#একজন_রুশা,পর্ব ১
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
রুশা দুই দিন ধরে খায়নি। আব্বা সেধেছিলেন কয়েকবার। কয়েকবার মানে রুটিন করে তিন বেলা খাওয়ার সময়,” রুশা মা,খাবি না? আয়।খাওয়ার উপরে রাগ কিসের?” ব্যাস, ওই পর্যন্ত ই। মা কঠিন,কঠোর। “না খেলে স্পষ্ট বলে দাও। খাবার উঠিয়ে ফেলবো।” বড় ভাবি আসেন,”যা করা হচ্ছে, তোর ভালোর জন্য। সংসারের অবস্থা তো বুঝতে হবে। তুমিতো এখন পুতুল খেলার বয়সে নাই। একটু বুঝদার হতে হয়। খেয়ে নে,ওঠ্।”
রুশা ওঠেনা। মাস খানিকের মধ্যে তার বয়স ষোল হবে। সে ক্লাস টেনে পড়ে। । যুদ্ধের আগের বছরেও সে দাপিয়ে বেড়িয়েছে, স্কুলে গেছে,সাঁতরে নদী পার হয়েছে, যখন খুশি হারমোনিয়াম টেনে গান গেয়েছে, পড়তে বসে খাতা ভরে মনের সুখে সুন্দর সুন্দর ছবি এঁকেছে, মনের সাধ মিটিয়ে গল্পের বই, ম্যাগাজিন পড়েছে, এখন সব বন্ধ। ঘরে থাকো, গান-টান গাও,ছবি আঁকো, ব্যাস,যথেষ্ট। বাইরে যাওয়া বন্ধ। আর হ্যাঁ, যা বলা হচ্ছে, তাতে রাজি হতে হবে,হতেই হবে।অভাবের সংসারে তোমার মতামত থাকতে পারেনা। এতো ভালো পাত্র,এতো বেশি আগ্রহী, তাকে না করে দেওয়া অসম্ভব।
রুশা মধ্যম মানের ছাত্রী। তার অনেক গুণ। সে খুব ভালো গাইতে পারে,ছবি আঁকতে পারে,গল্প লিখতে পারে। সংসারে
মা,ভাবী রান্না করলেও সে কখনো কখনো শখ করে রাঁধে। সেই রান্না বয়স ও অভিজ্ঞতা অনুপাতে বেশ ভালো হয়। রুশা ডাকসাইটে সুন্দরী। তাই ভাইদের বন্ধুরা গায়ে পড়ে নানা গল্প করে,ইশারায় কিছু বোঝাতে চায়।রুশা বেচারা বুঝে না। তার মন সোজা সরল।প্যাঁচ ঘোঁচ সে বুঝে না। কোন ছেলের দিকে রুশার যে এখনো কোন আসক্তি নেই, মনের দিক দিয়ে সে এখনো কিশোরী, তা রুশার মা-ভাবীও বোঝেন।এই মেয়ে কখনো এসব বিষয়ে তাঁদের মুখে চুনকালি দিবেনা, এই বিষয়েও পুরো পরিবার নিশ্চিন্ত। তবু এখনই কন্যা বিদায় করা চাই।ছেলে তাঁদের মেয়েকে মহা পছন্দ করেছে।ছেলের বাবা সুদূর এলাকা থেকে এসে মেয়ের বাবার হাত ধরে বলেছিলেন, ” আপনার কন্যাকে আমি পুত্রবধূ করতে চাই। না করবেন না দয়া করে।আমার এই ছেলে কোন মেয়েকে এ যাবৎ পছন্দ করতে পারেনি, কোন মেয়েকে দেখতেও চায়নি,আপনার মেয়েকে সে অত্যধিক পছন্দ করেছে। মা জননীকে আমারও খুব পছন্দ হয়েছে। আমাকে হতাশ করে এখান থেকে ফিরাবেন না।”
এরপরে আর কি কথা থাকে?ছেলের বাবা নিজে এমন কথা বলেছেন, মেয়েকে পাত্রের এতো বেশি পছন্দ, হবু জামাই অত্যন্ত সম্মানজনক পজিশনে আছে, আর কি চাই?দেনা-পাওনার কোন বিষয় নেই।এখন মেয়ে বিদ্রোহ করুক,কাঁদুক, না খেয়ে থাকুক,কি যায় আসে তাতে? ষোলো বছর হয়নি,এতো তেজই বা কেন?গার্জিয়ানরা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটাই ফাইনাল।
বিয়ে হয়ে গেল একদমই অনাড়ম্বর ভাবে। বাবা-মা মেয়েকে কিছুই দিলেন না,একটা সাধারণ শাড়ি পর্যন্ত না। জামাইকেও না। পাত্র এলেন তাঁর বাবা ও তাঐকে নিয়ে, কিশোরী বধূর জন্য দুইটা তাঁতের শাড়ি নিয়ে। রুশার ছোট তিন ভাই আর বড় ভাবী ছাড়া কেউ উপস্থিত ছিলেন না। বড় তিন ভাই আসেন নি,একমাত্র বড় বোন ও দুলাভাইও না। এভাবে শুরু হলো রুশার বিবাহিত জীবন।
রুশার বাবা যে নিম্নবিত্ত মানুষ তা নন। বড় মেয়ের বিয়ে তিনি যথেষ্ট ধুমধামের সাথে দিয়েছিলেন। মেয়েকে শাড়ি গয়নায় সাজিয়ে গুজিয়েই দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, বড় মেয়ে শম্পার কন্যার জন্মের পরে আদর আহলাদ করে নাতনিকে ভারী সোনার হারও দিয়েছিলেন। রুশার জন্য কোন সঞ্চয়ের কথা তাঁদের মনেও আসেনি। আর এখনতো সব দুর্দান্ত যুক্তি।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ।হাতে টাকা পয়সা নেই। এতো ভালো পাত্র রুশাকে এতো বেশি পছন্দ করেছে, আয়োজন হোক আর না হোক,বিয়ে ক্যান্সেল করা যাবেনা। পরে ভালো সময় আসলে বড় করে অনুষ্ঠান হবে।
রুশার বিয়ে হলো ষোলো বছর বয়স হওয়ার দশদিন আগে,তার তীব্র অমত ও বিদ্রোহ উপেক্ষা ও দমন করে।
সবার মতামত গুরুত্বপূর্ণ, শুধু রুশার ইচ্ছা -অনিচ্ছা সম্পূর্ণ
মূল্যহীন।
জাঁকজমক দূরের কথা,সাধারণ বিদায় অনুষ্ঠানও হোলোনা। আকদের আকষ্মিক ভাবে চারমাস পরে রুশাকে যেতে হলো শ্বশুর বাড়িতে। অনেক দূরের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। শাশুড়ি বধূবরণ করলেন পাঁচ টাকা দিয়ে।এর বেশি দেওয়ার যথেষ্ট সঙ্গতি তাঁর আছে।কিন্তু বৌকে দিয়ে টাকা নষ্ট করার দরকার কি? তবে ভদ্রমহিলা মুখে নরম, নতুন বৌ এর সাথে কটু কথা বা কটু আচরণের মধ্যে নেই। মনে দোলাচল, বৌ অত্যন্ত রূপবতী বলে খুশি,এদিকে একেবারে খালি হাতে এসেছে দেখে মনোক্ষুণ্ণ।
প্রথম থেকেই খুব আন্তরিকতার সাথে রুশাকে মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেললেন রুশার ভাশুর-জা,দেবর এবং শ্বশুর। অন্যান্য জায়েরাও। বাড়ির শিশুকুল। একেতো রফিক সাহেবের পছন্দ করা বৌ, তার উপরে রুশা পরীর মতো সুন্দর। কথাবার্তাও সুন্দর।শ্বশুর কুলের সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে থাকার মানসিকতা রুশার আছে। কে ধনী,কে গরীব,তা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই।
কিছুদিন শ্বশুর বাড়িতে কাটিয়ে আবার রফিক সাহেবের কর্মস্হল অর্থাৎ রুশার বাপের বাড়ির শহরে ফিরে আসা। এবারে সরাসরি টোনাটুনির সংসার। বাবার বাড়ির প্রতি নিস্পৃহতা এসেছে রুশার। অনেক কথা এখন তার মনে হয় যা আগে হতোনা। তার বাবার সরকারি চাকরি। সেই সুবাদে যেতে হয়েছে কত শহর।প্রতি শহরে রুশা নিজেই যেয়ে স্কুলে ভর্তি হয়ে এসেছে।ঐটুকু বয়স হতে। সাথে না গেছে বাপ,না ভাইয়েরা,না পিওন। অবশ্য সেজ ভাই আর রুশা হলো হরিহর আত্মা। সেজ ভাই বোনের বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। রুশার বিয়ের খবরটা পর্যন্ত তিনি জানতেন না।কারণ তখন তিনি ইন্ডিয়াতে ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে কাজ করতেন। বাড়ি ফিরে এসে বোনের বিয়ের খবর শুনে তিনি মহা হুলুস্থুল করেন এবং পরে ভগ্নিপতির চেহারা, কথাবার্তা, পদমর্যাদা, শহরে তার সুনাম ইত্যাদি দেখেশুনে তাঁর রাগ পড়ে যায়।
রফিক সাহেব কথা দিয়েছিলেন, স্কুল ছাত্রী স্ত্রীকে তিনি পড়াবেন,যতোটা রুশা পড়তে চায় তিনি পড়াবেন।কিন্তু প্রচন্ড রাগ ও জিদে রুশা পড়তে চাইছিলো না। ঘটনার আকস্মিকতায়, নিজের বাপ-মায়ের হঠকারিতায় তার স্বাভাবিক বুদ্ধি লোপ পেয়েছিল। তাছাড়া হঠাৎ করে সবাই তাকে অনেক বড়,অভিজ্ঞ,পাকা গিন্নি বানিয়ে ফেললো।যেন সে ষোল-সতেরো বছরের অপরিপক্ক বুদ্ধির সদ্যতরুণী নয় বরং বহুকাল সংসার করা, পোড় খাওয়া, সাত ছেলের মা, অতি অভিজ্ঞ এক পাকা,বয়স্কা মহিলা। সে মন খারাপ করতে পারবেনা, সংসারের কাজে পান থেকে চুণ খসতে পারবেনা,তাকে লোকলৌকিকতাও করতে হবে একজন উচ্চ পদস্হ কর্মকর্তার স্ত্রীকে যেমন করতে হয়,গ্রাম থেকে লোক আসলে তাদের আপ্যায়নে কোন ত্রুটি করা যাবে না।সে এখন আর ছোট মানুষ নেই, তার করা কোন ভুল নিঃসন্দেহে অপরাধ।
রফিক সাহেব স্ত্রীর জন্য পড়ার টেবিল, চেয়ার,বই খাতা সব নিয়ে আসলেন। পড়তে হবে। এদিকে ঘর-দুয়ার,বিছানা-পর্দা সব ঝকঝকে পরিস্কার হওয়া চাই,রফিক সাহেব অপরিচ্ছন্নতা একদম সহ্য করতে পারেন না।ছুটা খালা একজন আছেন বটে। ঘর ঝাড়ু দেন,মুছেন, বড় মাছ থাকলে কেটে দেন,হাড়ি পাতিল মাজেন, তবে রান্নাবান্না, কাপড় কাচা, ঘর গোছানো, মেহমানদারি করা তাঁর কাজ নয়।এগুলো রুশা করে। এদিকে ছেলের সংসার দেখতে এলেন বাবা-মা,সাথে মেয়ের ঘরের নাতি,বয়স ছয়-সাত বছরের বেশি হবেনা। তাঁদের যত্ন -আত্তিতে কোন ত্রুটি থাকা যাবেনা। কিন্তু সবকিছুর পাশাপাশি পড়ালেখা চালিয়ে যেতে হবে। ।ঠিকমতো না পড়তে পারলে সেটা রুশার অপারগতা।
এদিকে রুশা বেশ অনেকদিন ধরে খেতে পারছেনা। রান্নার সময় ঠেলে বমি আসে। শরীরটাও খুব দুর্বল। ছুটা খালা জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। রুশা কে মোটা রুটির সাথে মরিচ বাটা মাখিয়ে দেন।একমাত্র ওই বস্তুটাই রুশা একটু আধটু খেতে পারে। রুশা-রফিক বুঝেনি,কিন্তু মুরব্বিরা বুঝতে পারেন রুশা সন্তান সম্ভবা। তার প্রথম সন্তানের জন্ম হয় রুশার সতেরো বছর বয়স হওয়ার দশদিন আগে। বিয়ের কাঁটায় কাঁটায় এক বছরের মাথায়।
রুশার জীবনসঙ্গীর কথা একটু না বললে নয়।ভদ্রলোক অসম্ভব সুদর্শন, দায়িত্বশীল, সৎ,নির্লোভ কিন্তু খুবই রগচটা। তাঁর কথা ও কাজের সাথে তাল মিলিয়ে চললে খুব ভালো, অনথ্যা হলে লঙ্কাকাণ্ড। তখন তিনি প্রচন্ড কর্কশভাষী। প্রয়োজন ছাড়াও তিনি প্রায়ই কর্কশ কথা বলেন, তার কিছুক্ষণ পরেই আবার হাসিখুশি, স্নেহময় বা স্বাভাবিক কথাবার্তা। কথা যে অতি মূল্যবান বস্তু, এটা রফিক সাহেব বুঝেন না। হয়তো কারণে -অকারণে কাঠিন্য পুরুষালি ব্যক্তিত্ব মনে করা হয়। তাঁর এই ব্যক্তিত্ব আরও অনেক বেড়ে যায় যখন গ্রাম থেকে আত্মীয় স্বজন আসে। হয়তো অবচেতন মন এই চিন্তা করে,গ্রামের লোকজন দেখুক তিনি মোটেও স্ত্রী ভক্ত নন, তাঁর একক পরিবারে তিনিই একমাত্র প্রভাবশালী ব্যক্তি, স্ত্রী তাঁর কথায় চলতে বাধ্য। সংসারে তাঁর কথাই শেষ কথা। এতে রফিক সাহেবের আত্মীয়রাও খুশি হন।সংসারে পুরুষদের কথাই আসল কথা।তাছাড়া বেশির ভাগ মানুষ বধূমাতার হেনস্তা দেখতে পছন্দ করে। অথচ এরা এই অতি সহজ সত্যটা বুঝেনা,এতে সংসারের ভয়াবহ ক্ষতি হয়। সম্পর্কে ফাটল ধরে। স্বামী ও তার স্বজনদের প্রতি স্ত্রীর মনে গভীর বিতৃষ্ণা তৈরি হয়। ঐ পক্ষের লোকজন বাসায় আসলেই যখন এতো দুর্গতি,তখন তারা না আসলেই ভালো এমন অনুভূতি প্রতিটি মেয়েরই মনে হয়।
রুশা-রফিকের ছেলে হলো। ফুটফুটে, টুকটুকে। বাচ্চা তার নানীর বাড়িতেই হলো। নরমাল ডেলিভারি হয়েছিল। সেলাই পড়েছিল কয়েকটা। দুর্বল মা। অতি সবল ছেলে।গলায় মারাত্মক জোর। রাত জাগুনে।ছোট্ট পেটটা ভরা খিদে। একদিকে পুত্রের প্রতি সতরো বছরের মায়ের অপত্য ভালোবাসা, অন্যদিকে প্রসবজনিত শারীরিক দুর্বলতা ও মানসিক বৈকল্য। শিশু তার বড় মামীর কাছে অতি যত্ন-আহলাদ পেতো। মা-নানীতো আছেনই।
অনেকের মধ্যেই বাবুর নানীর বিষয়ে একটু বিরূপ মনোভাব আসবে,নানার বিরুদ্ধে নয়। নানা মাঝারি মানের চাকুরি করতেন।মাসের প্রথমে সব টাকা নানীর হাতে দিয়ে দিতেন। ব্যাস,নানার কাজ শেষ। আট ছেলেমেয়ে, নানা-নানি, রাজ্যের আত্মীয় স্বজন সবার দায়িত্ব তখন নানির। মাসের সাত দিন বাকি থাকতেই সংসার খরচ শেষ। বড় বৌ খুব ভালো,বড় ছেলে উল্টোটা। সংসারে টাকা দেওয়া দূরের কথা, নানা গল্প ফেঁদে সংসারের খরচ হতে নিজের খরচ আদায় করা ছিলো তাঁর নেশা ও পেশা। পাকিস্তান আমলে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করে,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে মাস্টার্স করে কেউ যে এমন বাউণ্ডুলেপনা করে বেড়ায়,তা রুশার বড় ভাইকে না দেখলে বুঝা যেতো না। মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান করার জন্য রুশার মা নাহার অনেক কষ্টে কিছু জমাতে পেরেছিলেন। তারপরে বড় ছেলের কথার ও অভিনয়ের জালে পড়ে তিনি সব টাকা বড় ছেলের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ছেলেকে কঠিন গলায় বলতে পারেন নি,”বড় ছেলে হয়ে সংসারের সামান্য দায়িত্ব পালন করোনি।শুধু নিয়েই গেছো।ছোট বোনের বিয়ের জন্য জমানো টাকাটাও নিয়ে যেতে চাও?ছিঃ! টাকা হবেনা।”
না,এসব কথা বলেন নি নাহার, রুশার প্রাপ্য অবলীলায় নিঃসংকোচে বড় ছেলের হাতে তুলে দিয়েছেন। এটা নিয়ে মা-ছেলের কারোর কোন অপরাধ বোধ নেই।
সংসার কিভাবে চলবে,সেই চিন্তায় নাহারের হাইপারটেনশন শুরু হলো।মেজাজ প্রায় খিটখিটে। এদিকে মতিউর রহমান সাহেব আছেন মহা আনন্দে। তিনি গল্পের বই পড়েন,ছবি আঁকেন, ছড়া লিখেন, অনুবাদ করেন,যা খেতে দেওয়া হয়,মহা তৃপ্তির সাথে তা খেয়ে উঠে চলে যান। রুশার মনে হয়,এসব শিল্পী শ্রেণির মানুষদের বিয়ে শাদি করতে নেই। তাঁরও কষ্ট, পরিবারেরও কষ্ট।
অবশ্য মতিউর রহমান সাহেবের কোন কষ্ট নেই। ছেলেমেয়ে পড়ছে কিনা,চাকরি করছে কিনা, তারা কোন সমস্যার মধ্যে আছে কিনা,এগুলো নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। তিনি আহ্লাদ দিয়ে আর নাহারের উপর সব দায়-দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে খালাস। তবে একটা প্রশংসা না করলেই নয়। নাহার আর মতিউর রহমান সাহেবের সম্পর্ক বড়ই মধুর। তাঁদের কোন বিরোধ,ঝগড়া ঝাটি,মন কষাকষি নেই। তাঁরা গল্প করেন, দাবা খেলেন,সদ্য পড়া উপন্যাস নিয়ে মত বিনিময় করেন। সেই আলোচনায় সন্তানদের সমস্যার কথা উঠে আসে না।
জামাই এর মেজাজ শ্বশুরের মতো নরম-সরম না। তিনি দায়িত্ব জ্ঞানহীনও না। তাঁর মধ্যে অদ্ভুত কিছু বিষয় আছে। রুশাকে তিনি অত্যন্ত ভালোবাসেন, তার অসুখ -বিসুখে অস্থির হয়ে যান, নিজ হাতে ত্রুটিবিহীন সেবাযত্ন করেন, ওষুধ -পথ্যের দিকে অতি সতর্ক নজর রাখেন, আবার অন্য সময় কাজকর্ম অন্য রকম। কিছুটা ডোমিনেটিং স্বভাব।
পুত্রের নাম রাখা হলো নৈঋত। ভারী সুন্দর বাবু।খেতে ভালোবাসে। মায়ের কাছে খাওয়ার পাশাপাশি সে দামী ব্র্যান্ডের দুধ, কমলার রস,অন্যান্য খাবার ধরলো।রাতে হাজার খাইয়ে ঘুম পাড়ালেও মধ্যরাতে তার লাগতো জব্বর খিদে।গলার জোর এতো বেশি ছিলো আশেপাশে চৌদ্দ ঘর প্রতিবেশী জেগে উঠতো তার কান্নার শব্দে। নরমাল ফিডারে বাবুর পোষাতো না। তার জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বড় স্পেশাল বোতল কেনা হয়েছিল। দেড় বোতল দুধ খেয়ে বাচ্চাটা শান্ত হতো। শুরু হতো তার খেলাধূলা, হাত-পা ছোড়াছুঁড়ি করে আনন্দ -আহলাদ প্রকাশ। ক্লান্ত রফিক সাহেব এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়তেন কিন্তু বেচারি রুশার ঘুমের কোন উপায় ছিল না। দিনেও ঘুমের তেমন স্কোপ নেই। না ঘুমাতে ঘুমাতে রুশার রীতিমতো অনিদ্রা রোগ হয়ে গেলো।
ছেলে কাঁদলে রফিক সাহেব কখনো মা-ছেলের প্রতি বিরক্ত হতেন না নিজে ঘুমাতে পারছেন না বলে। বরং সাধ্যমতো রুশাকে সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করতেন। বাংলাদেশের বেশির ভাগ পুরুষের এই গুণ থাকেনা।
এরমধ্যে রফিক সাহেব ঢাকায় বদলি হয়ে এলেন। ছোট্ট, সুন্দর, ছিমছাম ভাড়া বাসা। রুশা, কয়েক মাসের নৈঋত আর গ্রাম থেকে আনা গৃহকর্মী পারুলকে নিয়ে তাঁর সংসার। ভোরবেলা রফিক তারিখ অনুযায়ী রেশন তুলতে যান,লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন, রুশা স্বামীর সকালের খাবার স্টোভে রান্না করে, নিজেদেরটাও করে। গ্রাম থেকে যখন তখন লোক আসাতো আছেই। বিয়ে,এক বছরের মাথায় সন্তান, মা-শাশুড়ির সামান্য তম সাহায্য ছাড়া সন্তানকে লালন-পালন, ঘরের কাজ _ এর মধ্যে রুশার লেখাপড়ার স্বপ্ন ফিকে হয়ে আসছিল। সত্যি বলতে কি, ক্ষোভে -দুঃখে-অভিমানে তার সব স্বপ্ন -ইচ্ছা ই মরে গিয়েছিল।
আঠারো বছর বয়সে সবচেয়ে বড় আঘাত পেল রুশা। তার নৈঋত পোলিওতে আক্রান্ত হলো। তখন পোলিও ভ্যাকসিন নিয়ে অতো সচেতনতা ছিলো না। নৈঋত মুখ ভরা হাসি নিয়ে কারো কোলে দাঁড়িয়ে থাকতো,কিন্তু বাম পা সামান্য উপরে তুলে রাখতো। কোন ভাবে তার পায়ের পাতা সমতলে আনা যেতো না। আর সবকিছু স্বাভাবিক।
নতুন বাবা-মা ব্যাপারটা ধরতে পারেন নি। বাড়িওয়ালার গোটা পরিবার নৈঋত, রুশা,রফিককে খুব ভালোবাসতেন। বাড়িওয়ালি যখন খেয়াল করলেন নৈঋত বাম পা কিছুতেই কোলে-বিছানায় বা মাটিতে পুরোপুরি রাখছে না, তিনি এক মুহূর্ত কাল ক্ষেপন না করে রুশা-রফিককে বললেন বাবুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে।
ডাক্তার সাহেব জানালেন, পোলিও হয়েছে।ভাগ্য অত্যন্ত ভালো বিধায় শুধু একটা পায়ের উপর দিয়ে গিয়েছে। খুব বড় বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া গেছে আল্লাহ পাকের অশেষ রহমতে। এখন দরকার ডাক্তারের পরামর্শ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা, নিয়ম করে ধৈর্য্য ধরে ফিজিওথেরাপিস্টের শেখানো ব্যায়াম করানো।
রুশা তার সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। দিন -রাত ছেলের যত্ন,ডাক্তারের কাছে দৌড়ানো, ঘরের কাজ,অতিথি সামলানো। প্রাণ প্রিয় সন্তানের এতো বড় অসুখ, চরম অনিশ্চয়তা, আর্থিক দৈন্যতা, বাবা-মা-ভাই-বোনদের চরম অন্যায় -অবহেলা, শ্বশুরকুলের কিছু সদস্যের জটিল চিন্তা ও কাজ, স্বামীর রগচটা স্বভাব, সংসারের এতো এতো কাজ,কিছুই আঠারো বছরের রুশাকে দমাতে পারলোনা। একবারও তার মুখ থেকে বের হলো না, “আমার জীবন এমন হলো কেন?কি এক অসুস্থ বাচ্চা জন্মালো! কিভাবে এই ছেলেকে আমি মানুষ করবো?” রফিক -রুশা ছেলেকে আরও আঁকড়ে ধরলো। সবচেয়ে ভালো ডক্টর, সবচেয়ে ভালো ইনস্টিটিউটের খোঁজ নিতে লাগলো, নৈঋত কে সর্বোচ্চ কোয়ালিটিফুল সময় দিতে লাগলো। কাকডাকা ভোরে দুজন উঠতো।রফিক সাহেব রেশনের লাইনে দাঁড়াতেন। রুশা রান্না করতো, রফিকের টিফিন বক্স রেডি করে দিতো। বাবুকে ঘুম থেকে উঠিয়ে রেডি করাতো। তারপরে তিনজন মিলে যেতো অনেক দূরের এক নামকরা ফিজিওথেরাপি সেন্টারে। থেরাপি চলতে থাকতো,অফিস যাওয়ার জন্য একসময় রফিককে বের হয়ে পড়তে হতো,কাজ শেষ হওয়ার পরে রুশা ছোট্ট নৈঋতকে কোলে করে বের হতো। সুদীর্ঘ পথ। সবসময় রিকশা পাওয়া যেতোনা।বেশির ভাগ সময় রোগা-পাতলা রুশা ছেলেকে কোলে নিয়ে মাইলের পর মাইল হাঁটতো। নিজের জন্য তার এতোটুকু কষ্ট হতো না, বরং কচি বাচ্চাটা রোদে কাতর হয়ে যাচ্ছে দেখে তার খুব মন খারাপ হতো। ছেলের চিকিৎসার ব্যয় আছে,সাংসারিক খরচ আছে, আর আছে মানুষজনের নানা আবদার।
রুশাদের আর্থিক দুরবস্থা খুব বেশি হওয়ার কথা ছিলোনা।রফিক সাহেবের পরিবারে সামর্থ্য কম-বেশি সবার ছিল, কিন্তু বড় চাকরি করা মামা-ভাইয়ের কাছে নিজেদের একটা দাবী আছে না?
তাই প্রায় মাসেই চিঠি আসতো –
“মামা,নিম্ন লিখিত জিনিসগুলো একান্ত দরকার।প্রয়োজন মতো টাকা পাঠিয়ে দিবেন।”
তারপরে বড় একটা লিষ্ট।
কিংবা,”ভাইজান,একটা সাইকেল না কিনলেই না। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব, সাইকেলের টাকা পাঠিয়ে দিয়ে বাধিত করবেন।”
“ভাই, তোর ভাগনির বিয়ে। মোটা দেখে সোনার চেইন পাঠাবি।”
এমন আরও অনেক কিছু।
বৃদ্ধ বাবা-মায়ের জন্য করা ফরজ। কিন্তু বাকিদের জন্য?
কেউ জানতে চায়না,রফিকের দিন গুজরান কি করে হচ্ছে? বাবুটার এতো বড় অসুখ, ছেলের বড় চাচা-চাচী ছাড়া আর কে নেয় খোঁজ? রুশার খবর জানতে চাওয়াতো বাহুল্য।
বিয়ের কিছুদিন পরেই এক সন্ধ্যায় রুশা তার স্বামী,শ্বশুর ও শাশুড়ির কিছু কথা শুনে ফেলেছিলো।
শ্বশুর -শাশুড়ি আক্ষেপ করছিলেন,”এতো বড় অফিসার তুই। তোর জন্য মেয়ের বাপদের কতো বড় লাইন ছিলো। কতোজন কতো কিছু দিতে চেয়েছিলো। আর সোনার চাঁদ ছেলে,শ্বশুর বাড়ি থেকে কিছুই পেলিনা।”
রফিক বলেছিলেন,”আমি রুশাকে পছন্দ করেছি। ওর বাপ-মা কি দিলেন,এটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। মানুষে-মানুষে বিয়ে হয়, মানুষের সাথে অর্থ সম্পদের বিয়ে হয়না। শ্বশুর বাড়ির টাকা পয়সা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। ”
“তবু! মানুষ জন নানারকম কথা বলে।”
রুশার মাথা দপদপ করছিল। সে আচমকা ঘরে ঢুকে বলেছিলো,”আমি আপনার ছেলেকে জোর করে বিয়ে করিনি,বিয়েতে আমার এতোটুকু মত ছিলো না। আমার বাপ-মাও আমাকে বিয়ে করার জন্য আপনাদের ছেলেকে প্রভাবিত করেন নি।আপনারা অতি আগ্রহ করে আমাকে নিয়েছিলেন। আপনারা কি দিয়েছেন আমাকে এ পর্যন্ত? শুধু পাঁচটা টাকা।আপনার ছেলে বিয়েতে কি দিয়েছে আমাকে?দুইটা তাঁতের শাড়ি। যখন অফিসারদের বৌরা একসাথে হন,বেনারসি পরেন,গা ভরে গয়না পরেন,আমারতো কোন রাগ অভিমান হয়না। কিন্তু আপনার ছেলের কি কর্তব্য ছিলো না বৌকে আরেকটু ভালো কিছু দেওয়া? সেই সামর্থ্য ছিলো না তার?আরেকটা কথা,যা বলতে মন চায়,আমার সামনাসামনি বলবেন।প্লিজ, পিছনে নয়।”
এগুলো নৈঋত পেটে থাকার সময়ের কথা।
চলবে।