#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড),পর্বঃ বারো
#মম_সাহা
দুর্দান্ত কাঠ ফাঁটা রোদে বেশ নাজেহাল গ্রামের মানুষ। কী একটা ঋতু এলো! কখনো তুমুল বর্ষণ তো, কখনো কাঠফাটা রোদ্দুর। রোদের উত্তপ্ততা নিবিড় করতেই বোধহয় বর্ষণ আসে।
তনয়া বেগম তার ভীষণ ভেঙে যাওয়া শরীর খানা নিয়ে সদ্য গোসল করে এলো। আজ হাতে গণা পাঁচটা দিন মরে গেছে তাদের হাস্যোজ্বল বাড়ির আঙিনাটা। সুখের বীজ যে অচিরেই ঝড়ে গেছে।
আমান শেখ বাড়ির উঠোনের কিনারার চৌকিতে বসে আছেন। এখন ক্ষানিকটা নড়তে চড়তে পারেন। সবসময় সে কেবল নিজেকে দোষ দিয়ে যায়। না সে দুর্ঘটনার শিকার হতো, আর না তার আদরের মেয়ে এমন ভাবে হারিয়ে যেতো।
তনয়া উঠোনের মাঝামাঝি এসে দাঁড়াতেই তার বাড়িতে বকুলের মা হাজির হলো। বকুল তিস্তাদের সহপাঠী। গ্রামের দক্ষিণ দিকে তাদের বাড়ি।
বকুলের মায়ের শরীর দারুণ উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে। ভীষণ ঘামছে সে। হ্যাঁ, অতিরিক্ত গরমে ঘামাটা স্বাভাবিক কিন্তু তার এই ঘাম স্বাভাবিক না। অনাকাঙ্খিত কারণে।
তনয়া বেগম ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে এলেন। ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
-‘দিদি, ঘামছেন কেনো এভাবে! পানি খাবেন? পানি আনবো? আপনার শরীর কী খারাপ করছে?’
বকুলের মা তার নরম, পুরাতন সুতির কাপড়ের আঁচলটা দিয়ে মুখ মুছলেন। হাঁপাতে থাকা কণ্ঠে বললেন,
-‘আহ্লাদী’র মা তাড়াতাড়ি চলো,আমাদের তিস্তা পড়ে আছে সোহাগদের কাছারি বাড়ির বাগানে। তাড়াতাড়ি চলো।’
তিস্তা’র বড় বোনের নাম আহ্লাদী। সেই সুবাধে গ্রামের বেশিরভাগ মহিলা তনয়া’কে আহ্লাদীর মা বলে।
তনয়া বেগমের মস্তিষ্কে কথাটা পৌঁছাতেই হঠাৎ শরীরটা কেঁপে উঠলো। অনাকাঙ্খিত কিছু হয়েছে ভেবেই ঝড় উঠলো হৃদয় বাগিচায়। এতদিনের ভীষণ ঝড়টা যে এখন প্রলয়ঙ্কারী রূপ নিবে তা আর বুঝতে বাকি নেই। তিস্তা তবে দীর্ঘ পাঁচদিন পর ফিরেছে? আচ্ছা,মেয়েটা বেঁচে আছে তো!
তনয়া বেগম নড়লেন না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলেন। ততক্ষণে লতিকা বেগম ঘর থেকে হৈ হৈ করে ছুটে আসলেন। আহাজারি করতে করতে বললেন,
-‘আমার চোখের মণি ফিরছে! বাঁইচ্চা আছে তো? নাকি জানটাও খাইয়া ফেলছে জা’নোয়ার দের দলেরা?’
আমান শেখ টলতে টলতে পায়ে উঠার চেষ্ঠা করতে করতে আৎকে উঠে বললেন,
-‘অমন কথা বলবেন না, আম্মা। আমার মেয়ে তো অনেকদিন থাকবে আমাদের মাঝে। এত তাড়াতাড়ি কই যাবে?’
আর কথা বলতে পারলেন না আমান শেখ। দীর্ঘ ব্যাথাময় পা জোড়া তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দিলো না। মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো সে মাটিতে।
তনয়া বেগম,বকুলের মা,লতিকা বেগম ছুটে গেলেন আমান শেখের কাছে। তনয়া বেগম শক্ত হাতে স্বামীকে ধরে উঠে বসালেন। লতিকা বেগম তার বৃদ্ধ, কম্পমান পা নিয়ে এগিয়ে গেলেন রান্নাঘরে। মাটির কলসি থেকে একটু পানি ঢেলে ছুটে আসলেন ছেলের দিকে। এ বয়সে এত চাপ তার দেহখানা যে নিতে চাচ্ছে না আর!
বকুলের মা হাতপাখা টা দিয়ে দীর্ঘক্ষণ বাতাস করলো আমান শেখ’কে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতেই আমান শেখ ব্যাথিত কণ্ঠে বললো,
-‘আমি হতভাগা বাবা। নিজের মেয়েকে না রক্ষা করতে পারলাম,আর না আগলে রাখতে। তনয়া তুমি তাড়াতাড়ি যাও। আমার মেয়েটা তোমার অপেক্ষায় আছে। তাড়াতাড়ি যাও। ও কতদিন একা ছিলো আমাদের ছাড়া। যাও তাড়াতাড়ি।’
তনয়া বেগম স্বামীর মুখের লেপ্টে থাকা মাটিটুকু মুছে দিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বললো,
-‘আপনি এসব বলবেন না। তিস্তা’কে আমি নিয়ে আসছি। আপনি আর আম্মা থাকুন।’
লতিকা বেগম যেতে চেয়েও ছেলের কথা ভেবে আর গেলেন না। তনয়া বেগম শাড়ির আঁচলটা মাথায় জড়িয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ছুটে গেলেন। সে কাঁদে নি,ভেঙে পড়ে নি। পাহাড়ের মতন অটল রয়েছে। পাহাড়’কে নোয়ানো’র সাধ্য তো কারো নেই। এমনকি হয়তো তিস্তার ভয়ঙ্কর পরিণতিরও নেই।
___
মাথার উপর শব্দহীন, নির্লিপ্ত বাতাস দেওয়া যন্ত্র চলছে। রাজকীয় কার্পেটের মেঝেতে বাসন্তী রাঙা শাড়ি পড়ে ভেজা চুল গুলো মুছতে ব্যস্ত এক রমনী। সদ্য স্নান করে এসেছে। মুখমন্ডলে রাজ্যের স্নিগ্ধতা জড়ানো জেনো।
রমনী’র চুল মুছাতে বিঘ্ন ঘটিয়ে রুক্ষ পায়ে ঘরে হাজির হলো কেউ। কণ্ঠে রাজ্যের বিরক্ত ঢেলে মানবটা কঠিণ স্বরে বললো,
-‘বিষাদীনি, বিয়েটা আটকাবেন না? আমি আপনার কাছে রাজ্যের অসহায়ত্ব নিয়ে হাজির হয়েছি। ঠুনকো দৃঢ়তার দোহায় দিয়ে কেনো ক্ষত বিক্ষত করছেন আমার কোমল প্রেমোমন্দির?’
রমনী হাসে। নিশ্চুপ হাসি। সেগুন কাঠের তৈরী বড় আরশিযুক্ত আলমারি খানার কাছ থেকে মোটা কাঠের চিরুনি খানা নিয়ে চালান করলো দীঘল কালো চুল গুলোতো। চুল গুলোর আঁধারের মতন ঘন আঁধার, নারী’র হৃদয়ের রহস্য ঘেরা ভাবমূর্তিটাও।
প্লাবন বিরক্ত হয়। অতিষ্টও বলা চলে। মা যখন কসম নামক নিচু কাজ দ্বারা চুপ করিয়ে দিলো তাকে, তখন থেকেই এ মেয়েটা’র পিছু পড়ে আছে সে। মা তো তাকে দিব্যি দিয়েছে বিয়েটা করার জন্য তাই সে “না” করতে পারছে না। কিন্তু, এই মেয়েটা তো চাইলেই বিয়েটা ভাঙতে পারে। তবে কেনো এত উদাসীনতা মেয়েটার মাঝে এ সামান্য ব্যাপারটুকু মানতে! বুঝে না সে।
প্লাবন অতিষ্ট হয়ে বলে,
-‘আপনি তো বেশ সুন্দরী বিষাদিনী। কলেজও পাশ করেছেন। বেশ রুচিশীল নারী। আমার চেয়ে হাজার গুণ সুন্দর পুরুষ আপনার জন্য অপেক্ষিত, তবে কেনো আমায় একটু দয়া করছেন না?’
রমনী চুল আঁচড়ানো’তে মনোযোগ দিয়ে বাঁকা হেসে বললো,
-‘প্লাবন দা,আপনি তো আমার ভীষণ বড়। তবে আমায় কেনো আপনি করে বলেন? তুমি করে বলা শুরু করেন। দুদিন পর নাহয় মানুষ লজ্জা দিবে বউকে আপনি বলার কারণে।’
প্লাবন এমন সময়ে এমন কথায় আশ্চর্যিত,হতবাক এবং হতভম্ব। তার আকুতি মিনতি মেয়েটার কান অব্দি পৌঁছালো না?
ভীষণ ঠান্ডা মেজাজের প্লাবন ক্ষ্যাপে উঠলো। অসন্তোষজনক স্বরে বললো,
-‘আপনি কী আমার কথা বুজছেন না বিষাদীনি? আমি বিয়েটা করতে পারবো না।’
-‘কিন্তু কেনো, প্লাবন’দা?’
-‘কারণ আমার উড়ন্ত, ছুটন্ত এক কিশোরী প্রণয়ীনি’কে আমি অপেক্ষা করতে বলে এসেছি। আমার জন্য হয়তো দোর ধরে অপেক্ষা করছে সে। ভীষণ অবহেলায় হয়তো পড়ে আছে তার দেহ খানা যত্ন বিহীন। তাকে আমি ফিরাই কেমন করে? এই সাদাসিধা মাস্টারমশাই এর জন্য যে সে দাঁড়িয়ে আছে মধুসখী’র কোল ঘেষে। আমায় যে ফিরতে হবে তার কাছে।’
-‘তবে,এটা আপনি কেনো আপনার মাকে জানাচ্ছেন না? ফুপিমণি’কে বলুন আপনার পিপাসাময় প্রণয়ের কথা। প্রেমে পড়েছেন অথচ তা সৎ সাহস দেখিয়ে বলতে পারবেন না, তবে কেমন প্রেমিক হলেন? প্রেমিক হওয়ার অনিবার্য শর্ত হলো তাকে সৎ সাহসের অধিকারী হতে হবে। যখন তখন তার প্রেমের কথা তাকে নির্বিঘ্নে ঘোষণা করতে হবে। প্রেমের পূর্ণতা চান অথচ একটু পরিশ্রম করবেন না?’
প্লাবন থমকে যায় একটু। সে কী কম পরিশ্রম করেছে? সে তো মাকে জানাতে চেয়েছিলো কিন্তু মা তার আগেই তার মুখ আটকে দিয়েছে। আর মা তো তিস্তা’কে পছন্দও করেনা। জানালে বিশেষ একটা লাভ হবে বলে মনে হয় না যে।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্লাবন। নিচু কণ্ঠে বললো,
-‘সব চেষ্টা করেই আপনার দ্বারে এসেছি। ফিরাবেন না। আমার চেয়ে ভালো কেউ আপনার জন্য সৃষ্টি হয়েছে। আমায় একটু সাহায্য করুন।’
-‘আমি জানি আপনার চেয়ে ভালো কেউ আমার জন্য অবশ্যই সৃষ্টি হয়েছে। আপনি তো কেমন ভোলা ভালা। আপনার সাথে সত্যিই আমার মানায় না। তবুও আমি বিয়েটা ভাঙবো না। আমার শীতল বাড়িটা ছেড়ে আমি আপনাকে বিয়ে করে গ্রামে যাবো। ভীষণ অপছন্দের মানুষখানার সাথে ঘর করবো। তবুও ছাড়বো না।’
প্লাবন বিরক্ত হয়। এ অব্দি মেয়েটাকে সে তিনবার দেখেছে। এর আগে দু’বার দেখেছিলো ক্ষানিক সময়ের জন্য। কিন্তু এবার দেখছে অনেক দিন যাবত। মেয়েটার গাম্ভীর্যতা দেখে সে হতবাক। মেয়েটার বয়স বেশি হলে বিশ বা একুশ হবে। কিন্তু কথাবার্তা ভীষণ বড় ভাব। অবশ্য এসময়ে মেয়েদের বয়স পনেরো পেরুনোর আগেই মেয়েরা বাপের বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে যায়। সে অনুযায়ী মেয়েটার এমন বড় হওয়া টা স্বাভাবিক। আর শিক্ষিতও সে।
প্লাবন আর কিছু বলেনি। বিষাদীনি’র বোনের কণ্ঠ ভেসে এলো। খাবারের ডাক পরেছে। প্রাবন অসহ্যের শ্বাস ফেলে রুষ্ট পায়ে বেরিয়ে গেলো।
প্লাবন বেরুতেই বিষাদিনী বিষাদমাখা হাসি হাসলো। চুল গুলো হাত খোঁপা করে খাটের নিচ থেকে লোহার বড় একটা বাক্স বের করলো। পুরোনো রাজকীয় তালাটা খুলতেই একটা লালসালু কাপড়ে মোড়ানো বাক্স বের হলো। বিষাদিনী লালসালু কাপড়টাতে কতক্ষণ যত্নে হাত বুলালো। তারপর বাক্সটা খুলতেই খুব আগের তোলা দু’খানা ছবি বের হলো।
রমনী ছবি গুলোর দিকে তাকিয়ে এক বিন্দু বিষাদময় অশ্রু ঝড়ালো। প্রথম ছবিতে থাকা মানুষটার কপালে চুম্বন এঁকে বললো,
-‘আপনি আমায় নিয়ে গেলেই পারতেন। আপনার শূণ্যতা সত্যিই আমায় বিষাদিনী বানিয়েছে। যত্ন করে নামটা বুঝি এজন্যই রেখেছিলেন?’
ক্রন্দনরত কন্যার প্রশ্নের উত্তর মেলে না। উত্তর মিলবেই বা কীভাবে? ছবি কখনো কথা বলে?
রমনী ভীষণ যত্নে দ্বিতীয় ছবিটা উঠিয়ে নেয় হাতের মাঝে। বুকের মাঝে কতক্ষণ আগলে রাখলো। এবার ডুকরে কেঁদে উঠে বললো,
-‘আপনারে আমি কত যত্ন করে হৃদয় মাঝে গড়েছিলাম আপনি জানেন? জানার আগেই তো মূর্ছে দিলেন আমার হৃদয় খানা। আমিও তো প্রেমে পড়ে ছিলাম। ধ্যান জ্ঞান দিয়ে ভালোবেসে ছিলাম। তার বিনিময়ে তো অনল পেলাম। যে অনলে পুড়ছি দিবানিশি। তবে আমি কেনো অন্যের বেলায় মহৎ হবো! আমিও চাই পৃথিবীর প্রত্যেক টা প্রেমিক প্রেমিকা পুড়ুক ভীষণ না পাওয়ার অনলে। বুঝুক ভালোবাসার বিষবৃক্ষ কি! আমিও তো আমার ভাঙা হৃদয় খানা দাফন করেছি বক্ষ মাঝে। তবে কেনো অন্যের সুখ দেখবো?’
রমনীর গোপন কথা গোপন রয়। শুনেনা কেউ আর্তনাদ। কেবল রাজকীয় জানালা’র সামনে থাকা কাঁঠাল গাছের ডালে বসা অতিথি পাখি গুলো আগ্রহে তাকিয়ে রয় নিশ্চুপ।
___
কাছারি বাড়ির সামনে বিশাল বটগাছটার নিচে পড়ে আছে তিস্তা। শরীরে থাকা সেই পাঁচদিন আগের জামা খানা প্রায় ছিঁড়ে বিধ্বস্ত বললেই চলে।
এ জায়গাটা সবসময় ফাঁকা থাকলেও আজ দারুণ ভীড়। তিস্তার গলার কাছে, হাতে, আরও নানান জায়গায় শুঁকিয়ে থাকা রক্ত গুলোর উপর ভনভন করছে মাছির দল।
তনয়া ছুটে আসে ভীড় ঠেলে। চমকে উঠে মেয়ের পরিণতি দেখে। মেয়েটা নড়ছে না কেনো? শ্বাসও তো নিচ্ছে না। তবে কী,,,!
#চলবে