গল্প-মধ্যবিত্তের সুখদুঃখের কাব্য
পর্ব-০১,০২,০৩
নার্গিস_দোজা
০১
সকাল সকাল জয়ীতা বাবার দুপুরের খাবার টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে রেখেছে। নিজেরটা ভরবে বলে তার ক্যারিয়ারটা সামনে টেনে নিল। বড়ো ডিব্বাটায় মাত্র ভাত দিতে শুরু করেছে ছোটবোন নম্রতা আস্তে করে এসে বললো আপা কয়টা টাকাদিবি স্যান্ডেলটা ছিঁড়ে গেছে একটা চপ্পল কিনে নিতাম। এসে দিলে হবে? জয়ীতা জানতে চাইলে নম্রতার মুখ হাসিতে ছেয়ে যায়।সে জোরে মাথা নেড়ে সায় দেয়। শরফুদ্দিন সাহেব প্রস্তুত হয়ে এসে বলেন হয়েছে রে মা? তারপর বলেন তোরটা রেডি করিসনি? ভেবেছিলাম তোকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যাব।
– হয়নি আব্বা তুমি বরং চলেই যাও।তোমার দেরি হয়ে যাবে।জয়ীতা তার বাবাকে বলে।
-ঠিক আছে মা বলে টিফিন ক্যারিয়ারটা হাতে নিয়ে রান্না ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। নম্রতা বারান্দায় দড়িতে ঝুলতে থাকা ছাতাটা নামিয়ে তার বাবার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলে আব্বা ছাতাটা নিয়ে যাও বৃষ্টি নামবেে।শরফুদ্দিন সাহেব সস্নেহে নম্রতার মাথায় হাতটা ছুঁয়ে দেন।
শরফুদ্দিন সাহেবের দুটো মেয়েই। কোন ছেলে নেই।তার জন্য কোন কষ্ট বা ক্ষোভ নেই শরফুদ্দিন সাহেবের।বড়ো লক্ষী তার মেয়ে দুটি। জয়ীতা যখন অনার্সে পড়ে ভাল পাত্র দেখে তার বিয়ে দিয়েছিলেন। ছেলে প্রবাসী। তিন মাসের ছুটি নিয়ে দেশে এসেছিল বিয়ে করবে বলে। জয়ীতাকে দেখেই পছন্দ হয়েগিয়েছিল শিহাবের। বিশেষ করে বাংলায় পড়ে জেনে আরও ভালো লেগেছিল।সে নিজেও বাংলায় মাস্টার্স টুকটাক লেখালেখিও করতো। শিক্ষক হবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু মধ্যবিত্ত বাবার চাপে বিদেশে চাকরি নেয়। দেশে চাকরিও হচ্ছিলনা। ভেবেছিল কিছু টাকা পয়সা জমলে দেশে ফেরত চলে আসবে।বিয়েরপর দুমাস থাকার কথা থাকলেও আরও একমাস ছুটি বাড়িয়েছিল। শিহাবের বাবার ব্যাপারটা পছন্দ ছিলনা আর শিহাব বিয়েতেও মোটামুটি খরচ করেছিল।এদিকে শিহাবের বাবার দোতলায় দুটোরুম তোলার ইচ্ছে ছিল। ফিরে যাবার পর খচরগুলে তুলে নেবার জন্য আর তাড়াতাড়ি দেশে জয়িতার কাছে ফেরার তাড়নায় শিহাব ওভার টাইম করা শুরু করে বেশি বেশি করে। মরুর দেশের প্রচন্ড গরম আর অতিরিক্ত পরিশ্রম সহ্য করতেনা পেরে হার্ট এটাকে মারা যায় মাত্র আঠাশ বছর বয়সে। বাংলাদেশের অসংখ্য ভাগ্যহত ব্যাক্তির মতো সেও বলি হয়ে যায় অতিরিক্ত লোভের।জয়ীতা ফিরে আসে বাবার কাছে বাইশ বছর বয়সেই। আদরের মেয়ের স্বামীর অকাল মৃত্যুতে শরফুদ্দিন সাহেবের স্ত্রীর স্ট্রোক করে।শরীরের নিচের অংশ অসাড় হয়ে যায়। চিকিৎসার পর ওয়াকার নিয়ে অল্প অল্প হাঁটতে পারলেও সংসারে তেমন সাহায্য করতে পারেন না।সৌভাগ্যক্রমে জয়িতার লেখাপড়া চালিয়ে নিতে পারেন শরফুদ্দিন কষ্ট করে হলে। অনার্স পাশ করার পর জয়ীতা একটা স্কুলে চাকরি পেয়ে যায়।
গল্প–মধ্যবিত্তের সুখদুঃখের কাব্য
পর্ব – ২
রাস্তায় রিক্সা ধরার অপেক্ষায় জয়ীতা। লাঞ্চবক্স , ব্যাগ আর ছাতাটা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সে। গলির মোড়ে এসে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। জয়ীতার “এমন দিনে তারে বলা যায় । এমন ঘন ঘোর বরিষায়” কবিগুরুর গানটার কথা মনে হোল। বুকচিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো জয়িতার। কতো কথা যে বলার ছিল মানুষটাকে কিছুই বলা হোলনা। তার আগেই চলে গেল সব ছেড়েছুড়ে। শেষ বারের মতো চোখের দেখাটাও হয়নি। খরচের জন্যে লাশটাও দেশে আনা হয়নি।বিদেশ বিভুঁইয়ে সে কোথায় শেষঘুম ঘুমাচ্ছে কে জানে।শিহাব মারা যাবার পর আত্মীয় স্বজন তার বাবার কাছে তার বিয়ের কথা তুলতে চেয়েছিল।শরফুদ্দিন সাহেবকে জয়ীতা না করে দিয়ে বলেছে – শিহাব মারা গেছে তার বিশ্বাস করতে মনচায়না। তরতাজা একটা মানুষ বলানেই কওয়ানেই দুম করে মরে গেল। লাশটা দেখলেও নাহয় কথা ছিল।
দুপুরবেলা নম্রতা তার মায়ের জন্য টেবিলে খাবার বেড়ে বাঁধা বুয়াকে পানি দিতে বলে টেবিলে। তারপর জহুরা বেগমকে ওয়াকার সহ বাথরুমে নিয়ে যেয়ে হাত মুখ ধুতে সাহায্য করে।জহুরাবেগম নম্রতার মাথায় হাতবুলিয়ে দেন। ভিষন লক্ষী তার মেয়ে দুটো। বুক দিয়ে আগলে রাখে তাকে। স্ট্রোকের পরপর সবকিছু তার মনে পড়তোনা ঠিকমতো।বড়ো যত্নে আগলে রাখতো তারা ।শরফুদ্দিন সাহেবের মতো স্বামী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। চরম দুঃসময়ের সময় মাথা ঠাণ্ডা রেখে অসুস্থ স্ত্রীকে আর শোক মুঝ্যমাণ কন্যাকে পরম মমতায় সামলেছেন। জয়ীতার শশুর তো জামাই মারা যাবার খবর শুনেই তাদের সাথে সব সম্পর্কের ইতি ঘটান। শোকের ভার কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা হিসাবে আবার কলেজে ফেরত পাঠিয়েছিলেন জয়িতাকে।স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ জয়ীতার পড়ার খরচ সামাল দেবারজন্য শুক্র- শনিবার পার্টটাইম চাকরি নিয়েছেন।জয়ীতা পাশকরে চাকরি পাবার পর তার জোরাজুরিতে পার্টটাইম চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছেন।শরফুদ্দিন সাহেব বৃষ্টির ছাঁটবাচিয়ে অফিস পৌছান।সরকারি অফিসের মাঝারিমানের চাকুরে। টিফিন ক্যারিয়ার কিউবিকলের একপাশে রেখে চেয়ারের ব্যাকে ঝোলানো তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে মনে মনে নম্রতাকে ধন্যবাদ দিতে থাকেন।মেয়েটা ছাতাটা হাতে ধরিয়ে না দিলে বেশ ভিজেই যেতেন। মনেমনে ভাবলেন মেয়েটাকে সামনে মাসের বেতন পেয়ে কিছু একটা কিনে দেবেন।
পর্ব-৩
শুক্রবার ছুটির দিন। জয়ীতা আজ দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছে। যদিও কালরাতে ঠিক করে রেখেছিল বাইরে পরার কিছু শাড়ি সকালবেলায় ধোয়ার জন্য ভিজিয়ে দেবে নিজেই। ধোয়ার পর মাড়টাড় দিয়ে শুখাতে দেবে। জয়ীতা বেশির ভাগ সময় সুতি শাড়িই পরে। নম্রতা সবসময় বলে আপু তুমি জর্জেট শিফন এধরনের শাড়ি কেন পরোনা। সুতিশাড়িতে তো অনেক ঝামেলা।ওসবশাড়ি পরলে তোমায় কষ্ট করে মাড়ও দিতে হয় না স্ত্রীও করতে লন্ড্রিতে পাঠাতে হয় না।জয়ীতাও অনেকদিন ভেবেছে বাইরে আর সুতি শাড়ি পরবেনা। কিন্তু যখনই প্রথমবার শিহাবের সাথে দেখার কথা মনে পড়ে কেন জানি তার আর সুতিশাড়ি পরাটা ছাড়া হয়না। সেদিনও জয়ীতা সুতিশাড়ি পরে ছিল। রূপালীপাড়ের নীলশাড়ি।কপালে ছোট্ট একটা টিপ।শিহাবের চোখে মুগ্ধতা ছড়ানো ছিল। জয়ীতার মনে আজও একটা লুকোনো স্বপ্ন আছে।একদিন একটা মিরাকল ঘটবে আর শিহাব তার কাছে ফিরে আসবে। যদিও সে জানে এটা তার আকাশ কুসুম স্বপ্ন। তবুও তার কেবলি মনে হয় দশ বছর পরে হলেও মানুষটা তার কাছেই ফিরে আসবে। সেতো শিহাবের লাশ দেখেনি কি করে নিশ্চিত হবে। শশুর আব্বা তো দেশে লাশটাই আনলোনা।কতো সময় তো দেখা গেছে ভুল মানুষের লাশ এসেছে। দাফন করার সময় শেষ বার দেখতে গিয়ে ধরা পড়েছে। কিন্তু মানুষটা গেল কোথায় যদি না মারা গিয়ে থাকে। দেখতে দেখতে তিনটে বছর চলে গেল।আসলে শিহাব মারাই গিয়েছে মনকে বোঝায় জয়িতা।
আপু এখনো ঘুমাচ্ছিস! তুই ঠিক আছিস তো? বলে নম্রতা জয়ীতার কপালে হাত দিয়ে ডাকাডাকি শুরু করে আব্বু দেখে যাও আপুর জ্বর এসেছে।শরফুদ্দিন সাহেব চায়ের কাপ টেবিলে নামিয়ে রেখে জয়ীতাদের শোবার ঘরে যেয়ে জয়ীতাকে জিজ্ঞেস করেন কি হয়েছে রে মা? আপুর জ্বর এসেছে, দেখ কপাল গরম! উত্তর দেয় নম্রতা! শরফুদ্দিন সাহেব বলেন তাইতো দেখছি,কপালে হাত দিয়ে। নম্রতার দিকে তাকিয়ে বলেন জয়ীর নাস্তাটা এখানে এনেদে মা একটা প্যারাসিটামল না হয় নাপা দিয়ে দিস খাওয়া হলে। ঠিক আছে আব্বু উত্তর দেয় নম্রতা।জহুরা বেগমও ওয়াকারে ভরদিয়ে জয়ীতাকে দেখতে আসেন। তার মায়াবতী মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন পাশে বসে।জয়ীতা মাকে জড়িয়ে ধরে বলে তুমি কেন কষ্ট করে আসতে গেলে মা।জহুরা বেগমের মুখে স্মিত হাসি ছড়িয়ে পড়ে।কয়েকদিন ভুগিয়ে জয়ীতার জ্বর ছাড়ে। শরফুদ্দিন সাহেব জয়ীতার অসুস্থতার খবর রবিবার অফিস যাবার পথে তার স্কুলে জানিয়ে দিয়েছেন। রবিবার বিকেলে জয়ীতার স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল জামান সাহেব ওনার বোনসহ জয়ীতাকে দেখতে আসে। জামান সাহেব তাকে যে পছন্দ করে জয়ীতা সেটা বুঝতে পারে। কিন্তু সে এটা নিয়ে কখন মাথা ঘামায়নি। জামান সাহেবের বোনও জয়ীতার স্কুলেরই টিচার।স্কুলটা তাদের পারিবারিকই বলা চলে।জামান সাহেবের বয়স তিরিশের উপরে। একসময় বামরাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন। কবি সুকান্তের ভক্ত ছিলেন। সারাদিন আওড়াতেন ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় চাঁদ যেন ঝলসান রটি। সাম্যের সমাজ গড়ার কথা ভাবতেন। কিন্তু একদিন তার নিজেরই চাঁদকে ঝলসান রুটি মনেহতে লাগলো যখন তার বাবা তার নিজের হাতে গড়া স্কুলটার সামনে মিশুক থেকে নামার সময় ট্রাকের তলায় পড়লেন।
-চলবে।