স্বর্ণাভ সুখানুভূতি দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
নিবেদন। পর্ব-৪,০৫
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
০৪
ফ্লোরে বসে আছে মুশরাফা। চোখ বন্ধ তার, মুখে হাসি। লায়লা খাটে বসে আলতো হাতে মেয়ের চুলে তেল দিয়ে বেনুনি করে দিচ্ছেন। মুশরাফা মায়ের আদর উপভোগ করছে প্রফুল্ল মনে। লায়লা আঞ্জুমান বেনুনি করতে করতে ডাকলেন,
‘রাফা, শুননা?’
‘জ্বি, মা।’
‘আমাদের ড্রাইভার আছে না আনিস? ওর গ্রামের বাড়িঘর না কি বন্যায় ভেসে গেছে। স্ত্রী সন্তানের থাকতে কষ্ট হচ্ছে। কাল বাইরে যাবার সময় ওকে ফোনে বলতে শুনলাম। ভাবছি, তোর বাবাকে বলে গ্রামে একটা ঘর তুলে দিব। কী বলিস?’
লায়লার পরামর্শ চাইলেন মেয়ের কাছে। মুশরাফা ঘাড় ঘুরিয়ে হেসে বলল,
‘ গৃহহীনের গৃহের ব্যবস্থা করার মতো উত্তম কাজ দুটি নেই। এই উত্তম কাজটা তুমি নির্দ্বিধায় করতে পারো, মা। ‘
লায়লা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ তোর সাথে পরামর্শ করব বলে তোর বাবাকে জানাইনি। তাহলে আমি আজই তোর বাবাকে বলব। কাল থেকে কাজ শুরু করুক।’
‘জাযাকিল্লাহু খায়রান।’ মুশরাফা সামনে তাকাল। লায়লা আবার বেনুনিতে মনোযোগ দিলেন। মুশরাফা আকস্মিক ডাকল,
‘মা?’
‘ বল।’
‘একটা হাদিস মনে পড়ছে, বলব?’
লায়লাকে ভীষণ আগ্রহী দেখাল, ‘বল দেখি।’
মুশরাফা হেসে বলল, ‘রাসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদেরকে বলেন, আমার বান্দা কোনো গুনাহের কাজ করার নিয়ত করলে তা না করা পর্যন্ত তার জন্য কোনো গুনাহ লিপিবদ্ধ কোরো না। তবে সে যদি গুনাহের কাজটি করে ফেলে, তা হলে কাজটির অনুপাতে তার গুনাহ লিখো। আর যদি আমার কারণে তা পরিত্যাগ করে তা হলে তার জন্য একটি নেকি লিপিবদ্ধ করো। সে যদি কোনো নেকির কাজ করার জন্য ইচ্ছা বা নিয়ত করে কিন্তু এখনও তা করেনি তা হলে তার জন্য একটি নেকি লিপিবদ্ধ কর। আর যদি কাজটি সে করে তা হলে তার জন্য দশগুণ থেকে (আন্তরিকতা অনুপাতে) সাতশগুণ পর্যন্ত নেকি লিপিবদ্ধ কর।’ (বুখারি)।’
থেমে বলল, ‘ভালো কাজের ইচ্ছে পোষণ করে তুমি নেকির ভাগিদার হয়ে গেছো। পরকালে আল্লাহ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দিবে।’
লায়লার চোখে মুখে খুশির ঝিলিক দেখা গেল। বললেন,
‘ তোর বলা হাদিস গুলো সুন্দর। শুনতে ভালো লাগে। ভালো কাজের কথা ভাবলেই সাওয়াব! সুন্দর তো ব্যাপারটা। ‘
থেমে বললেন, ‘ জা..যা…
কিছু বলার চেষ্টা করলেন তিনি। মুশরাফা হেসে বলল, ‘জাযাকিল্লাহু খায়রান।’
লায়লা ও হেসে বললেন, ‘ জাযাকিল্লাহু খায়রান। আল্লাহ আমাকে মেয়েকে অনেক অনেক মঙ্গলকর পুরষ্কার দিক।’
‘আমার মেয়ে’ কথাটা কী হৃদয়গ্রাহী শুনাল। বুকে শীতলতা বয়ে গেল। মুশরাফা চমৎকার হাসল। বলল,
‘ওয়া আনতুম ফাজাযাকুমুল্লাহু খায়রান। ( আপনাকেও আল্লাহ উত্তম প্রতিদান দিন।)’
লায়লার বেনুনি বাধা শেষ। বেনুনির আগায় সুন্দর ফুলের একটা হেয়ার ব্যান্ড বেধে সামনের দিকে ছেড়ে দিলেন। তারপর উঠে গেলেন। আলমারির দরজা খুলে কী যেন খুঁজলেন। পেয়ে ও গেলেন। একটা প্যাকেট হাতে মেয়ের কাছে এসে দাঁড়ালেন। মেয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
‘দেখতো এটা কেমন হয়েছে?’
একরাশ কৌতুহলের সাথে প্যাকেটটা হাতে নিল মুশরাফা। ভেতরে হাতড়াতে বেরিয়ে এলো একটা কালো বোরকা। মুশরাফা ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘এটা কার জন্য মা?’
লায়লার মুখে অমায়িক হাসি, ঝলকানো খুশির রেশ। ঠোঁটের কোণে হাসি বজায় রেখে বললেন, ‘গেলো বার যখন দুবাই গিয়েছিলাম, তখন তোর জন্য কিনেছিলাম। তুই ত তখন আমার কাছে ছিলি না, তাই দেয়া হয়নি। বাইরে যাবার সময় পরিস। ‘
যেই পর্দার জন্য মায়ের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছেদ হলো, সেই মায়ের কাছ থেকে পর্দা সমগ্রী পেয়ে আবেগে আপ্লূত হয়ে গেল মুশরাফা। চোখে বিস্ময়, খুশির জল চিকচিক করল। কাঁপা স্বরে কেবল বলল, ‘আ…মার জন্য তু…মি বো..র..কা নিয়ে…
‘দুবাইয়ের বোরকা দোকানে চোখ পড়লেই তোর কথা মনে পড়তো আমার। মনে হতো ওখানে তুই দাঁড়িয়ে আছিস। মনটা হু হু করে উঠতো জানিস? কতবার যে পুতুল গুলো ছুঁয়ে দেখেছি তুই ভেবে হিসেব নেই। শেষ দিকে তোর বাবা আমাকে ওই দোকানের সামনে দিয়ে যেতে দিত না। এই বোরকা তোর বাবার অমতে কিনেছি। পরে দেখ তো, হয় কি না।’
মুশরাফা বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে আছে কেবল। নড়ছে না। লায়লা নিজ উদ্যোগে মেয়েকে উঠে দাঁড় করালেন। বোরকা খুলে মেয়েক পরিয়ে দিলেন। দেখলেন বোরকাটা হয় কি না। মেয়েয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বিজয়ী হেসে বললেন, ‘ আমি ভীষণ ভয়ে ছিলাম হবে কি না। যাক, হয়েছে। বাইরে যাবার সময় পরে যাস।’
মায়ের দেয়া প্রথম উপহার পেয়ে বেজায় খুশি মুশরাফা। আবেশে মাকে জড়িয়ে ধরল। ঠোঁটের হাসি নিয়ে কেঁদে উঠল, খুশির কান্না। সেই কান্নার শব্দ হলো, চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াল।
‘রাফা! এই রাফা! কী হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেন?’ কে যেন বাহুতে আলতো ধাক্কা দিল। ওমনি ঘুম ছুটে গেল মুশরাফার। চমকে তাকাল। চোখের সামনে একটা পরিচিত মুখে ভেসে উঠল। চোখে হাজার উদ্ধিগ্ন তার। মুশরাফা ধরপরিয়ে উঠে বসল। আশপাশ খুঁজল, মা নেই। এই তো এখানেই ছিল। গেল কোথায়! জাওয়াদ বলল,
‘ কাঁদছিলে কেন? খারাপ স্বপ্ন দেখছিলে?’
ওটা স্বপ্ন ছিল! মা স্বপ্নে ছিল বাস্তবে নয়! মুশরাফা নিজের দিকে তাকাল, ওর গায়ে বেগুনী রঙা জামা। মা নেই, মায়ের দেয়া বোরকা ও নেই, মাথার বেনুনি ও নেই। তার বদলে খোঁপা করা।
মুশরাফার মনে পড়ল মা তো ওর হয়ে ও নেই। মা তো সেই এইটের পর ওর দিকে ভালো চোখে তাকায় ও নি, সেখানে ওমন ভালো আচরণ, এত যত্ন সব তো কল্পনা হতে পারে। আর পর্দা বিরোধী মা ওকে বোরকা উপহার দিবে! এটা সম্ভব? হয়তো, আর তা স্বপ্নেই। বাস্তবে কি কখনো সুযোগ হবে মাকে হাদিস শুনাতে? কখনো ভাগ্য হবে মায়ের থেকে উপহার পেতে? আচ্ছা, দুবাই গেলে কি মায়ের ওর কথা মনে পড়ে? ওর জন্য বোরকা কিনেন? উত্তরটা জানতে ইচ্ছে হলো মুশরাফার। সে বিড়বিড় করে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়ল।
স্বপ্নটা সত্য হলে কত ভালো হতো। মুশরাফা হতাশ চোখে তাকাল জাওয়াদের পানে। জাওয়াদ তখনো প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকানো। স্বপ্নের সুন্দর দৃশ্য চোখে ভাসতেই মুশরাফা হেসে বলল,
‘খারাপ না ভালো স্বপ্ন দেখছিলাম। কী সুন্দর ছিল স্বপ্নটা!’
জাওয়াদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘কাঁদছিলে কেন? ‘
মুশরাফা ঘুম ঘুম স্বরে উৎফুল্লতা মাখিয়ে বলল,
‘খুশির মাত্রা বাড়লে মানু্ষ কাঁদে। আমি খুশিতে কাঁদছিলাম। আচ্ছা, স্বপ্ন গুলো এত সুন্দর হয় কেন?’
জাওয়াদ ভ্র কুঁচকে বলল, ‘কী স্বপ্ন দেখলে?
সে কথার উত্তর দিল না মুশরাফা। প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করল, ‘ সুন্দর স্বপ্ন গুলো বাস্তব হয় না কেন?’
জাওয়ার ওর পানে চাইল এক পলক। সেই ক্ষণে ওর মন বলে উঠল,
‘তোমার দেখা স্বপ্ন যদি তোমার চোখে সুন্দর এবং তোমার জন্য মঙ্গলকর হয়। তবে আল্লাহ সেই স্বপ্ন পূরণ করুক।’
মুখে বলল, ‘আল্লাহ যা করেন বান্দার ভালোর জন্য করেন। সুন্দর স্বপ্ন যদি পূরণ না হয় তবে বুঝতে হবে সেই স্বপ্নের বাস্তব রূপ কঠিন এবং অমঙ্গলকর। ‘
‘যাক গে, স্বপ্নটা কী দেখেছিলে?’
মুশরাফার মুখে খুশির রেশ। ঘুমজড়ানো মনে কী দুষ্টুমি ভর করল কে জানে। সে দুষ্টু হাসল। বলল,
‘আপনি আমায় ভালোবাসেন?’
এ কেমন প্রশ্ন! রাত দুটোয় ঘুমের ঘোরে কেঁদে অস্থির মেয়ের পাশে থাকা মানুষকে বলছে ভালোবাসে কি না! জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকে তাকাল, ‘কেন?’
মুশরাফা বিজ্ঞ গলায় বলল,
‘ স্বপ্নের কথা কেবল দুই শ্রেণির মানুষকে বলা যাবে। এক, ধর্ম সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান রাখে। যে স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে জানে।
দুই, আপন এবং ভালোবাসে এমন মানুষ। যে শুভাকাঙ্ক্ষী, সব সময় ভালো চায়। আপনি কোন শ্রেণির মধ্যে পড়েন? স্বপ্নের ব্যাখ্যা তো জানেন না। যদি ভালোবাসেন তবে আপনাকে স্বপ্নের কথা বলা যাবে, নয়তো যাবে না।’
জাওয়াদ কেমন ক্ষ্যাপা চোখে তাকাল। রেগে রেগে বলল, ‘ বললে কী হবে?’
‘ স্বপ্নের ব্যাখাকারী আর শুভাকাঙ্ক্ষী ছাড়া স্বপ্নের কথা কাউকে বলতে নেই। কারণ, কাউকে স্বপ্নের কথা বললে, সে যদি স্বপ্নের ভুল ব্যাখা করে তবে তা ফলে যায়। ‘
জাওয়াদ জানতো না ব্যাপারটা। ‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ। ‘
‘ভালো স্বপ্ন দেখলে কী করতে হয়?’
মুশরাফার ঘুমভাব চলে গেছে। বেশ গম্ভীরতা তার চোয়ালে। ইসলাম সম্পর্কে বলতে গেলে গম্ভীর হতে হয়। হেসে খেলে ভুল বলল ঈমান নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
‘ যদি কেউ ভালো স্বপ্ন দেখে, তবে তাকে তিনটি কাজ করতে হবে।
এক. আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করে ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ বলবে।
দুই. এটা অন্যকে সুসংবাদ হিসেবে জানাবে।
তিন. স্বপ্ন এমন ব্যক্তিকে বলবে, যে তাকে ভালোবাসে। আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ এমন স্বপ্ন দেখে, যা তার ভালো লাগে, তাহলে সে বুঝে নেবে, এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে। সে এ স্বপ্নের জন্য আল্লাহর প্রশংসা করবে আর অন্যকে এ ব্যাপারে জানাবে। আর যদি এমন স্বপ্ন দেখে, যা সে পছন্দ করে না, তাহলে বুঝে নেবে, এটা শয়তানের পক্ষ থেকে। তখন সে এ স্বপ্নের ক্ষতি থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করবে এবং বাঁদিকে তিনবার থুতু নিক্ষেপ করবে। আর কাউকে এ স্বপ্নের কথা বলবে না। মনে রাখবে, এ স্বপ্ন তার ক্ষতি করতে পারবে না।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৫৮৩)’
জাওয়ার নড়ে চড়ে বসল। আগ্রহী গলায় বলল, ‘আর খারাপ স্বপ্ন দেখলে কী করতে হবে?কত ভয়ানক স্বপ্ন আসে, ভীষণ ভয় লাগে তখন।’
মুশরাফা ধীর স্বরে বলল,
‘ খারাপ স্বপ্নে ভয় বা বিচলিত হওয়ার কারণ নেই। কেউ খারাপ স্বপ্ন দেখলে পাঁচটা কাজ কাজ করবে তাহলে খারাপ স্বপ্ন তার ক্ষতি করতে পারবে না।
এক. এই স্বপ্নের ক্ষতি ও অনিষ্ট থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করবে এবং তিনবার ‘আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম’ পড়বে। (মুসলিম, হাদিস : ২২৬২)
এ ক্ষেত্রে এই দোয়াও পড়া যায় : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজু বিকা মিন শাররি হাজিহির রুইয়া।’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে এই স্বপ্নের অনিষ্ট থেকে পরিত্রাণ চাই।
দুই. বাঁদিকে তিনবার থুতু নিক্ষেপ করবে। (মুসলিম, হাদিস : ২২৬১)
তিন. যে কাতে ঘুমিয়ে খারাপ স্বপ্ন দেখেছে, তা পরিবর্তন করে অন্য কাতে শুতে হবে। (মুসলিম, হাদিস : ২২৬২)। অবস্থা বদলে দেওয়ার ইঙ্গিতস্বরূপ এটা করা হয়ে থাকে।
চার. খারাপ স্বপ্ন দেখলে কারো কাছে বলবে না। আর নিজেও এর ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করবে না। (বুখারি, হাদিস : ৬৫৮৩)
পাঁচ. স্বপ্ন দেখার পর ঘুম ভেঙে গেলে উঠে দুই রাকাত নামাজ পড়বে। (মুসলিম, হাদিস : ২২৬৩)’
জাওয়াদ খানিকক্ষণ ভাবল, তারপর বলল, আমি আজ প্রথম শুনেছি। পরের বার থেকে মাথায় রাখব।’
থেমে প্রশ্নবোধক চাহনিতে বলল, ‘তুমি ভালো স্বপ্ন দেখেছো, তবে সুসংবাদ হিসেবে আমাকে জানাচ্ছো না কেন?’
মুশরাফা চুপ রইল। ওর মা সম্পর্কে জাওয়াদকে কিছুই জানানো হয়নি, এখন স্বপ্ন সম্পর্কে বলতে গেলে কত প্রশ্ন সামনে আসবে। তখন কী জবাব দিবে সে? সে চাইছেনা সত্যের মুখোমুখি হতে। সে উদাসমনে ভেবে গেল। ওর ভাবুকতা দেখে জাওয়াদ আন্দাজ করল, যে ওর পরিবার নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে। ও বলল, ‘আচ্ছা বলা লাগবে না। ঘুমাও।’
মুশরাফা উঠে গেল। ওয়াশরুমে চলে গেল। ফিরে এসে জায়নামাজ হাতে নিল। ড্রিম লাইটের আলোয় তা দেখে জাওয়াদ প্রশ্ন করল, ‘এখন কিসের নামাজ পড়ছো?’
মুশরাফা জায়নামাজ বিছাতে বিছাতে বলল,
‘ যখন বেশি খুশি হয় তখন আল্লাহকে স্মরণ করতে বলা হয়েছে। এই মুহুর্তে আমার ভীষণ সুখীবোধ হচ্ছে। তাই আল্লাহকে স্মরণ করব, ধন্যবাদ দিব। এত সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখানোর জন্য একটু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাই যায়। দোয়া করব স্বপ্নে দেখা মানুষটার জন্য।’
মুশরাফার ঠোঁটের কোণে হাসি সরছেইনা। কী খুশি দেখাচ্ছে ওকে! জাওয়াদ ওকে দেখে ভাবল, একটা স্বপ্ন কাউকে এতটা সুখীবোধ করাতে পারে! কী এমন স্বপ্ন? কাকে দেখেছে? মা কে? হতে পারে। এত কষ্ট দেয়া মানুষটার জন্য এত ভালোবাসা কিভাবে আসে বুঝতে পারে না জাওয়াদ। তবে একটা কথা বেশ বুঝতে পারে, তা হলো মায়ের আদরের জন্য ব্যাকুল মেয়েটা। এই ব্যাকুলতা বিয়ের পর বেড়ে গিয়েছে, বোধহয় শ্বাশুড়ি মন্দ আচরণের পরেই। মেয়ে শ্বাশুড়ির মাঝে মাকে পাবার আশা করেছিল, না পেয়ে হতাশ হয়েছে। মা কেন যে ওকে আপন করতে পারেনা? একটু মা হয়ে দেখালে কী হয়? শ্বাশুড়ির মাঝে মাকে খুঁজে পেলে ওই নির্দয় মহিলা স্মরণে আসবে না। কাল ফিরেই মায়ের সাথে কথা বলতে হবে। খাটে বসে কত কী ভেবে গেল জাওয়াদ।
চলবে..
স্বর্ণাভ সুখানুভূতি। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
নিবেদন। (পর্ব- ৫)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
ফজর নামাজ পড়েই ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল জাওয়াদ। ওয়ারড্রবের উপর থেকে কুরআন শরীফ তুলে নিতে নিতে মুশরাফা বলল,
‘ ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ (সা.) থেকে বর্ণিত, একদা রাসুল (সা.) আমার ঘরে এসে আমাকে ভোরবেলায় ঘুমন্ত অবস্থায় দেখলেন, তখন আমাকে জাগিয়ে বলেন, মামণি, ওঠো! তোমার রবের পক্ষ থেকে রিজিক গ্রহণ করো! অলসদের দলভুক্ত হয়ো না। কেননা আল্লাহ তাআলা সুবহে সাদিক থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত মানুষের মাঝে রিজিক বণ্টন করে থাকেন। (আত-তারগিব ওয়াত তারহিব, হাদিস : ২৬১৬)’
জাওয়াদ বালিশ ঠিক করছিল। মুশরাফার মুখে হাদিসটা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। মুশরাফা একগাল হাসল। বলল, ‘ সুবহে সাদিক থেকে সুর্যোদয় পর্যন্ত যারা রবের স্মরণ করে। রিজিক পায় তারা। ঘুমালে রিজিক পাওয়া যায়না। যাক গে, এবার আপনি চাইলে ঘুমাতে পারেন।’ বলে কুরআন নিয়ে জায়নামাজে বসে পড়ল।
জাওয়াদ সোজা হয়ে বসে ভ্রু কুঁচকাল। এ কেমন অনুমতি! ঘুমানোর অপকারিতা ও বলছে, আবার ঘুমানোর কথাও বলছে! এই মেয়েটা ভীষণ চালাক। সোজা বলবে না, আপনি এটা করবে না। হাদিস শুনিয়ে বলবে আপনি চাইলে এটা করতে পারেন। সিদ্ধান্তের ভার জাওয়াদের উপর তুলে দিবে। কারণ ও জানে, অপকারিতা জেনে জাওয়াদ কখনো ওই কাজ করবে না। পরিশেষে মুশরাফার মতের প্রেক্ষিতেই কাজ করবে। হয় ও তাই। জাওয়াদ আবার বিছানায় পিঠ লাগাতে পারল না। রিজিক ভীষণ প্রয়োজন, আল্লাহ রিজিক না দিলে দিন ভালো যাবে না, বরকতময় হবে না। দিনের অগ্রগতির জন্য রিজিক প্রয়োজন। ঘুমের জন্য রিজিক হাতছাড়া করা উচিত হবে না। তারচেয়ে ভালো, না ঘুমানো। জাওয়াদ বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। চারদিক তাকিয়ে গিয়ে মুশরাফার পাশে গিয়ে বসল। মুশরাফা মৃদু শব্দে অর্থসহ কুরআন পড়ছে। জাওয়াদ বলল,
‘ জোরে পড়ো।’
মুশরাফার ঠোঁটে বিজয়ী হাসি। কুরআন পড়তে পড়তেই হাসছে সে। হাসতে হাসতে পড়ার শব্দটা খানিক বাড়াল। কেমন সুর তুলে পড়ে গেল, সুরা ইয়াসিন। যাকে বলা হয় কুরআনের হৃদয়।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘প্রত্যেক বস্তুরই একটা হৃদয় থাকে আর কুরআনের হৃদয় হল সুরা ইয়াসিন। যে ব্যক্তি সূরা ইয়াসিন একবার পড়বে, মহান আল্লাহ তাকে দশবার পুরো কুরআন পড়ার সওয়াব দান করবেন।’ (তিরমিজি)
হজরত ইয়াহইয়া ইবনে কাসির রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘যে ব্যক্তি সকালে সুরা ইয়াসিন পাঠ করবে সে সন্ধ্যা পর্যন্ত সুখে-স্বস্তিতে থাকবে। যে সন্ধ্যায় পাঠ করবে সে সকাল পর্যন্ত শান্তিতে থাকবে।’ (মাজহারি)
জাওয়াদ মনোযোগ দিয়ে শুনে গেল। হৃদয় শীতল হয়ে এলো ওর। কোন বাদ্যযন্ত্র নেই, কোন তাল নেই, তাও কী সুন্দর সুর! কী সুন্দর ছন্দ কুরআনের! শুনলেই আত্মরাত্মা ঠান্ডা হয়ে যায়। শরীরের নার্ভগুলো সচল হয়ে যায় যেন। প্রগাঢ় প্রশান্তিতে ছেয়ে যায় মন। জাওয়াদ তাকিয়ে রইল স্ত্রীর পানে, স্ত্রীর পড়া কুরআনের পানে। কী সুন্দর!
জাওয়াদ বলল, ‘আরেকটু জোরে পড়ো।’
মুশরাফা পড়া থামাল। কুরআন বন্ধ করে বলল,
‘পাশের ঘরে ফাবিহা আপুর হাজবেন্ড আছে। এর চেয়ে জোরে পড়লে আমার পড়া তার কানে যাবে। তখন আমার গুনাহ হবে।’
‘তোমার কুরআনের সুর গায়রে মাহরম শুনতে পারবে না! ‘
‘না। এতে ফেৎনার আশঙ্কা আছে।’
জাওয়াদ ভেবে দেখল, মুশরাফার কুরআন পড়ার সুর ভীষণ সুন্দর। আয়াতের পর চমৎকার ভঙ্গিতে অর্থ পড়ছে মুশরাফা। হৃদয়গ্রাহী এই সুর কোন পুরুষ শুনলে, অবাক হবে, মুগ্ধ হবে, দেখতে ইচ্ছে হবে, মনে কত ইচ্ছে জাগতে পারে। আর বেগানাপুরুষকে মুগ্ধ করা কোন পর্দাশীল মহিলার কাজ হতে পারেনা। তাই বোধহয় এই কাজ। জাওয়াদ নিজ মনেই সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা করল। এর মাঝে মুশরাফা করল কী? জাওয়াদের একবারে কাছ ঘেঁষে বসল। নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায় এমন। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকালে বলল, ‘এবার আমার পড়া আপনার কানে যাবে।’
মুশরাফা আবার পড়া শুরু করল।
ইন্নামা-তুনযিরু মানিত্তাবা‘আয্ যিকর অখশির্য়া রাহমা-না বিল্গাইবি ফাবার্শ্শিহু বিমাগ্ফিরতিঁও অআজরিন্ কারীম্।
অর্থ- তুমি শুধু তাদেরকেই সতর্ক করতে পার, যারা উপদেশ মেনে চলে এবং না দেখে দয়াময় রাহমানকে ভয় করে। অতএব তুমি তাদেরকে ক্ষমা ও মহা পুরস্কারের সংবাদ দাও।
এত সুন্দর, রোমান্টিক পদ্ধতিতে কুরআন পড়া যায় জানতো না জাওয়াদ। প্রথমে চমকে তাকাল, পরপরেই চমৎকার হাসল। একটা হাত মনের অগোচরেই চলে গেল মুশরাফার বাহুতে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্ত্রীর কুরআন তেলাওয়াত শুনে গেল জাওয়াদ। মুগ্ধঘন মুহুর্তের মাঝে সুরা ইয়াসিন পড়ে শেষ করল মুশরাফা। কুরআন বন্ধ করে জাওয়াদের দিকে তাকাল। জাওয়াদের চোখ মুগ্ধতা, দৃষ্টি তখনো ওর মাঝে। মুশরাফা ভ্রু নাড়াল, ‘কী!’
তড়িৎ চোখ সরাল জাওয়াদ। অন্যদিকে ফিরল। কী যেন ভাবল, তারপর বলল, ‘ আচ্ছা আমি যে তোমার তেলাওয়াত শুনলাম, আমার কি সাওয়াব হবে?’
‘হবে। তবে তেলাওয়াতকারীর সাওয়াব এবং মর্যাদা বেশি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা কুরআন তেলাওয়াত কর। কেননা কেয়ামতের দিন কুরআন তার তেলাওয়াতকারীর জন্য সুপারিশকারী হবে।’
কুরআনের একটি অক্ষর পাঠ করল ১০নেকি পাওয়া যাবে। তাই শোনা থেকে পাঠ করা উত্তম। ‘
জাওয়াদের মুখে হতাশা ছেয়ে গেল, ‘সেই ছোটোবেলায় কুরআন পড়া শিখেছি। এতদিনে সব ভুলে বসেছি। ‘ ওর চোখে অপরাধবোধ। মুশরাফা আলতো স্বরে বলল,
‘ আমি শিখিয়ে দিলে হবে?’
প্রশ্নের উত্তরে চমকাল প্রশ্ন করল জাওয়াদ, ‘তুমি শেখাবে! ‘ পরপরেই আশাভরা স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি কি পারব শিখতে? এই বয়সে এসে?’
মুশরাফা ধীর স্বরেই বলল, ‘দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত শিক্ষাজীবন। চেষ্টা করলে অবশ্যই পারবেন। কুরআন শেখাটা বেশি কঠিন না। ফজরের পর কয়েকদিন আমার সাথে বসবেন, আমি শিখিয়ে দিব। চেষ্টা করবেন?’
কুরআন পড়তে না পারার অপরাধবোধ অনেকদিন ধরেই খেয়ে যাচ্ছিল জাওয়াদকে। বিশেষ করে প্রতিদিন সকালে যখন মুশরাফাকে কুরআন তেলাওয়াত করতে দেখে তখনই পড়তে ইচ্ছে করে। শেখার সু্যোগ আসতেই হাতছাড়া করল না জাওয়াদ। উৎফুল্ল স্বরে বলল, ‘করাই যায়।’
মুশরাফা মজার স্থলে বলল, ‘কাল থেকে শুরু হবে আপনার টিউশন।’
মজার চেইন টানল জাওয়াদ, ‘তা টিউটর কি আমার কাছ থেকে ফি নিবে?’
মুশরাফা প্রফুল্লচিত্তে বলল, ‘টিউটর তার ফি আল্লাহর কাছ থেকে নিবে। ‘
কথা ভারি সুন্দর লাগল জাওয়াদের। ফি নিবে আল্লাহর কাছ থেকে! কী চমৎকার কথা। মুশরাফা কিছুক্ষণ জিকির করে উঠে দাঁড়াল। কুরআন রাখল ওয়াড্রবের উপর। রক্তিম মেঘ ঠেলে সূর্য উদয় হয়েছে পূর্বাকাশে। মুশরাফা আকাশ পরখ করে বলল,
‘বাইরে যাবেন?’
জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল, ‘এখন!’
‘হ্যাঁ। রাস্তা এখন মানুষ শূন্য, ঠান্ডা বাতাস বইছে। ফুটপাতের ধারে হাঁটতে বেরোনোর জন্য চমৎকার সময়। যাবেন?’
জাওয়াদ ভাবনা চিন্তা শেষে সায় জানাল। মুশরাফার মত স্ত্রী থাকলে জীবন সুন্দর। এর সৌন্দর্য উপভোগ করা জাওয়াদের মতো স্বামীর জন্য বাধ্যতামূলক এবং আনন্দের।
•
তখন সন্ধ্যাবেলা। ক্লান্ত বদনে অফিস থেকে ফিরেছে জাওয়াদ। আজ বাসায় যাবার কথা থাকলে ও যাওয়া হয়নি। অফিস শেষে মামা শ্বশুর বাসায় এসেছে। রুমের ভেজানো দরজা ঠেলে সালাম দিল,
‘আসসালামু আলাইকুম।’
গালে হাত দিয়ে চেয়ারে বসে আছে মুশরাফা। টেবিলের উপর ল্যাপটপ মেলে ধরা, উদাস চোখে পর্দায় তাকানো সে। জাওয়াদের কথার খেয়ালটি নেই। ফলাফল হিসেবে সালামের উত্তর এলো না। ভ্রু কুঁচকে ভেতরে ঢুকল জাওয়াদ। মুশরাফার গভীর দৃষ্টি পরখ করে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বলল,
‘ আপনার মন কোন দুনিয়ার বিচরণ করছে?’
মুশরাফা চমকে উঠে তাকাল। পরপরেই শূন্য চোখ তাকিয়ে বলল,
‘পরীক্ষার রুটিন দিয়েছে। ‘
টাইয়ের নাট ঢিলে করে জাওয়াদ বলল, ‘ভালো তো।বই গুলে পানি খেয়ে নিন।’
‘কিছুই পড়া হয়নি এখনো।’
‘সারাবছর গায়ে বাতাস দিয়ে ঘুরলে পড়া হবার কথাও নয়।’
‘ইচ্ছে করে ঘুরেছি আমি!’
‘তা নয়তো কি আমি ঘুরিয়েছি!’ ফ্যানের নিচে বসে বলল জাওয়াদ। মুশরাফা কেমন রাগ রাগ চোখে তাকাল। জাওয়াদের হাসি পেয়ে গেল। দুষ্টুমির স্থলে বলল,
‘ এভাবে তাকিয়ে লাভ নেই। আগেই বলে দিচ্ছি, আমি তোমাকে জানালা দিয়ে নকল টকল সাপ্লাই দিতে পারব না।’
মুশরাফা যথেষ্ট ভালো ছাত্রী। দ্বিতীয় বর্ষে ওর রেজাল্ট ছিল ৪.৬৬। বিয়ে, সংসারের ভার বয়ে বেড়াতে গিয়ে তৃতীয় বর্ষে বইমুখো হতে পারেনি। নয়তো এতদিনে পড়া কমপ্লিট হয়ে যেত। ভালো ছাত্রী হওয়ার দরুন পরীক্ষার চিন্তা একটু বেশিই ঝেকে বসেছে ওর মাথায়। তারউপর জাওয়াদের এমন উদ্ভট কথা যেন রাগের জোগান দিচ্ছে। এত বছরের শিক্ষা জীবনে নকল তো দূরে থাক, কপি অবধি করেনি, সেখানে জাওয়াদ কীসব বলছে! মুশরাফা চোখ রাঙাল, ‘ আপনার আমাকে নকল করে পাশ করা মেয়ে মনে হয়!’
জাওয়াদ নিষ্পাপের ভান করে বলল,
‘ আমি তো তোমার সাথে ছিলাম না তাই বলতে পারছি না। করতেই পারো। অসম্ভব তো না। তাছাড়া নকল টকলের বেলায় মেয়েরা এক্সপার্ট হয় বেশি। ওড়নায় গিট বেধে চিরকুট নিয়ে যায়। কতগুলো মেয়ের বয়ফ্রেন্ড এসে জানালা দিয়ে চিরকুট সাপ্লাই দেয়।’
মুশরাফার রাগ বাড়ল তরতর করে, ‘কোন প্রতিষ্ঠানে জানালা দিয়ে চিরকুট ছুঁড়াছুঁড়ি হয়, নাম বলুন। আমি মামলা ঠুকে দিব। ‘
‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করো না, রাফা। সত্যি করে বলো, নকল টকল করো তুমি?’
মুশরাফা বুঝল জাওয়াদ ইচ্ছে করে ওকে রাগাচ্ছে। মুশরাফাকে খুব একটা রাগতে দেখা যায় না। আজ ওর রাগ মাখা মুখ দেখে ওকে রাগানোর সুযোগ মিস করছে না। মুশরাফা আবার চোখ রাঙাল, ‘আপনি ফ্রেশ হতে যাবেন!’
জাওয়াদ সেসবে কান দিল না। ঠায় বসে রইল। গুরুগম্ভীর ভঙিমায় বলল,
‘ তোমার কথা ঘুরানো দেখে আমার রীতিমতো চিন্তা হচ্ছে। ভয় হচ্ছে, এই বুঝি তুমি বলো নকল সাপ্লাই করতে। জোর টোর করে না আবার জানালার কাছে নিয়ে দাঁড় করাও। তারপর যদি নকল সাপ্লাই করতে গিয়ে ধরা খাই, ঘটনা চারকান হলে আমার মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না রাফা। তাই বলি কি, একটু ভালো করে পড়ো। টেনেটুনে সৌজন্যপাশ করলেও সমস্যা নেই, আমি কিছু বলব না। তাও নকল করো না। প্লিজ!’
মুশরাফা তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে আছে। দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘আপনি কি যাবেন!’
জাওয়াদ উঠে দাঁড়াল। ওয়াশরুমের দিকে হাঁটা ধরে মুখ চেপে হাসল। হাসি থামিয়ে বলল, ‘ আমাকে নকল সাপ্লাই দিতে বলো না, প্লিজ!’
ওয়াশরুমের দরজা দিয়ে হেসে গেল কিছুক্ষণ। মুশরাফা রাগত চোখেই তাকিয়ে আছে দরজায়,পরপরেই ল্যাপটপের স্ক্রিনে। ‘আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম।’ পড়ে রাগ নিয়ন্ত্রণ করল। তারপর বই মেলে পড়তে বসল।
একটানা আধঘন্টা পড়ল। গলা শুকিয়ে গেলে পানি খেতে উঠল। পানির বোতলটা খালি। মুশরাফা পানির বোতল হাতে রুম থেকে বেরোল। ফিরে এসে দেখল জাওয়াদ খাটে বসা। সবে বেরিয়েছে।মনোযোগ দিয়ে ফোন দেখছে। মুশরাফাকে দেখে চমৎকার হাসল। মুশরাফা কড়া স্বরে বলল,
‘ আমি পড়তে বসছি, কোনরূপ বিরক্ত করবে না।’
জাওয়াদ নিরীহ ভঙ্গিমায় বলল,
‘ একটা কথা শুনো। তারপর আর বিরক্ত করব না।’
মুশরাফা টেবিলে বসে বলল, ‘কী!’
জাওয়াদ বলল, ‘ অনেকদিন ঘুরাঘুরি হয়না। চলো সিলেট থেকে ঘুরে আসি?’
মুশরাফার নিভে যাওয়া রাগটা আবার যেন উঁকি দিল। রাগমাখা চোখে তাকাল। জাওয়াদ কোমল স্বরে বলল, ‘ তুমি কি খরচের ভয় পাচ্ছো? তোমাকে একটাকাও দিতে হবে না, সব খরচ আমার। আমি দয়ালু মানুষ, ঘুরতে যাবার সময় ওমন এক আধজনকে মানিব্যাগে ভাজ করে ও নিয়ে যেতে পারি। বিছানাকান্দি, রাতারগুল, জাফলং, ভেলাগঞ্জ, লাক্কাতুরা চা বাগান, লালাখাল সব জায়গা ঘুরব। তোমার জন্য এক সপ্তাহের ফ্রি ট্রিপ। যাবে না কি! ‘
মুশরাফা ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘ আপনি কি আমাকে রাগানোর ফন্দি নিয়ে অফিস থেকে ফিরেছেন?’
জাওয়াদকে প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে। সে অবাক হয়ে বলল, ‘ আমি তোমাকে রাগাব কেন! ‘
‘ আপনি ভালো জানেন।’
‘ পড়ার চিন্তায় তুমি উলটো পালটা ভাবছো। এত চিন্তা করার কিছু নেই। আচ্ছা যাও, আমি জানালায় গিয়ে দাঁড়াব। ধরা খেলে মুখ ঢেকে চলবো। এবার অন্তত চলো ট্রিপে। তুমি বললে আজ রাতেই বেরিয়ে পড়ব আমরা।’
মুশরাফা মাথা চেপে ধরল। মুখে বিড়বিড় করে আউজুবিল্লাহ পড়ছে সে। অসহায় সুরে বলল,
‘ এমন করছেন কেন? আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে।’
‘তোমার রাগ হচ্ছে? কোথায়? দেখি?’ জাওয়াদ উঠে এলো। মুশরাফার মুখে নেড়েচেড়ে দেখল। মুশরাফা অনুরোধের সুরে বলল,
‘ আমাকে পড়তে দিন প্লিজ!’
জাওয়াদ থামল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘পড়বে? আচ্ছা পড়ো। আমি অনিকের বাসায় যাচ্ছি।’ মুশরাফার মাথায় হাত দিয়ে হাঁটা ধরল। মুশরাফা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। জাওয়াদ দরজা অবধি গিয়ে আবার পিছন ফিরল। অনুরোধের সুরে বলল,
‘ আমি তোমাকে নকল সাপ্লাই করতে গিয়ে ধরা পড়েছি জানলে মা খুব কষ্ট পাবেন। প্লিজ ভালো করে পড়ো!’
মুশরাফা আবার চোখ রাঙাল। জাওয়াদ হাসল। বলল, ‘পড়া শেষ হলে ফোন দিও।’
জাওয়াদ চলে গেল। বসার ঘরে নাজমুল সাহেব বসা ছিলেন। জাওয়াদকে দেখে ডাকলেন। শ্বশুর জামাইয়ের আড্ডা বসল। আড্ডার মাঝেই নাজমুল সাহেবের ফোন বাজল। পর্দায় চোখ রেখেই থমকালেন, লায়লার ফোন! হঠাৎ! আবার কীছু হলো না কি!
ফোন ধরতেই বেরিয়ে এলো আরেকটা বিভীষিকাময় অধ্যায়।
চলবে..
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা