একজন_রুশা,৯ম পর্ব

#একজন_রুশা,৯ম পর্ব
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

আপন বড় ভাই মারা গেছেন। আট ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড়। তাঁকে ভালোবাসতে পারতো না রুশা। তার বাবা-মায়ের সংসারের অনেক দুর্যোগ, দুঃসময়ের জন্য দায়ী এই ভদ্রলোক। বড় বিচিত্র চরিত্রের ছিলেন। খুবই সুদর্শন। লম্বা,ফর্সা। প্রমিত বাংলা,বিশুদ্ধ ইংরেজি উচ্চারণ। রুশার জন্মসালে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন। ঐ আমলে প্রথম বিভাগে। তীক্ষ্ণ মেধাবী ছিলেন। হা,হা করে হেসে, নানারকম মজার কথা বলে যখন যেখানে যেতেন,সেই জায়গা মাতিয়ে রাখতেন। ছোট ভাই বোনদের একদমই বকাঝকা করতেন না। বড় ভাই সুলভ গাম্ভীর্য নিয়ে থাকতেন না। কিন্তু গোড়া থেকেই সংসারের বাড়তি সুবিধাটা তিনি ভোগ করতেন। সকালে ছোট ভাই বোনেরা রুটি-ভাজি দিয়ে নাশতা করতো, তাদের সামনেই তিনি ডিম দিয়ে নাশতা সারতেন। এতোটুকু সংকোচ বোধ করতেন না। নাহার বানুও অন্য ছেলেমেয়েদের সামনেই যা কিছু ভালো,বড় ছেলেকেই দিতেন। এই ছেলে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হলেন, তখনও বাসা থেকে টাকা নেওয়া বন্ধ করলেন না। টিউশন করে নিজের পড়ার খরচ চালাতে পারতেন, লেখাপড়ার পাশাপাশি অন্য যে কোনো কাজ করতে পারতেন, করলেন না। বরং প্রায়ই বিভিন্ন বাহানায় টাকা চেয়ে পাঠাতেন।বাসার আর্থিক অবস্হা জেনেও একবার ভাবতেন না, বাবা-মা কিভাবে এতো বড় সংসার চালাচ্ছেন। পাশ করে তিনি দুর্দান্ত চাকরি পেলেন। তাঁর বিয়ে হলো। বৌটি বড় ভালো। কিছুদিন পরে তিনি চাকরি ছেড়ে দিলেন।
বেকার। এ নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নেই, আফসোস নেই। এরমধ্যে ঘর আলো করে সন্তানের জন্ম হয়। তিনি আরেকটি ভালো চাকরি পেয়ে যান। কিছুদিন পরে সেই চাকরিও ছেড়ে দেন। এভাবে চাকরি ধরেন আর ছাড়েন। এরমধ্যে তিন ছেলের বাবা হয়ে গেছেন। কিন্তু স্বভাবের কোনো পরিবর্তন ঘটে নি। প্রৌঢ় বাবা-মায়ের দিশাহারা অবস্থা। দিশাহারা অবস্থা নির্দোষ স্ত্রীর। বাচ্চারা মা সহ বেশির ভাগ সময় নানার বাড়িতে থাকে। কিংবা দাদাবাড়ি। ভদ্রলোক এরপরে শুরু করলেন বিভিন্ন জায়গায় ধার করা। পরিশোধের দায়িত্ব বাবা-মায়ের। তাও বাপ-মা’র রাগ হয়না। আহা! মনে হয় কোনো সমস্যায় পড়ে বাধ্য হয়ে ধার করেছে। বড় ভাইয়ের এহেন কার্যকলাপের বলি হতে হয় ছোট ভাইবোনগুলোকে।

এভাবেই সারাজীবন চালিয়ে গেলেন বড় ভাই। কখনো দায়িত্ব নেন নি কারো। শুধু নিয়েই গেছেন। আবার হাতে টাকা আসলে দেদারসে খরচ করতেন, একে এটা উপহার,ওকে সেটা উপহার। টাকা ফুরিয়ে গেলে আবার তিনি উধাও। কথা দিয়ে সহজেই প্রভাবিত করতে পারতেন বেশির ভাগ মানুষকে। তাই চলার পথে তাঁকে হোঁচট খেতে হয়নি কোনোদিন।

এমন স্বভাবের ভাইকে পছন্দ করতো না রুশা। বড় ভাই রুশার বাসায় প্রায় বেড়াতে আসতেন। রুশা অন্ধকার মুখে থাকতো। পারত পক্ষে ভাইয়ের সাথে কথা বলতো না। কিন্তু তাতে বড় ভাইয়ের কিছুই যেতো আসতো না।

আজ বড়ভাইয়ের আকষ্মিক মৃত্যুসংবাদ যখন এলো তখন রুশা উত্তরাকে দেখে কেবল গাড়িতে উঠছিলেন। আশফাকও তখন শাশুড়ির কাছে ছিলো। বড় মামা শ্বশুরের মৃত্যু সংবাদ এসেছে বুঝতে পেরে সে তটস্থ হয়ে শাশুড়ির মুখের দিকে তাকালো। রুশার মুখ হতবিহ্বল কিছুটা, কিন্তু ডাক ছেড়ে কান্না নেই, চোখে পানি পর্যন্ত নেই, আশফাক বুঝতে পারছিলো না কি করবে।

রুশা খুব স্বাভাবিক ভাবে আশফাকের সাথে কথা বার্তা বললো। সে বড় ভাইকে দেখতে খুলনাতে যাবে না,উত্তরার বাসাতেই আপাতত থাকবে, সেটা আশফাককে জানালো। আশফাক বেশ বিস্মিত হলো শাশুড়িকে ভেঙে পড়তে না দেখে। রুশা বললো,” তুমি যাও। উত্তরা একা আছে।”

রুশা গাড়িতে উঠে বোন রশ্মিকে ফোন করলো। বড় ভাইয়ের মৃত্যু বিষয়ে দু’একটা সাধারণ কথাবার্তা বললো স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। তারপরে ফোন করে খবর জানালো নৈঋতকে।

“নৈঋত, তোমার আব্বুকে এই ঘটনা জানানোর দরকার নেই। আমি যখন বাসায় ফিরবো,তখন ধীরে সুস্হে বলবো।”

এরপরে সে ফোন করলো দুই মেয়েকে। ঈশানী আর উত্তরাকে।

” তোমাদের বড় মামা কিছুক্ষণ আগে মারা গেছেন। দোয়া কোরো।বিচলিত হয়ো না। উত্তরা,একদম টেনশন কোরো না। আশফাক তোমার কাছে পৌঁছেছে? আমি ঠিক আছি। না,না, খুলনায় যাবো না। তোমার আর তোমার আব্বুর এই অবস্থায় যাওয়ার প্রশ্ন উঠে না। তুমি সাবধানে থেকো।”

দুই নাতি বারবার নানীর দিকে তাকাচ্ছে। নানা-নানী তাদের প্রাণ। নানীকে তারা আপা বলে ডাকে। আপার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?

কিছুই হয়নি এমন ভাবে রুশা নাতিদের সাথে কথা বলতে থাকলো। মৃত্যু বিষয়ক আর কোনো কথা নাতিদের সামনে তুললেো না। বেচারারা এমনি নিজেদের মায়ের ব্যাপারে মুষড়ে পড়েছে, এই মুহূর্তে মৃত্যু নিয়ে কথা বললে মায়ের কথা ভেবে তারা আরও ভয় পেয়ে যাবে।

বাসায় ফিরে রুশা হাতমুখ ধুলো, নাতিদের ধোয়ালো। নাতিদের নিয়ে খেতেও বসলো। খাবার গলা দিয়ে নামতে চাচ্ছে না,তাও।

নাতিরা ঘুমিয়ে পড়লো। অন্ধকার ঘরে বিছানায় শুয়ে রুশার মনে হলো দমটা যেন আটকে যাচ্ছে। এতো কষ্ট হচ্ছে কেন? কেন বড়ভাইয়ের বিভিন্ন সময়ের স্মৃতি হাজারে হাজারে ভীড় জমাচ্ছে মনে? রুশাকে ঘাড়ে নিয়ে বড় ভাই, কোলে নিয়ে বড় ভাই, সদা হাস্যময় বড়ভাই। রুশার কান্না আসছে ভীষণ, কিন্তু চোখ খটখটে শুকনো। এটাই রুশার বড় সমস্যা। সে সহজে কাঁদতে পারে না। এতে কষ্টটা বেশি হয়। তাছাড়া সবাই মনে করে,রুশা কঠিন মানুষ। বাস্তববাদী। সে শোককে সামাল দিতে পারে। কাজেই তার স্বান্তনার দরকার নেই।

কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, কেউ একটু মাথায় হাত রাখুক, দুটো স্বান্তনার কথা বলুক। বড় ভাইয়ের জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আহা রে বড় ভাই! আপনি আসলে কতো বিরক্ত হতাম আমি। আপনি এমন কেন ছিলেন বড় ভাই?

কয়েকদিন ধরেই রুশার মাথায় একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। বড় ভাই মানসিক রোগী নন তো? নইলে এতো মেধাবী, এতো চৌকস মানুষটি এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন, কিছুটা নীতিবর্জিত বোহেমিয়ান জীবন যাপন করতেন কেন? সত্যি যদি তিনি মানসিক রোগী হন, তাহলেতো তাঁর উপরে বড্ড অবিচার করা হয়েছে। আল্লাহ তাঁকে মাফ করে দিন।

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে উত্তরাও নানা কথা ভাবছিলো। বড় মামার মৃত্যুতে সে শোকাহত হয় নি। মামা তাকে আদর করতেন ভীষণ। বড় মামার কাছে উত্তরা প্রথম হুমায়ূন আহমদের নাম শুনেছিলো। তার তখন নয়-দশ বছর বয়স। মামা খুব প্রশংসা করছিলেন হুমায়ূন আহমদের, লেখা নাকি খুবই ভালো। নৈঋত আর উত্তরা তখনও হুমায়ূন আহমদের নাম জানে না দেখে তিনি দুই ভাইবোনকে প্রিয় লেখকের দুইটা বই কিনে দিলেন।

কোণ আইসক্রিমও প্রথম খাইয়েছিলেন বড় মামা। আইসক্রিম টুকু খেয়ে উত্তরা বিস্কিটটা ফেলে দিতে যাচ্ছিলো কনটেইনার ভেবে, বড় মামা হাঁ হাঁ করে আটকালেন।

“তোর বাপ-মা দেখি তোকে খাওয়া শেখায় নি রে। ”

নৈঋত, উত্তরা,ঈশানীকে নিয়ে শিশুপার্কে যেতেন মামা। খাইয়ে,ঘুরিয়ে আবার বাসায় ছেড়ে দিতেন। কখনো নিজে থেকে যেতেন। আবার একদিন উধাও হয়ে যেতেন। বড়মামাকে ভীষণ ভালোবাসতো উত্তরা, কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথে সে যখন ধীরে ধীরে অনেক কিছু বুঝতে শিখলো,তখন ভালোবাসা কমতে থাকলো, কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকলো।

উত্তরার শরীরটা বড় খারাপ লাগছে। এতো বড় একটা ধকল গেলো শরীরের উপর দিয়ে। আল্লাহ জানেন,বায়োপসি রিপোর্ট কি আসবে ।
হাসপাতালে থাকতে একটুও ভালো লাগছে না। মন বাসার জন্য অস্থির। টুকুন আজ নানীকে লুকিয়ে মায়ের কাছে এসে বলেছে,”কবে বাসায় আসবা মা?তোমাকে ছাড়া আমি একদম থাকতে পারছি না।” কথার সাথে চোখ ভাসিয়ে বড় বড় ফোঁটায় পানি। নানীকে লুকিয়ে বলার কারণ, নানী এতো আদর করে, অথচ টুকুন বলছে মা ছাড়া বাসায় ভালো লাগছে না।এ কথা শুনলে রুশার খুবই দুঃখ লাগবে, টুকুনের ধারণা।

আব্বুর শরীর ভালো যাচ্ছে না। আম্মা তার ছেলেদের আর সংসারের দেখাশোনা করছে। আম্মারওতো শরীর ভেঙে গেছে অনেকটা। তাই নিয়ে দৌড়াদৌড়ি।

নার্স আসেন,ডাক্তার আসেন, একই কথা তাঁদের, “ঘুমাচ্ছেন না কেন? এতো পেথিডিন দেওয়া হচ্ছে, তাও ঘুম আসছে না? প্লিজ, ঘুমানোর চেষ্টা করেন। ঘুমটা আপনার বড় দরকার।”

উত্তরা বলে,”আমাকে আরেকটা ঘুমের ওষুধ দেন।”

“অসম্ভব। একবার কড়া ডোজে দেওয়া হয়েছে, পেথিডিন দেওয়া হচ্ছে, আজ আর ঘুমের ওষুধ দেওয়া সম্ভব না। ”

ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয় না। তাই উত্তরার ঘুমও আসে না। নিদ্রাহীন সুদীর্ঘ রাত। বড্ড অস্থির লাগে।

আগের দিনগুলো কি সুন্দরই না ছিলো। লেখাপড়া নিয়ে যা একটু টেনশন।আর আব্বু-আম্মার ঝগড়া ঝাটি হলে একটু মন খারাপ। এর বাইরে শুধু আনন্দ আর আনন্দ। অতি অল্পতেই গভীর আনন্দ। বাসায় মেহমান এসেছে? মহানন্দ। নানা-নানী-মামা-খালা-চাচারা কেউ আসবে, থাকবে, আনন্দে দমবন্ধ হওয়ার যোগাড়। নতুন একটা গল্পের বই এসেছে বাসায়, সবার তখন আনন্দ। বই নিয়ে কাড়াকাড়ি, কে আগে পড়বে তা নিয়ে মহা বিতর্ক। রাতে বাসার পাঁচ সদস্য মিলে একসাথে খাওয়া,গল্প, টিভিতে ভালো প্রোগ্রাম হলে একসাথে টিভি দেখা, একসাথে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাওয়া,ঘুমানোর আগে নৈঋত বা ঈশানীর পিঠে সুড়সুড়ি দিয়ে দেওয়া, নানী বা দাদীকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে গল্প শোনা, আরও কতোশতো রঙিন মুহূর্ত! আর আজ ভয়ে ভয়ে থাকতে হয় কখন কোন পরমপ্রিয় মানুষের চিরতরে চলে যাওয়ার সংবাদ আসবে।

অনেক বেশি খারাপ লাগছে। একটু ঘুমের দরকার। শান্তিময় ঘুম।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here