সময়টা_প্রতিশোধের(৪র্থ পর্ব শেষ)

গল্পঃ #সময়টা_প্রতিশোধের(৪র্থ পর্ব শেষ)
লেখায়ঃ #তাজরীন_খন্দকার

এদিকে আশা অভির মাথায় জীবনেও হাত বুলাবে না বলে মনে মনে মিনমিন করে যাচ্ছে..আর ভাবছে নিজের বাড়ির লোকজনের সামনে এমন অধিকার দেখানোর মজা আজকে তাদের বাড়িতে যাওয়ার পরে বের করবে!

এরপর আশা শুধু আক্ষেপ করছে,অভির মাথায় হাত লাগানোর আগে নোহা কেন রুম থেকে যাচ্ছেনা ! নাহ নোহা বেচারি এখানেই খুঁটি মেরে বসে আছে। বাধ্য হয়ে আশা অভির মাথায় হাত দিলো, অন্যদিকে নোহা নিজের ফোনের দিকে ব্যস্ত হয়ে গেলো। আশা খেয়াল করলো নোহা অন্যদিক ফিরে আছে। তারপর নিজের দাঁত কিড়মিড় করে মনে মনে বলতে লাগলো আমাকে দিয়ে মাথা বুলানো বের করছি আপনার । আঙুলের ভাজে ভাজে চুল মুষ্টিবদ্ধ করে এমন জোরে জোরে টান দিলো যে,অভি মাগো বলে উঠে বসে গেলো।

অভির এই অবস্থা দেখে নোহা এদিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলো.
___ কি হয়েছে ভাই। ব্যথা পাইছো নাকি?

অভি আশার দিকে তাকিয়ে দেখে সে একদম নিশ্চুপ হয়ে আছে,যেন সে কিছুই জানেনা টাইপ!
অভি আশার দিকে তাকিয়েই বলল..
___আরে নাহ আমি এদিকে শুয়ে আছি,কিন্তু ওইদিকে আমার ইম্পর্ট্যান্ট কাজ গোছানো হয়নি। মনে হতেই উঠে বসলাম।
আর তোর ভাবীর যত্ন তো অলটাইম পাবো বুঝস না?? তবে এখন কাজ সেরে নেই। তুই থাক ওকে, আমি যাচ্ছি?

নোহা মাথা নাড়লো। আর আশা ওর কথা শুনে বড়সড় একটা ভেটকি দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো। তার বয়েই গেছে তাকে অলটাইম যত্ন করতে। রাতে নিজের ঘরে থাকার সাধ্য হয়নি,তার আবার কতো শখ!

এরপর অভি কাজ আর মেহমানদারীতে এতোই ব্যস্ত হয়ে যায় যে তাকে দেখাই যায়নি সারাদিন।
একদম পড়ন্ত বিকেলে তাদের বাড়িতে যাওয়ার গাড়ী ছেড়ে দিবে দিবে এমন সময় অভি রেডি হয়ে গাড়ীতে উঠলো। আশা অভির প্রথমত তাকাতে চায়নি, কিন্তু একটা নেশাময় স্মিল তাকে চুম্বকের মতো টানছিল। এটা কি কোনো পারফিউমের ঘ্রাণ, এটা দেখতেই আশা জানালার দিক থেকে মাথা ঘুরিয়ে অভির দিকে তাকালো, তাকিয়ে কিছুক্ষণের জন্য তার চোখ যেন এখানেই স্থির হয়ে গেছে, কালো পাঞ্জাবি, কালো জিন্স,কালো চশমা,কালো হাতের ঘড়ি এমনকি হাতের ফোনটার কাভারও কালো রঙের।

এই মূহুর্তে অভি আশার দিকে তাকাচ্ছেনা,সে একমনে ফেইসবুক স্ক্রল করছে৷ আশার মনে হচ্ছে সে যেন তার মধ্যেই ডুবে যাচ্ছে। খুব চেষ্টায়ও তার থেকে চক্ষু ফেরাতে পারছেনা। রাস্তার গতিপথ একটু উঁচুনিচু হওয়ার জন্য গাড়ীটা বারবার হেলছিল, তার সাথে সাথে অভির চুলগুলো বারবার সামনে পড়ছিলো ,আর সেটা অভি হাত দিয়ে আবার ঠিক করছে। হঠাৎ আশা অভির ঠোঁটের দিকে তাকাতেই আরো থমকে গেলো, সে মুচকি মুচকি হাসছে!

এটা দেখেই আশা একটু নড়েচড়ে বসলো।ভাবছে আশা তাকিয়েছে বলে সে হাসছে। কিন্তু নাহ হেসেই যাচ্ছে। এরপর একটু পরে আবার আস্তে করে তাকালো,দেখে তখনো সে হাসছে। তার মানে অন্য কারণে অভি হাসছে। মাথা উঁকি দিয়ে মোবাইলের দিকে দেখার চেষ্টা করলো,কি এমন দেখছে যে এভাবে একা একা হাসতে হচ্ছে!
কোনো মেয়ের সাথে কথা বলছেনা তো!

আশা পট করে মোবাইলটা টান মেরে নিয়ে আসলো। দেখে অনি নামে কোনো ছেলের সাথে চ্যাট করছে। সেখানে তার টেক্সট.
__ আমার বউ আমাকে সারারাত বাইরে রেখেছে বুঝলি,এখন আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে মনে হচ্ছে যেন চোখ দিয়ে গিলে খাবে!

এসব ম্যসেজের ফানি রিপ্লে দিচ্ছে অনি। সেও বলে যাচ্ছে এমন টাইপের কিছুই। এটা দেখে আশার মাথায় রক্ত উঠে যাওয়ার উপক্রম। বন্ধুর কাছে এসব বলে মজা করে,কতো বড় সাহস!

আশা মোবাইলটা সিটের পাশে রেখে,এক হাত দিয়ে অভির কান ধরে টেনে নামিয়ে ফিসফিস করে বললো..
__ এই ছেলে সমস্যা কি? স্বামী স্ত্রীর ব্যক্তিগত কথা কি মানুষ বাইরের মানুষকে বলা লাগে

___ মানে আমি আপনার স্বামী সেটা মানেন আপনি?
যদি মানে তাহলে আর কখনো বলবোনা।
আশা হাত দিয়ে মুখে চেপে ধরলো,অভি উমমম উমমম করছে মুখ ছাড়ানোর জন্য। কিন্তু আশা মুখে চেপে ধরেই সামনে দিকে তাকিয়ে অভির খুব নিকটে গিয়ে বললো..
___ এতো জোরে কথা বলেন কেন? সামনে ড্রাইভার আছে দেখেন না? আর কখনো জোরে কথা বলবেন?

অভি মাথা নেড়ে বললো..
__ না আর জোরে কথা বলবেনা।

আশা মুখ ছাড়লো। পরক্ষণে অভি বললো
___ আমার ফোনটা দিয়ে দেন।

___ এই ফোন আজকের পর আমার কাছেই থাকবে। জরুরি দরকার ছাড়া পাবেন না। এসব ফালতু পোলাপানের সাথে কথা বলা বের করবো আপনার ।

অভি চোখ ছলছল করে তাকালো। এতো বড় অন্যায় কিভাবে মেনে নিবে!
সামনে ড্রাইভার আছে কোনো কিছু জোর দিয়ে বলতেও পারছেনা। নিরুপায় হয়ে জানালার দিকে এগিয়ে বসলো।
আশার খুব ইচ্ছে করছে অভির কাঁধে মাথা রাখতে। কিন্তু এটা করা যাবেনা,তার দিকে একটু তাকানোর জন্য এই ছেলে এটাও বন্ধুর কাছে বলে দিয়েছে৷ এখন কাঁধে মাথা রাখলে তো নিজেকে বাহাদুর ভাবতে শুরু করবে। যেভাবে আছে সেভাবেই ঠিক আছে।

বাড়িতে পৌঁছে সবাই জামাইকে বরণ করতে ব্যস্ত৷ আশার আত্মীয়রা এবং অভির শালা-শালীরা দুলাভাই দুলাভাই করতে করতে বাড়িঘর মাতিয়ে তুলেছে।

এর মধ্যে কিছু দুষ্ট ছেলে মেয়ে তাদের দুলাভাইয়ের খাবারে আজেবাজে কিছু মেশানোর জন্য লুকিয়ে রান্না ঘরে গেলো, মরিচ হলুদ, জিরা, এলাচি ইচ্ছেমতো দিয়ে যা-তা বানাচ্ছে খাবারকে। তাদের কাজকর্ম প্রায় শেষ তখনই আশা গিয়ে দেখে ফেললো এসব কান্ড৷ আশাকে দেখে সবাই থতমত খেয়ে গেলো। আশা রেগে বললো..
___ এখানে কি হচ্ছে?

বাচ্চারা ভয়ে চুপসে গেলো। তখনই আশা উচ্চস্বরে হেসে উঠলো আর বললো..
___ আরে ইচ্ছেমতো ভেজাল মিশা৷ আয় আমিও সাহায্য করি।
বলেই আশা আরো বেশি পরিমাণে রং, চুন আরো যতো আবিজাবি কিছু আছে সব মিশিয়ে দিলো।

সবার মজার পার্টনার হয়ে সেও তাদের পেছন পেছন গেলো৷ কিন্তু আশা রুমের ভেতরে গেলোনা৷
অভির সামনে অসংখ্য খাবার আইটেম রাখা, কিন্তু খাবারের দিকে তার কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছেনা। সে সবার সাথে কথা মজার মজার কথা বলায় ব্যস্ত।
আর যারা এসব নিয়ে পরিকল্পনা করে এসেছে তারা বারবার খাবার জন্য রিকুয়েষ্ট করতেছে৷ কিন্তু অভির এখন কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না বলে ওদেরকে খেতে বললো।কিন্তু ওরা খাবেনা । শুধু অভিকেই খেতে হবে,কারণ সে হলো দুলাভাই, এবং আজকের স্পেশাল গেস্ট!

কিন্তু অভির কোনো কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না,আর এই কথাটা বারবার বলতেছে। সব বাচ্চারা শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে গেলো। সবাই গিয়ে আশাকে বিষয়টা জানালো। আশা বললো আমার কাছে খাবার বাটিগুলো দে।
সে সব নিয়ে তাদের সামনেই গিয়ে বললো..
__ আপনি নাকি খাচ্ছেন না? তারা এতো কষ্ট করে বানিয়েছে না খেলে কিভাবে হবে বলুন!?

___ আমার খেতে ইচ্ছে করছে না সত্যি!

___ আচ্ছা আমি খাইয়ে দেই?

আশার মুখে কথাটা শুনে অভি অবাক হলো। সে আশার চোখের দিকে তাকিয়ে, না শব্দটা বলতে পারলো না।
শুধু মাথা নাড়লো.. সে খাবে!

আশা সবার দিকে তাকিয়ে একটা সফলতার হাসি হেসে অভির মুখে প্রথমে নুডলস তোলে দিলো। মুখে দেওয়ার পর সে চিবুতে যাবে তখনি তার পুরো মুখ চোখ লাল গোল্লা হয়ে গেলো। ফ্লোরের উপরেই ওয়াক ওয়াক করতে করতে ফেললো।
সরবতের গ্লাস মুখ দিতেই তার মুখ ভেটকিয়ে আসলো, হলুদ, মরিচ জিরা,আর কিছু ভেতরে গেছে। অভির মুখ জ্বলে যাচ্ছে। আশা কিছু না বুঝার ভান করে বললো..
___বাচ্চারা এসব কি দিয়েছে আল্লাহ! ওয়েট ওয়েট আমি পানি দিচ্ছি।
বলেই পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো। অভি সেটা মুখে দিয়ে একটু খেয়েই আবার মেঝেতে ফেলে দিলো। তার ভেতরের সবকিছু যেন বাইরে চলে আসবে দশা।
কি বিশ্রী গন্ধ আর বাজে জিনিসের মিশ্রণ!
তার প্রবল বেগে বমি পাচ্ছে। নিজের মাথায় হাত দিয়ে নুইয়ে গেলো একদম। এই অবস্থা দেখে সবাইই যার যার মতো করে সরে পড়লো।

আশা অভির মাথাটা তোলার চেষ্টা করে তার দিকে তাকালো,অভির চোখ বেয়ে অঝোরে জল পড়ছে,চুন লেগে মুখের চামড়া পুড়ে গেছে অনেকটা, ঠসা উঠে গেছে। এবার আশার চোখ দিয়ে পানি চলে আসলো। মজা করতে গিয়ে এখন কি থেকে কি হয়ে গেলো!
আশা অভির মাথায় হাত দিয়ে বলছে
___ আপনার খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে?

___ না আমি ঠিক আছি!

___ তাহলে কাঁদছেন কেন?

___ আরে কাঁদছিনা তো, আপনা আপনি পানি পড়তেছে,খুব ধাচ তো এসবের। শুধু মুখে নয় মাথা চোখে প্রভাব করছে। কিন্তু আপনি কাঁদেন কেন?

___কাঁদবোনা তো কি করবো,আপনি এতো বোকা কেন? আপনি জানেননা নতুন নতুন অনেক জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। আপনি একটু টেস্ট করে ফেলে দিতেন। অন্যকিছু না খেলেও হতো।

___ আমি ওদের কথায় খাইনি তো৷ খেয়েছিলাম আমার বউকে খুশি করতে। আমি ভেবেছি এখানে কোনো ভেজাল থাকতে পারেনা,কারণ বউয়ের ছোঁয়া পড়েছে তো!

___ আমি সরি! আমি বুঝতে পারিনি।
অভিকে জড়িয়ে আশা হুহু করে কেঁদে ওঠলো।

অভি বিশ্বাস করতে পারছিল না আশার এই ব্যবহার। তাই নিজে থেকে বলে বসলো
__ সরি কেন? আমার উপর আপনার অনেক জিদ আছে,এর মধ্যে এটা কোনো ব্যপারই না৷ প্রতিশোধ নিতে হবে তো আপনার!

___ আচ্ছা নিবো, তবে ভালোবেসে। বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন যে সেটা খেয়াল আছে? প্রতিশোধের পর্ব শেষ হতে হতে প্রেম করার বয়স কি অবশিষ্ট থাকবে?

___ হেহেহেহে তা তো ভেবে দেখিনি। আসলেই বুড়ো হয়ে যাচ্ছি! তখন বিয়েটা করে ফেললে পাচঁটা বছর আরো কত্ত প্রেম করতে পারতাম। কিন্তু নিজের ক্যারিয়ারের আগে বিয়ে করতে চাইনি,মাকে শান্তনা দিতে শুধু পাত্রী দেখেছি। তুমি ভাবছো আমি শুধু তোমাকে অপমান করেছি? শুনো আমি অসংখ্য বিয়ে এভাবে ভেঙেছি শুধুমাত্র তখন বিয়ের ইচ্ছে ছিল না বলে!

__ কি বলছেন এসব? তাই বলে অপমান করতে হবে?

___হুম তাই যদি না করতাম তাহলে সেই তখনই বিয়ে করে ফেলতে হতো। আর আমি জীবনের প্রতি হতাশ হয়ে যেতাম। এখন বলার একটা ওয়ে আছে,নাহ আমি লক্ষ্য পূরণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। যাই হোক মাফ চাওয়ার সুযোগ পাইনি এখন পর্যন্ত, আর চাওয়ার মতো সাহসও ছিল না। তুমি আমাকে মাফ করে দিও৷ পুরনো কিছু ভুলে নতুন কিছুর সন্ধানে চলো দুজন আগায়?

___ আচ্ছা ডান! তবে মাফ করলাম না পুরোপুরি। আপনার সাজা আরো পাওয়ার আছে। তবে সেটা তোলা রইলো,যখন আমার কোনো ভুল হবে তখন এটা প্রয়োগে সেটা নিরোধ করবো!
আমার প্রতিশোধ চলবেই, তবে সেটা ভালোসাময়!

(সমাপ্তি!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here