#একজন_রুশা,পর্ব ২
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
রুশারা তখনও তার বাবার বাড়ির শহরেই থাকে। শ্বশুর -শাশুড়ির এই ধরণের কথাবার্তা শুনে পরদিন সকাল হতে না হতেই সে ছুটে গেলো বাপের বাড়িতে , তার চোখ মুখ লাল। কঠিন গলায় সে বাপ-মাকে বললো,” বাড়ির মেয়েকে বাড়ি রাখলে না,অকালে মাথা থেকে দায় নামিয়ে দিলে।একজন দিনমজুর বাবাও কষ্ট করে মেয়ে বিয়ে দেয়,লোক খাওয়ায়,মেয়ে-জামাইকে সাধ্যের মধ্যে কিছু দেয়।তোমরা কি করেছো? আমার কথা বাদ দাও,তোমাদের সাধের জামাইকে সামান্য কিছু দিয়েছো? কতো কথা হয় সামনে-পেছনে, সেসব খবর জানো, না জানার চেষ্টা করো?তোমরা কি সত্যি আমার বাপ-মা?”
রুশা থাকলো না। ঝড়ের মতো বের হয়ে গেলো। মতিউর রহমান সাহেব ঐদিনই জামাইএর জন্য ভালো ঘড়ি,শার্ট -প্যান্টের কাপড় নিয়ে এলেন। এই আনাটা তিনি আগেও আনতে পারতেন। রফিক সাহেব যারপরনাই লজ্জিত হলেন।
রুশা বানিয়ে বানিয়ে কিছু কথা শুরু করলো। যেমন, একদিন
বিভিন্ন কথা বলে সে রফিককে বিশ্বাসই করিয়ে ফেললো সে ঐ বাড়ির মেয়ে না। লালিত পালিত হয়েছে মাত্র। এজন্যই তো এমন তাড়াহুড়ার বিয়ে। যত অল্পে মেয়ে পার করা যায়।অভিনয়ের নৈপুণ্যে রফিক সাহেব বিশ্বাস করে ফেললেন।
শ্বশুর বাড়িতে প্রসঙ্গটা উঠিয়ে নিশ্চিত হলেন,রুশা সব বানিয়ে বলেছে।
অনেক আগের প্রসঙ্গে চলে এসেছি। আবার আগের জায়গায় চলে যাই।
নৈঋতের জন্য মা-বাবা জীবন লড়িয়ে দিচ্ছে। এতোটুকু ক্লান্তি নেই,অবসাদ নেই, ভাগ্যকে দোষ দেওয়া নেই, রাত জাগার ক্লান্তি আর সারাদিনের কঠোর পরিশ্রম করার রাগ ছোট্ট বাবুর উপরে ঝাড়া নেই, একটাই লক্ষ্য, নৈঋতকে সুস্থ করতে হবে।
এর মধ্যে বিনা মেঘে বজ্রপাত। রফিক সাহেব প্রমোশন পেয়ে বদলি হয়ে গেলেন দূরের এক জেলায়। ঢাকায় ভাড়া বাড়িতে এতো অল্প বয়সী রুশা থাকবে কি করে? বাবুর চিকিৎসা, ওকে ফিজিওথেরাপি সেন্টারে আনা-নেওয়া করা,সংসার চালানো একা একা রুশা কি করে করবে? আত্মীয়, তিনি যতো আপন হোন না কেন, তাঁর বা তাঁদের বাসায় অনির্দিষ্টকালের জন্য থাকার মতো বিড়ম্বনা আর নেই।
অনেক ভেবে চিন্তে প্রায় দেড় বছরের নৈঋতকে ভর্তি করা হলো গুলশান ১ এর বিখ্যাত ফিজিওথেরাপি সেন্টার স্যালভেশন আর্মিতে। বিদেশি এক্সপার্ট চিকিৎসক। কঠিন নিয়ম শৃঙ্খলা। আরও অনেক শিশু আছে, খুবই আদর-যত্নে থাকে।
নৈঋত বাবু নিশ্চিন্ত মনে মায়ের কোলে বসে খেলছে। তার বাবা অফিসিয়াল ফর্মালিটিজ নিয়ে ব্যস্ত। কাজ শেষ। সিস্টার এগিয়ে এলেন রুশার দিকে। নৈঋতকে ভিতরে নিয়ে যাবেন। আবার কবে মা-ছেলের দেখা হবে, আল্লাহ পাক জানেন। রফিক সাহেব প্রাণপণে শক্ত আছেন। তাঁকে বলে দেওয়া হয়েছে, “আপনি অকেশনালি আসবেন।ইমোশনাল হবেন না।এতে বেবির ক্ষতি। আর বেবির মা’কে একেবারেই আনবেন না চিকিৎসা শেষ না হওয়া পর্যন্ত। মা ও বেবি দুজনের উপরেই কঠিন মানসিক চাপ পড়বে।”
সিস্টার স্নেহের হাত প্রসারিত করলেন,”হ্যালো বেবি।”
বেবি সন্দিগ্ধ চোখে তাকালো নার্সের দিকে।সে কিছু একটা আঁচ করেছে।
রুশা পাগলের মতো ছেলেকে বুকে চেপে ধরলো।কিছুতেই সে ছেলেকে কোল ছাড়া করবে না,কিছুতেই না।
সময় অপেক্ষা করেনা।মানুষের সুখ -দুঃখ কিছুই তাকে স্পর্শ করেনা। সে বয়ে চলে আপন গতিতে।
নতুন শহর,নতুন কোয়ার্টার। ফুলবানুর নানী বলে একজন ছুটা খালা আছেন। অসম্ভব ভালো মহিলা।রফিক অফিসে চলে যান, রুশা চুপচাপ ঘরের কাজ করে।তার কিছু ভালো লাগেনা,কিছু করতে ইচ্ছা করেনা। যন্ত্রের মতো দিনগুলো কাটিয়ে দেওয়া। রফিক সাহেব মাঝে মধ্যে ঢাকা যান ছেলেকে দেখতে। ওয়েটিং রুমে বাবুকে আনা হয়। বাবু নতুন পরিবেশে ভালোই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাপ-মায়ের কথা তার স্মৃতিতে তখন তেমন নেই। সিস্টার গেস্টের সাথে কথা বলতে অনুরোধ করলে বাবাকে সে বিচিত্র কারণে মামা ডাকা শুরু করলো, “হাই মামা,হাউ ডু ইউ ডু?” কি মিষ্টি ,আধো আধো কথা।
রফিকতো মাঝে মাঝে ছেলের মুখ দেখতে পান,রুশা তাও পায়না। ড্রইং রুমে বাবুর বিশাল এক ছবি টাঙানো।কদাচিত সন্ধ্যার পরে বাসার বাইরে গেলে রফিক সাহেব ছবিটাকে একটি বড় চাদর দিয়ে ঢেকে ঘরের লাইট অন করে যান। পাছে নৈঋত অন্ধকারে ভয় পায়।
রুশার মন ভালো করার জন্য তাকে তার বাবার বাড়ি,শ্বশুর বাড়ি,বোনের বাড়ি বেড়াতে পাঠানো হলো। মন আর ভালো হয় কই? কত স্মৃতি ছোট্ট বাবাকে নিয়ে, কি সুন্দর তার চেহারা,হামাগুড়ি দিয়ে আসা, মায়ের সাথে আহলাদ।ওরা ঠিকমতো পেট ভরে খাওয়ায় তো?আচ্ছা, বাবুর মনে ঠিক কি চলছে?বাবা-মায়ের কথা মনে হয়? সারা পৃথিবী রুশাকে কষ্ট দিয়েছে, বঞ্চনা করেছে, শুধু এই শিশুটি করেনি। সেই দেবশিশুকে ছেড়ে, সেই একমাত্র বন্ধুকে ছেড়ে মাসের পর মাস থাকতে হচ্ছে রুশাকে।
আট মাস পরে অবশেষে অপেক্ষার অবসান হলো। বাবু এখন বাসাতেই থাকতে পারবে।বিশেষ ব্যায়াম করাতে হবে,বিশেষ জুতা পরিয়ে রাখতে হবে।
স্যালভেশন আর্মি থেকে নৈঋত বেবিকে অতি আদর,সম্মান,ভালোবাসার সাথে বিদায় দেওয়া হলো।আট মাস সে ছিলো ওখানে। প্রচুর উপহারসহ নৈঋত তার বাড়িতে ফিরলো। মুখে স্মিত হাসি, লাজুক ভাব। লজ্জায় সে কথা ই বলতে পারছেনা। রুশা কতো আদর করলো,চেষ্টা করলো,শিশু লজ্জা লজ্জা মুখে চুপ। পরদিন সকালে রিনরিনে শিশু গলায় ঘুম ভাঙলো রুশার,”হ্যালো আন্টি,হাউ আর ইউ?”
সংসার চলছে সংসারের মতো করে। সব মা-ই স্নেহশীলা। তবে রুশার ভালোবাসা, কর্তব্য, সহিষ্ণুতা অসাধারণ বললে কম হবে। অবোধ শিশু, কেন তাকে সে বকবে,মারবে,তার উপরে চিৎকার, হৈচৈ করবে,অন্যের উপরে রাগ হলে সেই রাগ শিশু সন্তানের উপর ঝাড়বে?নৈঋত বড় হতে থাকলো মায়ের সান্নিধ্যে খুব চমৎকার ভাবে। মায়ের কাছে পড়তে,গলা জড়িয়ে ঘুমাতে, মায়ের কাছে গোসল করতে,কতো রকম মজার মজার গল্প করতে,লুকোচুরি খেলতে নৈঋতের আনন্দের সীমা থাকতো না। বাপি মানুষটা বেশ রাগী তবে আদরও করেন ভীষণ। আর মামনি তুলনাবিহীন।
রুশার বঞ্চিত জীবনে নৈঋত আল্লাহ প্রদত্ত এক অতি মূল্যবান উপহার।
মামনি-বাপি-ছোট্ট ছোট্ট বন্ধুদের নিয়ে নৈঋতের দুর্দান্ত জীবন কাটছিলো। তবে তার পৌণে তিন বছর বয়সে সে বড় রকমের একটা ধাক্কা খেলো। রুশা দ্বিতীয় সন্তানের জননী হলো। কন্যা। মেয়ের জন্মের সময় রফিক সাহেবকে অতি জরুরি কাজে অফিসে যেতে হয়েছিল কয়েক ঘন্টার জন্য। মা-শাশুড়িকে আসার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছিলো। রফিকের মা
শামসুননাহারের তখন নাকি বড়ই ব্যস্ততা। আসার জন্য বুক ফেটে গেলেও এখন আসতে পারবেন না। রুশার মায়েরও কি একটা সমস্যা। রুশার একমাত্র বড় বোন নিজের বৃহৎ সংসার নিয়ে ব্যাতিব্যস্ত। তাঁর সময় কিংবা উপায় কিংবা ইচ্ছা নাই একমাত্র বোনের বিপদে পাশে এসে দাঁড়ানোর।
নৈঋতের বোন জন্ম নিলো সকাল সোয়া নয়টায়,দেশের এক অতি অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে। বাসায় তার গর্ভধারিণী, হিংসায় কাতর হয়ে থাকা পৌনে তিন বছর বয়সী বড় ভাই, নার্স, ফুলবানুর নানী, বেশ কয়েকজন প্রতিবেশী। এর মাঝে কিছু প্রতিবেশী ছিলেন আত্মীয় থেকেও অনেক উত্তম।
কাজ শেষ হলেই রফিক সাহেব ছুটে এলেন। চোখ ছোট,নাক বোঁচা, টুকটুকে ফর্সা,মাথায় অল্প কিছু লাল চুলের মালিক পাহাড়ি চেহারার কন্যার নাম রাখলেন আনারকলি যা পলকে খারিজ হয়ে যায়।
রুশা মেয়ের নাম রাখলেন উত্তরা। মেয়ের বেলায়ও নরমাল ডেলিভারি। বাসাতেই। কন্যার জন্মের ঘন্টা খানিকের মধ্যে রুশা বিছানা ছেড়ে নৈঋত কে ভালো করে গোসল করালেন।দুপুরে পেট ভরে ভাত খাইয়ে দিলেন। অনেকেই হাঁ হাঁকরে বাধা দিতে গেলেন।রুশা শুনলেন না।বাচ্চাদের মধ্যে তিনি কখনো কোন বিভাজন করবেন না। ডেলিভারির ব্যথা স্বত্বেও তিনি নৈঋতকে নিজ হাতে গোসল করিয়েছেন,খাইয়েছেন। এতে তাঁরও তৃপ্তি, নৈঋতেরও।
উত্তরার জন্মের কয়েক মাস আগ থেকে নৈঋত বাপির সাথে ঘুমাতো। পাশের খাটে মামনি। নতুন বাবুটা যখন মামনির বিছানায় অয়েলক্লথ, কাঁথা, বালিশ নিয়ে থিতু হলো, তখন নৈঋত শুরু করলো অসহযোগ আন্দোলন। সে মামনির কাছে ঘুমাবে,উড়ে এসে জুড়ে বসা বাবুটা নয়। উত্তরাকে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হোক। বিশেষ বিবেচনায় তাকে বাপির কাছে রাখা যেতে পারে,কিন্তু মামনির কাছে কিছুতেই নয়।
নৈঋত বোনটাকে সহ্য ই করতে পারতো না।প্রায়ই শিশুকন্যার আর্ত চিৎকারে ছুটে এসে রুশা দেখতো নৈঋত তাড়াহুড়ো করে অন্য দরজা দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।
কয়েকদিন পরে নার্স এলেন রুশার হাল হকিকত পর্যবেক্ষণ করতে। সাথে বড় মেডিসিন বক্স। রুশা নৈঋতকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো,”সিস্টার,এই নতুন বাচ্চাটাকে নিয়ে যান। ওকে আমরা রাখবো না। ” বুদ্ধিমতি নার্স বললেন,” ঠিক আছে। আমিতো আসলে বাবুটাকে নিয়ে যেতেই এসেছি।এই দেখেন না বাক্স? ”
পর্দার ওপাশে ছোট্ট একজোড়া পা দেখা যাচ্ছিল প্রথম থেকেই। এখন পায়ের মালিক হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকলো। উত্তরাকে আড়াল করে নৈঋত বললো,”বাবু কোথাও যাবে না। ও আমার বোন। আমাদের বাসাতেই থাকবে।”
এখন নৈঋত ও উত্তরার মধ্যে খাতিরের সীমা নেই। একে অন্যকে চোখে হারায়। তিন বছর বয়সে আচমকা উত্তরা অসুস্থ হয়ে পড়ে।দেশের সবচেয়ে ভালো শিশুরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখানো হয়। উত্তরার রিউম্যাটিক ফিভার হয়েছে।ছোট্ট উত্তরাকে দুই বেলা অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো ছিলো কঠিন যুদ্ধ। ওষুধ গুঁড়ো করে পানিতে মিশিয়ে চামচে করে খাওয়াতে হতো। রুশা উত্তরাকে ওষুধ খাওয়াতো,রফিক সাহেব মেয়ের কান্নাকাটি থামানোর জন্য নানা কসরত করতেন। হায় আল্লাহ,ছেলের হলো পোলিও,মেয়ের রিউম্যাটিক ফিভার। কোন অপরাধের শাস্তি পাচ্ছেন রফিক সাহেব আর রুশা কোনো অপরাধ না করেও?
প্রায় রুশার মাথা ঘোরে। শরীর খুব দুর্বল লাগে। গাইনোকোলোজিস্টকে দেখানো হলো।রিপোর্ট দেখে ডাক্তার হতভম্ব। শরীরে এতো কম রক্ত নিয়ে স্বাভাবিক কাজকর্ম কি করে করছে রুশা? মেয়েটাকে এখনই হাসপাতালে ভর্তি করে রক্ত দিতে হবে।
রফিক সাধ্যমতো স্ত্রীর চিকিৎসা করালেন। রুশা খুব দুর্বল। তাও তার সমস্ত চিন্তা রফিক , নৈঋত, উত্তরাকে নিয়ে। পাশের বাসার ভাবীরা বড্ড সাপোর্ট দিচ্ছেন। যখনই যেখানে তারা বদলি হয়ে গেছে,প্রতিবেশীদের প্রচুর সাপোর্ট পেয়েছে। হাসিখুশি মিষ্টি স্বভাব, পরোপকার, কর্মদক্ষতার জন্য রফিক ও রুশাকে ভালোবাসতো সবাই। যে কোন ক্যাম্পাসে কথা উঠতো,রুশা ভাবীর চেয়ে সুন্দর এই শহরেই কেউ নেই। বাচ্চাদের দল প্রসঙ্গ আসলে প্রকাশ্যে বলতো “সুন্দর চাচীটা”।
রুশা নিজে চরম অসুস্থ, ছেলে-মেয়ে অসুস্থ, সাংসারিক কাজকর্ম, সামাজিকতা…তবু রুশা দমে না,হতাশ হয় না,অর্থাৎ পরাজিত হয়না। পরাজয় শব্দটা রুশার অভিধানে নেই। জীবনে উত্থান -পতন,দুঃখ-কষ্ট সব আছে, অনেকের সারাজীবন ধরেই দুঃসময় থাকে,তাতে কি হলো?ভাগ্যের কাছে হার মানতে হবে?জিতে যাওয়ার জন্য লড়াই করতে হবেনা? রুশা তাই অবিরাম লড়াই করে যায়। হতাশ হয় না।
উত্তরার সাড়ে ছয় বছর বয়সে রফিক -রুশার আরেকটি ফুটফুটে কন্যার জন্ম হলো । ঈশানী। নৈঋত -উত্তরার আনন্দের সীমা রইলো না।রফিক রুশাও মহাখুশি। তিন সন্তান সমান তাঁদের কাছে।পুত্র -কন্যা ভেদাভেদ নেই। রুশা সারাক্ষণ আল্লাহর কাছে দোয়া করত,” আল্লাহ পাক,আপনি আমার তিন সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার তৌফিক দিন।বিদ্যায়,সুবুদ্ধিতে,মনুষ্যত্বে। আমি ওদের জন্য সম্পদ চাইনা, সুশিক্ষা চাই, বিবেচনা বোধ চাই। ” তিনি দুই মেয়ের জন্য একটি স্পেশাল দোয়া করতেন, “আল্লাহ, আমার মেয়ে দুটো যেন কখনো লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, অপমানের শিকার না হয়। ওরা যেন সুশিক্ষিত, স্বাবলম্বী হয়। নিজেদের পায়ের তলায় তারা যেন শক্ত মাটি খুঁজে নেয়। ”
উত্তরা বরাবরই ভালো ফল করে নামকরা মেডিক্যাল কলেজে চান্স পেলো। ঢাকা থেকে অনেক দূর। নৌপথে যাতায়াত।শুধু মাত্র এই কারণে অনেক ছাত্রীর মা আতংকে অস্হির হয়ে পড়লেন। মেয়ে ঘরে থাকবে না,কান্নাকাটি। মেয়ে কি খাবে না খাবে,কান্নাকাটি। লঞ্চে আসা -যাওয়া করতে হবে,কান্নাকাটি।
এতো কান্নাকাটির মধ্যে উত্তরার মা নির্বিকার। মেয়েকে শান্ত ভাবে বললেন,”কখনো আমাদের ছেড়ে একদিনও থাকতে পারোনি। কান্নাকাটি শুরু করেছো। আমাদের অবস্থাও একই।
তোমার আব্বুর,আমার,নৈঋত, ঈশানীর ভীষণ কষ্ট হবে তোমাকে ছাড়া থাকতে। হোষ্টেলে তুমি কষ্ট পাবে, এটা ভেবে আমার গলা দিয়ে খাবার নামবেনা। কিন্তু মা,যেতেতো হবেই। লেখাপড়া করতে কতদূরে মানুষকে যেতে হয়। খুব বড় কিছু পেতে হলে খুব বড় ত্যাগও স্বীকার করতে হয়। মা প্রচন্ড কষ্ট করে সন্তানকে জন্ম দেন বলেই সন্তান মায়ের এতো আদরের। বুঝতে পেরেছো আমার কথা?”
উত্তরার সামনে নয়,সে চলে যাওয়ার পরে রুশা কাঁদলেন। এবারে ভালো করে ধরলেন ঈশানীকে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে মেয়েদের। শক্ত অবস্থান তৈরি করতে হবে।পারলে আর দশজন অসহায় মেয়েকে সাহায্য করবে।
রুশার কাছে পড়তে গেলে তিন ভাই বোনেরই আনন্দ ধরেনা।মামনি এতো সুন্দর করে পড়ান। বাবার কাছে পড়তে তাদের দারুণ ভয়। প্রাথমিক শিক্ষা তিন ভাই বোনই মায়ের কাছে পেয়েছে। সেই সাথে নৈতিক শিক্ষা। মামনির কাছে পড়া একটা উৎসবের মতো।
বাবা সরকারি চাকরি করলে বাচ্চাদের সাফার করতে হয় খুব। পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া ঈশানীকে ভালো কোথাও ভর্তি করা যাচ্ছে না। আগে দামী কিন্ডারগার্টেনে পড়তো। এখন পঞ্চম শ্রেণিতে ভালো স্কুল পাওয়া যাচ্ছে না। মানে স্কুলগুলো পঞ্চম শ্রেণির জন্য ভর্তি পরীক্ষা নিচ্ছিলো না। বেচারি ঈশানীকে ভর্তি করা হলো এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী গার্লস স্কুলে, যে স্কুল এখন বিলুপ্তির পথে।
ঈশানী অতি উজ্জ্বল ছাত্রী। কিন্তু নতুন স্কুলে তার অবস্থা হলো ডাঙায় তোলা মাছের মতো। তাদের ক্লাসে একজনই তারকা ছাত্রী আছে, নাদিয়া। শিক্ষক -ছাত্রী সবাই নাদিয়ার বন্দনাতেই ব্যস্ত। টিচার-ছাত্রীরা ঈশানীকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখে। ওরা ক্লাস ওয়ান থেকে একসাথে পড়েছে, নাদিয়া ওদের চোখে অতি আদর্শ ছাত্রী, নবাগত ঈশানীকে হ্যারাস করতে ওদের সবারই ভালো লাগে।
হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষায় একটা দুর্ঘটনা ঘটলো। নাদিয়াকে বিশাল নম্বরের ব্যবধানে পিছনে ফেলে ঈশানী ক্লাসে প্রথম হয়ে গেলো।
রুশা প্রতিটি বিষয় যত্ন করে পড়াতেন ঈশানীকে। একদিন তাঁর কাছে ফোন এলো। ফোন করেছেন ঈশানীর ক্লাস টিচার।
“ঈশানী কয়জন টিচারের কাছে পড়ে?”
” ঈশানীর গৃহশিক্ষক নেই। আমি পড়াই।”
“বৃত্তির বছর।ওকে কোচিং করতে হবে।”
“মাফ করবেন। কোচিং করাতে চাচ্ছিনা।আমিই পড়াবো।”
“সেই ক্ষেত্রে ঈশানী বৃত্তি দিতে পারবে না।আমাদের স্কুলের রেপুটেশন আছে।বাছাই করা ছাত্রীদের দিয়ে পরীক্ষা দেওয়াই আমরা।”
“ঈশানীর মেধা নিয়ে সংশয় আছে এখনো?”
“দেখুন,এতো বুঝিনা।কোচিং না করলে বৃত্তি দিতে পারবে না।”
“আপনাদের স্কুল কমিটির চেয়ারম্যানের ফোন নং দিন প্লিজ। ”
ক্লাস টিচারের বহু আস্ফালনের পরে চেয়ারম্যান সাহেবের ফোন নং পাওয়া গেলো। ভদ্রলোক ফোনে রুশাকে জানালেন,এমন কোন নিয়ম নেই যে বৃত্তি দিতে গেলে স্কুলে কোচিং করতে হবে। কাজেই ঈশানী কোচিং করলো না,রুশার কাছেই পড়াশোনা করলো।
সুদীর্ঘ নয় বছর পরে ঐ স্কুল থেকে একজনই বৃত্তি পেল, ঈশানী।
চলবে।