নিরুদ্দেশ ২য় খন্ড পর্ব ৩০

নিরুদ্দেশ ২য় খন্ড
পর্ব ৩০

শাশুড়ি মায়ের অদ্ভুত রকমের চিৎকারে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল তোতার। বাইরে তাকিয়ে বুঝলো অনেক আগে সকাল হয়ে গেছে। তার ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছে। কিন্তু শাশুড়ি মা এভাবে চিৎকার করলেন কেন? বিছানা ছাড়তে চাইলো। খেয়াল করলো অভিমুন্য তাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। গতকাল রাতেও অভিমুন্য তার সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিল। তাকে কোনোরকম ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। চতুর্দিকে নির্জনতা। দ্রুত নতুন ঘরে গেল। ওই ঘরে গিয়ে যা দেখল তার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। এই ঘটনার বর্ণনা হয় না। আকস্মিক ঘটনায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। এ যেন সম্ভব নয়। গতিহীন ভাবে চোখ থেকে ঝর-ঝর করে জল ঝরে পড়ল। কথা বলতে পারল না। কাঁদতে পারলো না। দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়লো। দিদি আত্মহত্যা কেন করেছে? তার কাছে কারণটা খুব স্পষ্ট। কিন্তু সেগুলো সে ভাবতে চাইছে না। দিদি আর নেই এটা ভাবতেই বুকের কোনো স্থানে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। কেমন একটা গভীর শূন্যতা। শাশুড়ি মায়ের চিৎকারে আরও কয়েকজন দৌড়ে এসেছে। তারাও এমন বীভৎস মৃত্যু দেখে আশ্চর্য হয়েছে। এদের তো কোনো কিছুর অভাব নেই। টাকা বাড়ি গাড়ি সম্মান সব কিছু রয়েছে তারপরও কেন আত্মহত্যা! কাছে কেউ যেতে চাইলো না। কিন্তু মৃত লাশ এভাবে ঝুলে থাকাটা শোভা পায় না। কয়েকজন গ্রামবাসী মিলে লাশ নিচে নামালো। সাদা চাদরে মুড়ে রাখা হলো। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে। অন্তিমও খবর পেয়েছে। তোতা সেখানে থাকতে পারল না। তার গলা ভারী হয়ে এসেছে। একের পর এক আঘাত তাকে পাথর বানিয়ে দিয়েছে। নিজের ঘরে এসে ঘরের কোনায় চুপচাপ বসে রইল। কিছুক্ষণ পর ঘুম থেকে অভিমুন্য উঠে পড়ল। সকালে সে কাকিমাকে খুঁজে না, মাকে খুঁজে। তার মাকে কোথায় পাবে তোতা? গতকাল রাতে সে সবাইকে ছেড়ে দূরে চলে গেছে। কি উত্তর দেবে অভিমুন্যকে? পালঙ্ক থেকে নেমে একা একা নতুন ঘরের দিকে চলল। কাছে বসে আছে তোতা কিছু বলল না। তাকে আটকালো না। যেতে দিল। বেলা বাড়লো। অন্তিম ফিরে এসেছে। স্ত্রীর পাশে দু’দণ্ড বসে চোখের জল ফেললো। ছেলেকে কোলে নিয়ে দূরে সরে গেল। অভিমুন্য কিছু বুঝতে পারছে না। সবার চোখে জল দেখে তার চোখ থেকেও জল ঝরে পড়লো। মাঝেমধ্যে বাবাকে কাঁদতে দেখে সেও কেঁদে ফেলছে। বাবাকে বারবার জিজ্ঞেস করছে, সবাই এভাবে চুপচাপ কেন? সবাই কাঁদছে কেন? অন্তিম উত্তর দিতে পারে না। ছেলের পিঠে হাত চাপড়ে বলে, সব ঠিক হয়ে যাবে, সব ঠিক হয়ে যাবে। একটু অপেক্ষা করো। পুলিশ এলো। এই সব ঝামেলার মধ্যে অভিমন্যুকে রাখতে চাইলো না। অন্তিম একটু খেয়াল করে দেখল বাড়ির সকলে সেখানে থাকলেও তোতা নেই। আসার মুহূর্ত থেকে তাকে কোথাও দেখতে পায়নি। কোথায় গেছে সে? মাকে জিজ্ঞেস করতে তিনি জানালেন তোতা সকাল থেকেই এখানে ছিল। হয়তো পার্বতীর মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি। তাই বাড়ি থেকে বের হয়নি। নিজের ঘরেই রয়েছে। আর জবাব দিল না অন্তিম। ছেলেকে কোলে নিয়ে সোজা পুরনো ঘরে চলে এলো। নতুন ঘর হওয়ার পর এই বাড়ি থেকে যে বেরিয়ে গেছিল তারপর আর কোনোদিন এই বাড়িতে আসেনি। আজ অনেক দিনের পরে এ ঘরে এলো। দরজা খোলা ছিল। সোজা প্রবেশ করে তোতাকে ডাক দিল। তোতা ভীষণ অবাক হলো। আজ এতগুলো বছর সে এ বাড়িতে রয়েছে। অন্তিম কখনো তার সঙ্গে কথা বলেনি। আজ হঠাৎ তাকে ডাকছে! একটু ভয়ও করল। চোখের জল মুছে বাইরে বের হলো। সামনাসামনি দেখে ঘাবড়ে গেল। কি অবস্থা করে ফেলেছে নিজের! যতই স্ত্রীকে অবহেলা করুক না কেন, স্ত্রীর আকস্মিক মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি। চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল হয়ে আছে। শান্ত কন্ঠে বলল,’অভিমুন্যকে একটু তোমার কাছে রেখো। আমার একটু কাজ রয়েছে। সে বাইরের দৃশ্য গুলো দেখলে ভয় পাবে।’ অভিমুন্য কাকিমার কাছে চলে গেল। তোতা আশ্বস্ত করলো ছেলেকে ঠিক সামলে নেবে। বাইরে বেরোতে দেবে না। মন খারাপ হতে দেবে না। ভরসা পেয়ে অন্তিম বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কিছুটা গিয়ে আবার ফিরে এলো। বলল,’একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’ বিনা কারণে তোতার মুখে জড়তা নেমে এলো। অন্তিম কখনো তার সঙ্গে কথা বলে না সেই জন্য হয়তো একটু ভয় পাচ্ছে। মাথা নাড়াতে অন্তিম বলল,’বুকের মধ্যে কিসের এত কষ্ট লুকিয়ে ছিল যে নিজেকে শেষ করে দিতে হলো?’ তোতা কি জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারলো না। পার্বতী কি কারণে আত্মহত্যা করেছে? ভালো করে জানে তোতা। তাকে উত্তর দিতে না দেখে অন্তিম আবার বলল,’আমি জানি তুমি সব কিছু জানো। পার্বতী কিসের প্রতি এত অভিমান ছিল?’ তথাপি তোতা জবাব দিল না। জবাব দেওয়ার মতো কিছু নেই। তার আত্মহত্যার কারণ তোতা নিজেই। তাদের প্রতি তীব্র অভিমানে পৃথিবীর ছেড়েছে সে। আকাশ সমান স্বপ্ন নিয়ে এ বাড়িতে এসেছিল। প্রথম থেকেই নিজের সবটুকু দিয়ে স্বামী সংসার এক করতে চাইছিল। প্রত্যেকবারই ব্যর্থ হয়েছে। নিজের সবটুকু দেওয়ার পরও স্বামীর ভালোবাসা জয় করতে পারেনি। বারবার হেরে যেতে হয়েছে। দুটো পরিবারকে এক করতে পারেনি। দিনের-পর-দিন স্বামীর জন্য অপেক্ষা করেছে। একটু ভালোবাসা পেতে চেয়েছে। কিচ্ছু পায়নি। নিজের রাগ অভিমান পুষে রেখে জীবনের গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। তারপর কোলে সন্তান এসেছে। সব কিছু না পাওয়ার যন্ত্রনা এক নিমেষে উধাও হয়ে যায়। অভিমুন্যকে পেয়ে সব কিছু পেয়ে যায়। কিন্তু বেশিদিন নিজের ছেলেকে নিজের করে রাখতে পারেনি। একটু বড়ো হতেই কাকিমার প্রতি ঝুঁকে পড়ে। কাকিমা ছাড়া তার আর কাউকে প্রয়োজন নেই। পার্বতী আবার ভেঙে পড়ে। আবার চুপচাপ হয়ে যায়। আর সহ্য করতে পারে না। নিজের প্রতি একটা ঘেন্না চলে আসে। সবাইকে আপন করার ব্যর্থ পরিহাস ত্যাগ করে। তীব্র অভিমানে সবার থেকে দূরে চলে গেছে। অন্তিম জবাব পেলো না। বাইরে থেকে তাকে কেউ ডাকলো। জবাব না নিয়েই ফিরে গেল।

পার্বতীর শেষ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পুরো বাড়ি জুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। এই বাড়িতে কার নজর পড়েছে কে জানে। একের পর এক দুর্ঘটনা। এমন একটা বড় দুর্ঘটনার পর সবাই ভেঙে পড়েছে। একে অপরের সাথে ঠিকমতো কথা বলছে না। কে কাকে সামলাবে বুঝে উঠতে পারছে না। অন্তিম খুব ভালোভাবে ভেঙে পড়েছে। স্ত্রীকে হারিয়ে সে যেন সব কিছু হারিয়ে ফেলেছে। সারাদিন চুপচাপ বসে থাকে। তাকে এভাবে একাকী চুপচাপ থাকতে কখনো দেখা যায় না। প্রায় সময়ই বাড়ির উঠোনে নয়তো পেছনে পুকুর ঘাটে বসে থাকতে দেখা যায়। আনমনে সবসময় বকে যায়। তাকে সামলানোর মতো কেউ নেই। এই কয়েকদিনে তোতা অন্তিমের সঙ্গে বেশ কয়েকটা কথা বলেছে। তবে লজ্জা বা অন্য কোনো কারণে তাদের কথোপকথন দীর্ঘ হয়নি। অভিমন্যুও বেশ চুপচাপ হয়ে আছে। মায়ের অনুপস্থিতি তাকে বেশ আঘাত করেছে। হয়তো বুঝতে পেরে গেছে তার মা আর নেই। তাই খোঁজ করে না। সবসময় কাকিমার কাছে থাকে। আর খেলাধুলা করে না। বাইরে যেতে চায় না। চোখ দুটো সবসময় ছলছল করে। কাকিমার কোল পেলেই হলো। বাবার কাছে মাঝেমধ্যে যায় আবার ফিরে আসে। শত ভালোবাসা দিয়েও অভিমুন্যর মন ভালো করতে পারে না তোতা। তাকে চঞ্চল করে তুলতে পারে না। এই বয়সে দীর্ঘদিন চুপচাপ থাকা ভালো না। অনেক চেষ্টা করেছে অভিমুন্যকে খুশি করার। কিন্তু সে নিজে থেকে খুশি হওয়ার চেষ্টা করছে না। মাকে হারিয়ে সে সর্বহারা হয়ে পড়েছে। শিশুর মন বোঝা সহজ নয়। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে একটু সময় লাগলো। অনেকদিন কাজ থেকে দূরে রয়েছে অন্তিম। অজস্র কাজ পড়ে রয়েছে। তাকে শহরে যেতে হবে। এভাবে বাড়িতে থাকলে চলবে না। বিকেলের দিকে শহরে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিল। তবে আজ শুধুমাত্র বাবা মার সাথে কথা বলে বিদায় নিল না। পুরনো বাড়িতে এলো। তোতা অভিমুন্যকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছিল। অন্তিমের ডাক শুনে বাইরে বেরোলো।
‘ঘুমিয়েছিলে! বিরক্ত করলাম মনে হয়!’
‘না না, ঠিক আছে। কি বলতে চাইছিলে বলো?’
‘আমি শহরে চলে যাচ্ছি। অনেক কাজ পড়ে আছে। সেখানে তো আর ছেলেকে নিয়ে যেতে পারি না। নিয়ে গিয়েই বা কি করবো? তোমাদের কাছে থাকলো। ওর দেখাশোনা করো। কোনো কিছু দরকার হলে বলো।’
‘তার মা নেই। আবার তুমিও চলে যাচ্ছো! এ ভাবে কি হয়? একটা শিশুর সর্বপ্রথম বাবা-মাকে প্রয়োজন। আর তোমরা…।’
‘আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার কথা একবার ভেবে দেখো। আমার কাছে থেকে কি করবে সে? সেখানে নিয়ে গেলে তাকে একা থাকতে হবে। আমি তো প্রায় সময় বাইরে থাকবো। বরং এখানে থাকলে দাদু-দিদা তোমাকে সঙ্গে পাবে।’
‘আমি বলছি না ছেলেকে সেখানে নিয়ে যেতে কিন্তু..।’
‘তাহলে কি করবো?’ তোতা জবাব দিল না। এই মানুষটাকে জবাব দিয়ে লাভ নেই। কখনো কিছু বুঝবে না। পার্বতী ঠিক কথা বলতো অন্তিম বোঝার ছেলে নয়। সে কখনো কোনোদিন কিচ্ছু বোঝেনি। আজ বোঝালেও বুঝবে না। ইতিমধ্যে অভিমুন্য ঘুম থেকে উঠে এসেছে। কাকিমার কাছে এসে দাঁড়ালো। চোখে বারবার হাত ঘোষছে। তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে তোতা বলল,’বাবার কাছে যাও।’ অন্তিম ছেলেকে কোলে তুলে নিল। আদর করে বলল,’কাকিমার কাছে থেকো। একদম দুষ্টুমি করবে না। কাকিমার কথা শুনে চলবে। পড়াশোনা করবে। আমি মাঝে মাঝে আসবো।’ অভিমুন্য মাথা নাড়ানো। অন্তিম ছেলের কপালে চুমু দিয়ে নামিয়ে দিল। ছেলে সোজা কাকিমার কাছে চলে এলো। এবার কোলে তুলে নিল তোতা। বেরিয়ে যাওয়ার আগে অন্তিম তোতাকে জিজ্ঞেস করল,’সেদিন একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলাম। তার উত্তর এখনো পেলাম না।’
‘উত্তর আমার কাছে নেই। প্রশ্নটা আমাকে জিজ্ঞেস না করে নিজেকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর এতদিনে পেয়ে যেতে। জীবনে টাকা বাড়ি গাড়ি সম্মান এগুলো কি সব কিছু? এগুলোর বাইরে কি কিচ্ছু নেই? নিজের পরিবার রয়েছে কখনো পেছনে ঘুরে তাদের দেখেছো? ঈশ্বরের দেওয়া সবচেয়ে বড় উপহার নিজের স্ত্রী তাকে কখনো পাশে বসিয়ে তার ইচ্ছের কথা জেনেছো? সে কি চায়? কোথায় সবচেয়ে বেশি খুশি পায় তুমি জানো? পার্বতী তোমার স্ত্রী, বলতে পারবে তার প্রিয় খাবার কি? তার প্রিয় রং কি?’ অন্তিম মাথা নিচু করে ফেলল। তোতা আবার বলল,’তুমি হয়তো আবার বিয়ে করে নেবে। তুমি স্ত্রী পাবে। অভিমুন্য মা পাবে। আমি দিদিকে পাবো। কিন্তু আমরা কেউ কি আর পার্বতীকে পাবো? হয়তো এখন তার জন্য অনুশোচনা করবে। কিন্তু অনুশোচনা করে লাভ কি? মানুষটা তো আর নেই।’
অন্তিম চলে যাওয়ার পর বাবা-মা আর নতুন ঘরে থাকলো না। তাদের ওই ঘরে থাকতে ভীষণ ভয় করে। কেউ যেন বারবার ডাক দেয়। পায়েলের ঝমঝম শব্দ কানে ভেসে আসে। মাঝ রাতে দরজায় আওয়াজ হয়। মাঝেমধ্যে গুনগুন শব্দে গান শুনতে পায়। এই অদ্ভুত শব্দের কারণে তারা নতুন বাড়ি ছেড়ে পুরনো বাড়িতে চলে এসেছে। এখানে থাকতে শুরু করেছে। অভিমুন্য একটু একটু করে স্বাভাবিক হতে শুরু করল। অনেক দায়িত্ব এসে পড়ল তোতার উপরে। সবদিক সামলেও সে সুখ খুঁজে পেল না। মাঝেমধ্যে একা বসে বিড়বিড় করে বলে, ঠিক করলে না দিদি। এভাবে চলে গিয়ে কি হলো? অভিমুন্যকে হয়তো আমাকে দিয়ে গেলে। কিন্তু আমি যে নিঃস্ব হয়ে গেলাম। এমনটা আমি কখনো চাইনি। সব কিছু হারানোর পর একটা দিদি পেয়েছিলাম। যার কাছে থেকে অনেক কিছু শিখ ছিলাম। যখনই ভয় করতো নির্বিধায় তোমার কাছে চলে যেতাম। রাতে একসঙ্গে ঘুরতাম। কত ভীতু ছিলাম আমি। রাতে কিছুক্ষণ বাড়িতে একা থাকলে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যেত। আর এখন বাবা-মা ভয় পেলে তাদেরকে আমি সামলাই। ভাবতে পারছো! কত পরিবর্তন হয়েছে আমার মধ্যে। জীবন মানুষকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করায় তা আমার অভিজ্ঞতার বাইরে। এতকিছুর মধ্যেও আমি তোমাকে খুঁজে বেড়াই। খুব মিস করি দিদি। তোমাকে আমার সত্যিই প্রয়োজন। কথা দিচ্ছি আমি তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করবো। অভিমুন্যকে অনেক বড়ো করবো। তোমার মতো করে গড়ে তুলবো। তুমি সবসময় চাইতে এই পরিবার এক হয়ে যাক। আমি এই পরিবারকে এক করে ছাড়বো। পার্বতী চলে যাওয়ার পর অন্তিমের মধ্যে অনেক পরিবর্তন এলো। সে কথা রেখেছে। ছেলের টানে কিংবা অন্য কোনো কারণে এখন প্রায় বাড়িতে ফিরে আসে। সবার সাথে খুব ভালোভাবে কথা বলে। মেলামেশা করে। পুরনো বাড়িতে আসতে দ্বিধাবোধ করে না।

জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত মানুষকে শিক্ষা দেয়। জীবন সবসময় সুন্দরভাবে এগিয়ে যেতে পারে না। সুন্দরের মধ্যে অসুন্দর খুশির মধ্যে বেদনা কিংবা মর্মান্তিক কিছু এসে পড়ে। তাদেরকে সঙ্গে করে এগিয়ে যেতে হয়। পেছনে যা পড়ে থাকে তা অতীত। অতীতকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া বোকামি। সর্বহারা হয়ে পড়লেও জীবনের কাছে হার মেনে নেয়নি লতা। জীবনের সঙ্গে লড়াই করতে শিখিয়ে দিয়ে গেছে সূর্যময়। সূর্যময় চলে যাওয়ার পর তার লড়াইটা অনেক কঠিন হয়ে ওঠে। কঠিন লড়াইটা সহজ করে নেওয়ার দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে চেপে নেয়। শ্বশুর শাশুড়ির দেখাশোনার পাশাপাশি নিজের ছেলেকে সযত্নে বড় করে তোলে। ময়ূর বরাবরই দুষ্টু ছেলে ছিল। বাবা না হলে তার একটা মুহূর্ত কাটতো না। কিন্তু বাবা চলে যাওয়ার পর তার মধ্যে অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে। সে তেমন দুষ্টুমি করেনি। একটা সময়ের পর তার দুষ্টুমি পুরোপুরি কমে যায়। বাবা থাকাকালীন প্রচুর আবদার করতো। মায়ের কাছ থেকে কখনো কিছু চায়নি। কোনো আবদার রাখেনি। বড়ো শান্ত ছেলে হয়ে ওঠে। তবে সবসময় বাবার খোঁজ করে। মাঝেমধ্যে একা চুপচাপ চুপচাপ বসে থাকতে দেখা যায়। চোখ থেকে ঝর-ঝর করে জল ঝরে পড়ে। কারণ জানতে চাইলে কিছু বলে না। উঠে দূরে কোথাও চলে যায়। লতা সবকিছু বুঝতে পারে। সান্ত্বনা দেয়। ওই সান্ত্বনায় মন ভরে না ময়ূরের। সে বাবাকে খুঁজে বেড়ায়। বাবাকে চাই। কোথায় পাবে বাবাকে? ময়ূর ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে ওঠে। মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ লাইফ শেষ করে। তারপর শুরু হয় চাকরি খোঁজা। এভাবে কেটে যায় কুড়িটা বছর। ময়ূর প্রতিষ্ঠিত হয়। চাকরি পেয়ে যায়। ইতিমধ্যে দাদু-দিদা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। বাড়িতে একা মা রয়েছে। কাজের সূত্রে সে এখন শহরে থাকে। লতা খুব অভিমানী। কোলে পিঠে করে ছেলেকে মানুষ করল। আর ছেলে বড় হয়ে শহরে থেকে গেল। মায়ের কাছে ফিরে এলো না কেন? ময়ূর তো সপ্তাহে একবার করে মায়ের কাছে ফিরে আসে। তাতেও শান্তি মিলে না লতার। সে তো সবসময় ছেলেকে নিজের আঁচলে বেঁধে রাখতে চায়। কিন্তু তা কি সম্ভব? ছেলে যে বড় হয়েছে। সূর্যময় সবসময় স্বপ্ন দেখতো তার ছেলে অনেক বড়ো হবে। তার মতো এই পল্লীগ্রামে পড়ে থাকবে না। শহরে যাবে। নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে মিশবে। অনেক বড়ো হবে অনেক। যেখানে সহজে কেউ তাকে ছুঁতে পারবে না। ছেলের জন্য নিজের চিকিৎসা করিয়ে ছিল না। ছেলের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য টাকা রেখে গেছিলো। সে-ই ছেলে আজ মানুষ হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাকে কি এখন ঘরে বেঁধে রাখা সঠিক হবে? লতা নিশ্চিত, সে যদি ছেলেকে বলে গ্রামে থেকে যেতে তাহলে তার ছেলে থেকে যাবে। কিন্তু এখানে থেকে কি করবে? এই পল্লীগ্রামে তো কিচ্ছু নেই। তার বাবার মতো তাকেও মাঠে কাজ করতে হবে। লতা চায় না বাবার মতো সে এতটা পরিশ্রম করুক। ছেলের স্বপ্ন শেষ করতে চায় না। ছেলেকে কিচ্ছু বলে না। ময়ূর বারবার মাকে বলে, মা যেন শহরে চলে আসে। তার সঙ্গে থাকে। লতার যেতে ইচ্ছে করে না। এই ঘরবাড়ি সংসার সব নিজের হাতে সাজিয়েছে। এখানে ময়ূরকে বড়ো করেছে। এখানে সূর্যময় আর তার সোনার সংসার ছিল। সব কিছু তোয়াক্কা করে সে শহরে যেতে পারবে না। মন সায় দেয় না। অদ্ভুত টানাপোড়েনের মধ্যে কোনো কিছুই জিতে যায়নি। এখনো শরীরে শক্তি রয়েছে। কাজ করতে পারে। যদিও এখন তেমন কোনো কাজ করতে হয় না। রান্নাবান্না ছাড়া আর কিছুই করে না। সারাদিন বাড়িতে একা থাকতে ভালো লাগে না। বড় একা লাগে। কারোর সঙ্গে বসে দু’দণ্ড কথা বলতে পারলে মনে শান্তি মিলে। কিন্তু কথা কার সঙ্গে বলবে? ছেলে সারাদিনে আরেকবার ফোন করে। কিন্তু প্রত্যেকবারই কিছুক্ষণ কথা বলে রেখে দেয়। এত কাজ রয়েছে। সবসময় মায়ের সঙ্গে কথা বলতে পারে না। লতা মন থেকে অন্য কিছু চায়। কিন্তু ছেলের সামনে অন্য কিছু বলে। ছেলে বারবার ফোন করলে বলে, এতবার ফোন করার কি আছে? মা তো ভালো আছে। তোমার কাজ রয়েছে না। কাজে মন দাও। প্রত্যেক সপ্তাহের শেষে মার কাছে ফিরে এলে মা বলে, প্রত্যেকবার এতদূর আসার কি দরকার? আমি তো ভালো আছি। সারা সপ্তাহ পরিশ্রমের পর এত দূর যাওয়া-আসা করলে তোমার শরীর তো কষ্ট পাবে। শরীর খারাপ করবে। নিজের খেয়াল রেখো।ময়ূর মায়ের কোলে মাথা রেখে দু-দন্ড শান্তি খোঁজে। মাঝেমধ্যে জিজ্ঞেস করে, বাবার কথা মনে পড়ে? লতা জবাব দেয় না। স্কুল জীবনে কত বন্ধুর কথা আজও মনে পড়ে। সেখানে সূর্যময়কে কি করে ভুলবে? সবকিছু মনে আছে। কোনো কিছু ভুলে যায়নি। মায়ের জবাব না পেলে ময়ূর আবার প্রশ্ন করে, মা, বাবা তো খুব অল্প বয়সে চলে গেছিল। তুমি চাইলে আবার বিয়ে করতে পারতে। কেন বিয়ে করলে না? শেষ জীবনে অন্তত একটা সঙ্গী পেতে। এভাবে সমস্ত দুঃখ যন্ত্রণা কেন নিজের ঘাড়ে চেপে নিলে? হাসি মুখে লতা জবাব দেয়, আমার কষ্ট হয় না। যেটুকু কষ্ট হয় ওটা কষ্ট নয়। কিছু কিছু দুঃখ কষ্টের মধ্যে এক সমুদ্র আনন্দ ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে। ওই আনন্দ স্বাভাবিক জীবনের আনন্দ থেকে অনেকটাই আলাদা। যা সবাই উপলব্ধি করতে পারে না। ময়ূর আর কোনো প্রশ্ন করে না। মায়ের মুখের দিকে তাকায়। কি মৃন্ময়ী রূপ! নাম না জানা এক সাম্রাজ্যের রানী। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শান্তি পায়। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আদর করে। এত ভালোবাসার মধ্যেও ময়ূরের আকাঙ্ক্ষা শেষ হয় না। সে বাবাকে খোঁজে। বাবার কাঁধে বসে শহরে যাওয়া কিংবা বাজারে যাওয়ার কথা ভুলতে পারে না। বাবার কথা সবসময় মনে পড়ে। খুব মনে পড়ে। রোগাক্রান্ত শরীরে হাসিমুখে ছেলের সব আবদার পূরণ করেছে। কিন্তু সে ছেলে হয়ে বাবাকে ভালো কিছু দিতে পারিনি। ছেলের কাছ থেকে কিছু না নিয়েই চলে গেছে। কিন্তু বাবার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস তার কাছে রেখে গেছে। তাকে আদর যত্ন করতে পারলে তাকে ভালো রাখতে পারলে বাবা অনেক খুশি হবে। তাই ময়ূর সবসময় মাকে আগলে রাখে। কষ্ট পেতে দেয় না।
আজকাল লতা খুব একা অনুভব করে। ছেলের কাজ দিনের পর দিন বাড়তে শুরু করলো। মায়ের থেকে দূরত্ব আরও কিছুটা বেড়ে গেল। একাকীত্বটা খুব বেশি সহ্য করতে পারলো না লতা। সে ভাবলো, ছেলেকে বিয়ে করে আনলে তো ভালো হয়। বাড়িতে একটা বউ আসবে। অনেক বছরের পর সংসার আবার আলোকিত হবে। নিজের একাকীত্ব অনেকটা দূর হবে। সবসময় একা থাকতে কার ভালো লাগে? বৌমার সঙ্গে দু’দণ্ড কথা বলতে পারবে। সে বেঁচে থাকতে তাদের সংসার গুছিয়ে দিয়ে যাবে। এমন সব ভাবছিল। ছেলেকে কথাগুলো জানাবে বলেও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে ছিল। এমনই একদিন দুপুরে ছেলের ফোন এলো..
‘মা!’
‘হ্যাঁ,বাবা বল! খেয়েছো? শরীর ভালো আছে তো?’
‘সবকিছু ঠিক আছে।’
‘কী করছো এখন? অফিসে?’ ময়ূর জবাব দিল না। কণ্ঠস্বরে কেমন একটা ভয়ার্ত ভাব লুকিয়ে রয়েছে তা অনুভব করতে পারল লতা। জবাব না পেতে লতা বললো,’কিছু সমস্যা হয়েছে? আমায় বলো।’ ময়ূর উত্তর করলো না। আরও কিছুটা সময় চুপচাপ থাকার পর বলল,’মা, আমি সকালে বিয়ে করে নিয়েছি।’ লতার চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরে পড়ল। এই মুহূর্তে নিজেকে সামলে নেওয়া মুশকিল। তবুও সামলে নিল। এই তো সকাল বেলা স্বপ্ন দেখছিল, তার একমাত্র ছেলে ময়ূর। তাকে ঘিরে কত সুন্দর স্বপ্ন। ধুমধাম করে বিয়ে দেবে। পাড়াগাঁয়ের মানুষদের নেমন্তন্ন করবে। তার ছেলে বলে কথা। কিন্তু কি হলো? ছেলে নিজে থেকে বিয়ে করে নিল। একবার মাকে বলার প্রয়োজন হলো না। সে যদি কাউকে পছন্দ করতো মাকে বললে কি মেনে নিতো না! একবার অন্তত বলে দেখতে পারতো। ছেলে সেটাও করল না। খুব রাগ হলো। অভিমান হলো। তবে ছেলের ওপর কোনো কিছুই প্রকাশ করল না। কিছু বছর আগে সে নিজেও এমনটা করেছে। যদিও সে তার বাবা-মাকে জানিয়েছিল। তারা মেনে না নিতে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আজ সে-ই জায়গায় দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছে তার বাবা-মা ভুল ছিল না। তীব্র রাগ অভিমানে তারা মেয়ের সাথে যোগাযোগ রাখনি। দীর্ঘ সময় পরও মাকে জবাব দিতে না দেখে ময়ূর বলল,’কিছু বলবে না? আমাদের ঘরে যেতে দেবে না?’
‘তোমার ঘর তুমি থাকবে না তো কে থাকবে? চলে এসো। আমি অপেক্ষায় রইলাম। তাড়াতাড়ি বৌমাকে নিয়ে ফিরে এসো।’
ময়ূর ভীষণ খুশি হলো। সে জানতো তার মা মেনে নেবে। তাই এত বড় একটা সিদ্ধান্ত খুব সহজে নিতে পেরেছিল। ছেলের খুশি দেখে লতা খুব খুশি হলো। ঘর দুয়ার ভালো করে ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করল। বাড়িতে নতুন বউ আসবে। তার আনন্দ সইছে না। নিজের মনের মতো হয়তো হলো না তবুও মেনে নিল সবকিছু। ছেলের খুশিতে সে খুশি। তারপর নিজের ঘর থেকে সমস্ত জিনিসপত্র গুটিয়ে নিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ি যে ঘরে থাকতো ওই ঘরে নিয়ে গেল। আজ থেকে শ্বশুর-শাশুড়ির ঘরে থাকবে সে। এই ঘরটায় ছেলে আর বৌমা থাকবে। তার বয়স হয়েছে। তার কি আর এত সুন্দর ঘরের প্রয়োজন? প্রয়োজন নয়। কোনোরকম একটা ঘর হলেই হবে। কিন্তু ছেলে আর বৌমার জন্য একটা ভালো ঘরের প্রয়োজন। নিজে থেকেই ঘর ছেড়ে দিল। ভালো করে পরিষ্কার করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখলো। সন্ধ্যার সময় ছেলে আর বৌমা ফিরল। সাথে অনেকগুলো লোককে দেখে অবাক হলো। লোকগুলোকে দেখে বুঝতে পারলো তারা মেয়ে বাড়ির লোকজন। লতা অবাক হলো। মেয়ে বাড়ির সবাই বিয়ের ব্যাপারে জানে। শুধুমাত্র এই বৃদ্ধা মাকে কেউ খবর দিল না। বৃদ্ধা মাকে একবার খবর দিলে খুব কি অসুবিধা হয়ে যেত? খুব কষ্ট হল। নতুন বউ বেশ সুন্দরী। ছেলের সাথে খুব মানিয়েছে। খুব খুশি। কিন্তু নতুন বউকে শাঁখা পলা সিন্দুর পরতে না দেখে মনে খটকা লাগলো। এটাই কি আধুনিক জীবন? না অন্য কিছু? এতগুলো মানুষের সামনে প্রশ্ন করতে সাহস পেল না। এতগুলো মানুষের খাওয়া-দাওয়া বাসনপত্র গোটাতে অনেক রাত হয়ে গেলো। সারারাত ঘুমোতে পারলো না লতা। এ-পাশ ও-পাশ করতে রইল। সকালে খুব তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল। ছেলে ঘুম থেকে উঠেই মার কাছে এলো। দু-একটা কথা বলার পর লতা বলল,’এমন কি হয়েছিল? মাকে একবারও বিয়ের কথা বলতে পারলে না? আমাকে বললে বাধা দিতাম বুঝি? মেয়ে বাড়ির সবাই তো জানে। আর আমি জানলে ক্ষতি হয়ে যেত?’
‘তেমন কিছু নয়, মা। আসলে?’
‘আসলে কি?’
‘আসলে! মেয়েটি অন্য ধর্মের। তাদের পরিবার খ্রিস্টান ধর্ম পালন করে। আর তুমি এ-সব জানার পর কখনোই আমাদের মেনে নিতে না। আর সুমিত্রা নিজের পরিবারের অমতে বিয়েতে রাজি হচ্ছিল না। আমি ওকে খুব ভালোবাসি। তাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। তাই আমিও খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছি। আমাদের খ্রিস্টান ধর্ম অনুযায়ী বিয়ে হয়েছে। তুমি এগুলো কখনো মেনে নিতে না। তাই তোমার কাছে সব লুকিয়ে ছিলাম।’ লতা কোনো জবাব দিল না। মিহি চোখে শুধু ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

পর্ব ৩১ আসছে।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here