ছেঁড়া বাঁধন পর্ব- ৫

ছেঁড়া বাঁধন
পর্ব- ৫
(নূর নাফিসা)
.
.
ফাইজা মুখ চেপে চলে এসেছিলো পাশের রুমে। মেয়েটা টিভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছে। টিভির কার্টুন টিভিতে চলছেই। তার বাবা আসার আগেই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে, যা কেউই খেয়াল করেনি। নয়তো বাবাকে দেখে তখনই ছুটে যেতো। ভাগ্যিস, মেয়েটাকে চোখের জল দেখাতে হয়নি! টিভি বন্ধ করে মেয়ের পাশে বসে পড়েছে ফাইজা। মুখ চেপে আরও কেঁদেছে সে। খুব কেঁদেছে, যা দেখার মতো কোনো মানুষই নেই তার পাশে। পাশে আর কি? জীবনেই নেই!
একটা পর্যায়ে খাটে হেলান দিয়ে শান্ত হয়ে বসে রইলো। পাশে যখন কেউই থাকে না, নিজেই নিজেকে শান্ত করার একমাত্র ভরসা। নিজেকে মানিয়ে নিতে জানে সে৷ তবে অভিমানটাও কড়া। যখন জন্মে, তখন সেরে উঠে না খুব সহজে। মেয়েটাও তার মতোই বড্ড অভিমানী হয়েছে। খেয়াল করলো মেয়ে টিভি দেখতে দেখতে যেভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলো, এখনো সেভাবেই আছে। বালিশ ছাড়া, হাতে মাথা ভর করা অবস্থায়। ফাইজা ধীরে ধীরে টেনে তাকে ঠিক করে শুয়িয়ে দিলো। আজ মা মেয়ের রাত পাড় হলো এখানেই। যায়নি তারা ওই রুমে। আসবাবপত্র দিয়ে এই রুমের ডেকোরেশন করা হয়েছে বছরখানেক হয়। মেয়ে বড় হচ্ছে, আলাদা রুম প্রয়োজন। তাই এখানে খাট বিছানো হয়েছে। যদিও এখনো অভ্যস্ত হয়নি বাবামাকে ছাড়া থেকে। মেয়ে স্কুলে ভর্তি হবে, পড়াশোনা শুরু করবে তাই পড়ার টেবিলও এনে দিয়েছে। এর আগে শুধু টিভির ট্রলি ছিলো এখানে। এখন রুমটা ভরো ভরো হয়েছে। মেয়ে জোর দাবি করে বলতে পারে, “আমার রুম”। শুনতে ভালোই লাগে মায়ের। আজ এই দুঃখের দিনে মেয়ের রুমে আশ্রিত হয়েও ভালো লাগলো। ভালো লাগলো না শুধু প্রিয় মানুষটার কাছ থেকে পাওয়া আঘাতটা। তা-ও গায়ে মাখতো না, যদি প্রিয়জন একান্তই নিজের হয়ে থাকতো।
মনের আঘাত চোখের ঘুমও কেড়ে নিয়েছে। চোখমুখ হয়েছে দেখার মতো। কিন্তু দেখার লোকেদের বড্ড অভাব! ফজরের নামাজ আদায় করে রুম ছেড়ে বেরিয়েছে ফাইজা। রাতে যে খেয়েছে নোমান, এঁটো প্লেটটাও এখানেই পড়ে আছে। পোকামাকড় চাটতেও কম চাটেনি। তবে খাবারগুলোতে ঢাকনা দেওয়া আছে। জায়গা থেকে না সরলেও খুলে রেখে যায়নি একটাও। গত রাতে তো ক্ষুধা পাত্তা পায়নি তাই আজ সকালেই পেটের নাড়িভুঁড়ি পেচিয়ে যাচ্ছে ক্ষুধার যন্ত্রণায়। অথচ মুখের কিংবা মনের, কোনোটারই রুচি বজায় নেই। তবুও খাবার পেটে ফেলার জন্য হামলা চলছে ক্ষুধাদের। উপায় নেই তো কোনোদিকে। মন না চাইলেও খেতে হবে। পেটে আরেকজনের আহার হচ্ছে যে এতে। ফাইজা বাসি খাবার গরম করে মুখে পুরলো। যেন খাবার নয়, একরাশ যন্ত্রণা পুরেছে মুখে। খাবার যদি হাত দিয়ে সরাসরি পাকস্থলীতে রেখে দেওয়া যেতো, তবে তা-ই করতো। গলা দিয়ে নামাতে যে ভীষণ কষ্ট হয়! তবুও নামাতে হয়।
স্বল্প আহারে নিজের পেট শান্ত করে বাকি পেটের আহারের ব্যবস্থায় নামলো ফাইজা। শরীরের শক্তি যেন শূন্যে নেমে যাচ্ছে বারবার। তবুও মন থেকে প্রেশার দিয়ে শক্তি সঞ্চয় করা হচ্ছে কাজ সম্পন্ন করার জন্য। মনের বিরুদ্ধে লড়ে, চুপচাপ একা একা কাজ করে গেলো এই এক কোণে। খুব সকালে রান্না বসানোর কারণে তাড়াতাড়িই শেষ হয়েছে। কাজ শেষে আবারও ফিরে এসেছে মেয়ের কাছে। পিঠের নিচে বালিশ চেপে আনমনে তাকিয়ে আছে জানালার বাইরে। মন সাক্ষাৎ করতে চাইছে সৃষ্টিকর্তার সাথে। কেন এমন হলো? কেন এমন হয়?
অভ্যাস মোতাবেক আটটার দিকেই ঘুম ভেঙেছে নওরিনের। এমনিতে স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রতিদিন সাড়ে সাতটার পরপর ডেকে তোলে ফাইজা। নওরিন আড়মোড়া ভেঙে চোখ খুলে দেখলো আজ সে নিজের রুমে! পাশে মা বসে আছে। কিন্তু তার দিকে মায়ের খেয়াল নেই। সে ঘুমঘুম চোখে উঠে বসে ঝিমাতে ঝিমাতে মাকে কিছু বলতে যাচ্ছিলো। কিন্তু মায়ের চোখে পানি দেখে ঝিমানো দূর হয়ে গেলো। প্রশ্ন করতেও ভুলে গেলো আজ সে এই রুমে ঘুমিয়েছে কি না, কিংবা কেন? ঝটপট মায়ের কাছে এসে হাত বাড়িয়ে গাল মুছে দিয়ে বলতে লাগলো,
“আম্মু? আম্মু, তুমি কাঁদছো কেন? কি হয়েছে তোমার?”
কচি কণ্ঠ ও কোমল হাতের স্পর্শ পেয়ে ধ্যান ভাঙলো ফাইজার। মেয়ের ঘুম ভেঙে গেছে, সে খেয়ালই করেনি পাশে থেকে! দ্রুত নিশ্বাসে নাক টেনে সে নিজেও চোখ মুছে বললো,
“কিছু হয়নি, মা।”
“তবে কাঁদছো কেন তুমি? তোমার কি শরীর খারাপ করছে? বাবাইকে ডাকবো?”
“না, বাবাইকে ডাকতে হবে না। যাও, ব্রাশ করো গিয়ে। সুন্দর করে করবে। ঠিক আছে?”
নওরিন মাথা নেড়ে সায় দিলে ফাইজা মেয়ের কপালে চুমু এঁকে দিলো। ব্রাশ করতে চলে গেলো নওরিন। মুখ ধুয়ে আবার মায়ের কাছেই ফিরে এলো তোয়ালে দিয়ে মুখ ঘঁষতে ঘঁষতে। ই করে দাতের পাটি বের করে বললো,
“সুন্দর করে মেজেছি না, আম্মু?”
ফাইজা ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টানার চেষ্টা করে বললো,
“হুম। কাছে এসো।”
মুখ ধুতে গিয়ে চুলও ভিজিয়ে ফেলেছে, তাই তোয়ালে নিয়ে ভালোভাবে মুছে দিলো মুখ ও মাথা। তারপর হাতেই চুল চিরুনি করে ঠিক করে দিতে দিতে বললো,
“বাবাই উঠেছে ঘুম থেকে?”
“না তো। বাবাই তো এখনো ঘুমাচ্ছে। ডেকে তুলবো? অফিস যাবে না?”
“না, আজ অফ ডে।”
নিজের কপাল ঠুকে নওরিন বললো,
“ও…! আমারও তো আজ স্কুল অফ। শুক্রবার কবে আসে, আম্মু? আমি ভুলে যাই কেন?”
মেয়ের কথায় আবারও মৃদু হাসলো ফাইজা। তারপর থুতনি ধরে বললো,
“শুক্রবার, শুক্রবারেই আসে। বৃহস্পতিবারের পরে এবং শনিবারের আগে। তোমার মনে রাখার বয়স হয়নি, তাই ভুলে যাও। চলো, নাস্তা করবে।”
“তুমি এখানে নিয়ে এসো।”
“ওকে।”
নওরিন রিমোর্টের দিকে এগিয়ে গেলে ফাইজা শাসিত গলায় বললো,
“এই, টিভি দেখবে না এখন। গতরাতে পড়তে বসোনি, মনে আছে?”
নওরিন ধরা পড়ে আস্তেধীরে হাত গুটিয়ে নিয়ে চলে এলো এপাশে। বালিশের উপর গড়াগড়ি খেলো বিছানায় পড়ে। ফাইজা খাবার এনে দিলে খেয়ে নিলো ভদ্র মেয়ের মতো। তারপর স্কুলের হোমওয়ার্ক কমপ্লিট করতে বসলো। ফাইজা ওদিকে নোমানের খাবার প্লেটে রেডি করে দিয়ে মেয়ের পাশে এসে বসেছে। কোনটা লিখতে দিয়েছে তা বুঝিয়ে দিলে নওরিন একা একাই লিখে নিতে পারছে।
কিছুক্ষণ পর শব্দ পেয়ে ফাইজা তাকে বললো,
“দেখে এসো তো, বাবাই উঠেছে কি না। উঠলে বলে এসো নাস্তা করতে।”
পেন্সিল হাতে নিয়েই ছুটে গেছে নওরিন। ফিরে এসে বললো,
“উঠেছে, আম্মু।”
“নাস্তা করতে বলেছো?”
“হ্যাঁ।”
“বসো, লিখো।”
এরপর থেকে ফাইজা তার চেহারাও দেখাতে যায় না নোমানের সামনে, কোনো কথাও বলে না আর। মেয়েকে আদেশ নিষেধ করতেই যতটুকু কথার প্রয়োজন, ততটুকুই উচ্চারণ করে মুখে। এছাড়া ফাইজার কোনো সাড়াশব্দই শোনা যায় না ঘরে। নোমানও বলে না কোনো কথা, তাই একরকম নিরবতা বিরাজ করে ঘরে। আর বাবামায়ের নিরবতায় নওরিনকেও হৈ-হুল্লোড় করতে দেখা যায় না। মাকে টুকটাক জিজ্ঞাসা করার হলে করে, নয়তো চুপচাপ টিভি দেখে বাকিটুকু সময়। ঘরে যার শব্দ বেশি শোনা যায়, সে হচ্ছে টিভিতে নওরিনের কার্টুন। নোমানকে বেরিয়ে যেতে দেখলে চুপচাপ দরজা লাগিয়ে আসে ফাইজা। নোমান ফিরে কলিং বেল বাজালে হয় নওরিনকে পাঠায়, নয়তো সে-ই খুলে দিয়ে সাথে সাথেই পাশের রুমে চলে যায়। কেউ কারো সম্মুখীন হয় না। অফিস থেকে ফিরলে খাবার প্লেটে দিয়ে নওরিনকে পাঠায় ডেকে বলার জন্য। সকালে নাস্তার সময় হলেও নিজেই এসে বসে নোমান, কিংবা দেরি হলে নওরিনকে ডাকতে বলে ফাইজা। কোনো প্রয়োজনের কথাও তুলে ধরে না ফাইজা। এ শুক্রবার নিজ থেকেই এক গাদা বাজার এনে দিয়েছে নোমান। প্রথমদিন এই রুমে ঘুমাতে দেখে নওরিন জিজ্ঞেস করেছিলো,
“আম্মু, আমরা বাবাইয়ের কাছে ঘুমাতে যাবো না?”
“না, এখানে এসো। বাবাইয়ের ঘুমে ডিস্টার্ব হয়।”
এরপর আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি মাকে, এমনকি যেতেও চায় নি বাবাইয়ের সাথে ঘুমাতে। আর নোমান? সে তো একরোখা ব্যক্তি! মায়ামমতা যেন একদম বিলুপ্ত হয়ে গেছে তার মাঝে। ফাইজার সাথে তো কথা বলেই না, মেয়েটাকেও ডাকে না। তার মতো সে ঘরে আসছে যাচ্ছে। নওরিন খাবারের জন্য ডাকলে শুধু সাড়া দেয়, “যাও, আসছি।” ঘরে শুধুমাত্র এটুকুই কথা ফুটে তার মুখে। নওরিনও কোনো উৎসাহ পায় না বাবাইয়ের কাছে গিয়ে দুষ্টুমি কিংবা আদর আবদার করতে। গম্ভীরতা দেখেই যেন দূরে থেকে যায়। এভাবে কেটেছে পরবর্তী দুদিন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here