নিষ্কলুষচিত্ত তুমি |৭|

নিষ্কলুষচিত্ত তুমি |৭|
লেখা : মান্নাত মিম

থমথমে অবস্থা বিরাজমান প্যান্ডেল জুড়ে। তবুও আগত মেহমান’দের ফিসফিসানি শব্দ ঠান্ডা, নিশ্চুপ জনবহুল পরিবেশকে গমগমে করে তুলছে। অদূরে ভয়ে থরথর করে কাঁপছে নন্দিতা। তাকে জড়িয়ে ধরাবস্থায় বধূ বেশে সায়মা। অগ্নি দৃষ্টি নন্দিতার ওপর বর্ষণকারী ফারজানা দু’হাতে জাপটে ধরে আছে বন্ধু রিফাত’কে। লায়লা বেগম মাথা নতাবস্থায় চেয়ারে বসা। সায়মার স্বামী আশফাক জড়িয়ে ধরে রয়েছে পলক’কে। এ যেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে দু’জন পুরুষের মধ্যে। কিন্তু দু’জনের এহেন অবস্থার মধ্যমনি হলো নন্দিতা। রিফাতের রক্তাক্ত মুখ ঠোঁটের কোণ, চোখের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্তের ফোঁটা। পলকের-ও অবস্থা একই, তবে আঘাত কিছুটা কম’ই। কিন্তু তাকে ধরেবেঁধে রাখা পড়েছে বেশ দায়। পাগলা ঘোড়ার মতো উদ্যমশীলতা পেয়ে বসেছে তাকে। দৌড়ে গিয়ে বারংবার রিফাতকে আহত করার চেষ্টা চালাচ্ছে পলক।
_______

রিফাত ফারজানার সাথে এসেছে সায়মার বিয়ের অনুষ্ঠান উপলক্ষে। বেশকিছু দিন যাবৎ লন্ডনে ছিল, ক’দিন আগেই বাংলাদেশে পদার্পণ করেছে। ফারজানার সাথের ব্যাচমেট ছিল, একই সাথে ডাক্তারি পড়া শেষ করেছে। সেই বন্ধুত্বের সূত্র ধরেই ফারজানা তাকে নিয়ে এসেছে, উপরন্তু পলকের সাথে পরিচয় করানো মূল উদ্দেশ্য ছিল। বধূ বেশে সায়মার সাথে এসে প্রথমেই ছেলেদের মতো কোলাকুলি ভঙ্গিতে গলা জড়িয়ে গালে শব্দ করে চুমো দেয়, বিষয়টা বিদেশি কালচারের হলেও বাংলাদেশের অনেকের কাছে চক্ষুশূল। পলক মেজবানের আতিথেয়তায় ব্যস্ত। সায়মার সাথে কিছুক্ষণ দেখা-সাক্ষাৎ সেরে ফারজানা সেদিকে যায়, রিফাতকে সেখানেই রেখে। রিফাত তখন একা একাই এদিক-সেদিক ঘুরে-ফিরে দেখার উদ্দেশ্য হাঁটতে থাকলে ব্যস্ত থাকা লায়লা বেগমের সামনে পড়ে যায়। ধাক্কা না লাগলেও হাতে থাকা প্লেটের ডাল আন্দোলিত হয়ে কিছুটা রিফাতের কোর্টে পড়ে। আফসোস ভঙ্গিতে লায়লা বেগম বললেন,

“ইস, দেখ কারবার! কিছু মনে করো না বাবা, ব্যস্ততায় অধিকন্তু বয়সের কারণেও দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে এমনটা হয়েছে।”

রিফাত ভদ্রতা মেশানো গলায় বলল,

“না, না ঠিক আছে। একটু ওয়াশরুমটা দেখালেই হতো।”

“আসো, আসো আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।”

রিফাত বাঁধা দিয়ে নম্র স্বরে বলল,

“না, না আপনাকে সবাই খুঁজবে। আপনি শুধু আমাকে বলে দেন কোন দিকে।”

লায়লা বেগমের দেখানো দিকে অগ্রসর হয় রিফাত। পথিমধ্যে একজন মহিলা ছোটো বাচ্চা নিয়ে যাচ্ছেন, যেদিকে রিফাত যাচ্ছে। সে-ও মহিলার পিছু নিয়ে বুঝতে পারল বাচ্চাটা ওয়দশরুমে যাবে। সেই হিসেব করেই রিফাত দেখল বাচ্চা নিয়ে একটা রুমের ভেতর ঢুকতে৷ সে ভাবল, এটাই সম্ভবত ওয়াশরুম। যেহেতু সকলেই এটা ব্যবহার করছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল বাইরে বাচ্চা ও তার মা’য়ের ভেতর থেকে কার্যক্রম সেরে আসার জন্য। ততক্ষণ যাবৎ সকলের আনাগোনা দেখতে থাকল বাড়ির ভেতরে, সাথে ঘুরে ঘুরে দেখল ড্রয়িংরুমের চারপাশটা, কেউ কেউ তাকেও দুয়েকবার নজর দিয়ে পরখ করে নিলো। ড্রয়িংরুমটা বেশখানিক জায়গা নিয়ে করা, আর গোলাকৃতি ভাবে একেকটা রুমের দরজা দেখা যায়। মূল ফটকের বামপাশ দিয়ে চলে গেছে ছাদের সিঁড়ি। ফারুক হাসান ছাদের সিঁড়িটা ভেতরেই রেখেছেন, যেন বারবার গেট খুলে বাইরে দিয়ে ছাদে যাওয়ার প্রয়োজন না হয় কিংবা বাইরের মানুষ যেন সেটা ব্যবহার না করতে পারে। এমন সময় ভেতর থেকে মহিলা ও তার বাচ্চাটা বাইরে বের হয়ে এলো। ওমনি রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে হাসিমুখ তাদের বিদায় দিয়ে দরজার খিল লাগাতে গিয়ে রিফাতের সেভ করা মুখশ্রী চকচক করে নন্দিতাকে জানান দিলো পুরোনো স্মৃতি হাতড়াতে। নন্দিতার অন্তঃকরণে কম্পন সৃষ্টি হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। বোধশক্তি লোপ পেয়ে বসেছে। ভয়ের মাত্রা ছড়িয়ে গিয়ে মুখশশী হয়ে উঠেছে রক্তাভ। চিৎকার দেওয়ার জন্য উদ্যত হলেই রিফাত চতুরতার সহিত ক্ষীপ্র গতিতে নন্দিতার মুখ চেপে ধরে রুমের ভেতর চলে গিয়ে দরজা আঁটকে দেয়। দমবন্ধ হয়ে আসার জোগাড়, সম্মুখে মৃত্যু দেওয়ার জন্য স্বয়ং যমদূত দণ্ডায়মান। একি মৃত্যু নাকি মৃত্যুর চেয়েও ভয়ানক কিছুর সৃষ্টিকারী? মনের কথা মনের দরজায় খিল গেঁথে বসে থাকে। মুখ স্ফুটিত হয় না, মুখ চেপে ধরে রাখার ফলস্বরূপ।

“আহা, রসের হাঁড়ি যে!”

তীব্র অবাক হওয়ার আবেশে ছেয়ে আছে রিফাতের মুখায়ব। ফের বলে ওঠে,

“এখানে কীভাবে? মৃত্যু-ও জুটল না, এত অত্যাচারে?”

নন্দিতা ভেতরেই ভেতরে বারংবার নিজের মৃত্যুকে ডাকছে। কিন্তু হায়! মৃত্যু-ও ধোঁকা দিচ্ছে তাকে। একটুও দর্শন দিচ্ছে না। নাহলে আজ এই নরপিশাচের হাতের কবলে পড়ে পিষ্ট হতে হত না।

“ওহ্হ রে! মুখ তো আমি-ই ধরে রেখেছি। কথা বলবে কীভাবে বলো তো?”

বেশ ভাবুক নয়নে একবার ওপরে তাকিয়ে ফের অশ্রু বিসর্জনকৃত নন্দিতার দিকে তাকাল রিফাত। শয়তানি হাসি হেসে নিজের মুখটা নন্দিতার কানে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

“প্রয়োজনই বা কী মুখে বলার? যদি এই রসালো ঠোঁটের অভ্যন্তরে আরেক ঠোঁটের আগমনে কথাই না হয়! ঠিক না?”

বাঁকা হাসির রেশ দেখা যাচ্ছে, যা কি না নন্দিতা চোখ ঘুরিয়ে দেখতে পেল, আর মাথা ডানে-বামে করে গোঙাতে গোঙাতে না বোধক সম্মতি করতে লাগল। সেটা অবশ্যই ছেড়ে দেওয়ার আকুতি। মনের মধ্যে বয়ে বেড়াচ্ছে, অতীত রাতের নির্মমতার দৃশ্য। যদি-ও সেদিনের সংখ্যা বেশি তা স্বত্বেও একেকটা নরপিশাচ শক্তিধারী।
_____

সকলের খাওয়ার মাঝে হঠাৎই মনে একটা খেয়াল এলো পলকের। সকাল থেকে যে বিকেল গড়িয়ে চলছে, নন্দিতার দেখা তো মিললই না উপরন্তু মেয়েটা খেয়েছে কি না সেদিকেও কারো খেয়াল গেল না। বিষয়টা নিজেরই কাছে অত্যন্ত লজ্জাজনক ঠেকল। লায়লা বেগম যে সেসবে একদম অনাগ্রহী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সায়মাকে-ও বলা চলে না, নিজ বিবাহে অন্যের বিষয়ে জ্ঞাত হওয়াটা বেমানান, কারণ কিছুক্ষণ আগেই তো মাত্র বিয়ে পড়ানো হলো। অগত্যা সকলের ব্যস্ততার কারণে নিজ উদ্যোগেই নন্দিতার খোঁজখবর নেওয়ার জন্য এগিয়ে গেল বাড়ির ভেতরে। পথিমধ্যে মহিলা বাচ্চাসহ একজনকে বেরিয়ে আসতে দেখল সে বাড়ির ভেতর থেকে। সেদিকে একবার মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। নন্দিতার রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে লাগল পলক। সবাই কেমন জানি করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এভাবে সবার নজরবন্দি হওয়ায় ইতস্ততভাব আরো দ্বিগুণ বেড়ে গিয়ে ফিরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। তখনই ভেতর থেকে গোঙানি স্বরূপ গোঁ-গোঁ শব্দ শোনা যাচ্ছে। এক সেকেন্ডের দেরিও সহ্য না করে ধড়াম শব্দে আঁটকে থাকা দরজা সশব্দে খুলে গেল। ভেতরে রিফাত ও নন্দিতাকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখা গেল। নন্দিতার সাথে যে জোরজবরদস্তি করা হচ্ছিল, সেটা পলকের বুঝতে সময় নিলো না। এগিয়ে গিয়ে নন্দিতাকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় থাকা রিফাতকে পিছন থেকে কোর্টের কলার চেপে ধরে বাইরে নিয়ে এলো পলক। এদিকে রিফাত ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেনি যে, এভাবে ধরা পড়ে যাবে। কারণ বিয়ে বাড়ি বলে সকলেই ব্যস্ত থাকবে, এদিকে শুধু ওয়াশরুমের ব্যবহারের তাগিয়েই আসবে সবাই। যতটুকু তারা মস্তিষ্কে বুঝেছে আরকি। আর নন্দিতা বাড়ির ভেতরে মানেই বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ এমন কিছু একটা হবে। তাহলে এখন এই ছেলেটা কে যে, এভাবে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে? ভাবনার ভেতর থেকে ফিরে এলো মুগুর সমান বাড়ি খেয়ে। বাড়ির উঠানে বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজিত করার উদ্দেশ্যে টানানো প্যান্ডেলের মাঝে দু’জন তাগড়া যুবকের মারামারির তোপে সকল মেহমান খাওয়ার টেবিল থেকে ওঠে দূরে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ায়। মারামারির খবর পেয়ে লায়লা বেগম, ফারজানা ছুটে আসে; যারা কি না দূরে অবস্থান করছিল। এদিকে সায়মার স্বামী আশফাক দ্রুত মাথার পাগড়ী রেখে বন্ধুদের নিয়ে পলকের কাছে গেল। ততক্ষণে মারামারি করে রক্তাক্ত অবস্থা দু’জনের। তবুও দু’জনকে দু’দিকে সরিয়ে নিলো। ফারজানা এসে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বোঝার চেষ্টা করছে, এখানে চলছে কী? সায়মা বুদ্ধিমত্তার প্রকাশিত করে নন্দিতাকে নিয়ে এলো। কারণ সে বুঝেছে পলকের মুখ নিঃসৃত উচ্চারিত শব্দবাক্য “তাকে ছোঁয়ার সাহস হলো কীভাবে?” দ্বারা। তন্মধ্যে ক্রন্দনরত হতবিহ্বল নন্দিতাকে নিয়ে এলো। লায়লা বেগম এসব পেরেশানির ওপর অতিষ্ঠ হয়ে চেয়ারে মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন। ফারজানা তখন নন্দিতাকে অযথা কাঁদার রেশ ধরতে পেরে রিফাতকে গিয়ে দু’হাতে আগলে ধরল। সাথে ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল নন্দিতার ওপর।
______

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here