নিরুদ্দেশ
পর্ব ১৩
জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, এই তিনটি কথা পূর্ব থেকে কেউ বলতে পারে না। সহজ সরল স্বাভাবিক জীবনে কখন কি ঘটে যাবে কেউ জানে না। সকালে ঘুম থেকে উঠে সবুজ যখন শুনলো গতকাল রাতে সূর্যময় বিয়ে করেছে তখন সে আশ্চর্য হল না -তার মুখে সুন্দর একটা হাসি ফুটে উঠল। সূর্যময়ের বয়স কত? বাইশ-তেইশের মধ্যে। আইনগতভাবে সে কোনো অন্যায় করেনি। বর্তমানে সে প্রতিষ্ঠিত। হঠাৎ করে বিয়ে করতে গেল কেন? বন্ধুর বিয়েতে বেজায় খুশি সে। কিন্তু তার ভাবলেশহীন সিদ্ধান্তকে সমর্থন করতে পারল না। আজ থেকে তিন বছর আগে তারা একটা দ্বীপে বেড়াতে গিয়েছিল। আর সেখানে সূর্যময় বলেছিল, তার দু-বন্ধুর অনুপস্থিতিতে কখনো বিয়ে করতে পারবে না সে। ও একেবারেই সম্ভব নয়। আর বিয়ের সময় একটি বারও জানানোর প্রয়োজন মনে করল না। মনের কোনো স্থানে হঠাৎ করে অভিমান জন্মালো। সংকেত বাড়িতে নেই। সেও নিশ্চয়ই কিছু জানে না। তাকে একবার ফোন করলে হয়। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। ফোন করার আগেই তার ফোন বেজে উঠল। সংকেত ফোন করেছে। তার মুখে সমস্ত কিছু শুনে সবুজের অভিমান দূর হলো। সূর্যময় তিন বছর আগে একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে। মেয়েটির পরিবার অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বেশ স্বাবলম্বী হলেও বাহ্যিক শিক্ষাগত যোগ্যতা খুবই নগণ্য। সূর্যময় তিনটা বছর ডুবে ডুবে প্রেম করেছে। কোনো বন্ধুকে জানায়নি। হঠাৎ করে লতার পরিবার তার বিয়ের জন্য তোড়জোড় করে। লতা বাড়িতে সূর্যময়ের কথা বলে। বাড়িতে এত অল্প বয়সী ছেলের সঙ্গে বিয়ে মেনে নিতে চায়নি। তাছাড়া সূর্যময় তেমন কোনো ভালো কাজ করে না। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের উপর মেয়েকে ঝোলাতে চায় না। তারা উচ্চবংশের মানুষ। অনেক ভালো পরিবার দেখে মেয়ের বিয়ে দিতে পারবে। তাই লতার প্রস্তাব মানেনি। সূর্যময় উতলা হয়ে ওঠে। সমাধান কার কাছে পাবে বুঝে উঠতে পারছিল না। সবুজকে কিছু বলতে পারেনি। সে এখন ন্যায়-অন্যায় বার করবে। সামান্য কিছু করতে গেলে দশবার ভাববে। তাই সে প্রথমে সংকেতকে বলে। অনেক আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় তারা বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করবে। এবং শুভ কাজটা বেশি দেরি করেনি। অর্থাৎ সংকেত পূর্ব থেকে সবকিছু-ই জানতো। সে সবুজকে জানাতে চাইছিল কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত বদলেছে। কারণ, সে সবকিছু জেনে গেলে বলতো সূর্যময় যা করছে তা অন্যায়। সে থাকতে বন্ধুকে কিছুতে অন্যায় করতে দেবে না। কিছু একটা ব্যাঘাত ঘটাতো। তাই তারা বিয়ের আগে কিছু জানায়নি সবুজকে।
সবুজের এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা খুব কম। সে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না সূর্যময় সঠিক কাজ করেছে কিনা। তবে লতার কোনো ভুল দেখতে পেল না। সে সঠিক মানুষের হাত ধরেছে। ভালোবাসা,সম্মান,শান্তি, মর্যাদা কোনো কিছুর অভাব হবে না। শুধু নিজের বন্ধু বলে নয়, সত্যিকারের ভালো মানুষ সূর্যময়। অজুহাত দেখিয়ে লতা যে অন্য পুরুষের হাত ধরেনি এটাই বড় মহত্ত্বের। ভালোবাসার জন্য সুবিধা ছেড়ে অসুবিধাকে বেছে নিয়েছে। মনে মনে ভীষণ খুশি হলো। ইচ্ছে করলো সূর্যময়কে ফোন করে অভিনন্দন জানাতে। কিন্তু ব্যাপারটি কেমন বিদঘুঁটে হবে। এখনো সব কিছু পরিস্কার নয়। অনেক উড়ো উড়ো খবর ভেসে আসছে কানে। কেউ বলছে অতুলবাবু এই বিয়ে মেনে নেননি। ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। আবার কেউ উল্টোটা বলছে। আবার কেউ বলছে, মেয়ের বাড়ি থেকে নাকি পুলিশে অভিযোগ করেছে। পুলিশ তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। সবুজ এত কিছু নিতে পারল না। বন্ধুর ঘন বিপদ আসন্ন। এই সময়ে পাশে থাকা উচিত। অপেক্ষা না করেই ফোন করলো। সূর্যময়ের কণ্ঠস্বর শুনে মনে হলো না সে দুশ্চিন্তায় আছে। বরং অনেক হাসি খুশি লাগলো তাকে। মনে জোয়ার এসেছে। সে প্রথমে ফোন ধরে বলল,’দুঃখিত,দুঃখিত বন্ধু। আমি চরমভাবে লজ্জিত। আসলে….।’ তার কথা আটকে সবুজ বলল,’আমি সব শুনেছি। এখন সবকিছু ঠিকঠাক না! কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? তোমার বাবা মেনে নিয়েছেন?’
‘হ্যাঁ, বাবা অনেক খুশি। মা একটু মুখ গোমরা করে রেখেছেন। একটা ছেলে। অনেক কিছু আশা করেছিলেন। খুব কষ্ট পেয়েছেন।’
‘থাকতে থাকতে ঠিক হয়ে যাবে। তোমার চিন্তা করার দরকার নেই। শুধু ধৈর্য ধরো।’
‘সেসব না হয় হলো। তুমি একবার আমার বাড়িতে আসবে?’
‘অবশ্যই যাবো।’
‘আজকেই আসতে হবে।’
‘সন্ধ্যার দিকে যাব কথা দিলাম। আর সংকেত আসবে না?’
‘ও তো ট্রেনিংয়ে রয়েছে। আসা সম্ভব নয়।’
‘ঠিক আছে আমি যথা সময়ে পৌঁছে যাব।’ ফোনটা রেখে দিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। সূর্যময়ের আপাতত কোনো বিপদ নেই -এটা ভেবেই মনে শান্তি পেল। সুখী হোক ছেলেটা। এই অল্প বয়সে অনেক পরিশ্রম করেছে। তার হাতটা যেন সারা জীবন কেউ শক্ত করে ধরে রাখে -ঈশ্বরের কাছে এটাই তার প্রার্থনা। একটু পর আবার একবার ফোন বেজে উঠলো। দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকের ফোন। সামনে সপ্তাহে সবুজের একটা লেখা প্রকাশ পাওয়ার কথা। ওটা আজকের মধ্যেই জমা চাইছে। সবুজ যথা সময়ে পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব রাখল। দাদা আর বাবার সাথে মনোমালিন্যের পর আরও দুটো বছর কেটে গেছে। কিন্তু সবুজ তেমন কোনো সুবিধা করে উঠতে পারেনি। এখনো খাদের কিনারায় পড়ে আছে। টুকটাক লেখালেখি চলছে। দু-একটা লেখা পত্রিকায় বেরিয়েছেও। যদিও কোনো লেখা জনপ্রিয়তা পায়নি। বাড়ির সাথে সম্পর্কটা দিনের-পর-দিন অবনতি হচ্ছে। দাদা এমনিতেই তার সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলতো না। সেদিনের পর থেকে তার মুখের দিকে তাকায় না পর্যন্ত। সে নিজে থেকে কথা বলতে গেলেও আগ্রহ দেখায় না। বাবাও ছোট ছেলের প্রতি উদাসীন হয়ে উঠেছেন। বাকি থাকলেন মা! তিনি ছেলেকে বারবার বুঝিয়ে চলেছেন। ছেলের ব্যবহারের মোটেও সন্তুষ্ট নন।
সন্ধ্যার সময় সবুজ সূর্যময়ে বাড়িতে পৌঁছালো। বাড়িতে বেশ আত্মীয়-স্বজন রয়েছে। ভালো মন্দ রান্না যে হচ্ছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ রইল না। চতুর্দিকে বেশ কোলাহল। সূর্যময় খুব ব্যস্ত। সবদিক সামলাতে হচ্ছে তাকে। তার চোখ-মুখ ব্যক্তিত্ব আর গাম্ভীর্যে টসটস করছে। একদিনে যেন অনেক বড় হয়ে গেছে সে। কত দায়িত্ব তার। আত্মীয়-স্বজনের মুখমন্ডল লক্ষ করে সবুজ বুঝলো, সবাই সবুজের বিয়েটা মেনে নিতে পারেনি। সামনে থেকে সমর্থন করলেও ভেতর থেকে কাঠি নাড়ছে। কিছু সময় পর সূর্যময় তার কাছে এসে বসলো। হাঁপাচ্ছে সে। কপালে ঘাম টিপটিপ করছে। কান আর ঘাড়ের কাছে চুলগুলো ঘামে ভিজে গেছে। তবুও অস্বস্তি বোধ করছে না। সবুজ সু-কন্ঠে বলল,’খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে?’
‘ওই আর কি! সবদিক সামলাতে…..।’
‘মেয়ের বাড়িতে কেউ আসেনি?’
‘না,ওরা এই বিয়ে মেনে নিতে পারেনি। থানায় অভিযোগ করেছে।’
‘তাহলে তো এখনো ঝামেলা চুকে যায়নি। যেকোনো সময়ে বিপদ হতে পারে।’
‘তেমন কোনো বিপদ হবে না। প্রথমতঃ আইনত ভাবে ছেলেমেয়ের বয়স হয়ে গেছে। দ্বিতীয়তঃ আমরা রেজিস্ট্রি করে নিয়েছি। তাছাড়া, লতাকে তো জোর করে বিয়ে করিনি। সে এই বিয়েতে সম্মতি জানিয়েছে।’
‘ বাহ্ বন্ধু, বাহ্! বড্ড চালাক হয়ে গেছো দেখছি।’
‘ও চালাক হয়নি, সমস্ত বুদ্ধি আমি দিয়েছি। পেছনের মাস্টারমাইন্ড আসলে আমি।’ কণ্ঠস্বর খুব পরিচিত। দুজনে তাজ্জব বনে তাকিয়ে দেখল। লম্বা কাঠিন্য এক যুবক তাদের সামনে বুক উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে গাম্ভীর্য। মুখে সুকুমার ভঙ্গি। তাদের চোখ বিশ্বাস করতে পারছে না। এ যে সংকেত। কোথা থেকে এলো? তার তো এখন ডিউটিতে থাকার কথা। সূর্যময় আমতা আমতা করে বলল,’সংকেত, তুমি! এখানে! কি করে সম্ভব?’ সে চটজলদি কাছ থেকে একটা চেয়ার টেনে এনে তাদের কাছে বসে পড়ল। হাসিমুখে বলল,’বন্ধুর বিয়ে। আর আমি থাকবো ডিউটিতে। তা কি শোভনীয় দেখাবে? তাই অনেক ধরে পিঠে তিন দিনের জন্য ছুটি নিয়ে চলে এলাম।’ সূর্যময়ের চোখে জল চলে এলো। স্থির হলে সময় লাগলো। তার চোখের জল দেখে একটু কৌতুক করে সংকেত বলল,’এতদিন তো তোমরা আমায় কাঁদুনে বলেছো, কিন্তু এখন তোমার চোখে জল কেন?’ সূর্যময় কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,’এ তো আনন্দের জল গো। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। এত সহজে সবকিছু উতরে যাবে। আমার এত বড় অন্যায় কাজকে সবুজ সমর্থন করেছে। এর চাইতে বড় কি হতে পারে? আর তুমি সবকিছু ফেলে ছুটে এসেছো। এগুলো কখনো শুধুমাত্র দায়িত্ব হতে পারে না। এ তো গভীর ভালোবাসা।’ সংকেত মৃদু হাসলো। বলল,’আমরা তো কথা দিয়েছি। জীবনে যাই হয়ে যাক না কেন আমরা কখনো নিরুদ্দেশ হয়ে যাব না। আমরা তিনটি পৃথক মানুষ কিন্তু প্রাণ একটা। আমরা তো কৃষকের ঘাম। আমারা অনেক দামী।’ কিছুটা সময় নিস্তব্ধতায় কেটে গেল। এই নিস্তব্ধতা সৌন্দর্যের সীমা বাড়িয়ে দিল। তারপর সূর্যময় বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলল,’তোমরা একটু অপেক্ষা করো। আমি তোমাদের জন্য খাবার আনছি।’ বলেই উঠে গেল সে। সংকেত সবুজের দিকে তাকালো। মৃদু হাসলো। হাসতে দেখে অবাক হল সবুজ। মিছামিছি হাসছে কেন ছেলেটা? বিস্ময় সুরে বলল,’হাসছো কেন?’
‘অবাক হচ্ছি..তাই…।’
‘মানুষ অবাক হলে হাসে বুঝি!’
‘মানুষ হাসে কিনা জানি না, তবে আমি হাসি।’
‘ঠিক আছে। তোমার অবাক হওয়ার কারণটা কি জানতে পারি?’ সংকেত ভ্রু কুঁচকালো। বলল,’তুমি এই বিয়েকে কি করে সমর্থন করলে? এখানে বুঝি কোনো অন্যায় হচ্ছে না?’ সবুজের ঠোঁটের গোড়ায় যেন উত্তর লুকিয়ে ছিল। কোনো কিছু না ভেবেই বলল,’ভালোবাসার অতৃপ্ততার স্বাদ খুব কঠিন। মানুষ ভালোবাসে নিজেকে ভালো রাখার জন্য। সেখানে ছেড়ে যাওয়ার মত একটা নোংরা শব্দ আসতে পারে না। অন্যদেরকে খুশি করতে গিয়ে নিজেদেরকে দুঃখের আগুনে দগ্ধ করাকে কোনো মহত্ব বলে না। এটা এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা। নিজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। অন্যকে খুশি করে যদি নিজে খুশি থাকতে পারো তাহলে ওটাই মহত্ব।’
‘ছোটবেলা থেকে কোলে পিঠে করে লতার বাবা-মা লতাকে মানুষ করল। আর বড় হয়ে কাউকে তোয়াক্কা না করে চলে এলো। এটা বুঝি অন্যায় নয়? এটা বুঝি লতার বাবা-মার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা নয়।’
‘না, এটা অন্যায় নয়। লতা লুকিয়ে তো কিছু করেনি।সে পূর্বে বাবা-মাকে সবকিছু জানিয়েছে। মেয়ে বড় হয়েছে তার পছন্দকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল। তারা তা করেনি। আর লতা কোনো ভুল মানুষের হাতও ধরেনি।’
সংকেত মাথা নাড়ালো। কিছুক্ষণ আবার নিস্তব্ধতা।
সূর্যময় মিষ্টি এনে দুজনকে দিল। তারা দুজন বন্ধুকে না খাইয়ে ছাড়বে না। সূর্যময়কেও খেতে হল। সে বলল, রাতে তার বাড়িতে থাকার জন্য। অনেক গল্প হবে মজা হবে। সারারাত আড্ডায় জমে থাকবে। কারোরই বাড়ি ফেরার ইচ্ছে ছিল না। সহজে রাজী হয়ে গেল। অনেকক্ষণ এসেছে কিন্তু নতুন বউ দেখা হয়নি। সূর্যময় বন্ধুদের নিজের ঘরে নিয়ে গেল। সে হনহন করে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো সবুজ আর সংকেত। দুজনেই বেশ লাজুক। ও একবার তাকে ঠেলে তো সে একবার ওকে ঠেলে। কেউ আগে যেতে চাইছে না। লজ্জা পাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সংকেতই প্রথমে গেল। সে ভেতরে প্রবেশ করে সূর্যময়ের আড়াল হয়ে পালঙ্কের উপর বসে পড়ল। তারপর ধীরে ধীরে সবুজ প্রবেশ করল। নতুন বউয়ের সামনে দাঁড়ালো। দুজনেই পূর্বে লতাকে দেখেনি। একুশ-বাইশ বছরের যুবতী, বধু রূপে দারুণ দেখাচ্ছে। মাথায় বেশ চুল, ডাগর ডাগর চোখ, মুখখানা খাসা। এই মেয়ে নদীর মতো চাঞ্চল্য। তাদের উপস্থিতিতে ভিমরি খেলো না। চোখটা যেন কেমন কেমন। মনে হচ্ছে হাজারো দুঃখ লুকিয়ে আছে। সে যেমন সূর্যময়কে ছাড়তে চায়নি তেমনি
বাবা মাকেও…। বাইরে থেকে খুশি থাকলেও ভেতরে মোটেও খুশি নেই। মুখশ্রীতে কৃত্রিম লাবণ্য ঝরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। সূর্যময় পাশে গিয়ে বসল। নতুন ব্লাউজ পরেছে, চুলের তেলের গন্ধ, শাড়ি-জামার গন্ধ মিলে কেমন একটা নতুন নতুন ভাব। স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে বলল,’এদেরকে চিনতে পারছো?’ মেয়েটি হাসলো। তারপর সংকেতের দিকে ইঙ্গিত করে তার নাম বলল আর সবুজের দিকে ইঙ্গিত করে তার নাম বলল। সংকেত আনন্দে লাফিয়ে উঠলো। হাসিমুখে বলল,’তুমি তো দেখছি আমাদের সবাইকে চেনো?’
‘তোমাদের বন্ধু সবসময় তোমাদের নাম নিতো। তোমাদের কত গল্প শুনেছি। ও সব সময় বলে তোমরা তিনটা মানুষ কিন্তু প্রাণ একটা।’
‘ও মা,এ তো দেখছিস স্বামীর নাম মুখে নিতে লজ্জা পাচ্ছে।’ সে যেনে হাসির কিছু বলল। এই ভেবে নিজেই হেসে উঠলো। লতা লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে ফেলল।
সবুজ নতুন বাড়িতে না থাকলেও এখন সেখানে তিন বেলা খেতে যায়। পুরনো বাড়িতে আর খাবার আনতে হয় না। হঠাৎ করে পরিবর্তন হয়নি। গত দু’মাস আগে রিপন বিয়ে করেছে। বৌদিমণি সবুজকে আলাদা ঘরে থাকতে দেখে অবাক হয়। এর কারণ অবশ্য জানতে চায়নি। সদ্য শ্বশুর বাড়ি এসেছে। সমস্ত কিছুতে দ্রুত অকপট হওয়া উচিত নয়। তবে ছোট ভাই হিসেবে সবুজকে বলে, সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে খাবার খায়। আর সে একা একা ওই বাড়িতে খাবে কেন? সবার সঙ্গে মিলেমিশে খেতে অসুবিধা কোথায়? সবুজ কোনো উত্তর দিতে পারেনি। পার্বতী জোর করেনি। শুধু বলেছিল, সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকলে ভালো হয়। একা একা ঘরে খাওয়ার প্রয়োজন নেই। তাকে এখানে আসতে কেউ বারন করেনি। মন চাইলে আসতে পারে। বৌদিমণি নতুন এসেছে। তার অনুরোধ ফেলতে পারেনি সবুজ। ভেবেও দেখেছে, নতুন বাড়ি ভালো লাগে না তাই পুরনো বাড়িতে আছে -অসুবিধা নেই। তবে সবসময় আলাদা একা একা খাবার খাওয়া কোনো সুস্থ মস্তিস্কের মানসিকতা নয়। তার একটা সুন্দর পরিবার রয়েছে। তারা কেউই তার প্রতি খুব বেশি বিরূপ আচরণ করেনি। তাহলে এভাবে সবার থেকে আলাদা হওয়ার কারণ কি? পরে নিজের কৃতকার্যের জন্য লজ্জিত বোধ করেছে।
লেখালেখি নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন সবুজ। প্রতিদিন কারোর না কারোর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। একটা সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। পরিশ্রমের কোনো খামতি রাখেনি। একটা কাজে শহরে গিয়েছিল। ফিরতে বিকেল হয়ে গেল। খিদে পেয়েছে। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে নতুন ঘরে গেল। আশেপাশে কাউকে দেখতে পেল না। মায়ের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল তিনি ঘুমাচ্ছেন। বিরক্ত করল না।সে নিজে ভাত বেড়ে নিল। তরকারি নিতে গেছে তখনই বৌদিমণিকে দেখে থতমত খেয়ে গেল। সে যেনে কিছু চুরি করেছিল আর ধরা পড়ে গেছে। দ্রুত নিজেকে স্বাভাবিক করল। কিছু বলার আগেই বৌদিমণি বলল,’কখন এলে? আমায় একবার ডাকতে তো পারতে! তোমার উপস্থিতি আমি খেয়াল করিনি। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বাসনের শব্দ শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল।’ সবুজ কিছু বলল না। সে আবার বলল,’তুমি গিয়ে বসো। আমি খাবার নিয়ে যাচ্ছি।’ সবুজ ফিরে এলো। মেঝেতে আসন পাতিয়ে বসলো। আধুনিক ডাইনিং টেবিল রয়েছে। ও-গুলো পছন্দ নয় তার। তাছাড়া সে সেখানে কম্ফোর্টেবল করে না। বৌদিমণি দুটো থালায় খাবার নিয়ে এলো। দুটো থালা দেখে অবাক হলো সবুজ। জিজ্ঞেস করল,’তুমি এতক্ষণ খাওনি?’
‘বাড়ির ছোট ছেলে বাইরে রয়েছে। সারাদিন খেয়েছে কিনা খেয়েছে কোনো ঠিক নেই। আর আমি খেয়ে নেব? এতটা বিবেকহীন মানুষ নই আমি।’ সবুজ বৌদিমণির দিকে তাকালো। একটু লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে বলল,’মা খেয়ে নিয়েছে না!’
‘বয়স হয়েছে। সময় মত না খেলে তো শরীর খারাপ করবে।’
কিছু বলল না সবুজ। মনের মধ্যে কোনো অনুভূতিও জাগলো না। তার ঠিক মনে আছে,মা কখনো তার জন্য কিংবা দাদার জন্য বা বাবার জন্য কারোর জন্য কখনো অপেক্ষা করে না। নিজের মতো থাকে। জানে না, তিনি কেন এমন? হয়তো সেগুলো তিনি পছন্দ করেন না। স্বাভাবিক ব্যাপার, উনার জন্য কেউ অপেক্ষা করে না,তাহলে তিনি কেন মিছামিছি অপেক্ষা করতে যাবেন? হঠাৎ করে তার চোখের সামনে কাজল দিদির মুখশ্রী ভেসে উঠলো। অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে দেখা হয়নি। সেই মানুষটি সবুজের জন্য অপেক্ষা করতো। সবুজ খেয়েছে কিনা আগে জানতো তারপর তাকে খেতে দিয়ে নিজে খেতো কিংবা তাকে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিতে বলে নিজে খেতে বসতো। মুখ রঙ্গিন আভায় ভরে গেল। বৌদিমণিকে মেঝেতে খেতে বসতে দেখে দ্বিতীয় বার অবাক হলো। সে সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করল,’তুমি এখানে বসে খাবে? ডাইনিং টেবিলে যাও। এখানে তোমার অসুবিধা হবে।’
‘আমি খুব ধনী পরিবারের মেয়ে নই, সবুজ। আমি সাধারণ বাড়ির মেয়ে। মেঝেতে বসে খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে। একজন উপরে বসে খাবে আর একজন নীচে বসে খাবে এটা কি শোভনীয় দেখায়?’
সবুজ জবাব দিল না। চুপচাপ বসে খেতে শুরু করল। পার্বতী চুপচাপ হয়ে থাকতে পারে না। কথা বলতে পছন্দ করে। কিন্তু এই বাড়িতে বেশীরভাগ সময় চুপচাপ থাকতে হয়। কথা বলার মতো তেমন কেউ নেই। রিপন বাড়িতে থাকে না। সপ্তাহের শেষে একবার করে আসে। শ্বশুরমশাই কাজে ব্যস্ত। বাড়িতে খুব কম আসেন। সবুজ তো কথা বলতেই চায় না। বাকি থাকলেন শাশুড়ি মা। সারাদিন যেটুকু গল্প করে উনার সাথেই। সবুজকে শান্ত ভদ্র ছেলের মত খেয়ে যেতে দেখে ঠোঁট টিপে হাসলো পার্বতী। হায় ঈশ্বর! এ কেমন ছেলে! এখন যৌবন বয়স। রক্তের তেজ রয়েছে। ছটফট করার কথা। সবার সঙ্গে মেশার কথা। হাসি খুশিতে থাকার কথা। কিন্তু এ ছেলে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। যেন গ্রীষ্মের নির্জন দুপুরের ক্লান্ত এক পথিক। সংসারের চাপে নির্জীব হয়ে পড়েছে। বড্ড নিঃস্ব একা।
‘সবুজ!’
ডাক শুনে মুখ তুলে বউদিমণির দিকে তাকালো সে। হাসলো। আবার মুখ নিচু করে ফেলল। সলজ্জ চোখে তাকিয়ে পার্বতী বলল,’তোমায় একটা কথা বলি? খুব বেশি দিন তোমাদের বাড়িতে আসিনি। জানি না এই কথাগুলো বলা সঠিক কিনা। তবুও বলতে চাই। শুনবে?’ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
‘তোমার সাথে তোমার দাদার কি কোনো মনোমালিন্য রয়েছে? একে অপরের সাথে ভালো মতো কথা বলো না কেন? তোমাদের দেখলে মনে হয় তোমরা একে অপরের শত্রু। শুধু দাদা নয় তুমি তো মা বাবা কারোর সাথে ঠিকমত কথা বলো না। এমনটা কেন? তুমি কি চাও?’ সবুজ একটু থতমত খেলো। বৌদিমণি কোনো ভুল কিছু বলছে না। নিজেও জানে না, কেন কথা বলতে ইচ্ছে করে না। সবুজ উত্তর দিতে পারল না। জবাব না পেয়ে বৌদিমণি আবার বলল,’দেখো সবুজ, আমি শুধু তোমায় দোষ দিচ্ছি না। তোমাদের প্রত্যেকেরই দোষ রয়েছে। এই ব্যাপারে তোমার দাদাকে বলেছিলাম। কিন্তু তিনি কোনো আগ্রহ প্রকাশ করলেন না। তাই তোমায় বললাম। যা করছো তা ভালো নয়। কোনো ঝগড়া নেই কিছু নেই অথচ একটা বিশাল দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এই দূরত্ব বাড়তে দিও না। সম্পর্কের মধ্যে একটা প্রাচীর দাঁড়িয়ে গেছে। পারলে প্রাচীরটা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দাও। তাতে সবাই ভালো থাকবে।’ না, সবুজ তাও কোনো জবাব দিল না। শুধু চোখাচোখি হতেই হেসে ফেললো। বৌদিমণি মোটেও খুশি হলেন না। এত কথা বলল অথচ সবুজ একটাও কথা বলল না। খাবার শেষ হওয়ার পর সবুজ বাইরে বেরিয়ে এলো। বারবার বউদিমণির কথায় মাথায় আঁচড় কাটলো। সে কি ভুল কিছু বলেছে? মনে হয় না ভুল কিছু বলেছে বলে। বন্ধুদের সাথে এবং তাদের পরিবারের সাথে খুব ভালো ভাবে মিশতে পারে। কথার ফুলঝুরি ঝরে পড়ে। মুখ বন্ধ করতে চায় না। অথচ ঘরের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। পরিবারের প্রসঙ্গ উঠলেই তার মধ্যে কেমন ভয় কাজ করে। ভীতু হয়ে ওঠে। ভাবলেশহীন হয়ে যায়। কিন্তু কেন? এর উত্তর সবুজের জানা নেই।
বেশ অনেকগুলো মাস হলো সংকেত আর তৃধার দেখা হয় না। সংকেত ট্রেনিং এ ব্যস্ত ছিল। এখন চাকরি পেয়ে গেছে। মুর্শিদাবাদে সিংহ পুর থানার কনস্টেবল হিসেবে কাজ করে। চাকরি পাওয়ার পর একটু হালকা হয়েছে। অবসর সময়ের পরিমাণ কিছুটা হলেও বেড়েছে। তবে মনে শান্তি নেই। সে অনুভব করতে পারে, তৃধাকে খুব ভালোবাসে। তাকে মন থেকে পেতে চায়। লাজুকতার জন্য কিছু বলতে পারে না। কথা বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বলে না। যদি বারবার ফোন করলে রেগে যায় তৃধা। সব বুঝে গেলে সমস্যা আছে। যদি সে তাকে পছন্দ না করে? তাহলে কতটা খারাপ লাগবে? যদি আর কোনো দিন কথা না বলে? তখন যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে দিন অতিক্রম করতে হবে। আবার ভাবে,তৃধা কেন তাকে পছন্দ করবে না?সে বড় বাড়ির মেয়ে,তাই! কিন্তু এখন সে ও তো চাকরি পেয়েছে। সে একজন পুলিশ অফিসার। এতেও কি আপত্তি থাকবে? না,না,তৃধা এমন মেয়ে নয়। সে খুব ভালো। টাকা-পয়সা বাড়ি-গাড়ির সঙ্গে ভালোবাসার তুলনা করবে না। সে জানে ভালোবাসা হৃদয়ের বন্ধন। কিন্তু সে অন্য কাউকে পছন্দ করতে পারে। তার পছন্দকে সম্মান জানানো উচিত। এই ভেবে আর এগোতে চায় না সংকেত। এদিকে তৃধার মনেও একই বাসা বেঁধে আছে। কিন্তু মনের কথা বলতে পারে না।
অনেকদিন বাবাকে ছেড়ে বাইরে রয়েছে সংকেত। কাজের সূত্রে আর আসা হয় না। মন বড্ড উতলা হয়ে পড়েছিল। তাই কয়েকদিনের জন্য ছুটি নিয়ে বাড়িতে চলে এলো। আর বাড়িতে আসার পরেই বাবার মুখে দুঃখের সংবাদ শুনতে বেশি দেরী হলো না। তৃধার বিয়ের জন্য পাত্র দেখা চলছে। চমকে উঠল। মুহুর্তের মধ্যে সারা শরীর ঝড়ের মতো কেঁপে উঠলো। তৃধার সত্যি সত্যি বিয়ে হয়ে যাবে? পারবে তো তাকে ছাড়া থাকতে? খুব কষ্ট হবে। ছোটোবেলা থেকে মা নেই। নারীরা আসলে কেমন হয় এই বিষয়ে তার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তৃধাকে প্রথম থেকেই দেখে আসছে। তার ছোট ছোট দুষ্টুমি পাগলামো শাসন গুলো আঁকড়ে ধরে ছিল। এগুলো হারাতে চায় না সংকেত। একটু একটু করে তার মনে দাগ কাটে। সে-ই মেয়েটা দূরে চলে যাবে, কল্পনাও করতে পারছে না। কি করবে সে? কি করা-ই-বা আছে? বড্ড মুষড়ে পড়লো। হতাশ হলো। তার এই খারাপ লাগাটা কিছু সময়ের পর দূর হলো। তৃধা জানতে পেরেছে সংকেত বাড়ি ফিরেছে। ফোন করে বিকালে দেখা করতে বলল। সংকেত কৌতুহলী হয়ে পড়ল। তৃধা নিশ্চয়ই তাকে পছন্দ করে। না হলে তার খোঁজ নেবে কেন? তার তো এখন আসার কথা ছিল না। যদি তৃধা নিজের মনের কথা না বলতে পারে তাহলে সে অবশ্যই বলবে। তাকে পারতেই হবে।
বন্ধুদের নিয়ে বিকালে রওনা হলো সমুদ্রের পাড়ে। তারা সারাটা রাস্তা তার সঙ্গে কৌতুক করে চলল। প্রেমের বিষয়। সব যেন ঠিকঠাক হয়। সংকেত প্রথমে বলেছিল, সে বলতে না পারলে সূর্যময় যেন তার হয়ে সবকিছু বলে দেয়। কিন্তু সূর্যময় রাজি হয়নি। নিজের মনের কথা নিজেকে বলতে হয়। অন্য কেউ বলে দিলে তার গ্রহণযোগ্যতা খুব নগণ্য। তাতে বিপরীত মানুষটি আরও বেশি কষ্ট পায়। দূরে সরে যায়। সূর্যময় এ কাজ কখনো করতে পারবে না। বন্ধুর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়। নিজের অনুভূতি নিজেই ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারবে। সেখানে পৌঁছে দু-একটা কথা বলে কথায় কথায় সরে পরল সূর্যময় আর সবুজ। তাদেরকে কিছুক্ষণ একা থাকতে দেওয়া উচিত। প্রথমে তারা আসতেই চাইছিল না। সংকেত জোর করে নিয়ে এসেছে। তারও একা আসতে মন সায় দিচ্ছিলো না। তারা দুজন কথায় কথায় তৃধাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে কেটে পড়ল। তাদের মূল উদ্দেশ্য, তৃধা আর সংকেতকে কিছুটা সময় একা থাকতে দেওয়া। তৃধা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো একটা উঁচু বেঞ্চের উপর গিয়ে বসলো। পেছনে পেছনে সংকেতও গেল। পাশে বসলো। কোনো কথা বলল না। চোখে চোখ পড়তেই চোখ ফিরিয়ে নিল। তৃধা বড্ড চঞ্চলা মেয়ে। প্রচুর কথা বলে। মনে যা আসে তাই বলে দেয়। কোনো কিছু মুখে আটকায় না। তবে প্রেম সম্পর্কে বড্ড লাজুক। কিছুতেই মনের কথা বলতে পারে না। না হলে এই চঞ্চলা যুবতী এতদিন নিজের মনের কথা লুকিয়ে রাখতো না। সংকেত কে কিছু বলতে না দেখে সে একটু উদাসীনভাবে বলল,’তারা কখন ফিরবে?’ সংকেত ফিরে তাকালো।
‘সমুদ্রের ধারে গেছে। বেশি সময় লাগবে না ফিরে আসতে।’
‘তুমি গেলে না কেন?’
‘সদ্য বাড়ি এসেছি। ক্লান্ত লাগছে।’
‘আমি তো তোমায় একা আসতে বলেছিলাম, তাই না!’
‘তারা সঙ্গে আসতে তোমার অসুবিধা হলো বুঝি!’
‘অসুবিধা হবে কেন? শুধু জানতে চাইলাম।’
‘একা আসতে মন সায় দিচ্ছিলো না, তাই…।’
তৃধা তার মুখের পানে তাকিয়ে রইল। সংকেত লজ্জায় পড়ে গেল। বুক ধুকপুক করছে। এমন অনুভূতি কখনো হয়নি। তার চোখে মায়ায় ভরা। এমন মায়া ছেড়ে বেরানো সম্ভব নয়। এই সমীকরণ বোঝা অসম্ভব। এই অনুভূতি পরবর্তী সময়ে যেন ভয় হয়ে উঠল। তৃধাকে ভয় পেলো। অজানা ভয়ের কারণ জানে না। চুপসে গেল। তৃধা মৃদু কণ্ঠে বলল,’কিছু বলবে না?’ মুখ তুলে তৃধাকে দেখলো।
‘তুমি তো আমাকে ডাকলে। তুমিই বলো।’
‘আমি তোমায় ডেকেছি মানে আমাকেই কথা বলতে হবে। তুমি বলতে পারো না?’
‘তেমনটা নয়।’
‘তেমনটা নয় তো কেমনটা?’
‘রেগে যাচ্ছ কেন?’
‘রাগ করছি না। স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছি। তোমার কাছে যদি রাগ মনে হয় আমার কিছু করার নেই।’
‘তোমার সঙ্গে ঝগড়া করতে কি আমাকে এখানে ডেকেছো?’
‘ওহ, এগুলো তোমার ঝগড়া লাগছে? তাহলে আমি চলে যাচ্ছি।’ তৃধা বেঞ্চ ছেড়ে উঠে পড়লো। সত্যি সত্যি চলে যাবে না তো? কোমল স্বরে বলল,’আরে বসো। এত রাগ করো কেনো?’ তৃধা তার দিকে তাকালো। তার কোমল মুখমণ্ডলে শিশুসুলভ হাসি দেখে রাগটা উধাও হয়ে গেল। চুপ করে আবার বসে পড়ল। খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। এই ছেলেটা এত উদাসীন কেন? কেন বুঝতে পারছে না তার মনের কথা? রাগটা তো আসলে রাগ নয়। ওটা অভিমান। কেন ধরতে পারছে না? কে তার ভালোবাসাটা ধরতে পারছে না? আজকে যদি দুজনের মধ্যে কেউ একজন মনের কথা না বলে তাহলে হয়তো সারা জীবনের জন্য আলাদা হয়ে যেতে হবে। তৃধা চায় না আলাদা হয়ে যেতে।তাকে ছাড়া জীবন অতিক্রম অনেক কষ্টকর হয়ে উঠবে। মনের কথাও কিছুতে বলতে পারছে না। কিছু সময় পর কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,’জানো, আমার জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে। সবকিছু ঠিক থাকলে সামনে মাসে হয়তো আমার বিয়ে হয়ে যাবে।’ পাখনাহীন চোখে তাকিয়ে রইলো সংকেত। চোখের পলক বারবার পড়তে রইল। মুখের শব্দ মুখে রয়ে গেল। কিছু বলে উঠতে পারল না। অনুভূতিগুলো কিছুতেই প্রকাশ করতে পারছে না। চোখের জল জমেছে কিন্তু গড়িয়ে পরল না। কিছু বলতে না দেখে তৃধা বলল,’কিছু বল?’
‘কি বলবো?’
‘কিছু বলার নেই তোমার?’ সংকেত জবাব দিল না। মুখ নিচু করে ফেলল। তৃধা উঠে দাঁড়ালো। মায়া ভরা কন্ঠে বলল,’জীবনে সব অনুভূতি লুকিয়ে রাখতে নেই। কিছু অনুভূতি প্রকাশ করতে হয়। না হলে সারা জীবন একটা আক্ষেপ বয়ে বেড়াতে হয়। মনে হচ্ছে তুমি আক্ষেপ বয়ে বেড়ানোর জন্য প্রস্তুত। আমার আর কিছু বলার নেই। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। আমি চললাম। তুমি বন্ধুদের সাথে সাবধানে বাড়ি যেও।’ তৃধা একটিবারও সংকেতের দিকে আর ঘুরে তাকালো না। বন্দুকের নল থেকে বেরিয়ে আসা গুলির মত দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। ওই স্থানে বসে রইল সংকেত। নিঝুম চোখে তৃধাকে দেখে গেল। একটু একটু করে চোখের সামনে মলিন হয়ে গেল। হু হু করে চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসলো। তবুও তৃধাকে আটকালো না।
পর্ব ১৪ আসছে।।