#অন্য_মানুষ (পর্ব ১)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
নিজের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে ভালোবাসার মানুষটাকে দেখে নিশ্চুপ হয়ে চেয়ে রইল প্রিয়া।
ছল ছল চোখে চেয়ে আছে সামনে হলুদ পাজ্ঞাবি পরিহিত শান্ত’র দিকে। ছলছল অশ্রুকনা গাল বেয়ে গড়িয়ে পরবে পরবে ভাব।
এতো মানুষের হৈ-হুল্লোড়ের মাঝে তার এই ছল ছল চোখ তেমন কারো দৃষ্টিতে বাধলো না।
শান্ত হাসি মুখে প্রিয়ার পাশে গিয়ে বসলো। সামনে থেকে হলুদ নিয়ে প্রিয়ার গালে আলতো করে লাগিয়ে দিলো শান্ত ।
অন্য কাউকে বিয়ে করতে হচ্ছে প্রিয়ার। আর সেখানে তার ভালোবাসার মানুষটি এসে হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছে তাকে। বিষয়টা কতোটা কষ্ট দায়ক তা প্রিয়া ব্যাতিত অন্য কারো অনুভব করার স্বাধ্য নেই। কাঁন্না গুলো গলায় আটকে আছে তার। শুধু দু-চোখে জমা অশ্রুকনা গড়িয়ে পরলো গাল বেয়ে।
শান্ত আঙুল দিয়ে তা মুছে দিয়ে বলে,
– দোয়া করি, পৃথিবীর সব সুখ এসে তোমার কপাল ছুয়ে দিক।
বলেই উঠে সেখান থেকে দ্রুত পায়ে হেটে অনেকটা দুড়ে গিয়ে একাকি দাড়িয়ে রইলো শান্ত। গেটের বাইরে দাড়িয়ে পকেট থেকে সিগারেটের পেকেট বের করে একটা মুখে নিয়ে তা আবার পকেটে নিয়ে নিলো। এটা শান্তর একটা বদ অভ্যেসে পরিনত হয়েছে।
ম্যাচ এর কাঠি আগুন সহ সিগারেটের মাঝে লাগাতে এই নিয়ে ৩ বার ব্যার্থ হলো শান্তু। হালকা বাতাসে বার বার নিভিয়ে দিচ্ছে সেই আগুন। কিন্তু মনের আগুন নেভাতে ব্যর্থ এই শীতল বাতাস। তা যেন ক্রমশ বেড়েই চলছে।
পেছনে এসে দাড়ালো ফাহিম। প্রিয়ার বড় ভাই সে। ফাহিম আর শান্ত সম বয়সি। একই বাড়িতে থাকার ফলে ভালো বন্ধুও দুজন।
শান্তরা হলো উপর তলায় আর প্রিয়া ও ফাহিম’রা থাকে নিচ তলায়।
তবে শান্তু দু,মাস হলো বাড়িতে আসেনি। দুরে চলে গিয়েছিলো কোনো এক কারণে। দুই মাস পর গতকাল বাড়িতে আসলো প্রিয়ার বিয়ে উপলক্ষে। কেন জানি বৌ সাজে প্রিয়াকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিলো খুব। কিন্তু এমন অবস্থায় হটাৎ যে কষ্টটা বেড়ে যাবে, তা আগে জানলে হয়তো প্রিয়ার দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যেতো। কখনো সামনে আসতো না।
ফাহিম পেছন থেকে কাধে হাত রাখতেই চমকে উঠে মুখ থেকে সিগারেট টা ফেলে দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো শান্ত। মুখে হাসি ফুটিয়ে ফাহিমের দিকে চেয়ে বলে,
– কি রে বাসায় এতো কাজ ফেলে তুই বাইরে কি করছিস?
ফাহিম বাড়ির দিকে চেয়ে বলে,
– কোথায় নাকি লাইটিং এ প্রব্লেম হয়েছে তা দেখতে এলাম।
তারপর শান্তর হাতের দিকে চেয়ে ফাহিম একটু হেসে বলে,
– কিরে ভাই, আগে তুই আমায় কতো জ্ঞান দিতি এই সিগারেট খাওয়ার বিষয়ে। আর এখন নিজেই অভ্যেস বানিয়ে ফেললি?
শান্ত একটা মৃদ হাসি দিয়ে বলে,
– সময় কি আর সব সময় এক থাকে?
– আচ্ছা বাদ দে, সবাই ভেতরে আর তুই একা একা বাইরে কি করছিস?
শান্ত একটু হেসে বলে,
– এই যে যেটা দেখতে পাচ্ছিস,,,
– আচ্ছা যাই হোক ভেতরে আয়। কত কাজ বাকি আছে এখনো। আমি একা কি সব করতে পারবো?
বলেই শান্তকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো ফাহিম। ঘুরে ফিরে আবার সেই প্রিয়ার সামনে গিয়েই দাড়ালো সে।
পাশে বসে আছে প্রিয়ার হবু স্বামী। মানে যার সাথে বিয়ে হবে আগামি কাল। ছেলের বাড়ি চট্টগ্রামে। আর প্রিয়া’রা থাকে ঢাকায়। অল্প সংখ্যক বর যাত্রি এসেছে, এখানেই হলুদ ও বিয়ে শেষ করে তারপর প্রিয়াকে নিয়ে চলে যাবে চট্টগ্রাম।
ফাহিমের সাথে একই কম্পানিতে জব করে প্রিয়ার হবু বর। সেই সুবাধে এতদুর সম্পর্কে জড়াচ্ছে দুই পরিবার।
প্রিয়ার হবু স্বামীর নাম হাবিব। তাকেও হলুদ দেওয়া হচ্ছিলো। সারা দিন আলাদা আলাদা থাকায় প্রিয়ার স্বামীর সাথে তেমন একটা পরিচয় হয়নি শান্তর।
তাই শান্তকে নিয়ে হাবিবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো ফাহিম।
অপর পাশ থেকে সব দেখছিলো প্রিয়া। আজ যেন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। ভালোবাসার মানুষটার সামনে অন্য কারো হয়ে যাচ্ছে সে। অথচ সেই ভালোবাসার মানুষটার মুখে কত হাসি। বুকের বা’পাশ টায় ব্যাথা করছে খুব। লাল হয়ে থাকা টলমলে চোখ দুটু তাকিয়ে আছে শান্তর দিকে। মনে মনে চাইছে, বন্ধ চোখ খুলে যাক, দুঃস্বপ্ন ভেঙে যাক, দিন গুলো আগের মতোই ঝাপসা থাকুক, তবুও শান্তর জায়গায় অন্য কাউকে মেনে নিতে পারবে না সে।
কিন্তু আফসোস এটা কোনো দুঃস্বপ্ন নয়। এটা এক কঠিন বাস্তব চিত্র। খুব কঠিন।
হলুদের অনুষ্ঠান সব মিলিয়ে শেষ হতে রাত ২ টা বেজে গেলো। ২ টার পর একে একে ঘুমাতে গেলো সবাই। বিয়ে বাড়িতে একটাই সমস্যা হলো রাতে থাকার সমস্যা। কখনো একটা খাটও পাঁচ ছয় জন মিলে ভাগাভাগি করে নিতে হয়।
উপরের তলায় যেখানে প্রিয়া’রা থাকতো সেখানে মেহমানদের থাকার ব্যাবস্থা করা হলো। আর শান্তদে ফ্লাটে বাড়ির ও পরিচিতরা থাকলো। জায়গা নেই বলে ড্রয়িং রুমে সোফায় ঘুমালো শান্ত।
চোখ দুটু যেন আজ কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। তবুও একটু ঘুম আসবে ভেবে চোখ দুটু বুজে রইলো শান্ত।
শান্তও হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। পুরো বাড়ি একেবারে নিরব।
প্রিয়া রুমের দরজাটা ফাক করে শান্তর দিকে তাকিয়ে রইলো দরজার সামনে দাড়িয়ে। বাইরে লাইটিং এর আলো জানালা দিয়ে প্রবেশ করে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে সব।
প্রিয়া রুমে গিয়ে একটা পাতলা কাঁথা নিয়ে শান্তর কাছে গিয়ে দাড়ায়। শান্তর গায়ে তা মেলে দিয়ে ফ্লোরে হাটু গড়ে বসে কিছুক্ষন চেয়ে থাকে শান্তর মুখের দিকে। কিছুক্ষন এভাবে থেকে চোখ দুটু ভিজে উঠা মাত্রই উঠে আবার উঠে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো সে। শান্ত তখন গভির ঘুমে।
,
,
সেদিন শান্তর বাড়িতে কেউ ছিলো না। সবাই বড় আপুদের বাসায় গিয়েছিলো। শান্ত একা একা বসে খেলা দেখছিলো তখন।
তখনই কলিং বেল এর শব্দে দরজা খোলে শান্ত। দেখে বাইরে একটা বক্স হাতে দাড়িয়ে আছে প্রিয়া। শান্তর দিকে তা এগিয়ে দিয়ে বলে,
– মা পাঠিয়েছে আপনার জন্য।
যদিও শান্ত বিষয়টা ভালোই বুঝতে পারছে যে, বাসায় আর মা ও বাকিরা নেই বলে হয়তো ভেবেছে আমার খাওয়ায় প্রব্লেম হচ্ছে। তাই প্রিয়া নিজেই বানিয়ে এনেছে এসব।
শান্তকে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে প্রিয়া এবার নিজে নিজেই ভেতরে চলে এলো। বক্স টা টেবিলে রেখে সোফায় শান্তর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জামা ভাজ করতে করতে বলে,
– একটু গুছিয়ে রাখতে পারেন না সব?
বলেই গুছাতে গুছাতে আবার বলে,
– চা খেয়েছেন?
শান্ত না বললে প্রিয়া বলে,
– বসুন আমি বানিয়ে দিচ্ছি।
বলেই কিছুক্ষন পর এক কাপ চা নিয়ে শান্তর দিকে এগিয়ে দেয় প্রিয়া। শান্ত তা নিয়ে খেতে লাগলো। আর প্রিয়া আগোছালো বাকি জিনিস গুলো গুছিয়ে দিচ্ছিলো। চা প্রায় শেষ করতেই একটা কল আসায় বারান্দায় চলে যায় শান্ত।
আর প্রিয়া এগিয়ে গিয়ে কাপ টা নিয়ে চোখের সামনে কিছুক্ষন ধরে দেখলো সেটাকে। তার পর একটা মুচকি হাসি দিয়ে কাপের শেষ ভাগে থাকা অবশিষ্ট চায়ে চুমুক দিলো সে। ভালোবাসা সত্যিই অন্ধ হয়।
শান্ত কথা বলতে বলতে বেলকনি থেকে দেখছিলো পুরোটা। প্রিয়ার এমন অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ যেন মাঝে মাঝে তার ভেতর এমন অনুভূতি তৈরি করে, যা শান্ত নিজেও অনুভব করতে পারে না।
কল্পনায় পূর্বের স্মৃতি গুলো ভেষে উঠছে বার বার। শান্ত চোখ খুলে উঠে বসে রইলো সোফায়। আর কয়েক ঘন্টা পরই সেই প্রিয়া অন্য কারো হয়ে যাবে চিরতরে। কিছু ভালোবাসা হয় এমনই অপ্রকাশিত। জমা হয়ে থাকা ব্যার্থতার ডায়রিতে ব্যার্থ গল্প হয়ে।
আর ঘুম হবে না। শান্ত উঠে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো। ছাদের উপর গিয়ে দেখে হলুদের সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সকালে আবার এসব পরিষ্কার করে দুপুরে খাওয়ার জন্য গুছিয়ে নেওয়া হবে।
চার দিকে তখন ফজরের আজানের ধ্বনি ভেষে আসছে। ছাদের হালকা বাতাসে আরেকটা সিগারেট ধরালো শান্ত। ছাদের কর্নিশে দাড়িয়ে ধোয়া গুলো শুন্যে ছেরে দিচ্ছে নিরবে নিভৃতে। বুকের ভেতর যেন এক অজানা চাপা কষ্ট বাসা বেধেছে। কেন আসলো বাড়িতে? কেন আবার প্রিয়ার কাছে এলো সে? কেন নিজ চোখে দেখতে এলো যে প্রিয়া বৌ সাজে অন্য কারো হয়ে যাচ্ছে? দুরেই তো ভালো ছিলো খুব।
পেছন থেকে হটাৎ কারো জড়িয়ে ধরা অনুভব করতেই যেন পাথরের ন্যায় হয়ে গেলো শান্ত। বুঝতেই পারছে এটা অন্য কেও না।
পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে নিশ্চুপ হয়ে কেঁদে যাচ্ছে প্রিয়া।
কিছুক্ষন নিরবে কাঁদলো সে। অতঃপর কাতর স্বরে বলে,
– আমার আর সহ্য হচ্ছে না। প্লিজ এখানেই থামিয়ে দিন সব। আমি ম’রে যাবো দম বন্ধ হয়ে। তবুও আপনার জায়গায় কখনো ভাবতে পারবো না অন্য_মানুষ কে,,,,,,,,
To be continue,,,,,,,,,,,