে/রে/ছো! সাংঘাতিক। রান্নাঘর ত তবে রণক্ষেত্র বনে গেছে। স্পট ভিজিট করে ডে/ডবডি দেখা দরকার। ‘
মুশরাফা ও ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
‘ ডে’ড’ব’ডি রান্নাঘরে। আসুন।’
ব্যস্তভঙ্গিতে ছুটল রান্নাঘরে। ওদিকে রন্ধন কার্য ভেসে যাচ্ছে বলে।
জাওয়াদ ব্যাগ হাতে রান্নাঘরে যেতে মুশরাফা একটা বাটি এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ এই সেই এক’শ মৃত প্রাণ।’
বাটি ভরতি গুড়া চিংড়ি দেখে জাওয়াদ হো হো করে হেসে ফেলল। কিছুক্ষণ হাসি থামলোই না। এই মেয়ে চমৎকার কৌতুক জানে। গর্বিত অভিভাবকের মতো বলল,
‘আই প্রাউড অব ইউ, মাই লেডি। জীবনে এমন হাজারো যু/দ্ধ জয় করে যাও। হাজার প্রাণ কেড়ে নাও।’
মুশরাফা বলল, ‘ ফ্রেশ হতে যান।’
জাওয়াদ যাওয়া ধরল। আবার থেমে বলল, ‘ তোমার বীরত্ব এই মাছ অবধি থাকুক। মানুষ অবধি না যাক। তাহলে আমার জেল হয়ে যাবে। আমার ভয় লাগছে রাফা।’ সে কী ভয়ে ভান ওর! তা দেখে মুশরাফা হেসেই বেহুশ।
জাওয়াদ অতি সচেতনতার সাথে কিচেন থেকে রুমে ফিরে এলো। নাহ, আজ কাকনকে চোখে পড়ছে না। এমনকি জাহিনের ও সাড়া শব্দ নেই।
ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে ডাকল, ‘জাহিন, জাহিন? তোর আইসক্রিম নিয়ে যা।’
সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। জাওয়াদ আরও বারকয়েক ডাকল। ফলাফল এবারও শূন্যের কৌটায়। জাহিন এলো না, তার পরিবর্তে এলেন মায়মুনা ছেলের রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন,
‘কাকে ডাকছিস?’
‘জাহিন কোথায় মা? আজ সাড়াশব্দ নেই।’
‘জাহিন তো কাকনের সাথে নানুবাড়ি বেড়াতে গেছে। ‘
জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল, ‘হঠাৎ? ‘
‘কাকন ওর ভাইবোনদের সাথে শপিং করবে, আর কদিন বেড়িয়ে ও আসবে।’
জাওয়াদ নিশ্চুপ রইল। ওর সন্দিহান চোখ মায়ের দিকে। ওর মন বলছে, মা বাহানা দিয়ে পাঠিয়েছে কাকনকে। যাতে সিদ্ধান্তে উপনীত হবার আগ অবধি জাওয়াদের চলাফেরার সমস্যা না হয়। মায়মুনা সেসব গ্রাহ্য করলেন না। সংসার জীবনে এমন হাজারটা রাজনৈতিক চাল চালতে হয় কর্তীকে। যা সবার আড়ালে থেকে যায় সবসময়। মায়মুনা নিজের রুমের দিকে হাঁটা ধরে বললেন,
‘রুম থেকে বের হতে পারিস।’
ছোটোবেলায় জাওয়াদ অন্যায় করলে বাবা বেত নিয়ে তেড়ে আসতেন। মা’ই তখন বাবা আর ওর মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়াতেন। ওকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে স্বামী উদ্দেশ্যে আকুতি করতেন। এইক্ষণে এসে মনে হলো, মা এখনো তাকে আগলে রাখছেন সবসময়। মায়েদের দায়িত্ব কখনো শেষ হয়না।
প্রসন্নমনে রুম থেকে বের হলো জাওয়াদ। রান্নাঘরে পা রাখবার পরেই মুশরাফা বলল,
‘আমার ফোনটা দিন তো, মামীকে একটা ফোন করতে হবে। ‘
জাওয়াদ দুঃখী ভান করে বলল, ‘ফোন তো অফিসে রয়ে গেছে। তুমি বরং আমার ফোন থেকে কল করো।’ নিজের ফোন বাড়িয়ে দিল সে।
মুশরাফা জাওয়াদের ফোন থেকেই মামীকে কল দিল। ফোন রাখবার পর জাওয়াদ বলল,
‘নামাজ পড়েছো?’
মুশরাফা চিকেন রোল উলটে বলল,
‘ এটা শেষ করেই যাচ্ছি।’
জাওয়াদ চোখ রাঙাল, ‘ আগে নামাজ, পরে কাজ। দরকার হলে উপোস থাকব, তাও রান্নার জন্য নামাজ মিস দিবে না। যাও নামাজ পড়ে এসো।’
‘এক মিনিট লাগবে’
‘ এক সেকেন্ড ও না। আমি দেখছি, তুমি যাও।’
মুশরাফা অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি রান্না করবেন!’
জাওয়াদ নির্দ্বিধায় বলল, ‘ রাসূল (সাঃ) স্ত্রীদের ঘরের কাজে সাহায্য করতেন।
আসওয়াদ ইবনু ইয়াযীদ (রাহঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি আয়িশাহ (রাঃ) কে প্রশ্ন করলাম, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে থাকাবস্থায় কি করতেন? তিনি বললেন, তিনি সংসারের বিভিন্ন কাজে সাহায্য করতেন, তারপর নামাযের সময় ঘনিয়ে এলে তিনি উঠে গিয়ে নামায আদায় করতেন। (আত-তিরমিজি)
রাসূল পারলে আমি কেন পারব না? দাও আমাকে।’
হাদিসটা শুনে মুশরাফা চমৎকার হেসে বলল, ‘করেছেন কখনো?’
‘ স্ত্রীদের কাজে সাহায্য করা সুন্নত। এতে সাওয়াব মিলে। আগে জানা ছিল না, তাই করি ও নি। এই সওয়াবের কাজটা করার চেষ্টা এখন আমি করতেই পারি। তুমি আমাকে দেখিয়ে দাও।’ জাওয়াদ মুশরাফার হাত থেকে খুন্তি নিয়ে নিল।
জাওয়াদের গম্ভীর কথায় ওকে একটা সুযোগ দেবার ইচ্ছে হলো মুশরাফার। এতই যখন ইচ্ছে রান্না করুক, জাওয়াদের হাতের রান্না খাওয়ার সৌভাগ্য তারও হোক। মুশরাফা বলল,
‘ ফ্রাইপ্যানে যে চারটা রোল ভাজা হচ্ছে। কিছুক্ষণ লালচে হয়ে গেলে নামিয়ে ফেলবেন। ‘
তারপর তিনটা বাটি এগিয়ে দিল জাওয়াদের দিকে। একটাতে কাচা রোল, আরেকটায় ডিম গোলানো, আরেকটায় ব্রেড ক্রাম্ব। বাটি তিনটিতে ইশারা করে মুশরাফা বলল,
‘ একটা রোল নিবেন, প্রথমে ডিমের চুবাবেন। ভালো করে ঘুরিয়ে চারপাশ লেগে গেলে উঠিয়ে ব্রেড ক্রাম্বের বাটিতে রাখবেন। এটাও ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভালো করে চারপাশে ব্রেড ক্রাম্ব দিয়ে মোড়াবেন। শেষ হলে পাশের বাটিতে এক্সট্রা আছে, সেখান থেকে নিবেন। তারপর আলতো হাতে ধরে গরম হওয়া প্যানে ছেড়ে দিবেন। একমিনিট হলে উল্টিয়ে দিবেন। দুই পিঠে লালচে ভাব আসা অবধি ভাজবেন। লালচে ভাব এলে নামিয়ে টিস্যু রাখা বাটিতে রাখবেন।’
জাওয়াদ মনোযোগী শ্রোতার মতো পুরোটা শুনল। তারপর ভ্রু নাড়িয়ে বলল, ‘এ আর এমন কী? আমি পারব। তুমি এসে দেখবে, আমি চমৎকার করে রোল ভেজে ফেলেছি। এত চমৎকার হবে যে তোমার আফসোস হবে, হিংসে হবে, ইশ! আমি কেন এত ভালো ভাজতে পারিনা। ‘
মুশরাফা হাসল। ভাজার মধ্যে ও দক্ষতা প্রয়োগ! আল্লাহ জানে কী হয়। সে বলল,
‘ তাহলে তো হলোই। আমাদের এক্সপার্ট ভাজা বিশেষজ্ঞ যেহেতু আছেন। তাহলে আমার আর চিন্তা নেই। নিশ্চিন্তে নামাজ পড়ে আসি।’ বলে নামাজের জন্য চলে গেল মুশরাফা। নামাজ শেষে সালাম ফেরাতেই নাকে পোড়া গন্ধ এসে লাগল। মায়মুনার আওয়াজ শুনা গেল, ‘মুশরাফা, তরকারি দিয়ে কোথায় গেছো, সব পুড়ে ছাই হচ্ছে।’
মুশরাফা সংক্ষিপ্ত মোনাজাত শেষ করে ছুটল রান্নাঘরে। রান্নাঘরের অবস্থা দেখে চক্ষুচড়ক ওর। চুলোর আশপাশে ডিম ব্রেডক্রাম্বে ভরে গেছে। সর্বোচ্চ আঁচে চুলো জ্বলছে। প্যান থেকে ধোঁয়া উঠছে, রোল পুড়ে ছাই। আর কিছুক্ষণ হলেই বোধহয় আগুন উঠে যেত উপরে। কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটত! ভেবেই বুক কাঁপল মুশরাফার।
চোখ ঘুরিয়ে তাকাল জাওয়াদের দিকে। ফ্রিজের সাথে হেলান দিয়ে ফোনে কিছু দেখছে। গেম খেলছে বোধহয়। কানে হেডফোন। চারদিকের খবর নেই। কানে না হয় শুনছে না, নাকে ও কি গন্ধ লাগছে না। ঘ্রাণশক্তি লোপ পেল না কি লোকটার! এ না কি আবার করবে রান্না! মুশরাফা চাপা শ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল চুলোর দিকে। চুলো বন্ধ করে প্যান নিয়ে রাখল সিঙ্কে। ট্যাপ ছাড়তেই ওকে জাওয়াদের চোখে পড়ল। কান থেকে হেডফোন সরিয়ে বলল,
‘চলে এসেছো তুমি? রোল হয়ে এসেছে, দেখো।’
থেমে ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘এই গন্ধ লাগছে কিসের? আর প্যান কই?’
ঘ্রাণশক্তি ফিরে এসেছে অবশেষে। জনাবের খবর হলো সবে! মুশরাফা প্যান এর পানি ফেলে পুড়ে যাওয়া প্যান তুলে ধরল জাওয়াদের সামনে। জাওয়াদ ভারি আফসোসের সাথে বলল,
‘পুড়ে গেছে কিভাবে! সবেই তো দেখলাম, কালচে হয়নি।’
‘সেই সবে তো কবেই পেরিয়ে গেছে ভাজা বিশেষজ্ঞ।’
‘শিট! এক পিঠ হতে বের সময় নিচ্ছিল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বোর হচ্ছিলাম। তাই উল্টিয়ে ফোন চোখ ফেলেছিলাম সবে। তারপর মাথা থেকেই সরে গেল।’ মাথা চুলকাল জাওয়াদ। মুশরাফা পুড়ে ছাই হওয়া রোলের গুড়ো তুলে এনে বলল,
‘ দুঃখিত, আমি এই এই রোল গুড়োর উপর হিংসা করতে পারছিনা, আমার আফসোস ও হচ্ছে না। স্যরি।’
জাওয়াদ কাচুমাচু করে উঠল। মুশরাফা মুখ চেপে হেসে গেল কেবল। চুলোর কাছে গিয়ে ডিমের বাটিতে চোখ বুলাতে গিয়ে আরেকটা আশ্চর্যজনক দৃশ্য চোখে পড়ল। ডিমের বাটিতে ব্রেডক্রাম্ব ছড়িয়ে আছে। মুশরাফা ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ ডিম আর ব্রেড ক্রাম্ব মিশল কিভাবে?’
জাওয়াদ গর্বের সহিত বলল,
‘আমি মিশিয়েছি।’
‘কেন?’
‘ এ বাটি, ও বাটিতে চুবানোর কাজ বাড়তি মনে হয়েছে আমার। শেষ অবধি একসাথেই তো হবে, তবে এত আলাদা কেন। তাই একসাথে গুলে নিয়েছি। তারপর রোলে ডুবিয়ে তেল। ব্যাস! না পুড়লে দেখতে চরম টেস্ট হতো।’ জাওয়াদ উৎফুল্ল হয়ে গেল। কী যেন আবিষ্কার করে ফেলেছে সে। মুশরাফা বিড়বিড় করল,
‘ আল্লাহ যা করেন বন্দার ভালোর জন্যই করেন। পুড়ে যাওয়াতেই মঙ্গল ছিল বোধহয়। ‘
•
ঘড়ির কাটায় তখন ভোর ৪টা । সাহরি খেয়ে উঠে জিশানের ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল জাওয়াদ। বারকয়েক ডাকল, ‘জিশান? জিশান?’
ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দ আসল না।
রোজা রাখে না বিধায় সাহরিতে উঠেনা জিশান। রাত করে বাড়ি ফেরে, এসেই যে রুমে ঢুকে পরদিন দুপুরে বের হয়। এর মাঝে তাকে হাজার ডেকে ও বের করানো যায় না। ভাইয়ের দায়িত্ব থেকে গত কদিন যাবত ওকে সাহরিতে ডেকে আসছে জাওয়াদ। সাড়া না পেয়ে ফিরে গেছে প্রতিবারই। আজও সাহরির আগে ডেকে ফিরে গেছে। সাহরি খেয়ে আবার এসেছে ডাকতে। নক করে নব ঘুরাতেই দরজা খুলে গেল। জিশান তো দরজা বন্ধ করে ঘুমায় না। আজ কী হলো? প্রশ্নবিদ্ধ মনেই ভেতর ঢুকল। রুমে সুনসান নীরবতা ছাড়া কোন প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পেল না সে। প্রশ্ন, বিস্ময় দুটোই বাড়ল। রুম ঘুরে দেখল, নেই। ফোন পড়ে আছে বিছানায়। যার অর্থ আশপাশে আছে। আরেকবার খুঁজে রুম থেকে বেরিয়ে ছাদে চলে গেল। সন্দেহদের সত্য প্রমাণ করে জিশানকে পাওয়া গেল ছাদের কোণে। রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। পাশের বিল্ডিং থেকে আসা আলোর চটায় অবয়ব দেখা যাচ্ছে, আর দেখা যাচ্ছে জলন্ত সিগারেটের লালচে আলো। উদাস চোখে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে। জাওয়াদ ভাইয়ের পাশ গিয়ে দাঁড়াল। মোবাইলের আলো ফেলে ভাইকে দেখল এক পলক। অসহায়, গম্ভীর মুখখানা এক ঝলক দেখেই আলো বন্ধ করে ফেলল। জিশান ওকে দেখে কিছুটা অবাকের সাথে বলল,
‘ ভাইয়া, তুই এখানে!’
সেকথার উত্তর দিল না জাওয়াদ। উদ্ধিগ্ন হয়ে জানতে চাইল, ‘কী হয়েছে তোর? ‘
‘ কিছু হয়নি।’ জিশান গম্ভীর হলো। জাওয়াদের উদ্ধিগ্নতা কমল না,
‘ কোন সমস্যা? টাকা লাগবে? আমাকে বল?’
নিকোটিনের ধোঁয়া উড়িয়ে জিশান বলল,
‘ টাকাই কিন্তু সবকিছু সমাধান না ভাইয়া। এমন অনেক সময় আসে, কখনো কখনো আমাদের কাছে টাকা পয়সা সব থাকে, তবু ও আমরা নিজেদের কাছে নিজেরাই হেরে যাই। সব থেকে ও কিছুই থাকে না আমাদের কাছে। ‘ এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জিশান।
জাওয়াদ নিরব রইল কিছুক্ষণ। তারপর ভাইয়ের কাধ চাপড়ে বলল,
‘ সমস্যা, কারণ, প্রতিকার কিছুই জানতে বা জানাতে চাইব না আমি। শুধু মনের শান্তি ফিরে পাবার জন্য একটা সাজেশন দিতে পারি।’
‘কী সাজেশন?’
‘তুই ইসলামে ফিরতে পারিস। তুই যদি সঠিকভাবে ইসলাম ফলো করে চলি তবে হাজারো বিপদ এলে ও তোর মন থেকে প্রশান্তি ভাব কাটবেনা। অজানা এক শান্তি কাজ করবে সবসময়। ‘
বলতে গিয়ে হাসল জাওয়াদ। ওকে ভীষণ সন্তুষ্ট দেখাল। জিশান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ তুই অনেক চেঞ্জ হয়ে গেছিস ভাইয়া।’
জাওয়াদ আবার হাসল, ‘ইসলাম ইজ আ ম্যাজিক। ফলো করলেই লাইফ চেইঞ্জ করে দেয়। আগের লাইফ থেকে এই লাইফ ঠু মাচ বেটার। ট্রাই করে দেখ তুই।’
জিশান ধীরে বলল, ‘চারদিক থেকে হতাশা আসছে। আমি আর নিতে পারছিনা। গিভ আপ করে ফেলতে ইচ্ছে করছে।’
চারদিক থেকে আজান ভেসে আসছে। জাওয়াদ ওর মুখ থেকে সিগারেট টেনে ফেলে দিয়ে বলল, ‘এসব ছাইপাঁশ গেলা বন্ধ করে মনোযোগ দিয়ে আজান শুন। ‘
চারদিকে নিস্তব্ধ। নিস্তব্ধতার কোল ছিঁড়ে মুয়াজ্জিনের আযান ভেসে আসছে। মৃদু বাতাস বইছে। পাঁচ ওয়াক্ত আজানের মধ্যে সবচেয়ে হৃদয়গ্রাহী আজান হলো ফজরের আজান। এর বিশেষ কারণ নিস্তব্ধতা। চোখ বন্ধ করে আজানে মনোযোগ দিতেই হৃদয়ে গিয়ে আঘান হানে। জাওয়াদ রেলিঙে হেলান দিয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ বন্ধ তার। জিশান ভাইকে দেখে কী ভেবে চোখ বন্ধ করে আজানে মনোযোগ দিলে। মুয়াজ্জিনের স্বরে কী যেন ছিল, ঠান্ডা কিছু এসে ধাক্কা খেল বুকে। প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল মন। যতক্ষণ আজান হলো, পুরোটা সময় একটা অদ্ভুত শান্তি ঘিরে রাখল ওকে। কত গান শুনেছে, কখনো তো এত শান্তি লাগে নি। আজানে এত শান্তি কেন!
আজান শেষে আজানের জবাব দিয়ে জাওয়াদ চোখ খুলল। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ আজানে অদ্ভুত একটা প্রশান্তি ছিল না?’
জিশান উত্তর দিল না। চুপ করে রইল। জাওয়াদ বলল,
‘ফজরের নামাজের মাঝেও একটা ম্যাজিক আছে। নামাজ শেষে অদ্ভুত একটা শান্তি লাগে। চল, আজ নামাজ পড়ে দেখবি। কয়েকদিন নামাজ পড়, দেখবি এসব সমস্যা তোকে হতাশ করতে পারবে না। ‘
জিশান চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল। জাওয়াদ ওর হাত টেনে বলল, ‘ এত ফিল নিয়ে দুঃখ করার মতো কিছু হয়নি। যা গেছে তার থেকে ভালো কিছু পাবি। দুঃখ করিস না। আল্লাহ ভরসা। চল, এখন। ‘
জাওয়াদ ভাইকে সাথে করে নিয়ে গেল মসজিদে, সেই ছোটোবেলার মতো।
•
দুদিন পরের কথা। দিনটা ছিল শুক্রবার। অফিস যাবার তাড়া নেই জাওয়াদের। ঘুমটা বেলা করেই ভেঙেছে তার। আড়মোড়া ভেঙে উঠবার পরেই ফোন বেজে ওঠল। একটা আননোন নাম্বার ভাসছে স্ক্রিনে। ফোন ধরতেই বলল,
‘ ইজ ইট জাওয়াদ?’
‘জ্বি, আপনি কে বলছেন?’
কলদাতা পরিচয় দেবার প্রয়োজন বোধ করলেন না। ভণিতা না করে প্রসঙ্গে ফিরলেন। ক্ষোভ নিয়ে বললেন, ‘ এই ছেলে, তোমার সমস্যা কী?’
জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকে তাকাল ফোনের দিকে। খানিক ভাবনার পরেই মাথায় এলো তারিফ। শালাবাবু! চিনে ও না চেনার ভান করল,
‘ আমি তো আপনাকে চিনিইনা। আপনার সাথে আমার সমস্যা থাকবে কিভাবে? ‘
তারিফ দাঁতচেপে বলল, ‘আমি তারিফ।’
‘আপনি! কেন কল করেছেন?’ জাওয়াদের স্বর গম্ভীর হলো।
ওর কথার টোনে তারিফের চোখে রাগ দেখা গেল। এই ছেলে তো চরম বেয়াদব। বড়ো শ্যালকের সাথে এভাবে কথা বলে কেউ! না জানি বোন কিভাবে আছে ওর কাছে? বোনের জীবন নিয়ে চিন্তা হলো ওর। সে গম্ভীরমুখে বলল,
‘ তুমি মুশরাফার সাথে আমাকে কথা বলতে দিচ্ছ না কেন? ‘
জাওয়াদের দায়সারা উত্তর, ‘কেন দিব?’
‘বিকজ শি ইজ মাই সিস্টার।’ তারিফের স্বর দৃঢ়। জাওয়াদের আশপাশে চাইল। মুশরাফা বারান্দাতেই আছে। রুমে চলে আসবে যখন তখন। জাওয়াদ উঠে ছাদে চলে গেল। অনেক পুরনো হিসেব বাকি আছে। এবার নিরিবিলি মেটানো যাবে। তারপর ক্ষোভ ঝরাল।
চলবে…
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা