#একজন_রুশা,পর্ব ৩
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
কেমন করে ছোট্ট বাচ্চাগুলো বড় হয়ে যেতে লাগলো। তিন ভাই বোনে ভারী মিল। ঝগড়াঝাটি খুব কম হয়,মারামারিতো হয়ই না। তিনজনই পিতৃ মাতৃ অন্ত প্রাণ। তারমধ্যে উত্তরার সবটাতে বাড়াবাড়ি। বাসার লোকজন ছেড়ে সে থাকতেই পারে না। ছোট বেলায় বিকাল হলে রুশা মেয়েকে সাজিয়ে দিতো, ভালো ফ্রক, জুতা, চুলে দুইটা ঝুঁটি। কপালে ছোট টিপ। তারপরে পাঠাতো বাইরে খেলতে। বাসার মধ্যেও বিরাট কম্পাউন্ড,ওখানেও খেলা করা যায়,কিন্তু রফিক সাহেবের অফিস ওখানে। ডিসটার্ব হতে পারে।
উত্তরাকে তার সঙ্গী সাথীর সাথে বিদায় করে রুশা একটু ঘুমিয়ে নিতো বা গল্পের বই পড়তো। তবে খুব বেশি হলে দশ মিনিটের মধ্যে দরজার কড়া নাড়ার শব্দ। বাসা থেকে বিশাল উঠান পেরিয়ে দরজা খুলতে হতো।দরজা খোলার পরে দেখা যেতো, উত্তরা দাঁড়িয়ে আছে।
” কি ব্যাপার মা?”
“তোমাকে দেখতে আসলাম।”
এভাবে প্রতি বিকেলে পাঁচ -ছ’বার করে মা’কে দেখতে আসা।
ভালোবাসার অত্যাচারে রুশার প্রাণ ওষ্ঠাগত।
শেষে একটা উপায় বের হলো। রুশার শোয়ার ঘরের জানালার পাশে স্হায়ী ভাবে একটা টুল বসানো হলো। ওখানে ছোট্ট একটা মাঠ। কেউ আসেনা। উত্তরাকে বলা হলো,মা’কে দেখার ইচ্ছা হলে সে যেন এই টুলে দাঁড়িয়ে মা’কে দেখে নেয়।তবে মা ঘুমালে কথাবার্তা না বলে।
না,উত্তরা কথা বলতো না। কিন্তু একটু পরপর টুলটায় দাঁড়িয়ে থাকতো। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের জোরে রুশার ঘুম ভেঙে যেতো। সে দেখতো, জানালায় চুলে ঢাকা ছোট্ট কপাল,আর ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা একজোড়া চোখ।
এই হলো উত্তরা। যাকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পরেই ঘর ছাড়তে হলো।মেডিকেলে পড়াশোনা, হোস্টেল,বিয়ে। রুশার চাওয়া ছিল মেয়ের কাছে, “খুব ভালো করে পড়বে, নিজের সমস্যা বুদ্ধি দিয়ে নিজে সমাধান করার চেষ্টা করবে, কখনো কোন বিষয়ে হাল ছেড়ে দিবেনা, কারোর উপরে কোন বিষয়ে মুখাপেক্ষী হবেনা, আর স্বাবলম্বী হতে হবে এ কথাটা মাথায় রাখবে।”
শিশুকালে উত্তরা ভারি সুন্দর ছিল। এবং অতি শান্ত। রাতে ঘুমাতো না। রুশা -রফিক দফায় দফায় প্রাণপনে মেয়েকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করতেন,প্রতিবার একই ফলাফল, উত্তরা তাকিয়ে আছে। অন্ধকারে তার ক্ষুদ্র চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু কোন কান্নাকাটি নেই, ছটফটানি নেই। বাপ-মা ঘুমিয়ে পড়লেও কোনো আপত্তি নেই। সে তার মতো থাকে, আপন মনে চেয়ে থাকে, কিছু চিন্তা করে কি না কে জানে। যতোই শান্ত ভাবে চুপচাপ শুয়ে থাকুক, বাচ্চা না ঘুমালে বাপ-মা স্বস্তিতে ঘুমাতে পারেন না। বিশেষ করে রুশা-রফিকের মতো সন্তান অন্ত প্রাণ বাবা মায়েরা। মেয়েটা আরেকটা বিষয় নিয়েও ভারি যন্ত্রণা করে। সে কেবল মায়ের কাছে খেতেই ভালোবাসে,অন্য খাবার তাকে খাওয়ানোই যায় না। রফিক সাহেব মেয়ের হাত-পা চেপে ধরে থাকতেন, রুশা বাচ্চার চিবুকে চাপ দিয়ে টিপে থাকা ঠোঁট দুটিকে ফাঁক করিয়ে চামচে করে তরল খাবার মুখে ঢুকিয়ে দিতো। মেয়ে কান্নারত অবস্থায় সেই তরল খানিকক্ষণ মুখে রেখে আবার ফেলে দিতো। উত্তরাকে খাওয়ানো ছিলো এক রকমের যুদ্ধ।
সেই চিনে পুতুলের মতো মেয়ে আস্তে আস্তে শুকাতে লাগলো। তেরো বছর বয়স থেকে একেবারেই সরু কাঠি। চেহারায় লাবণ্যের ছোঁয়ামাত্র নেই। রুক্ষ সূক্ষ্ণ পাতলা চুল। নৈঋত -ঈশানীর মতো মেধাবী নয়, তবে লেখাপড়ায় শ্রম দেয় বলে ভালো ফল করে। আর তার ভারি মায়া। বাপ-মা-ভাই-বোন তো আছেই, নানা-নানী,দাদা-দাদী, মামাখালা-চাচা-ফুপু-আত্মীয় স্বজন-বন্ধু বান্ধব সবার প্রতি তার প্রবল মায়া। “এতো মায়া ভালো না রে মা,” রুশা মনে মনে ভাবেন। এতে বহু কষ্ট পেতে হয়।
এই উত্তরার জন্য রুশা বাবার বাড়ি পর্যন্ত যেতে পারতেন না। বছরে সন্তানদের নিয়ে একবার বা দুইবার বাবার বাড়ি যেতেন রুশা, থাকতেন কয়েক দিন। যেতেই তো নয় দশ ঘন্টা লেগে যায়। রুশার বাবা-মাও বছরে একবার হলেও আসতেন, কমপক্ষে এক মাসের জন্য। কিন্তু বাপ -মায়ের বিপদে আপদে রুশার একা ছুটে যাওয়ায় সবচেয়ে বড় বাধা ছিলো উত্তরা। কেঁদে কেটে অসুস্থ হয়ে পড়তো সে।
এখন পরিণত বয়সের উত্তরার খুব আত্মগ্লানি হয়। রুশা-রফিককে দেখতে যেতে বড়জোর একঘন্টা লাগে, একই শহরে বাস, তবু উত্তরার ভীষণ কষ্ট হয়। মনে হয়, সবাই মিলে যদি একসাথে থাকা যেতো! আহা, মায়েরও তো এমন ইচ্ছা হতো, তাঁর বাবা-মা-ভাই-বোনের সান্নিধ্যে থাকার, কিন্তু সংসারের যাঁতাকলে পড়ে,বিশেষত উত্তরার কারণে রুশা মনের মতো করে কোথাও বেড়াতে পারে নি,নিজের বাবার বাড়িতেও না।
যে মেয়েকে বলতে গেলে বাল্যকালে তার তীব্র অমত সত্বেও জোর করে বিয়ে দিয়েছিলেন রুশার বাবা-মা, সেই মেয়েই তাঁদের অনেকটা ভরসাস্থল হয়ে উঠলো। কিন্তু তাঁরা রুশার জন্য ভরসার জায়গা হতে পারলেন না আর কোনোদিন। তাঁদের টাকা বেশির ভাগ ব্যয় হতো নিস্কর্মা বড় ছেলের পিছনে, আর ব্যয় হতো সবচেয়ে ছোট ছেলে রূপের জন্য। রূপ ছোটবেলায় অসম্ভব মেধাবী , নম্র,ভদ্র, ভালো ছেলে ছিলো, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যেয়ে তার পাখা গজালো। লেখাপড়ার থেকে আড্ডা,গান-বাজনা গুরুত্ব পেলো অনেক বেশি, তারপরে একসময় পড়লো ড্রাগসের খপ্পরে। এসব করার আগে একটিবার ভাবলো না অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা বাবা আর সারাজীবন সংসারের ঘানি টেনে আসা মায়ের কথা। ভাবলো না বড় ভাই বাদে তার অন্যান্য ভাইবোনগুলোর কথা যাদের বঞ্চিত করে তাকে আর বড় ভাইকে উজাড় করে দিয়েছেন বাপ-মা, সবচেয়ে বড় কথা,নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবলো না। দীর্ঘ সাত বছর ধরে সেসন জট, পরীক্ষা, অমুক সমস্যা, তমুক সমস্যার কথা বলে দফায় দফায় বাপ-মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট না করে বীরদর্পে ফেরত এলো উত্তরার ছোট মামা। এ নিয়ে তার কোন অনুশোচনা বা লজ্জাবোধ নেই। পরবর্তীতে এই ছেলেকে ভালো জায়গায় চাকরির ব্যবস্থা রুশা-রফিকই করে দিয়েছিল।
সবাই বলে,মায়ের চোখে সব সন্তান এক। আসলে কি তাই? তাহলে রুশার মা সব ছেলেমেয়েকে রুটি-ভাজি খেতে দিয়ে বড় আর ছোট ছেলের পাতে ডিম দিতেন কেনো প্রকাশ্যে? কেন শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে হয়েও রুশার ষোলো বছর বয়স হওয়ার আগেই তার বিয়ে হয়ে গেলো? কিসের তাড়া ছিলো অতো? কেন এক মেয়ের বিয়ে জৌলুষপূর্ণ ভাবে, অন্য মেয়ের বিয়ে একেবারেই অনাড়ম্বর ভাবে দেওয়া হলো? বিয়ে যখন এমন ভাবে দিলেনই,পরে কিছু করতে পারতেন মেয়েটার জন্য। করেন নি। মানব চরিত্র আসলেই খুব অদ্ভুত।
রুশার শাড়ি,গয়নার লোভ ছিলো না এতোটুকু। সে দগ্ধ হচ্ছিল বঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভে। কেন তার পরিবার এমন করলো তার সাথে?
রুশা খুব ভালোবাসে তার বাবা-মা-ভাই-বোনদের, কিন্তু আবেগশূন্য ভাবে। অন্য কোনো মেয়ে হলে হয়তো বা জোর করে তার হক আদায় করতো, নইলে বাপের বাড়ির সাথে দূরত্ব বজায় রাখতো। মান-অভিমান দেখাতো।রুশা কিছুই করে নি। তার বাসাটা সবসময় আত্মীয় স্বজন দিয়ে গমগম করতো, নিজের বাড়ির, শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের দিয়ে। এমনকি বাপ-মায়ের মৃত্যুর পরে তাঁদের সহায় সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারার সময় রুশা কোনো ভাগ নেয়নি,একটা পয়সাও কখনো নেয়নি বাপ-মা-ভাইদের থেকে।
উত্তরার কথায় ফিরে আসি।বিয়েতে উত্তরা বেশ কিছু গয়না পেয়েছিল। বাপ-মা সাধ্যমতো দিয়েছিলো,আশফাকও। অন্যান্য আত্মীয় পরিজন, এমনকি উত্তরার প্রাণের বান্ধবীরাও এক সেট সোনা-মুক্তা মিলানো গয়না দিয়েছিলো। উত্তরা এতোটুকু খুশি হয়নি গয়নাপ্রাপ্তিতে।গয়নাগুলো তার কাছে সাপের মতো মনে হচ্ছিলো। উত্তরা তার মা রুশাকে সারাজীবন নিরাভরণ দেখে এসেছে। রুশার ভাশুর-জা ভাতৃবধূকে অত্যধিক স্নেহ করতেন। তাঁরা রুশাকে একজোড়া ঝুমকো বানিয়ে দিয়েছিলেন। রুশা ভারী যত্নে ঝুমকোজোড়া তুলে রাখতো,মাঝেমধ্যে পরতো। রফিক সাহেব বিয়ের অনেক পরে লকেট সহ একটি চেইন আর একটি আংটি বানিয়ে দিয়েছিলেন। রুশার মা দিয়েছিলেন একজোড়া ইয়ার রিং,বেশ শক্ত -পোক্ত। রুশা গয়না পরতেো ই না।হয়তো কোন এক অজানা অভিমানে। বিয়ের দিন কি কোন বধূ একেবারেই গয়নাবিহীন থাকে?
উত্তরার দাদী কিছুটা অবুঝ ছিলেন। ছেলে বড় চাকরি করে,তাহলে মনে হয় অনেক টাকা। কিন্তু সব টাকা বৌ-বাচ্চার পিছনে খরচ করে নিশ্চয়ই। শামসুন্নাহার নিজের জন্য কোনদিন একফোঁটা কিছু চান নি, অবশ্য চাওয়ার কোন সুযোগও তাঁকে ছেলে-বৌরা দেন নি, শাড়ি-কাপড়, ওষুধ পত্র,পর্যাপ্ত হাতখরচ এগুলোর অভাব ছেলেরা শামসুন্নাহারকে টের পেতে দেন নি। শামসুন্নাহারের মূল চাহিদা ছিল তাঁর কোলপোঁছা মেয়ের ব্যাপারে। মেয়ের শরীরটা নাকি কাহিল লাগে,তাই মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি পাঠালেন না। নিজের জমিতেই ঘর তুলে দিলেন। মেয়ে প্রায় প্রতি বছর একটি করে সন্তান প্রসব করে। তখন তার ভালো-মন্দ খাওয়ার দরকার হয়। মেয়ের ভালো খাবারের দরকার, শাড়ি-কাপড়ের দরকার,টাকা দরকার, বাচ্চার খরচ দরকার,অন্য বাচ্চাগুলোর নতুন জামা দরকার, অমুকের লেখাপড়ার খরচ দরকার, তমুকের কলেজের বেতন দরকার। সব দরকার মেটাতে হবে শামসুন্নাহারের চাকুরিজীবী দুই ছেলেকে।
প্রায় ঈদেই রফিক সাহেব রুশাকে শাড়ি দিতে পারতেন না।রুশাও এটা নিয়ে কোন কথা বলতো না। একবার এক ঈদে বহু টানপোড়েন অবস্থা। রফিক বললেন,”এবারে আর বাবুদের কাপড় কেনার দরকার নেই। অনেক খরচ হয়ে গেছে।”
নৈঋত তখন হয়তো সাড়ে চার বছরের, উত্তরা দুই।
রুশা ঠান্ডা গলায় বললেন,”ঈদে ওদের নতুন কাপড় লাগবে।
পুরানো জামা পরে ওরা ঈদ করবেনা।”
“আহা! ওরাতো ছোট মানুষ। নতুন-পুরাতন কিছু বুঝে না।”
“ওরা না বুঝুক,আমি বুঝি।”
এমনই চলছিল অবস্হাটা। এতোদিনেও চিত্র খুব একটা পাল্টায়নি সমাজে। ছেলে ভালো অবস্হানে আছে, কাজেই ছেলেকে সবসময় একতরফা করে যেতে হবে নিজের আত্মীয় স্বজনের জন্য। সে বেচারা ভালো চাকরি করলেও যে তার টাকাপয়সা সীমিত হতে পারে, তা নিজের পরিবারই মানতে চায় না।দুনিয়াতে একপক্ষ শুধু করে যায়, আরেক পক্ষ শুধু নিতে আর সমালোচনা করতে পারে। দেওয়ার কথা,সে অর্থ হোক, অন্য উপহার হোক, বিপদে পাশে দাঁড়ানো হোক, তাদের মাথাতেই আসে না। আরও একটা অদ্ভুত নিয়ম, যে কলুর বলদের মতো মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সবার জন্য ত্যাগ স্বীকার করে, তার কাজের স্বীকৃতি কোনোদিন মিলে না, সমালোচনা ই তাদের প্রাপ্য, আর যারা গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়, দায়িত্ব কর্তব্য থেকে নিপুণ ভাবে গা বাঁচিয়ে চলে, তাদের কাছে কারো কোনো চাহিদাও থাকে না, তাদের সমালোচনা ও হয় না।
একদিন মায়ের করা লম্বা লিষ্ট দেখে রফিক না বলে পারলেন না,”মা,তুমি কি একবার ভাবো,আমাদের কি ভাবে চলে?এ পর্যন্ত কোনদিন জানতে চেয়েছো,ঈদে রুশার বা নৈঋত -উত্তরার নতুন কাপড় কেনা হয়েছে কিনা? আমার কথা ধরলামই না।”
“এ আবার কি কথা। তোমার বৌ-বাচ্চার নতুন কাপড় থাকবেনা,তাই কি হয়? কতো বেতন পাও তুমি।”
“কতো বেতন পাই বলোতো?তুমি জানো আমি কয়টা ঈদে রুশাকে শাড়ি কিনে দিতে পারিনি? ও তো চায়ও না কোনদিন।মা,তোমার হাতে তো কতো টাকা, কোনদিন আমার বৌ-বাচ্চাদের একটা কিছু কিনে দিয়েছো? তোমার শুধু শাখী,শাখী। কম করা হয় তোমার শাখীর জন্য? সে সারাক্ষণ শুয়ে শুয়ে থাকবে, ছোট ভাইয়ের বৌএর রান্না খাবে,বছর বছর বাচ্চা জন্ম দিবে,সেই বাচ্চার খেয়াল রাখবে অন্য মানুষ। এ কেমন কথা মা? তুমি নিজেই শাখীকে নষ্ট করছো।সে অলস, অসুস্থ নয়। বাড়ির লোকজনের রান্নাতো আছেই, সেই সাথে তার জামাই আর সাত ছেলেমেয়ের রান্নাও তিন বেলা রেঁধে দিবে কেন ছোট বৌ?”
শামসুন্নাহার রাগ করে চলে যেতে চাইলেন।তাঁকে আটকানো হলো।
উত্তরার তিন বছর বয়সে তার বাবা ট্রেইনিং এ দেশের বাইরে যান এক বছরের জন্য। তিনি আসার সময় রুশার জন্য বেশ কিছু দামী ও অত্যন্ত চমৎকার শাড়ি কিনে নিয়ে আসেন। বিয়ের ছয়-সাত বছর পরে এই প্রথম ভালো কিছু শাড়ি কেনা রুশার জন্য।
সবচেয়ে ভালো দুটো শাড়ি টেনে নিয়ে রফিকের মা বললেন,”এই দুটো আমি শাখীর জন্য নিলাম।
রফিক বললেন,””শাখীর জন্য শাড়ি কিনেছি।এটা রুশার।”
শামসুন্নাহার অনেক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শাড়িগুলো দেখলেন।
তারপরে রুশার শাড়ি নিয়ে বললেন,”এটাই শাখীর জন্য নিবো। না হলে একটাও নিবো না।”
রফিক বললেন, “তাহলে আর কি করা,মা। এটা আমি রুশার জন্য কিনেছি,এটা রুশারই থাকবে।”
“এতোগুলা শাড়ি নিয়ে কি কবরে ঢুকবে?”
“মা,আর একটাও বাজে কথা বোলো না।”
উত্তরা দেখতো, দুই টাকার জিনিস কেনার ক্ষমতাও মায়ের ছিলো না। রফিক সাহেব নিয়ম করে তাঁর মায়ের হাতে হাতখরচের টাকা দিতেন,বোনের জন্য টাকা পাঠাতেন,রুশার হাতে কিছু দিতেন না। তাঁর বক্তব্য, রুশার যখন যা লাগবে,আলমারি থেকে নিয়ে নিবে। তাঁর আর রুশার টাকা কি ভিন্ন?
কিন্তু রুশা প্রবল আত্মসম্মান বোধ সম্পন্ন নারী, এক টাকাও না জানিয়ে নেওয়ার মানুষ না।সেই টাকাও হয়তো বাচ্চাদের জন্য। নিজের জন্য একটি পয়সাও না। কখনো যদি টাকা নিয়েছে, রফিক সাহেব তার কারণ জানতে চাইতেন। এতে রুশার আরও খারাপ লাগতো। রফিক সাহেবের অবশ্য কর্তব্য ছিলো স্ত্রী কে সসম্মানে হাত খরচ দেওয়া। তিনি স্ত্রীকে চিনতেন,প্রচন্ড আত্মসম্মান জ্ঞান সম্পন্ন রুশা যে নিজের মনমতো কোন খরচ করবেনা,তা রফিক সাহেবের থেকে বেশি কে বুঝতো?
উত্তরা সেই শিশুকাল হতে প্রতিজ্ঞা করেছিলো, একটু বড় হয়ে সে চাকরি করবে,মায়ের হাতে এত্তগুলা টাকা দিবে, মা’কে রং-বেরঙের শাড়ি কিনে দিবে।সে এগুলো মুখে বলতো না, মনের কথা মনেই রেখে দিতো।
বিয়ের পরে উত্তরা গয়না পরতে গেলে খুব কষ্ট পেতো।তার এতো গয়না,মায়ের গয়না নেই। সে তার সব গয়না মা’কে অতি আনন্দের সাথে দিয়ে দিতে পারে, কিন্তু এতে মা কঠিন অপমান বোধ করবে। মা গয়না পিয়াসী না। একদম অল্প বয়সে মায়ের হয়তো নেকলেস পরতে ইচ্ছা হতো, দু’হাত ভরে সোনার চূড়ি,সোনার হাতে সোনার কাঁকন , সুন্দর সুন্দর শাড়ি পরতে ইচ্ছা হতো। ইচ্ছার কথা বলাও হয়নি,ইচ্ছা পূরণও হয়নি। বড় কোন অনুষ্ঠানে গেলে মহিলাদের দামী বেনারসি শাড়ি আর গয়নার জৌলুসে চোখ ধাঁধিয়ে যেত, সেখানে রুশার একেবারে সাধারণ বেশভূষা।
তাই উত্তরাও গয়না পরেনা। গয়নায় তার আসক্তি নেই। সে নিজের থেকে কোন শাড়ি কিনেনা। কিন্তু আশফাক দেয়,রুশা-রফিক দেন, নৈঋত -শ্রাবণী দেয়,দেয় ছোট্ট ঈশানী আর তার বর জুবায়ের। বান্ধবীরা দেয় প্রচুর।খালা,চাচা, কাজিনরা দেন মাঝেমধ্যে। উত্তরা খুশি হয়,কিন্তু পরেনা।মনে হয়,সবকিছু যদি সে রুশাকে দিয়ে দিতে পারতো!
চলবে।