ছেঁড়া বাঁধন
পর্ব- ৪
(নূর নাফিসা)
.
.
পরদিন সন্ধ্যায় ঠিকই এলো সাবিহা। ফাইজা দরজা খুলে মুখে সামান্য বিরক্তি ফুটিয়ে দরজা চাপানো অবস্থায় রেখেই জিজ্ঞেস করলো,
“কি?”
ব্যাগের বেল্ট টানতে টানতে ইতস্ততবোধ করে সাবিহা বললো,
“ভাইয়া বলেছিলো আসতে।”
“ভাইয়া যখন বলেছে, তো ভাইয়ার কাছে যান। ভাইয়া অফিসে আছে।”
“না, মানে নওরিনকে নিয়মিত পড়াতে আসতে বলেছিলো। আপনার কাছে বলেনি কিছু?”
কথার সাথে নির্লজ্জের মতো হাসলো সাবিহা। এবার কণ্ঠে কিছুটা কঠোরতা এনে ফাইজা বললো,
“আমার মেয়েকে আপনার পড়াতে হবে না। আপনাকে আমি গতকালও নিষেধ করে দিয়েছি, এখনো দিচ্ছি। আপনি আর আসবেন না আমার বাড়িতে। আমার মেয়েকে পড়াবো না আপনার কাছে। কথা ক্লিয়ার?”
“নোমান ভাইয়াই আমাকে ডেকেছিলো।”
“আমিও নিষেধ করে দিয়েছিলাম।”
“তারপরই ভাইয়া আমাকে বলেছে আসতে।”
তার বড্ড বেহায়াপনা দেখে ফাইজার রাগ হলো। সে ধীর গলায়ই বললো,
“তবে ভাইয়ার পর আমি, ভাইয়ার ওয়াইফ আপনাকে সসম্মানে আবারও বলছি, চলে যান আপনি। পড়াবো না আপনার কাছে। সম্মান যথেষ্ট পেয়েছেন এ পর্যন্ত, সুতরাং বারবার আমার দুয়ারে এসে ভিড়ে এই সম্মানটা এখন নষ্ট করবেন না। শিক্ষক শব্দটা অনেক সম্মানের।”
অপমানবোধ করে সাবিহার মুখের হাসি তো উড়েছেই, সাথে কটু জবাবও ফুটেছে মুখে।
“আমার সম্মান কোথায় সেটা আপনাকে দেখাতে হবে না। আপনি বরং নিজেকে দেখুন। আমি আপনার দুয়ারে ভিড়তে আসিনি। আমার পায়ে পড়ে ডেকে নিতে হয় আমাকে।”
“ওহ্, স্যরি মিস। আমার এতো ঠ্যাকা পড়েনি আপনার পায়ে ধরতে যাওয়ার। প্রথম আসতে বলেই ভুল করে ফেলেছি, কারণ আপনি বসার জায়গায় ঘুমাতে চেয়েছেন। সত্যিই সেটা আমার ভুল ছিলো। এই ভুল বেশিক্ষণ ধরে রাখতে চাইছি না আর। গতকাল নিষেধ করে দেওয়ার পরও যখন আজ নির্লজ্জের মতো এসে পড়লেন, এতেই বুঝা যায় আপনার পায়ে কতটুকু ধরা হয়! আপনি এখন আসতে পারেন। আর হ্যাঁ, আমার পরিবার থেকে সম্পূর্ণ দুরত্ব বজায় রাখবেন। বসার জায়গায় ঘুমানোর অধিকার কিন্তু আপনাকে দেইনি। আমার পরিবারের সদস্যদের ধারেকাছেও যেন আপনাকে না দেখা যায়। নয়তো খুব একটা ভালো হবে না।”
“রিয়েলি! তা কি করবেন আপনি, শুনি?”
“আপনার পরিবারের কাছে এই চেহারাটার নতুন পরিচয় তুলে ধরবো।”
“যা করার করুন। আমিও দেখি কি উল্টাতে পারেন আপনি আমার। রাস্কেল!”
চোখ রাঙিয়ে জবাব দিয়ে হনহনিয়ে চলে গেলো সাবিহা। ফাইজা রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে রইলো তার স্পর্ধা দেখে। দরজা লক করে সে রুমে বসে বসে রাগ হজম করতে লাগলো। নওরিন বাথরুমে ছিলো। বাথরুমে থেকে কলিং বেলের শব্দ শুনেছে তাই বের হওয়ার পর জিজ্ঞেস করলো,
“আম্মু, বাবাই এসেছে কি?”
“না।”
“কে এসেছে তবে?”
“কেউ না। যাও, ড্রয়িং করো গিয়ে।”
ঘড়িতে সময় নয়টা বেজে গেছে, নোমান আজ এখনও বাড়ি ফিরছে না। পাশের রুম থেকে টিভির শব্দ ভেসে আসছে। নওরিন ড্রয়িং শেষ করে টিভি অন করে বসেছে। কাল অফ ডে তাই আজ পড়ার কোনো চাপ দেয়নি ফাইজা৷ দশটার দিকে ঘুমিয়ে পড়ে মেয়ে, খাবার দেওয়া দরকার৷ তার আগে নোমানকে একবার কল করলো। ফোন রিসিভ হয়নি। ইচ্ছাকৃতই কেটে দিয়েছে নোমান। ফাইজা দ্বিতীয়বার ডায়াল করেনি। প্লেটে খাবার নিয়ে মেয়ের কাছে গেলো। তাকে খেতে দিয়ে সেখানেই বসে রইলো। তবে টিভি অফ করে দিয়েছে। নয়তো আগামী দু ঘন্টায়ও খাওয়া শেষ হবে না। টিভি দেখার জন্য নওরিন ঝটপট খাওয়া সেড়েছে। মুখ মুছে দিয়ে প্লেট নিয়ে চলে এলো ফাইজা। রুমে টুকটাক গুছানোর কাজ করতে লাগলো নোমান ফেরার অপেক্ষায়। শরীরটা খারাপ লাগছে, এখন বিশ্রাম নিতে গেলে চোখে ঘুম নেমে আসতে পারে। নোমানকে খেতে দেওয়ার জন্য পরে উঠতেও মন চাইবে না আর। তাই যাচ্ছে না সেভাবে বিশ্রাম নিতে। সব কাজ সেরে পরেই ঘুমাতে যাবে।
নোমান ফিরেছে দশটার পরপর। গত দু-এক মাসে বোধহয় আজই এতো দেরি করে বাড়ি ফিরলো সে। দরজা খুলে দিলে নোমান ভেতরে প্রবেশ করতেই জিজ্ঞেস করলো,
“আজ এতো দেরি যে?”
“হাওয়া খেতে গেছি তাই।”
কেমন কটু জবাব দিয়ে রুমে চলে গেলো নোমান। ফাইজা দ্বিতীয় কোনো কথা না বলে কিচেনের দিকে গেলো। নোমানকে খাবার দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে লাগলো। সবটা রেডি করে গেলো নোমান ফ্রেশ হয়েছে কি না দেখতে। হাতমুখ ধুয়ে নিয়েছে সে। কাঁধে তোয়ালে ফেলে আলমারিতে টাকা রাখছে। আলমারি লক করে ফাইজাকে দেখতেই ভ্রু জোড়া কুচকে বললো,
“সাবিহা পড়াতে আসেনি?”
ফাইজা জবাব না দিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো অন্যদিকে। নোমানের রাগ বাড়লো। বেশিক্ষণ জবাবের অপেক্ষায় না থেকেই আবার প্রশ্ন করলো,
“তাকে তাড়িয়ে দিয়েছো কেন? গতকাল আমি বলে দেইনি সে আজ পড়াতে আসবে,,আমি তাকে আসতে বলেছি যে?”
ফাইজার বুঝতে মোটেও অসুবিধা হলো না যে সাবিহা সবটা তার কানে ঢেলে দিয়েছে। বুকে কষ্ট জমে থাকলেও ফাইজা চোখ তুলে মজবুত কণ্ঠে এবার প্রত্যুত্তর করলো,
“আমিও তো বলেছিলাম, আমি নিজেই পড়াতে পারবো।”
নোমানের গলা উঁচু হয়ে গেলো,
“এতোই যখন পড়াতে পারবে, তাকে ডেকেছিলে কেন সেদিন?”
“অসুস্থ ছিলাম বলে ডেকেছিলাম। আর এটাই আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো।”
“পড়াও, দেখি কেমন পড়াতে পারো। আবার কখনো বলবে, টিচার রাখতে? রাখাবো টিচার।”
“তোমার এতো জ্বলছে কেন? তার দিকে কেন এতো খেয়াল তোমার?”
“তুমি তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছো কেন?”
“এটা তো আমার প্রশ্নের জবাব নয়।”
“তোমার প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য নই।”
“নোমান, হতে হবে বাধ্য। আমি যেমন তোমাকে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকি, তোমারও হওয়া উচিত।”
“এখন তুমি আমাকে শিখাবে আমি বাধ্য হয়ে চলবো কি চলবো না? তুমিই বাধ্য হয়ে থাকছো কোথায়? যা বলছি, তার উল্টোটাই তো করছো সবসময়।”
“সবসময় করছি না। এখন করতে হচ্ছে বিধায়ই করছি। দিনদিন তুমি খুব করে ভুলে যাচ্ছো তোমার ঘরে বউ বাচ্চা আছে। তুমি ভুলে যাচ্ছো ঘরে তোমার অপেক্ষায় বসে থাকে তারা। তুমি দায়িত্ব থেকে পিছিয়ে যাচ্ছো ধীরে ধীরে। পরিবার পরিজনদের সাথে বাজে আচরণ করে যাচ্ছো।”
চোখ ভিজে উঠেছে ফাইজার। কিন্তু কথা স্পষ্ট। সে দুকদম এগিয়ে এসে নোমানকে স্পর্শ করে বিনয়ের সাথে বললো,
“কেন? মায়া কমে গেছে আমাদের প্রতি? আমরা যে তোমার উপর নির্ভর করে আছি, সেটা তুমি জানো না?”
“তো থাকো না! ঘাড় ধরে বের করে দিয়েছি নাকি ঘর থেকে?”
“নিজেই তো বেরিয়ে যাচ্ছো। আমার সাথে দুটো ভালো কথা বলা হয় না তোমার, মেয়ে বাবাই বাবাই বলতে পাগল অথচ ডাকে সাড়া দেওয়া হয় না তোমার। দূরে ঠেলে দিচ্ছো সবাইকে।”
তার কথায় যেন নোমানের রাগ বাড়তেই আছে, খারাপ হচ্ছে মেজাজ।
“তো এখন কাজকর্ম ফেলে তোদের আঁচল ধরে বসে থাকি ঘরে?”
“আঁচল ধরে ঘরে কেন বসে থাকতে হবে। কাজকর্ম তো আগেও করতে। আমাদেরও যত্ন নিতে৷ তবে এখন কেন তা পাই না আমরা?”
“কারণ এখন তোরা আমাকে নিতে পারিস না আগের মতো। তাই এমনটা মনে হচ্ছে। অফিস থেকে এসেছি, মেজাজ গরম করিস না। সর এখান থেকে।”
“অযথা মেজাজ কেন গরম করছো তুমি? আমরা তো তোমাকে কোনোভাবেই অবহেলা করছি না, নোমান। তুমিই আমাদের প্রতিনিয়ত অবহেলা করছো।”
“বেশ করছি। আমিই তোকে নিতে পারি না। অসহ্য লাগে। হয়েছে এবার?”
কষ্টে যেন ফাইজার গলাও উঁচু হয়ে গেছে কিছুটা। সে নিশ্বাস কাঁপিয়ে জিদ্দি গলায় বললো,
“কেন? এতো অরুচি কেন আমাদের প্রতি? তুমি ভুলে গেছো আমি তোমার জন্য আমার পরিবার ছেড়ে এসেছিলাম? ভুলে গেছো, তোমাকে আমার একমাত্র দুনিয়া বানিয়েছিলাম? ভুলে গেছো সেসব?”
“আমিও তো তোর জন্যই আমার পরিবার ছেড়েছি। তুই-ই তো নষ্ট করেছিস আমার সব।”
“হ্যাঁ, ছেড়েছো আমার জন্যই। তবে আজ কেন সেই আমাকেই ছেড়ে দিচ্ছো? কেন আর আগের মতো ভালোবাসতে পারো না? কেন আমার দিকে তোমার লক্ষ্য থাকে না? বাইরের মানুষের সাথে হাসিমুখে কথা বলো, আমার সাথে কথা বলতে এলেই কেন এভাবে রাগ দেখাও? ওই সাবিহা এতো প্রিয় কেন হয়ে উঠছে?”
“বেশি পকপক করে মেজাজ খারাপ করতে নিষেধ করেছি। সর, যা।”
“আমার জীবন নষ্টের মুখে ফেলে তো আমি সরবো না। ওই সাবিহার প্রতি তুমি দুর্বল কেন? ও আমার থেকে খুব বেশি সুন্দরী বলে? ও আমার থেকে বেশি শিক্ষিত বলে? সেদিন তো আমিই তোমার কাছে সবচেয়ে বেশি সুন্দরী ছিলাম! আমি তো তোমার জন্যই পড়াশোনাও ছেড়েছি। সব বিসর্জন দিয়েছি। তবে আজ আমার সাথেই এমন কেন করবে তুমি? আমার সুন্দর সংসারটা কেন এভাবে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে? তাকে নিয়ে ঘুরতে যাও, ওসব খবর কি আমার কানে আসে না? তবুও তো আমি জবাবদিহিতা চাইনা তোমার কাছে। আমি চাই তুমি নিজে শুধরে যাও। তোমার বউ আছে, বাচ্চা আছে। তবুও তুমি একটা পরনারীর সাথে এভাবে সময় কাটাও। পর নারীতে আসক্ত হয়ে আপনদের ঠেলে সরিয়ে দাও, এসব কেমন নোমান?”
প্রতিটি কথার সাথেই যেন মেজাজ চড়ে উঠেছে নোমানের৷ তাই মুহুর্তেই সজোরে এক থাপ্পড় পড়ে গেলো ফাইজার গালে। হালকা ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়েই বললো,
“এক কথায়ই তো বলেছি, তোকে সহ্য হয় না। তবে অযথা ঘ্যানঘ্যান করছিস কেন কানের কাছে? আমি কখন কি করবো, না করবো সেটা তোর কাছে বলে নিতে হবে আমার? তুই আমাকে শোধরানোর কে? দূর হো চোখের সামনে থেকে! আর একটা কথা বলবি, থাপড়ে দাঁত সবগুলো ফেলে দিবো!”
কাঁধের তোয়ালটা ঢিল ছুড়ে মারলো খাটের দিকে। রাগে কটমট করছে তার চোখমুখ। এদিকে স্তব্ধ হয়ে গেছে ফাইজা। নোমানের সাথে এতো বছর সম্পর্ক এবং সংসার জীবনে আজ এই প্রথম তার হাতে থাপ্পড় খেলো সে। যদি প্রতিনিয়ত খাওয়া হতো তবে হয়তো অভ্যস্ত হয়ে যেতো এবং গায়ে মাখতো না। অথচ আজ এর যন্ত্রণা তীব্রভাবে চেপে ধরেছে তাকে। একটা থাপ্পড়ে শারীরিক ব্যাথা আর কতটুকু? মনটা যে যন্ত্রণায় পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে মুহুর্তেই! যে মানুষটা ইচ্ছাকৃত একটু আঁচ লাগতে দিতো না তার উপর, আজ কি না সেই মানুষটাই এভাবে আঘাত করে বসলো তাকে! তা-ও একটা পরনারীর জন্য! কষ্টে শ্বাসপ্রশ্বাসও অস্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হচ্ছে। মুখ চেপে ধরে বেরিয়ে এলো ফাইজা। নোমান বিছানায় বালিশ ঠিক করতে ব্যস্ত। ফাইজা কতটুকু আঘাত পেলো, কিংবা আঘাত পেলো কি পেলো না। সেসব নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যাথা নেই। শুয়ে পড়তে যাচ্ছিলো, তখন হয়তো মনে পড়লো ক্ষুধা লেগেছে। তাই এসে খেতে বসলো। ফাইজা তো খাবার গুছিয়েই রেখেছিলো। একমনে তার খাওয়া সে খেতে লাগলো।