ছেঁড়া বাঁধন পর্ব- ৩

ছেঁড়া বাঁধন
পর্ব- ৩
(নূর নাফিসা)
.
.
ঘুম ভাঙতেই ক্ষণিকের শারীরিক শান্তি অনুভব হলো ফাইজার। কিন্তু ঘড়িতে চোখ পড়তেই ঝটপট বিছানা ছাড়তে হলো। মেয়ের স্কুল ছুটি হয়ে গেছে আরও দশ মিনিট আগে। আনতে যেতে হবে তাকে। সে আবার দ্রুত বোরকা পরে নিলো। পার্স নিতেও ভুলে গেছে৷ সিড়ি থেকে ফিরে এসে পার্স নিয়ে আবার বেরিয়ে এলো। নিচে নামতেই দেখলো মেয়ে এসে গেছে সিড়ির ধারে!
“নওরিন! একা একা এসে গেছো! রাস্তা চিনতে পেরেছো তুমি?”
কপালে বিষন্নতা এনে তার জবাব না দিয়ে নওরিন জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি আমাকে নিতে যাওনি কেন? আমি কতক্ষণ ধরে তোমাকে খুঁজছিলাম!”
মেয়েটা কিছুটা ভয় পেয়েছে, বুঝাই যাচ্ছে। ফাইজা এগিয়ে এসে মেয়ের ভয় কাটাতে জড়িয়ে ধরে বললো,
“স্যরি আম্মু। বাসায় এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমি এক্ষুনি বের হচ্ছিলাম তোমাকে নেওয়ার জন্য। কান্না করেছো তুমি?”
“দিতির আম্মু আমাকে না নিয়ে এলে আমি কিভাবে আসতাম বাড়িতে!”
“স্যরি, মা। দিতির আম্মু কি তোমাকে এগিয়ে দিয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ, রিকশা দিয়ে যাওয়ার সময় বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে গেছে।”
“তুমি অফিসরুমে গিয়ে মিস এর কাছে আমাকে কল করতে বললেই তো হতো।”
গাল ফুলিয়ে রেখেছে নওরিন। মাকে না দেখে ভয়ে কান্না করার অবস্থা, আবার মিসের কাছে যাবে কি করে! ফাইজা মাথায় চুমু দিয়ে তার হাত ধরে উপরে উঠে এলো। রুমে প্রবেশ করে বললো,
“আমি যদি কখনো দেরিতে যাই কিংবা আমাকে খুঁজে না পাও, তবে অফিস রুমে টিচারের কাছে বলবে আমাকে কল করতে। ঠিক আছে? অপরিচিত মানুষ ডাকলে যাবে না তাদের সাথে। আজ তো দিতির আম্মুকে পেয়েছো, সবসময় তো আর দিতির আম্মু নিয়ে আসবে না। অন্য কারো সাথে যেয়ো না কোনোদিকে। তারা তো আমাদের বাসা চিনে না। মিথ্যে বলে তোমাকে নিয়ে চলে যাবে। তখন আমি আমার নওরিনকে পাবো কোথায়? হুম? তাই আমাকে না পেলে সোজা অফিস রুমে যাবে এবং টিচারকে বলবে তোমার বাবাইয়ের কাছে কল করতে নাহয় আমাকে কল করতে। ওকে?”
মাথা কাত করে সম্মতি জানালো নওরিন। পোশাক পাল্টে নওরিনকে গোসল করিয়ে নিজেও গোসল সেড়ে নিয়েছে ফাইজা। রান্না করা হয়নি তাই পাউরুটি আর চমচম খেতে দিলো নওরিনকে। তারপর ঘুম পাড়িয়ে গেলো রান্না বসাতে। ঘুম হতে হতে তার রান্না শেষ হয়ে যাবে। পরে ভাত খেতে দিবে তাকে। বিকেলটা মেয়ের হোমওয়ার্ক করাতে করাতে মোটামুটি অবসরেই কাটলো তার। নওরিন হোমওয়ার্ক শেষে টিভি দেখে আর সে মেয়ের সঙ্গী হয়ে বসে। সন্ধ্যায় কলিং বেল বাজতেই বুঝতে পারলো সাবিহা এসেছে। তাই দরজা খোলার আগে গতকালের নেওয়া টাকাটা হাতে নিলো। তারপর দরজা খুলে সাবিহা সালাম দিতেই ফাইজা সালামের জবাব দিয়ে আর দরজার পাশ থেকে সরলো না। সাবিহাকে ওপাশে দাঁড়ানো অবস্থায়ই বিদায় জানাতে বললো,
“সাবিহা, আজ পড়াতে হবে না নওরিনকে। তার কিছুদিন ছুটি চাই। এইযে, আপনার বেতনটা। আর এখন কিছুদিন অফ থাকুক তার প্রাইভেট। আবার যখন পড়াবো, আপনার সাথে যোগাযোগ করবো। ঠিক আছে?”
টাকা হাতে নেওয়ার সাথে সাথে মুখটা যেন মলিন হয়ে গেছে সাবিহার। মলিন মুখেও মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে বললো,
“কেন ভাবি? কোনো সমস্যা?”
“জ্বি, সমস্যা। খুবই সমস্যা। কিন্তু আপনাকে বলা যাবে না। ব্যক্তিগত বিষয়।”
“ওহ্, ওকে। আজ এসেছি যখন, পড়িয়ে যাই তবে?”
“না, থাকুক। পড়াতে হবে না আজ।”
“ওকে।”
ব্যাঙ্গাত্মক মুখভঙ্গি নিয়ে ফিরে যেতে লাগলো সাবিহা। সে সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে শব্দ করেই দরজাটা লাগিয়ে দিলো ফাইজা। যেন শরীরের রাগ কিছুটা নেমে এসেছে দরজার উপর। মনোভাব এরকম যে, মেয়েকে মূর্খ রেখে দিবে তবুও তার মতো সাবিহার কাছে পড়তে দিবে না। এমনকি বাসায় টিচারই আনবে না পড়ানোর জন্য।
নোমান বাড়ি ফিরে আজ সাবিহাকে না দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“নওরিনের টিচার পড়াতে আসেনি?”
“এসেছিলো, চলে গেছে।”
“এতো তাড়াতাড়ি!”
“কেন, কোনো প্রয়োজন?”
“না, এমনি। টাকা দিয়েছো?”
“হ্যাঁ, টাকা দিয়েই বিদায় দিয়েছি।”
ফাইজা তাকে আর বেশি কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নওরিনের কাছে চলে গেলো। সে-ই পড়াচ্ছে নওরিনকে। রান্না আগে শেষ করায় এখন অবসরেই আছে সে। ঠিক করে নিয়েছে রাতের রান্নাটা প্রতিদিন সন্ধ্যার আগেই শেষ করে নেওয়ার চেষ্টা করবে। যাতে সন্ধ্যার সময়টা মেয়ের পড়াশোনায় দিতে পারে। পড়ার ফাঁকে নওরিন প্রশ্ন করলো,
“আম্মু, সাবিহা মিস কি আর পড়াতে আসবে না?”
“না।”
“কেন?”
“এখন থেকে আম্মু-ই পড়াবো।”
“কেন? আমি তো তোমার কাছেও পড়ি, মিসের কাছেও পড়ি।”
“মিস যেটা পড়ায়, আমিও সেটা পড়াতে পারবো। তাই নিষেধ করে দিয়েছি। আব্বুর কত টাকা খরচ হচ্ছে, দেখছো তো। তাই এখন পড়াবো না। তুমি আরেকটু বড় হলে, আরও বড় টিচারের কাছে তোমাকে পড়তে দিবো। এখন পড়ায় মনযোগ দাও। নয়তো টিভি দেখতে পারবে না।”
মায়ের কথামতো পড়ায় মনযোগ দিয়েছে নওরিন। ওদিকে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ পর নোমান এসে দাঁড়ালো দরজার সামনে।
“রান্না হয়নি?”
“হয়েছে।”
“খাবার দাও।”
“ইশার আজানটা মাত্র দিলো। নামাজটা পড়ে এলে কি হয়?”
“শরীর ক্লান্ত লাগছে। খাবার দাও।”
“নামাজ পড়লে ক্লান্তি দূর হয়।”
“খাবার দিবে কি না সেটা বলো।”
তার গরম চোখের প্রেক্ষিতে নিশ্বাস ফেলে ফাইজা চুপচাপ উঠে এলো খাবার দিতে। নওরিন পিছু থেকে বললো,
“আম্মু, আমিও কি এখন বাবাইয়ের সাথে খাবো?”
“লেখাটা শেষ করো। আমি রেডি করে ডাকবো তোমাকে।”
ফাইজা খাবার গুছিয়ে প্লেটে দিতে লাগলে নোমান গ্লাসে পানি ঢেলে নিলো। দুই চামচ ভাত তুলতেই প্লেট ধরে বললো,
“হয়েছে, পরে দাও।”
ফাইজা তরকারি তুলে দেওয়ার সময় সে বললো,
“সাবিহাকে পড়াতে আসতে নিষেধ করেছো কেন?”
নোমান যেমন শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো, ফাইজাও শান্ত গলায়ই পাল্টা প্রশ্ন জুড়ে দিলো,
“তুমি জানো কিভাবে সেটা?”
“ফোন করে জেনেছি। নিষেধ কেন করেছো?”
পাল্টা প্রশ্ন করায় যেন এবার দাতে রাগ চাপলো নোমানের। ফাইজা আগের মতোই শান্ত গলায় জবাব দিলো,
“আমিই পড়াতে পারবো নওরিনকে। অযথা টাকা খরচ করার কোনো প্রয়োজন নেই।”
“স্কুলে কেন ভর্তি করেছো তবে? তুমিই তো পড়াতে পারো।”
“স্কুলের সার্টিফিকেটের দরকার আছে। প্রাইভেট আবশ্যিক নয়।”
“টাকাটাও আমি দেই। তোমার যথাযথ খরচ আর অযথা খরচ দেখানোর প্রয়োজন নেই। যেখানে আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না খরচ করতে, সেখানে তোমার সমস্যা না দেখালেও চলবে। আমি বলে দিয়েছি পড়াতে আসতে, কাল থেকে পড়াতে আসবে।”
ভ্রু জোড়া সামান্য কুচকে মুখে বিরক্তি ও কষ্টের ছাপ পড়লো ফাইজার। সে তার কোনো প্রত্যুত্তর না করে, নোমানকে যথাসম্ভব ইগনোর করে নওরিনের জন্য খাবার প্লেটে তুলে নিলো। নওরিনকে এখানে না ডেকে, সে-ই চলে গেলো সেখানে।
নোমানকে খুব যন্ত্রণাদায়ক লাগছে এখন তার। না পারছে কিছু বলতে আর না পারছে সইতে। এখন যদি গলা উঁচিয়ে তার জবাব দিতে যায়, সৃষ্টি হবে ঝগড়ার। যা মোটেও মঙ্গলজনক নয় তার জন্য। কারণ নোমান বরাবরই একটু জেদি এবং ঘাড় বাঁকা স্বভাবের। তার উপর জবরদস্তি করে কোনো কাজ তাকে দিয়ে করানো যায় না। এমনিতেই তাকে অপছন্দের জায়গায় ফেলে তৃতীয় ব্যক্তিকে পছন্দ করতে শুরু করেছে। এখন যদি ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয়, সম্পর্কের বাঁধনটাই না আবার ছিঁড়ে যায়! ভয় হয় ফাইজার। প্রিয়জন হারাতে চায় না সে। এমনিতেই পরিবার হারিয়ে বড় অন্যায় করেছে, এখন এই মানুষটাকে হারালে তার কেউই রইলো না আর! তাই সে ধীরেসুস্থে কিছু করার জন্য ভাবছে তো ভাবছেই। কিন্তু উপায়ান্তর খুঁজে পাচ্ছে না। ঠান্ডা মাথায় নোমানের সাথে কথা বলতে গেলেও নোমান ক্ষেপে যাবে। কারণ মানুষের মস্তিষ্ক যখন বিকৃত হয়, কোনো হিতাহিতজ্ঞান মানুষ ধারণ করতে পারে না মাথায়। তখন সবই বিরক্তিকর হয় তার কাছে।
আজ নওরিনের বলতে হয়নি, ফাইজা ইচ্ছাকৃতই খায়িয়ে দিচ্ছে তাকে। নওরিন লিখছে আর সে পাশে বসে মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে। খাওয়া শেষ হলে খালি প্লেট হাতে নিয়েই বসে রইলো কিছুক্ষণ। সে মগ্ন চিন্তায়, আর মেয়ে এদিকে লেখা শেষ করে মগ্ন টিভি দেখায়। কয়েক মিনিট পর ধ্যানভঙ্গ হলে প্লেট নিয়ে উঠে এলো ফাইজা। নোমান সেই কখন উঠে গেছে খাওয়া শেষ করে। ফাইজা প্লেট ধুয়ে গুছিয়ে আবার নিজেও খেতে বসলো। খাওয়ার পরেই নামাজ আদায় করবে। নয়তো দেখা যাবে পরে আর একা একা খেতেই ইচ্ছে করছে না। শরীরটা ইদানীং বড্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে। খাওয়াদাওয়ায় একটু মনযোগ বসানো দরকার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here