#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড),১৯,২০
#মম_সাহা
পর্বঃ উনিশ
-‘জানিস তিস্তা, বকুল ফুলের মতন ঘ্রাণ আসতেছিলো ঐ শহুরে বউ এর শরীর থেকে। এত দারুণ ঘ্রাণ আমি এর আগে কখনো,কোথাও পাই নি। কী সুন্দর তারে দেখতে। এমন মেয়ে পুরো গ্রামে খুঁজে পাবি না। এ জন্য ই বুঝি মাস্টারমশাই ভুলে গেলো গ্রামের তিস্তাকে?’
নিজের বান্ধবী বকুলের কথায় তিস্তার হৃদয় কোণে রক্তক্ষরণ হলো। সেই সকালে মাস্টারমশাই এসেছে কিন্তু তিস্তা ঘর থেকে বের হয় নি এ অব্দি। না গিয়েছে মাস্টারমশাই এর কাছে ছুটে। হাত পা সব যেনো বাঁধা পড়ছে অদৃশ্য শিকলে।
এখন তেজস্বী দুপুর পরিবেশে। মাস্টারমশাই এর খবর নিয়ে বকুলই এসেছে তিস্তার কাছে। গ্রামে তো যেনো উৎসব লেগেছে। সবার শখের মাস্টারমশাই এর শহুরে বউ এসেছে,সেটা কী কম আনন্দের?
তিস্তা কিয়ৎপরিমাণ সময় মৌন থেকে বিধ্বস্ত কণ্ঠে বললো,
-‘বউ বুঝি অনেক সুন্দর? তোর সাথে কথা বলেছে? গম্ভীর হবে শহরের মেয়ে,তাই না?’
-‘না,না। তার আচরণ যেনো মাখনের মতন। সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলছে। কোনো অহংকার নেই। আমার সাথেও কথা বলেছে।’
তিস্তা বকুলের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকালো। তার বেহায়া মন যে বার বার ছুটে যেতে চাচ্ছে মাস্টারমশাই’র কাছে। কিন্তু নারীর শরীরের আত্মমর্যাদা যেতে দিচ্ছে না তিস্তার কিশোরী শরীরটাকে। নারীর যদি আত্মসম্মানই না থাকে,তবে সে পথের ধূলো হয়ে কেবল পদতলে গড়াগড়ি খাবে।
বকুল কিছুক্ষণ বান্ধবীকে বুঝিয়ে বাড়ির পথে রওনা হলো। তাকেও তো আজ দেখতে আসবে ছেলের বাড়ির লোক। কারো প্রিয় মানুষ হারাচ্ছে,কারো বা স্বপ্ন। ব্যাথা তো কোনোটাতেই কম না। তবে,কাকে দেখাবে সে ব্যাথা? হারানো জিনিস কী আর ফেরানো যায়?
____
‘তিস্তা তো চরিত্র হারাইছে। গ্রামের লোক তো তার নাম কলঙ্কিনী রাখছে।’
পাশের বাড়ির চাচীর এমন কথা শুনে সামান্য থমকে গেলো প্লাবন।
আশালতা ব্যাগ থেকে জামাকাপড় গুছোচ্ছিলেন। কথাটা শুনে তিনি অবাক হলেন।অবাক নয়নে ছেলের দিকে তাকালেন।
প্লাবন কেবল ভ্রু কুঁচকালো। সেও হালকা ভাবে কথাটা শুনেছে। তবে কথাটা কতটা ঠিক? অবাক নয়নে মায়ের দিকে তাকায়। মাও তো শুনেছে একই কথা। তবে কী বড় কোনো বিপদ হয়েছে তিস্তার? আসছে পর থেকে এ অব্দি মেয়েটাকে দেখে নি। অন্যান্য বার দু একদিনের জন্য সদরে গেলেই মেয়েটা স্টেশনে অপেক্ষা করতো,তবে আজ কেনো ঘরের দ্বার অব্দি এলো না?
তবে কী মেয়েটা ভুলে গেছে অভ্যাস গুলো? নাকি বদলে গেছে?
প্লাবনকে চুপ থাকতে দেখে আশালতা জানার আগ্রহ প্রকাশ করার সুযোগ পেলো। হাতের জামাকাপড় আলনা’র মাঝে রেখে বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
-‘আহা,তারপর মেয়েটার কী হলো!’
আশালতার প্রশ্নে চাচীও যেনো মজার কিছু বলার সুযোগ পেলো। তাই রসিয়ে রসিয়ে বললো,
-‘পাঁচদিন ধরে ওরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। ওর সাথে আরেকটা মেয়েও উধাও হয়েছিলো গ্রাম থেইক্যা। ঐ যে গ্রামের শেষ মাথায় বাড়িটা আছে না? তাদের বাড়ির মাইয়া। ওরে পরেরদিনই পরিত্যক্ত ক্ষেতের মাঝখানে পাইছিলো মরা অবস্থায়। কিন্তু তিস্তারে পাওয়া যায় নাই। পরে পাঁচদিন পর সোহাগ গো কাছারি বাড়ির বাগানে পাওয়া গেছিলো। কী অবস্থা আছিলো তখন মাইয়াটার। এর আগে ওর বাপের সাইকেলটা খাদে পইড়া পা ভাইঙা গেছিলো। মাইয়াটা তখন দোকানে বসা শুরু করছিলো। মাইয়া মানুষ হইলো গিয়া মিষ্টি,তাগোরে ঢাইকা রাখা লাগে। ভরা বজারে খোলা মিষ্টি দেখলে বেডাগো তো নজর যাইবো’ই। লোভ লাগবোই। এক হিসাবে নিজের ইচ্ছায় নষ্ট হইছে।’
-‘কেনো? মেয়ে হয়ে সংসারের হাল ধরতে চাওয়াটাই কী ভুল ছিলো, খালা? মেয়েটার বাবা অসুস্থ হওয়ার পর নিশ্চয় বাধ্য হয়েই বাজারে বসতে হয়েছিল মেয়েটাকে, তাই না? কেউ কী যেচে লোভের স্বীকার হতে চায় খালা?’
ভীষণ গম্ভীর কণ্ঠে সামান্য ভড়কে গেলো মহিলাটা। এমা, এ যে মাস্টারমশাই এর নতুন বউ।
প্লাবন পুরো থম মেরে গেছে। তার ছোট্ট মানবীর উপর এত কিছু বয়ে গেছে? সে টেরও পায় নি? গত আড়াইটা বছর যে মেয়েটাকে আগলে রেখেছিলো,তার একমাসেই এত বিধ্বস্ত অবস্থা! মহিলার কথার ধাঁচে তো খুব ভালো করেই বোঝা যাচ্ছে গ্রামের মানুষের প্রতিক্রিয়া। মেয়েটা একটুও ভালো নেই তবে!
চাচী তখন ভড়কে যাওয়া কণ্ঠে আমতা-আমতা করে বিষাদিনী’র উদ্দেশ্যে বললো,
-‘আরে না,না নতুন বউ। তুমি আমারে ভুল বুজছো। কিন্তু তুমিই ভাইবা দেখো,মাইয়া হইয়া কী বেডা গো ভীড়ে যাওয়া উচিত ছিলো?’
বিষাদিনী তার সদ্য ধুয়ে আসা মুখটা মুছতে মুছতে বললো,
-‘মানলাম, সে বাজারে বসাতেই তার সাথে এমন হয়েছে। আপনাদের ভাষায় তার বাজারে বসা কাজ টা অনুচিত ছিলো। আচ্ছা, সে যদি বাজারে না বসতো তবে তার ঘরের রেশন কী আপনারা দিতেন?’
যে উদ্যম ইচ্ছে নিয়ে কথা শুরু করেছিলো মহিলা, সে উদ্যমতা আর নেই চাচীর ভেতরে। শহরে মেয়ের সাথে কথা বলে পারবে না। আজকালকার মেয়েছেলে তর্ক করতে পারলেই যেনো জিতে যায়। এরা কী আর ভালো মন্দ বুঝে!
প্লাবন উঠে দাঁড়ালো। নাহ্,এখন এখানে বসে থাকাটা বোকামি। এমনেতেই অনেক কিছু বোধহয় হারিয়ে ফেলেছে। এখন যতটুকু আছে তা-ই আগলে ধরতে হবে।
প্লাবনকে হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতে দেখে, পিলে চমকে উঠে আশলতার। উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে বলে,
-‘কই যাও আব্বা? কই যাও?’
ভুল সময়ে, মায়ের এমন অবুঝ প্রশ্ন শুনে অবাক হয় প্লাবন। সাথে মাথায় ভোঁতা রাগে অনুভূতি গুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। মা-ই তো তাকে কত নাটক করে ঐ শহরে আটকে রেখেছিলো। নাহয় এত বড় ক্ষতি আদৌও হতো! ছোট্টো মেয়েটার উপর দিয়ে এত ঝড় বইতো?
প্লাবন মায়ের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না। গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলো। আশলতার ক্ষাণিকটা মনোক্ষুণ্ণ হলো। ছেলেটা তার এমন ছিলো না। যেদিন থেকে তিস্তা নামক মেয়েটার সাথে দেখা, সেদিন থেকেই ছেলেটা বদলে যায়। তাই তো মেয়েটাকে দু’চোখে সহ্য হয় না তার।
বিষাদিনী আশালতার মনোভাব বুঝে। শীতল কণ্ঠে, স্বান্তনার স্বরে বলে,
-‘ফুপিমণি, এত উত্তেজিত হচ্ছেন যে? প্লাবন দা কী ছোট্ট মানুষ? সে যা করবে বুঝেশুনেই করবে।’
আশালতার ভয় হয়। ছেলেটা যা তিস্তা ভক্ত,নষ্ট মেয়েকেই না আবার দুর্বলতা দেখিয়ে ফেলে। ভয়ে মায়ের প্রাণ আতঙ্কিত হয়। আকুতি ভরা কণ্ঠে, সামনের মেয়েটার উদ্দেশ্যে বললো,
-‘তুমি আমার ছেলেটাকে একটু বেঁধে রেখো,মা।’
-‘আপনার ছেলে কী বাঁধন মানবে,ফুপিমণি? আর না, আমি কারো জীবনে শিকল হয়ে থাকি। একটু ধৈর্য্য ধরুন। ভালো কিছু হবে।’
আশালতা খাটের এক কোণে বসে পড়ে। বিষাদিনী মেয়েটা এত ছন্নছাড়া কেনো? একজন নারী’ই তো পারে একজন পুরুষকে বাঁধতে। তবে,মেয়েটার এত অনীহা কেনো বাঁধনে?
বিষাদিনী তার জন্য বরাদ্দ করা রুমটাই চলে গেলো। জানালার রঙ উঠে যাওয়া লোহার শিকে মাথা ঠেকিয়ে বসে থাকে। জানালার বাহিরের জায়গাটায় একটু গাছপালা বেশি। শুকনো পাতা জানালার বরাবর পুকুরটাতে ভাসছে। পুকুরের পানি গুলো ভীষণ চকচক করছে মধ্যাহ্নের সূর্যের তাপে। বিষাদিনী বেশ আকর্ষণ অনুভব করে সেই দৃশ্য দেখে। আজকাল তার বিষন্নতা বোধ হয় না। তার আজকাল ভবঘুরে হতে ইচ্ছে হয়। বাঁধন তো আর সবার জন্য না। বিষাদিনীর মনে ভাবনার উদয় হয়। মূর্ছে যাওয়া হৃদয়টা ছন্দ পাতে, “কেউ কেউ উড়ে গেলে,কেউ কেউ মুক্তি পায়।”
পরক্ষণেই মনে হলো, বাহ্ দারুণ তো! মোটা কালির দোয়াত নিয়ে সাদা চকচকে কাগজে লিখে ফেলে ছন্দখানা। সাথে মিশিয়ে দেয় বিষাদ। বিষাদিনী হয়ে,বিষাদ লেপন করবে না, তা কী হয়? ছন্দখানা জ্বলজ্বল করছে। দারুণ হাতের লেখা দিয়ে বিষাদিনী লিখে ফেলে ব্যাথাময় কয়েকটা শব্দ,
“শিকল আমি নাহি হলাম,না-ই বা কাটলাম তার ডানা,
আমি পাখি রঙহীন বলে, রঙিন পাখির কী উড়তে মানা!”
কবিতাটার দু লাইন লিখে কাগজটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় ঝড়া পাতার মাঝখানে। কেউ জানবে না,সে যে মানুষকে উড়তে দিতে চায়। কেউ না জানুক, শক্ত খোলশের আড়ালে কোমলতা। জেনে গেলেই তো জ্বালিয়ে যাবে।
_
আজ আকাশে চাঁদ নেই। ভীষণ আঁধার চারপাশে। সারাদিন ঘর থেকে বের হয়নি তিস্তা। মাস্টারমশাই দেখা করতে এসেছিলো কিন্তু সে বের হয় নি। মাস্টারমশাই তো তার মানুষ না এখন। মাস্টারমশাই হলো পর মানুষ। পর মানুষের প্রতি মায়া বাড়িয়ে কী লাভ? শূণ্য’ই যার ফলাফল।
হঠাৎ জানালার পাশে খুব ধীরে শব্দ হলো। তিস্তা সামান্য চমকে গেলো। সে উবুড় হয়ে শুয়েছিলো এতক্ষণ। তার পায়ের দিকে দক্ষিণ বরাবর জানলা দিয়ে শব্দটা হলো। তিস্তা সামান্য ভয় পেয়ে গেলো। চমকে উঠে জানলার দিকে তাকাতেই দেখলো বাক্সবন্দি সুখ।
একটা দারুণ রাজকীয় বয়ামে ভরা জোনাকি পোঁকা। তিস্তার কলিজাটা সামান্য ছলাৎ করে উঠে। পুরোনো সুখ নতুন করে,নতুন রূপে তার জানালায়!
#চলবে
#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড)
#মম_সাহা
পর্বঃ বিশ
মধুসখী এখন জলে পরিপূর্ণ। একটু আগে চাঁদ ছিলো না গগণে কিন্তু এখন যেনো ভরা পূর্ণিমা। চাঁদের যেনো যৌবন উপচে পড়ছে। পরিবেশেও এখন একটা মুগ্ধতা কাজ করছে। এতদিন পর একটু দেখতে পাওয়ার তৃষ্ণায় আচ্ছাদিত মানব মানবী যে আজ মুখোমুখি। এতদিন পর তৃষ্ণার সমাপ্তিতে প্রকৃতি মাঝেও যেনো আনন্দের ঢেউ।
মধুসখী’র ঘাটে বসে আছে তিস্তা। তার সাথেই কিছুটা দূরে বসে আছে মাস্টারমশাই। দু’জনই চুপচাপ।
কত আকুতি মিনতি করে অবশেষে তিস্তাকে এ ঘাট অব্দি এনেছে প্লাবন। আর নয় দূরত্ব। এত কাছে থেকেও সে দূরত্ব মানবে না।
তিস্তা হাঁটুর উপর মাথা রেখে জলের দিকে তাকিয়ে আছে। তাকায় নি মাস্টারমশাই এর দিকে। সে কঠিন হতে চাচ্ছে। যতটা কঠিন হলে মাস্টারমশাই এর থেকে মুখ ফেরানো যায়, ঠিক ততটা কঠিন।
মুখ নাহয় ফেরানো যায় কিন্তু হৃদয়? হৃদয় কী আদৌও ফেরানো সম্ভব? সম্ভব না বলেই তো এত রাতে এ মানুষটার সাথে চলে এসেছে এত দূর। হৃদয় তো চায় মানুষটার সান্নিধ্য। বোঁকা হৃদয় কী আর কাঠিন্যতা বোঝে?
নিরবতা ভাঙলো প্লাবন। ক্ষীণ স্বরে ডেকে উঠলো,
-‘তিস্তা?’
তিস্তার শরীরের ভিতর হিমশীতল স্রোত বয়ে গেলো। এইতো,তার ভিতর রাজ্যের প্রশান্তি। এতদিনের দহন যেনো এক নিমিষেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। তিস্তা মনে মনে আওড়ালো “ভালোবাসা সুন্দর”।
তিস্তার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে প্লাবন এগিয়ে এলো। তিস্তার হাতটা বিনা সংকোচে নিজের হাতের ভাজে নিয়ে বেশ আদুরে স্বরে বললো,
-‘মান করেছিস নাকি রাগ?’
তিস্তার মন আহ্লাদ পেয়ে যায় কিন্তু তিস্তা তাদের আহ্লাদের মূল্য দেয় না। নিজের বা’হাতটা টান দিয়ে ছড়িয়ে নেয় মাস্টারমশাই’র হাত থেকে। কয়েকটা অমলিন শব্দ উচ্চারণ করে বলে,
-‘আমি নষ্ট মেয়ে মানুষ। পাপ লেগে যাবে।’
কয়েকটা শব্দ গুচ্ছ ক্ষতবিক্ষত করে প্লাবনকে। সবসময় কী ছুরি লাগে আঘাত করতে? বাক্যের আঘাত যে কী ভয়ঙ্কর। ছুরিও মাথা নত করবে নির্দ্বিধায়।
আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্লাবন করুণ স্বরে বললো,
-‘চাঁদের কী কলঙ্ক লাগে! যতই লোকে তারে কলঙ্কিনী বলে? তুই তো আমার চাঁদ।’
-‘আচ্ছা? তা এ আকাশে তো দুটি চাঁদ উঠে না, তবে মাস্টারমশাই এর হৃদয় মাঝে দুই চাঁদের আনাগোনা যে?’
আবার,আবার মেয়েটা তাকে ক্ষত-বিক্ষত করলো। বড্ড বড় হয়ে গেলো নাকি সে? আজকাল কথা বলতেও ভাবে না যে? নাকি হৃদয়ের কোমলতা জমে পাথর হয়ে গেছে?
নিজেকে ধাতস্থ করে প্লাবন। তিস্তার হাত’টা আবারও টেনে নিতে চায়। কিন্তু তিস্তা হাত’টা দ্বিগুণ শক্ত রেখে বললো,
-‘যখন এই হাতটার আপনাকে প্রয়োজন ছিলো,তখন তো ছিলেন না। তবে আজ কেনো? আজ তো তার কিছুই নেই। সব হারিয়েছে সে। তবে আজ কেনো তাকে ধরতে আসছেন? শূণ্যতা ধরে লাভ নেই। এর চেয়ে নতুনে যেমন মত্ত হয়েছেন,সেখানেই তেমন থাকুন।’
প্লাবনের এবার রাগ হলো। মেয়েটা তাকে কথা’ই বলতে দিচ্ছে না। একেক টা জবাব দিয়ে তাকে চুপ করিয়ে দিচ্ছে।
প্লাবন এবার জোর করে আঁকড়ে ধরলো তিস্তার হাত। শক্ত কণ্ঠে বললো,
-‘চড় চিনিস? ভালো ব্যবহার করছি তাই ভালো লাগে না, তাই না? আমি কী ইচ্ছে করে হাতটা ছেড়ে ছিলাম? নিত্যান্তই বাধ্য হয়ে তোকে ছেড়ে দূরে যেতে হয়েছে। আবার তোর টানে ফিরে এসেছি তো আমি। আসি নি? শুধু তোর জন্যই তো আমার এ বেহাল দশা। তোর বিরহে প্রতি নিয়ত মরছিলাম। বুজেছিলি সেসব তুই? নিজের অভিমান, অভিযোগ আমার উপর ছেড়ে দে। কিন্তু একদম তিক্ততা দিবি না। মে’রে ফেলবো। একদম মে’রে ফেলবো। বেশি বড় হয়েছিস?’
-‘ম’রেই তো গেছি। আর কী মা’রবেন? মৃত আত্মা নিয়ে তবুও তো ছিলাম আপনার অপেক্ষায়। কিন্তু আপনি, আপনি আমায় আরও দারুণ ভাবে মেরে ফেললেন। মুখ’ই যদি ফিরিয়ে নেওয়ার ছিলো,তবে অপেক্ষা করতে কেনো বলেছিলেন?’
প্লাবন কাল বিলম্ব না করে জড়িয়ে ধরলো তিস্তাকে। মধুসখী সাক্ষী হলো দারুণ মুহূর্তের। নিরব চারপাশে হঠাৎ কান্নার শব্দ ভেসে এলো। তিস্তা কাঁদছে। এতদিনের অভিযোগ, অভিমান সব উজাড় করে দিয়ে বললো,
-‘কেনো শহুরে বউ নিয়ে এলেন এখানে? আমাকে মে’রে ফেলার জন্য তাই না? কেনো ছোট্ট কিশোরীর মনে এমন অনুভূতির সৃষ্টি করেছিলেন? শেষমেশ অনলে পুড়িয়ে মা’রার জন্য তাই না?’
তিস্তার মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে শান্ত স্বরে প্লাবন উচ্চারণ করলো ভয়ঙ্কর সুখকর বাক্য,
-‘বিয়েটা হয় নি। তুই ছাড়া এই প্লাবনের সাথে আর কাউকে মানায় বল?’
তিস্তা যেনো ভুল কিছু শুনে ফেলেছে বোধ করলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
-‘ওরা যে বললো,শহুরে বউ এসেছে। তবে?’
প্লাবন তিস্তার কেঁদে ঢোল হওয়া চোখ মুখ মুছিয়ে দিয়ে বললো,
-‘ওরা না বুঝেই তো লাফিয়েছে। আর,বাকিটা আমার মায়ের জন্য বোঝাতে পারি নি। বিয়েটা হবে হবে করেও শেষ মুহূর্তে হয় নি।’
-‘কেনো?’
-‘বিষাদিনী, মানে যার সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো সে মেয়েটার জন্য। ও শেষ মুহূর্তে এসে বললো ও নাকি এখন বিয়েটা করবে না। আগে ও আমাদের গ্রামে আসবে তারপর এখানে এসে বিয়েটা করবে।’
তিস্তা প্রথম কথাটা অবাক হয়ে শুনলেও পরের কথাটাতে বিষন্নতা ভর করে। আজ হোক, কাল হোক,বিয়েটা তো হবেই।
আবারও অভিমান বাঁধে মানবী’র মনে। শক্ত কণ্ঠে বলে,
-‘ওহ্, তবে বিয়েটা একবারের জন্য বন্ধ হয় নি? বিয়েটা তবে শেষ পর্যন্ত হবে! আজ না হোক কাল,একদিন তো আপনার ঘরে বউ হয়ে ঐ মানুষটা আসবেই। তবে আর মায়া বাড়িয়ে কী লাভ!’
-‘বিয়েটা আর হবে না। একবার যেহেতু আমি তোর কাছ অব্দি এসেছি, বিয়েটা আর করছি না। তুই বিহীন আমি তো অসম্পূর্ণ।’
-‘কিন্তু আমিই যে এখন পঁচে গেছি। শুনেছেন তো। বড্ড দেরিতে এলেন যে।’
প্লাবনের ধৈর্যের সীমা আর বাঁধ মানলো না। মেয়েটাকে সত্যিই শাসন করা দরকার। তৎক্ষনাৎ চড় বসিয়ে দিলো তিস্তার গালে। রুক্ষ কণ্ঠে বললো,
-‘বেশি বুজতে শিখেছিস আজকাল? জিহ্বা টা টেনে ছিঁড়ে ফেলবো। অহেতুক কথা বলার জন্য এইটা থাকার প্রয়োজন নেই।’
তিস্তা এবার জড়িয়ে ধরলো মাস্টারমশাইকে। ভীষণ গভীর ভাবে আগলে নিলো প্রেম পায়রাকে। এইতো, মাস্টারমশাই তার। মাস্টারমশাই তো তার গায়ে কালী লেপন করে নি। তবে গ্রামের মানুষের কথায় কী আসে যায়?
_
বিষাদিনীও আজ চন্দ্র বিলাস করছে। জানালার লোহার মরচেপড়া শিকটা ধরে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে সাদাকালো ছবিটার দিকে। এইতো তার প্রাণের মানুষ। এইতো তার না হওয়া আপন মানুষ।
ছবিটাতে হাত বুলিয়ে যায় বিষাদিনী। কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, মুখভর্তি ঘন দাঁড়িওয়ালা সুপুরুষটির ভেতর কী যাদু আছে সে জানেনা। তবে,মানুষটির শূণ্যতা তাকে পোড়ায়। ভীষণ পোড়ায়। মানুষটি তো তার না। সৃষ্টিকর্তা যদি তার জন্য মানুষটাকে না-ই বানিয়েছিলেন তবে মানুষটার প্রতি মায়া জন্মাতে দিয়েছিলো কেনো?
সৃষ্টিকর্তার বুঝি দারুণ লাগে কাউকে পুড়তে দেখে?
বিষাদিনী খাতা নেয়। গোটা গোটা অক্ষরে লিখে,
“আপনি আমার ভীষন কাছে, সবটা হৃদয় জুড়ে,
ছুঁতে গেলে আপনি যেনো, আকাশ সমান দূরে।”
বরাবরের ন্যায় ছিঁড়ে ফেলে কাগজটা। ছুঁড়ে ফেলে শুকনো পাতার মাঝে। মানুষ জানবে না বিষাদিনীর আর্তনাদ। কেবল শুকনো পাতা গুলো জানবে, প্রেম বড় জ্বালাময়।
বিষাদিনী ছবি খানা জড়িয়ে ধরে বক্ষ মাঝে।
গভীর রাতে সবারই তো প্রিয় মানুষ সাথে আছে। শুধু তফাৎ একটায়। কারো সাথে কেবল স্মৃতি হয়ে, কারো কাছে বা রক্তমাংসের মানুষ হয়ে।
_
তিস্তা আর প্লাবনের নিরবতার মাঝে হঠাৎ ঝোঁপ থেকে শব্দ হয়। ভয় পেয়ে যায় তিস্তা। কেউ তাদের দেখে ফেলবে না তো?
প্লাবনও ক্ষানিকটা চমকে চায়। কত গুলো পায়ের শব্দ হয়। তিস্তা ছিটকে যায় প্লাবন থেকে। এই চাঁদনী রাত কী আবার ভয়ঙ্কর অমাবস্যা আনবে তার জীবনে?
মানুষ গুলোর পায়ের শব্দ আরও নিকটে শোনা যাচ্ছে সাথে তরতর করে ঘামছে তিস্তা। নতুন কালরাত্রি যোগ হবে কী তার জীবনে?
#চলবে