একজন রুশা,৭ম পর্ব
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
নৈঋত আসলেও হীরের টুকরা ছেলে। এই যুগে এমন মানুষ কমই পাওয়া যায়। নাহারের মৃত্যুর পরে মতিউর রহমান সাহেবকে রুশা নিজের কাছে নিয়ে এসেছিল কয়েকদিন বাবার সাথে কাটাবে বলে। বাবা-মায়ের বন্ধন বড় দৃঢ় ছিলো। জোড়া ভেঙে গেলো। মতিউর রহমান মানসিক ভাবে বড্ড অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। রুশা তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে আসলো বাবার এবং নিজের কষ্ট একটু হলেও কমানোর জন্য।
বিধি বাম। কয়েকদিনের মাথায় মতিউর রহমান সাহেব ভয়ংকর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। যমে-মানুষে লড়াই। হাসপাতালে থাকতে হলো অনেকদিন, তারপরে আবার রুশার বাসায়।
নিজের আরাম আয়েশ, আড্ডা-ভালো লাগা, লেখাপড়া সব শিকেয় তুলে নৈঋত নানার সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লো। মতিউর রহমানের ছেলেরা,অন্যান্য নাতি, আত্মীয় স্বজন সবাই মিলে যা করেছে, নৈঋত একা তার চেয়ে বেশি করেছে। নানার কাছে হাসপাতালে থাকা,খাইয়ে দেয়া,ধরে বাথরুমে নেওয়া, কমোডে নানাকে ধরে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকা, পরিস্কার করে দেওয়া, রাত দুপুরে
ডাক্তার-নার্স ওষুধের স্লিপ ধরিয়ে দিলে তৎক্ষনাৎ তা কিনে আনা, সব এক হাতে সামলেছে নৈঋত। নানার গুরুতর অসুস্থতার সময়ে টানা সাত রাত সাত দিন ঘুমায়নি নৈঋত। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি। কেউ তাকে এতো করতে জোর করে নি, নিজের ইচ্ছেতেই সে এসব করেছে। নানার টানে করেছে, আবার মা রুশার উপরে যেন বেশি চাপ না পড়ে,সেই চিন্তা থেকেও করেছে। নানা প্রাণভরা দোয়া দিয়ে গেছেন এই নাতিকে।
রুশার একাধারে মাতৃশোক, বাবার জন্য প্রবল দুশ্চিন্তা, আর ঘর ভরা মেহমান। রুশার বড় বোন রশ্মিও চলে এসেছিলেন বাবার অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে, দুই বোন মিলে সব ধকল সামলে নিলেন।
নৈঋত এমনই। দয়ালু,সেবাপরায়ণ। সেবাপরায়ণাতার গুণটা সে বাবার কাছ থেকে পেয়েছে। রুশার আগে এই গুণটা কম ছিলো। সে হাড়ভাঙা খাটনি খাটতো, রাত জেগে থাকতো, কিন্তু বমি,মলমূত্র পরিষ্কার করাটা সে পারতো না। সেবার ব্যাপারে রফিক সাহেব ওস্তাদ। নৈঋত বাবার যোগ্য উত্তরসূরী।
কতো কঠিন কঠিন সময় জীবনে এসেছে রুশার। অবশ্য সবার জীবনেই আসে। মুক্তিযুদ্ধের সময় রুশার বয়স পনেরো। তাদের বাসার পাশেই পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্প করেছিলো। যে মানুষটা দিনরাত উচ্ছ্বল প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াতো, বনে বাদাড়ে মনের সুখে ঘুরে বেড়াতো, পুকুর বা নদীতে বন্ধুদের সাথে পাল্লা দিয়ে সাঁতার কাটতো, স্কুলে যেতো, গান গাইতো, গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে পেয়ারা খেতো, তাকে দশটা মাস বদ্ধ ঘরে লুকিয়ে থাকতে হলো। নাহার বানু মেয়েকে কোণার দিকের ঘরে এমন ভাবে লুকিয়ে রেখেছিলেন, কাকপক্ষীও টের পায়নি এ বাড়িতে এক সদ্য তরুণী , পরমা সুন্দরী বাস করে। ঐ যে বন্দী হলো, আর স্বাধীন হতে পারলো না রুশা। বিজয়ের দুই মাসের মাথায় বিয়ে, তার এক বছরের মধ্যে নৈঋত, তার দশ মাসের মাথায় নৈঋতের পোলিও,চিকিৎসা নিয়ে ছোটাছুটি, এরপর উত্তরা, তারপরে ঈশানী, সংসারের জালে জড়িয়ে পড়া। রান্না করো,খাও,খাওয়াও, বাচ্চা পালো, মেহমান সামলাও। দুইটা শখ ধরে রেখেছে রুশা, গান গাওয়া আর নানা রকম গল্পের বই, পত্রিকা পড়া। বই পড়ার অতি নেশার জন্য মায়ের হাতে পিটান কম খায়নি রুশা। বিয়ের পরে দুধ জ্বাল দিতে যেয়ে বা রান্না বসিয়ে রুশা গল্পের বইতে হারিয়ে যেতো, প্রায়ই দুধ পুড়ে গেলে রুশার হুঁশ ফিরতো। একদিন রফিক সাহেব রাগ করে রুশার হাত থেকে গল্পের বই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। তবু রুশা বইয়ের নেশা কাটাতে পারে নি। রুশা গানও ছাড়েনি। রফিক সাহেব স্ত্রীর গানের একনিষ্ঠ ভক্ত। রুশার শ্বশুর-শাশুড়িও বড়ই আহ্লাদিত ও গর্বিত হতেন পুত্রবধূর সঙ্গীত সাধনায়।
রুশার বড় বোন রশ্মিও খুব ভালো গান গাইতেন। এক অনুষ্ঠানে তাঁর গান শুনে,সেই সাথে আচার ব্যবহার ও সুন্দর মুখখানা দেখে শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাঁকে ছেলের বৌ নির্বাচন করেন। এবং বিয়ের পরে তাঁর গান গাওয়ার উপরে আজীবন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
একবার রফিক সাহেব জন্ডিসে আক্রান্ত হলেন। বিলিরুবিন হু হু করে বাড়তে বাড়তে বিপদসীমা অতিক্রম করলো। রফিক সাহেব খেতে পারেন না,তীব্র অরুচি, বমি। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। ডায়াবেটিস থাকায় অবস্থা আরও সঙ্গীন। ঈশানীর ও সেই সময় ধূম জ্বর এবং পক্স। রুশা আর নৈঋত মিলে সব সামাল দিলো। হাসপাতাল,বাসা। বাসা,হাসপাতাল। দিন-রাত একাকার হয়ে গেলো। উত্তরা তখন হোষ্টেলে। সামনে পরীক্ষা। তার কাছে অনেক কিছু গোপন রাখা হলো। উত্তরা তাও কান্নাকাটি করে,বাসায় আসতে চায়। রুশা কঠোর ভাবে না করে দেয়। ঈশানীর অসুখের কথা উত্তরার কাছে সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়। ঐ সময়ে উত্তরার একমাত্র খালুর হার্টে বড় সমস্যা ধরা পড়লো। বাইপাস সার্জারির জন্য রুশার বোন দুলাভাই দিল্লিতে গেলেন। বোনকে রুশা খুব ভালোবাসে। দুলাভাইয়ের জন্য গভীর দুশ্চিন্তা। বিপদের এখানেই শেষ নয়। খবর আসলো, মতিউর রহমান সাহেবের অবস্থা এখন -তখন। খুলনায় হাসপাতালে ভর্তি। চিকিৎসকরা চিন্তিত। যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
স্বামী,মেয়ে,বাবা,দুলাভাই। রুশার উপায় নেই বাবাকে দেখতে যাওয়ার।সে ও নৈঋত হাসপাতাল সামলায়,বাসা সামলায়। ছোট্ট ঈশানীকে ততোটা সময় মা-ভাই দিতে পারে না। বোনের মেয়ে মীরা চলে আসে। ঈশানীর যত্ন করে। প্রতিবেশীরা খুব খোঁজ খবর নেন। আর সেই প্রবল দুঃসময়ে খুবই কাজে এসেছিল বাড়ির কিশোরী গৃহকর্মী রোজিনা।
একসময় বিপদের কালো রাত কেটে যায়। একে একে সবাই আল্লাহর অশেষ রহমতে সুস্থ হয়ে যান। জীবন আবার ছন্দ ফিরে পায়, সবকিছু স্বাভাবিক হয়। অনেকে বড় অবাক হয়। এতো বড় বিপদ গেলো, এতোদিন ধরে, রুশার চোখে কেউ এক ফোঁটা পানি দেখে নি, তাকে অস্হির হতে দেখেনি, আহাজারি বা হা হুতাশ করতে দেখেনি। রুশার অবিচল ধৈর্য্য, শান্ত ও শক্ত হাতে চারিদিক সামাল দেওয়া, নিষ্ঠার সাথে নিজ দায়িত্ব পালন করা অনেককে আকৃষ্ট ও অনুপ্রাণিত করে।
আল্লাহর প্রতি রুশার অগাধ বিশ্বাস ও ভরসা। বিপদে আপদে বিচলিত হওয়া বা অন্যকে বিচলিত করা তার অপছন্দ। আল্লাহর সিদ্ধান্তের উপর তো কোনো কথা নেই। আল্লাহ ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন, তা হবেই। তা খন্ডানোর সাধ্য কারোর নেই। তবে হ্যাঁ, আল্লাহ পাক হাত গুটিয়ে বসে থাকতে বলেন নি। চেষ্টা করতে বলেছেন। দোয়া আর দাওয়া দুইই রুশার কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ।
রুশার তিন সন্তানই তাদের নানা-নানীর অত্যধিক প্রিয় নাতি -নাতনি ছিলো।উত্তরা ছিলো নাহার বানুর নয়ন মনি। নাহারের বড্ড শখ ছিল উত্তরার বিয়ে দেখা। তাঁর সেই শখ পূরণ হয় নি। তাঁর মৃত্যুর তিন বছর পরে উত্তরার বিয়ে হয়। উত্তরার বিয়ের সময় রুশা ভীষণ কেঁদেছিল সবাইকে অবাক করে দিয়ে। কারণ, লৌহমানবী রুশাকে সবাই খুব কমই কান্নাকাটি করতে দেখেছে। আসলে রুশার ঐ কান্নাতে উত্তরাকে বিদায় দেওয়ার কষ্ট ছাড়াও মায়ের জন্য প্রবল শোক মেশানো ছিলো।
“তাও ভালো,উত্তরার বিয়ে আব্বা দেখে গিয়েছেন, ” রুশা ভাবে। আট ছেলেমেয়ের সন্তানদের মধ্যে একমাত্র উত্তরার বিয়েতে থাকতে পেরেছেন মতিউর রহমান সাহেব। আর মৃত্যুর ঠিক তিন মাস আগে এক পৌত্রির বিয়েতে। সেটা সম্ভব হয়েছে তাঁরা তখন একই জায়গায় বাস করতেন বলে।যদি অন্য কোথাও থাকতেন, তবু কেউ যেয়ে বলতো না,”আব্বা,আপনার নাতনির বিয়ে। আপনাকে ছাড়া হবে না।” বৃদ্ধ বাবা-মা’কে আসলেই তাঁদের ছেলেমেয়েরা কোনো না কোনোভাবে অবহেলা করেছে,প্রাপ্য গুরুত্ব ও ভালোবাসাটুকু দেয় নি।
তের বছর বয়সে মা হারানো সেই ব্যথাতুর অসহায় কিশোর, আঠাশ-ঊনত্রিশ বছর বয়সে নিজের দেশ হতে বিতাড়িত সেই তরুণ, স্ত্রীর মৃত্যুর সাত বছর পরে অল্প কদিন জ্বরে ভুগে অন্য ভুবনে চলে যান। তাঁর শেষ জন্মদিনের ঠিক পরের দিন।
রুশা তখন সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী। তার মেরুদণ্ডের কয়েকটি চাকতি সরে গিয়েছে। একা একা পাশও ফিরতে পারে না। রফিক সাহেব ছাড়া কারোর সেবা সে গ্রহণ করে না। রফিক সাহেব একই সাথে পিতা ও স্বামীর ভূমিকা নিয়ে রুশার দেখাশোনা করেছেন। রুশাকে খাওয়ানো, শরীর মুছিয়ে দেওয়া, মুখ ধোয়ানো, পরিষ্কার করানো, অতি সাবধানে জামাকাপড় পাল্টে দেওয়া যেন রুশা ব্যথা না পায়, মোট কথা রুশার যাবতীয় কাজকর্ম। রুশার অসুস্থতায় পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল রফিক সাহেবের।
সেই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে এক দুপুরে ফোনটা এলো। মতিউর রহমান সাহেব আর নেই। রুশার বাবা আর নেই। নৈঋত -উত্তরা-ঈশানীর নানা আর নেই। যে নানা চিঠিতে মজার মজার ছড়া লিখে নাতি-নাতনীদের নানাবাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাতেন,
তেলাপোকার চচ্চড়ি আর কোলা ব্যাঙের রোষ্ট,
গেষ্টরা হবেন খেয়ে খুশি, খাইয়ে খুশি হোস্ট,
এখন তাড়াতাড়ি চিঠি দিলে খুশি হবো মোস্ট,
অবশ্য ই লিখবে চিঠি বাই রিটার্ন পোস্ট।
রুশা জোরে কাঁদতেও পারলো না। কাঁদলেও শরীরে তীব্র ব্যথা। রফিক সাহেব কাঁদলেন। শ্বশুর -শাশুড়িকে তিনি অসম্ভব পছন্দ করতেন। শাশুড়ির জানাজায় শরিক হতে পারেন নি,আর শ্বশুরকে শেষ দেখাও দেখতে পারলেন না। রুশাকে এই অবস্থায় রেখে যাওয়া সম্ভব না। প্রায় পাঁচ -ছয় ঘন্টার পথ।
সব ছেলেমেয়েরা বাবাকে দেখলেন, “কানিজ কাদের” হতে মতিউর রহমান চির বিদায় নিলেন, শুধু রুশা দাঁড়িয়ে থেকে বাবাকে চিরবিদায় দিতে পারলো না।
চলবে।