নিষ্কলুষচিত্ত তুমি |৬|

নিষ্কলুষচিত্ত তুমি |৬|
লেখা : মান্নাত মিম

বিয়ের সাজে সজ্জিত হচ্ছে বাড়িটা, লায়লা বেগম সেখানে দাঁড়িয়ে সবকিছু নিজ হাতে তদারকি করছেন। সাথে তো ছেলে পলক আছেই বাকি কাজ দেখাশোনার জন্য। সায়মা-ও খুব ব্যস্ত তার হবু স্বামীর সাথে ফোনালাপে। নন্দিতা একমনে বসে বই পড়ছে উপন্যাসের। পলক-ই এনে দিয়েছে, তবে সায়মা’কে দিয়ে পাঠিয়েছে। সায়মা তাকে বলেছেও যে, বোরিং ফিল না করার জন্য বইগুলো দিয়ে গেল। কোথা থেকে আনল জিজ্ঞেস করলে বলে, তার ভাই নাকি শখ করে টুকটাক কবিতা লেখালেখি করে তাই তার ঘরে হরদমই নানান উপন্যাসের, কবিতার বই পাওয়া যায়। কিন্তু সে তো বুঝেছে পলকের তাকে সুস্থ করে তোলার প্রচেষ্টা এগুলো। আসলে শুধুই কি প্রচেষ্টা নাকি অন্যকিছুও নিহিত সেখানে? প্রশ্নগুলো করেই নিজেই কেমন বোবা বনে গেল। এসব সে কী ভাবছে? এগুলো মনে আনাও ঠিক নয়। তার অবস্থানটা তাকে মনে রাখা উচিত। অধিকন্তু সে আরো কয়েকদিনের মেহমান হলেও দ্রুত তার পথ তাকে দেখতে হবে। কারণ যেদিন হতে তার সাথে পলক’কে একরুমে কথা বলতে দেখেছেন লায়লা বেগম বিয়ের শপিং করে ফিরে, সেদিন হতেই কেমন জানি রাশভারি, গাম্ভীরতা ছেয়ে আছে তাঁর চোখে-মুখে। পারলে এখনই বিদায় করেন নন্দিতাকে। শুধু বিয়ে বাড়ি বলে কথা। তবে বিয়ের দু’দিন পরেই ফারজানার সাথে পলকের আংটিবদলের অনুষ্ঠান রেখেছেন। স্বাভাবিক ঘরে অচেনা সুন্দরী মেয়ের ছায়ায় পড়লে বিয়ের বয়সী ছেলের মাথা নষ্ট করা ভূত চাপবেই।
_______

গায়ে হলুদের শাড়িতে সজ্জিত ফারজানাকে অপ্সরার দেবী মনে হলেও পলকের তা নজর কাড়তে যথেষ্ট নয়। উলটো পলকের নজর তো আর সাধারণ সাদা সালোয়ার স্যুট পরা মুখ ঢেকে রাখা নন্দিতার দিকে। উঠানের গায়ে হলুদের প্যান্ডেলের স্টেজে বসা সায়মা। সকলের সাথে হেসে, মজা নিয়ে হলুদের ছোঁয়া লাগাচ্ছে। পলক কাজের ফাঁকে ফাঁকে বোনের সুবিধা-অসুবিধার খোঁজে নিচ্ছে। পাশে বসা ফারজানা তখন ব্যঙ্গ করে বলছে,

“ইস! বোনের দরদি ভাই তো দেখছি পারলে এখানেই রেখে দেয়। বোনকে আর বিয়ে দেওয়া লাগবে না।”

ফারুক হাসান মারা যাওয়ার সময় লায়লা বেগম যদি-ও প্রথম দিকে মুষড়ে পড়েছিলেন, তবুও নিজেকে শক্ত করতে সময় লেগে গিয়েছিল। স্বামী সোহাগী ছিলেন বেশ। তখন পলক’ই বোন সায়মার খেয়াল রাখত। ভাই ছিল বোনের জান, বোন ছিল ভাইয়ের জান। সায়মাকে রোজ ওঠে কলেজে নিয়ে যাওয়া, সময় মতো আনা সকল কিছু আস্তে আস্তে পলক খেয়াল করা শুরু করে একজন অভিভাবকের ন্যায়। অতঃপর সংসারের খরচ চালানোর মতো টাকা-পয়সার টান পড়লে লেখা পড়া বি.এ. পর্যন্ত শেষ করে হারিকেন দিয়ে খোঁজার মতো চাকরি খোঁজে। তবে বোনের লেখাপড়া বন্ধ করেনি। সেই আদরের বোনের বিয়ে, বাড়ি এখনই খালি খালি লাগা শুরু হয়ে গেছে। লায়লা বেগমের ডাকে চলে গেল ভাবনার সময় নেই। মানুষ সমাগম বলতে সায়মার বন্ধু-বান্ধবী, ফারজানা ও তার মা আর পাড়া-প্রতিবেশি অল্প কয়েকজনই। সায়মার শ্বশুর বাড়ি থেকে আসা পনের-বিশ জনের মতো। অনুষ্ঠান রাত একটা পর্যন্ত চলবে। কিন্তু লায়লা বেগমের প্রেশার হাই হয়ে গেছে এখুনি। নিজের রুমের সোফায় বসে হা করে শ্বাস টানছেন। নন্দিতা তখন লায়লা বেগম’কে সোফায় বসানো মাত্রই পলক চলে এলো।

“আম্মুর কী হলো?”

মিহি কণ্ঠে দ্রুততার সহিত নিজেকে সামলে নন্দিতা উত্তর দিলো,

“প্রেশার বেড়েছে সম্ভবত।”

“আচ্ছা, দেখ তো বিছানার পাশের ড্রয়ারে প্রেশারের ওষুধ আছে নাকি?”

চারিদিকের টেনশনের চোটে নন্দিতাকে “তুমি” সম্মোধন করেছে, সেটা খেয়াল এলো না পলকের। নন্দিতা ঠিকই খেয়াল করল, সাথে বুঝলও কারণটা। এগিয়ে গিয়ে বিছানার পাশে থাকা কর্ণার টেবিলের ড্রয়ার ঘেঁটে ওষুধ পেল, তন্মধ্যে পলক পানির গ্লাস হাতে নিয়ে। অতঃপর ওষুধ খাইয়ে রেস্ট নেওয়ার জন্য লায়লা বেগম’কে বিছানায় শুইয়ে দিলো। বের হয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে ঘোমটা দেওয়া নন্দিতার কোমলপ্রাণ, স্নিগ্ধ মুখশ্রীতে একনজর তাকিয়ে চোখ নামিয়ে বলল,

“তখন বোধহয় “তুমি” করে বলে ফেলেছি। সেজন্যে দুঃখিত খেয়াল ছিল না।”

মাথা নেড়ে নন্দিতা বিরোধ করে বলল,

“না, না সমস্যা নেই। আপনার বয়সে ছোটো আমি তাই তুমিই বলে ডেকেন।”

নতমুখী হয়ে কথাটা বলায় খেয়াল করল না নন্দিতা, একজনের ব্যাকুল হওয়া দু-চোখ তাকে তৃষাতুর দৃষ্টিতে দেখছিল।

“আচ্ছা, আম্মুর পাশে থেকো তাহলে। বাইরে না গেলেও চলবে।”

বলেই কক্ষ থেকে প্রস্থান করল পলক। পলক বেরিয়ে যাওয়ার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি ফেলে নন্দিতা মনে মনে ভাবল, শেষের বাক্যে অনুরোধের চেয়ে আদেশের দৃঢ়তা দেখা গেল বেশি। বাধ্য ভৃত্যের ন্যায় সে-ও লায়লা বেগমের পাশে বসে রইল বাকিটা সময় ধরে। যেখানে সকলে মশগুল আনন্দ-উল্লাসে, পলক সেখানে সকলের রাতের আনুষ্ঠানিকতায় ডিনারে বিরিয়ানি সার্ভ করতে ব্যস্ত। মাঝেমধ্যে টুকটাক প্রশ্নেরও মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। সেসব প্রশ্নের মধ্যে একটা প্রশ্ন তাকে বেশ রাগিয়ে তুলেছিল। ইনিয়েবিনিয়ে লায়লা বেগমের অসুস্থতার খবরের কথা জানতে চেয়ে নন্দিতার বিষয়ে নাক গলায় অতিথিরা বেশ কয়েকজনই। বিষয়টা যেমন পকল’কে রাগিয়ে তুলেছে, তেমনি করে ভাবিয়েও তুলেছে। কারণ নন্দিতার কোমলতা, সৌন্দর্য্যের বাহার নজর কাড়ার মতোই। সে যে এতক্ষণে সকলের নজরে এসে গেছে এ-ও বুঝতে পেরেছে পলক। মনের মধ্যে হঠাৎই বিষাক্ত অনুভূতিরা হানা দিতে শুরু করেছে। মনের চাওয়ার কথা মাথায় তার কিছুই আসছে না। অসাড় হয়ে আসা শরীরকে কোনোমতে টেনেটুনে হেলেদুলে অনুষ্ঠানের কার্যক্রমে সমাপ্তি টানল। অতঃপর সবকিছু গুছিয়ে নিতে নিতে রাত দু’টো বেজে গেল। সায়মা নিজ রুমে ততক্ষণে অবস্থান করেছে। একতলা পাকা দালান হলে কী হবে, ভেতরে বেশ জায়গা জুড়েই বাড়িটা তৈরি করা। তাই অনুষ্ঠানে উপলক্ষে আগত মেহমানের জন্য রাখা বরাদ্দ রুম যথেষ্ট হলো। আর এমনিতেও পলকের পরিবারের বেশি কেউ আত্মীয়-স্বজন আসেনি। পলক সকল কার্যক্রম শেষ করে মা’য়ের রুমে পা বাড়িয়ে দেখতে পায়, নন্দিতার ঢুলুঢুলু অবস্থা। সোফায় বসে ঝিমুচ্ছে। হঠাৎই পলকের পুরুষালি শক্ত কণ্ঠে ঘুম পুরো উবে গেল।

“তোমাকে অনেক কষ্ট দিলাম। আম্মু তো ঘুমিয়েই পড়েছিল, তুমি না-হয় চলে যেতে।”

নন্দিতার নীলাক্ষি রক্তাভ হয়ে আছে না ঘুমানোর ফলে। ঘুমা জড়ানো কণ্ঠে শুধু বলল,

“না, না ঠিক আছে। আমাকে যতটুকু করেছেন, তারচেয়ে এত কিছুই না।”

নন্দিতার ঘুমু কণ্ঠে ঘোরলাগা অবস্থা পলকের। কিন্তু সময় এখন অন্যরকম। তাই নন্দিতাকে আদেশ স্বরূপ বলল,

“তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। এখন আম্মু সম্ভবত ব্যাটার ফিল করছে।”

মাথা নেড়ে নিজের রুমের দিকে প্রস্থান করল নন্দিতা। পলক-ও মা’য়ের রুমের দরজা ভেজিয়ে নিজ রুমের দিকে পা দিলো।
_______

পার্লারে গিয়েছে বধূর সাজে সজ্জিত হতে সায়মা। সাথে গিয়েছে তার বান্ধবীরা ও ফারজানা। পলক আগের মতো এবারও সবকিছুর তদারকি করছে, তবে নতুন তদারকি হিসেবে জয়েন দিয়েছে চাচারা। লায়লা বেগম একটু আধটু ফোঁস ফোঁস করছেন। তার ভাষ্যমতে হলো, এতদিন করেনি কোনো কাজে সাহায্য, এখন দাওয়াত খেতে এসেছে তাহলে খেয়ে চলে যাবে। কাজে কেন আলগা দরদ দেখাতে হাত লাগাচ্ছে এখন? পলক আপাতত চুপ করিয়ে রেখেছে কোনোরকমে। করছে যেহেতু করুক না, বিয়ে বাড়িতে ঝামেলা করার কোনো মানেই হয় না। এতকিছুর মাঝেও পলকের মন অন্যকাউকে খোঁজছে খুব করে, হয়তো নতুন আলোয় নতুন রূপে দেখার আকাঙ্ক্ষা জেগেছে মনে। কথায় আছে, নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি তীব্র আকর্ষণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। পলকের ক্ষেত্রেও আর সাধারণের মতোই অবস্থা। নন্দিতাকে আজ দেখা যাচ্ছে না বেশ একটা। সে তো আর জানে না, গতকালের কথোপকথন লায়লা বেগমের হালকা ঘুমের মাঝেও স্পষ্টত শোনা গিয়েছে। যতোই সাহায্য করুক নন্দিতা, কিন্তু ছেলের মনকে তিনি বুঝেন। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি ছেলের আগ্রহ তাঁকে ক্রমশই ভীত করে তুলেছে। এজন্যই আজ কটুবাক্য বলতে বাধ্য হয়েছেন। এইতো কিছুক্ষণ আগেই বলে দিয়েছেন, আজ আত্মীয়স্বজনে ঘরদোর ভর্তি থাকবে। তাই তাকে বাইরে বের হতে না। এমনিতেই নাকি কাল নন্দিতার পরিচয় দিতে দিতে হাঁপিয়ে গিয়ে অসুস্থ হয়ে মেয়ের গায়ে হলুদে উপস্থিত থাকতে পারেননি। কারণ সকলে যদি জানত, নন্দিতা ধর্ষিত; উপরন্তু ধর্ষিত মেয়ে তাদের ঘরে আশ্রিত তাহলে নিজের মেয়ের বিয়েটা পণ্ড হয়ে যেত। কী থেকে তখন কী হতে ভেবেই তো অসুস্থ হলেন তিনি। তারচেয়ে ভাইয়ের মেয়ে বলে চালিয়ে দেওয়াই সঠিক মনে করেছেন। লায়লা বেগমের সকল কথা উপলব্ধি করে নন্দিতা নিজেকেই দোষী ভেবে তাঁকে আশ্বস্ত দিলো, আজ সে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাবে না। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে, সে অসুস্থবোধ করছে। সে কেউ-টা যে পরে পলক হবে তা ছিল নন্দিতার কল্পনারও বাইরে। উৎকন্ঠা হয়ে অপেক্ষার প্রহর গোনার পরেও যখন অনেক চাওয়ার প্রতীক্ষার ফলাফল হয় শূন্য, তখন মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারাগুলো হয় রাগান্বিত। সকল কাজ ছেড়েছুঁড়ে ধপাধপ পা ফেলে এগিয়ে যায় নন্দিতার দরজার কড়া নাড়তে। কিন্তু পরাস্ত সৈনিকের মতো ফিরে আসতে হয়, মা’য়ের ডাকে। যতই হোক বিয়ে বাড়ি বলে জাম রঙের থ্রি-পিস পরে নন্দিতা। হলুদ-সাদা গায়ের মধ্যে নির্মলতা ছড়িয়ে উজ্জ্বলতা দেখা যাচ্ছে। নিজের রুমের জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখছে সে। যদি-ও তার রুম থেকে উঠান নয়, বরং বাড়ির পেছনটা দেখা যায়; সে আপাতত সেটাই দেখছে। কারো পায়ের শব্দ নিজ রুমের দিকে শুনেছিল, কিন্তু পরে লায়লা বেগমের পলক’কে ডাকায় বুঝতে পেরেছিল; পলক যে তাকেই ডাকতে এসেছিল। এখন সে আরো সতর্ক হয়ে গেছে, এখান থেকে দ্রুততম চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কারণ একে তো সে মেয়ে উপরন্তু এতকিছুর ঘটার পরে তার বোঝ ক্ষমতাও হয়েছে, ছেলেদের মনোভাব অনুভব করার। লায়লা বেগম-ও যে কিছু আভাস করতে পেরেছেন, সেটা তাঁর মুখ দেখেই নন্দিতা আঁচ করতে পেরেছে। তাই জেনে-বুঝে তার অন্ধকার জীবনে পলকের জন্য দ্বার উন্মুক্ত রাখা অনুচিত। নিজের মনকে আরো শক্ত করতে হবে, ক্ষনিকের আবেগে ভেসে জীবনে বিপর্যয় একবার ঘটার পরেও দ্বিতীয়বারের জন্য মরন ছাড়া আরকিছু বাকি নেই।

“জীবন একটাই,
ভালোবাসা বেহিসাব নয়,
এক জীবনে, ভালোবাসা একবার’ই হয়।”
_______

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here