গল্পঃ#সময়টা প্রতিশোধের (প্রথম পর্ব)
লেখায়ঃ#তাজরীন_খন্দকার
পাক্কা পাঁচ বছর পর্যন্ত বউ খোঁজতে খোঁজতে শেষ পর্যন্ত যখন প্রথমবার দেখা পাত্রীর সাথেই বিয়ে হয়,তখনকার অবস্থাটা কতটা জটিল হতে পারে সেটা ঘোরপ্যাঁচ করে বিয়ে ভেঙে দেওয়া মানুষটা ছাড়া কেউ অনূভব করতে পারবেনা।
হ্যাঁ পাঁচ বছর ধরে অভি বিয়ের জন্য পাত্রী খোঁজছে৷
এখন পর্যন্ত মনে হয় শতেক বউ দেখে ফেলেছে । কিন্তু তার পক্ষ থেকেই কোনো না কোনো ত্রুটি পাওয়ার জন্য বিয়ে করা হচ্ছিলো না।
কিন্তু এবার সে বউ না দেখেই পরিবারের ইচ্ছেতে বিয়ের স্টেজে বসেছে৷ একটা অজানা উৎসুকভাব তার চোখে মুখে। কারণ সে ইচ্ছে করেই বিয়ের আগে তার হবু বউকে দেখতে চায়নি।
কারণ সে পাত্রী দেখলেই বিয়ে ভাঙার জন্য কোনো না কোনো পথ সামনে আসে। তাই শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত নেওয়া!
এর মধ্যে তার বিয়ে পড়ানো শেষ, শুধু বিভিন্ন সংস্কার অনুযায়ী এখন কিছু নিয়ম মানা বাকি। তাকে একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। যেহেতু আগে তাদের কোনো রকম আংটি পরানো সম্পন্ন হয়নি, তাই অভির হাতে একটা আংটি দেওয়া হলো।
তাকে নিয়ে বউয়ের সামনে বসানো হলো।
কনে পক্ষের একজন মহিলা মেয়ের ঘোমটা একটু উপরে তোলে তার হাতটা অভির দিকে এগিয়ে দিলো আংটি পরানোর জন্য । অভিকে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুটি আংটি পরানোর জন্য ইশারা করলো। তখন সে কাচুমাচু হয়ে সামনে তাকালো।
নিজের জীবন সঙ্গীকে এই প্রথমবার দেখবে,কিন্তু সে সামনে তাকাতেই তার হাত থেকে আংটিটা সাথে সাথে নিচে পড়ে গেলো। আকস্মিকতায় সে নিচে আংটির দিকে তাকিয়ে আবারো মেয়ের দিকে তাকালো। এটা সে কাকে দেখছে? কোনো স্বপ্ন নয়তো?
কারণ এই মেয়েই তো সেই মেয়ে, যাকে সে পাত্রী হিসেবে জীবনে প্রথমবার দেখেছিল। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে। এই মেয়ে তখন ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে ছিল, আর অভি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ফোর্থ ইয়ারে পড়তো। আর পাশাপাশি একটা বেসরকারি কোম্পানিতে জব করতো। তখন বিয়ে করতে চাওয়ার একটাই কারণ তার মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেছিলো, আর ঘরে সে প্রথম সন্তান।
কিন্তু তার সেসময় কোনো মেয়েকেই পছন্দ হয়নি বিয়ের জন্য।
এভাবে চলে গেলো তিন বছর আর দুই বছর হলো সে সরকারি চাকরি পেয়েছে৷ তার মা অসুস্থতা কাটিয়ে এখন সুস্থ স্বাভাবিক। কিন্তু চাকরি পাওয়ার দুই বছর পেরিয়ে গেলো এখনো তার বিয়েই করা হচ্ছেনা,এই বিষয়টা নিঃসন্দেহে অস্বাভাবিক।
আর এখানে বিয়ে করার আগে সে শুনেছে মেয়ে এবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ফোর্থ ইয়ার ফাইনাল দিবে। আর মেয়ের নাম আশা। আশা নামে অসংখ্য মেয়ে আছে এই দেশে,কিন্তু এই আশা যে সেই আশা হবে সেটা অভি কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। আর পাঁচ বছর আগের এই নামটা শতাধিক মেয়ে দেখার পরে কারই বা মনে থাকবে?
অভির এইসব ভাবনার ভেতর তার বন্ধু নুইয়ে আংটি তোলে তার হাতে দিয়ে বললো..
___,,অভি কি করছিস,ভাবীকে পরিয়ে দে তারাতাড়ি।
অভি মাত্র খেয়াল করে দেখলো আশা তার দিকে তাকিয়ে একটা ভিন্ন রকম পৈশাচিক হাসি দিয়ে আবার থেমে গেছে। যেন পাঁচ বছরের কোনো একটা প্রতিশোধ আজ পুরা হতে যাচ্ছে তার। মেয়ের দিকে তাকাতে তার ভয় লাগছে,কোনো রকম কাঁপা হাতে আংটিটা পরিয়ে দিলো।
আরো কিছু সংস্কার মোতাবেক কার্যক্রম চললো। এদিকে অভির তেমন খেয়াল নেই। তার সারা শরীর ভয়ে ঘামছে। পাঁচ বছর আগে কি অপমানটাই না করেছিলো মেয়েকে। কারণ সে তখন তো একটা ভালো ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিল, দেখতেও হ্যান্ডসাম লম্বাচওড়া। কিন্তু মেয়ে দেখতে সুন্দরী হলেও লম্বায় কম ছিলো। আর পড়ালেখায়ও এতো ট্যালেন্ট ছিলো না।
এই অল্প মাত্র অজুহাত দেখিয়ে মেয়েকে সে রিজেক্ট করেছে,সেটাও মেয়েকে ডিরেক্ট ফোন করে অপমানমূলক কথা বলে। সেদিন স্পষ্ট সে মেয়ের কান্না শুনেছিলো। কিন্তু অভির ভেতরে ছিল এক আকাশ অহংকার।
তার হৃদয় যেন ছিল একটা কঠিন পাথর,যা কারো আকুতিতে গলে যাবার নয়।
আশা মেয়েটার পড়ালেখার পেছনে পারিবারিক কোনো অনুপ্রেরণা নেই। তাই কচ্ছপের গতিতে নিজের পড়াশোনা কন্টিনিউ করে যাচ্ছিলো। কিন্তু সে যা চায় তার পরিবারো তাই চায়। বিয়ের জন্য পাঁচ বছর আগে সেও প্রস্তুত ছিল না,কিন্তু অভিকে দেখার পরে অভির উপর তার একটা ভালোলাগা কাজ করে ।
তাই সে এখানে বিয়ে করতে সানন্দে প্রস্তুত ছিলো।
অতঃপর অভি যখন তার এই অজানা আবেগের উপর ছুরি চালাতে দুবার ভাবেনি,তখন সে শপথ নিয়েছে তার এই অহংকার পর্যন্ত সেও পৌঁছে দেখাবে। পরিক্ষার ৮ মাস আগে থেকে সে পড়ালেখার প্রতি উঠেপড়ে লেগে যায়। এবং সে ভালো রেজাল্টসহ পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে চান্স পায়। এর মধ্যে আর কোনো পাত্রপক্ষের সামনে সে যায়নি। পাত্রপক্ষ হিসেবে আলাপ আলোচনায় অভি প্রথম ছিল আর অভিই আবার শেষ।
এবারো আশা ভেবেছিল অভি বিয়ের আগে অবশ্যই পাত্রী দেখবে। আর তখন আশা অভিকে উল্টো অপমান করে রিজেক্ট করবে। কারণ অভি একজন নন ক্যাডার চাকুরীজীবি। আর আশার জন্য অনেক বিসিএস ক্যাডার পাত্রও আসে। কারণ সে এখন মেধাবী শিক্ষার্থীদের একজন। তার সব সিজিপিএ অনেক বেশি ভালো। কিন্তু সে নিজের ক্যারিয়ার গড়ার আগে বিয়ে করবেনা বলে পরিবারকে জানিয়ে দিয়েছিলো।
এরপর যখন অভির পরিবার থেকে দ্বিতীয়বার বিয়ের প্রস্তাব আসে,তখন সে কিছু না ভেবেই সেখানে হ্যাঁ সম্মতি দিয়ে বসে। তার মূল উদ্দেশ্য অভিকে বিয়ে করা নয়, অভিকে অপমান করা।
কিন্তু যেভাবেই হোক অভির সাথে বিয়ের আগে যে দেখা সাক্ষাৎ সম্ভব হয়ে উঠেনি। তাই বিয়ের পরেই নিজের প্রতিশোধ হাসিল করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আজ তাকেই বিয়ে করেই ফেললো।
সবশেষে যখন আশা আর অভি এক গাড়িতে চড়ে বসেছে,অভির তখন দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম।
ইতিমধ্যে সবাইকে বিদায় জানিয়ে গাড়ী স্ট্রাট দিলো।
অভির মনে হচ্ছে গাড়িটা যেন কঠিন পর্বতের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এসি গাড়িতে বসেও সে অনূভব করছে তার কপাল বেয়ে চিনচিনে ঘাম থেমে নেই। অনবরত ঘাম ঝড়ছে।
তার এই খারাপ পরিস্থিতির বাধ ভেঙে আশা বলে উঠলো..
___ নিজের দিকে তাকিয়ে আমাকে কি আপনার জীবন সঙ্গী হিসেবে সুযোগ্য বলে মনে হয়?
কাঁটা গায়ে যেন লবণের পরিমাণটা বেশিই পড়ে গেছে। এই সেইম কথাটা পাঁচ বছর আগে অভি বলেছিল আশাকে।
কিন্তু বিষয়টা এমন নয় যে তারা দুজন দুজনের অযোগ্য। আগেও যোগ্য ছিলো আর এখনো আছে। কারণ দুটো পরিবারই সচ্ছল এবং দুজনেরই বংশ এবং নিজ নিজ যোগ্যতা বিদ্ধমান।
কথা হলো তাদের দুজনের মধ্যে মতবিরোধ। আগে ছিলো অভির মধ্যে, আর এখন আশার মধ্যে।
অভির মুখে কোনো প্রকার জবাব না পেয়ে আশা আবারো বললো..
___ সুন্দরী মেয়ে দেখলেই বিয়ের জন্য মন আকুপাকু করে তাইনা? বুড়া কোথাকার! কদিন পরে মরে যাবে,এখন আইছে বিয়ে করতে!
অভির মনে হচ্ছে এবার সে কলিজা ফেটে মারা যাবে। এতো কঠোর প্রতিশোধ, প্রতিটা বাক্য এই মেয়ে মনে রেখে বসে আছে। অভিও এমন ধরনের একটা কথা বলেছিল, যেটা ছিল..
__ তোমাদের বাচ্চা মেয়েদের একটাই সমস্যা সুন্দর হ্যান্ডসাম ছেলে দেখলেই বিয়ের জন্য পাগল হয়ে যাও। সংসারের বুঝো কিছু, হুহহ!
অভি নিজের বুকের উপরে হাত রেখে আশার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে আর একটা সেনসেটিভ কথা বাকি আছে যেটা আশার মুখে শুনলে নিশ্চিত সে এখন হার্টঅ্যাটাক করবে!
চলবে?..