নিষ্কলুষচিত্ত তুমি |১০|

নিষ্কলুষচিত্ত তুমি |১০|
লেখা : মান্নাত মিম

নন্দিতা চোখ মেলে আকাশের পানে তাকাল। সাদা পুঞ্জীভূত মেঘের ভেলা আকাশে ওড়ে চলেছে। স্নিগ্ধ এক ভোর, সারারাতের ক্লান্তির আবেশে সে যেন মূর্ছিত হলো না। উলটো ছাদের রেলিং ধরে প্রাণভরে নিশ্বাসে টেনে নিলো ভোরের ঠান্ডা বাতাসকে। আর সেই স্নিগ্ধ সকালকে উপভোগ করা লালিত্যপূর্ণ মেয়েটাকে একদৃষ্টিতে দেখতে লাগল পলক। এরমধ্যে ফারজানা এগিয়ে এসে সহমর্মিতা পূর্বক তার কাঁধে হাত রেখে স্বানুভাব দেখাল। মুচকি হেসে নন্দিতা বলল,

“আমি এখন সয়ে গেছি। মন খারাপ হয় না আর এসবে। শুধু খারাপ লাগে এতটুকুই, দেশে এখনো মেয়েরা নিরাপদ নয়। প্রিয়জন-স্বজন কিংবা অপরিচিত জন দ্বারাও হয়রানির শিকার হচ্ছে তারা প্রতিনিয়তই।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল কথাটা বলে। বুকের ভেতরে জমে থাকা কষ্টগুলো একটু নিষ্পত্তি পেল বোধহয়। পলকের ফোনে কল এলো, পুলিশ জানাল রিফাতের নামে ধর্ষণের মামলা দায়ের করার জন্য ভিক্টিমকে সাথে নিয়ে যেতে হবে। তাহলে বিষয়ের তদন্তের খুঁটিনাটি সম্পর্কে পুলিশ ভালো ধারণা করতে পারবে। কিন্তু নন্দিতা এসব মামলায় জড়াতে চাইছে না। সুযোগে ফারজানা-ও পলক ও তার পরিবারের এতে ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নন্দিতার কানে তুলে ধরছে। পলক শেষে বলিষ্ঠ কণ্ঠে দেয় এক ধমক।

“দু’জনই বোকার মতো কথা বলছ। নারী হয়ে এমন চিন্তাধারা পোষণ করো কেন তোমরা? আরো ভাবো, তোমাদের দেখে কত নারী পদক্ষেপ নিবে ধর্ষণের বিরুদ্ধে।”

শেষমেশ নন্দিতাকে কোনমতে রাজি করানো গেলেও ফারজানার চেহারা ছিল দেখার মতো। তার মন ভাষ্যমতে, অন্যকিছুই বলছে বা আভাস করছে। সেজন্যই যতোটা সম্ভব নন্দিতাকে এখান থেকে সরাতে চাচ্ছে। কিন্তু নাহ, পলক যেন নন্দিতাকে ন্যায় দিয়েই ছাড়বে। মন-মেজাজের বিক্ষিপ্ত অবস্থা নিয়ে নিচে নেমে এলো ফারজানা। ছাদে দু’টো প্রাণী রয়ে গেলো। বুক চিঁড়ে খুব সন্তর্পণে বেদনাপূর্ণ কাতর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো পলকের। এরইমধ্যে নন্দিতা যা বলল তাতে পলকের মনে স্থবিরতা, জীর্ণতা, শিথিলতা জেঁকে বসে। বিস্ময়কর নয়নে পূর্ণ দৃষ্টি নন্দিতার দিকেই বর্তায় সে।

“জানেন, কাইয়ূম’কে একসময় আমার ভালো লাগত, হয়তো ভালোও বাসতাম।”

বলেই পেছন ফিরে পলকের স্থবির হওয়া অবিশ্বাসী চোখের দিকে তাকাল নন্দিতা। ছেলেটা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যেন চোখের কোণ ঘেঁষে জল ছাড়ল খেয়ালই করল না। নন্দিতা সেটা দেখেও কিছু না বলে তার বাকি কথাগুলো চালিয়ে গেল। এখন আর আবেগে গা ভাসাতে ইচ্ছে হয় না তার। সব ভালোলাগারা মনের মৃত্যুর সাথে সমাধিতে স্থান করে নিয়েছে।

“কথাটা শুনেছেন বোধহয়, নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ হওয়ার প্রবণতা বেশি। আমার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই ঘটেছে। দ্বিতীয় বর্ষে কাইয়ূমের প্রেম নিবেদন আমাকে ভাবাতে বাধ্য করেছে, বাধ্য করেছে তার বাহ্যিক সৌন্দর্য এবং দাম্ভিকপূর্ণ কথাবার্তা পছন্দ করার জন্য। কিন্তু সেটা বলার আগেই নিশির সাথে করা আচরণ আমাকে ক্ষেপিয়ে তুলে তাকে সেই কথাগুলো বলতে, যা পরবর্তীকালে আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।”

এখনও পলকের দৃষ্টি জলে ভেজা। ছেলেদের নাকি কাঁদতে নিষেধ। তারা কি কোনো মূর্তি নাকি যে কাঁদা যাবে না? তাদের মন রয়েছে, রয়েছে অনুভূতি। সেই অনুভূতিগুলোই আজ পলকের চোখ দুু’টোকে অশ্রুতে সিক্ত করল। সেদিকে দ্বিতীয়বার তাকানোটা তার ভুল ছিল। তাই ভুল শোধরে নিয়ে কঠিন শব্দজালে প্রবিষ্ট করল পলক’কে।

“জীবন একটাই,
ভালোবাসা বেহিসাব নয়,
এক জীবনে, ভালোবাসা একবার’ই হয়।”

বলে থামল এই আশায় হয়তো পলক তাকে কিছু বলবে। কিন্তু নাহ, অপরপক্ষ থেকে কোনো উঁচুনিচু বাক্য বের তো হলোই না, উলটো ব্যক্তিটির একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা তাকে এবার অস্বস্তিকর পীড়া প্রদান করতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। এবার অপর পাশের রেলিংয়ে ঠেসে দাঁড়িয়ে থাকা পলকের দিকে নিচু হয়ে থাকা মুখ উঁচু করে বড়ো বড়ো পাপড়িযুক্ত চোখে পিটপিট তাকিয়ে বলল,

“একটা কবিতা শুনবেন?”

পলকের উত্তরের অপেক্ষা না করে আবার বলল,

“আচ্ছা শোনেন,

এই হারানো মহলে,
আমায় খোঁজ না ঘুরে-ফিরে,
তীরে এসে তরী হারিয়েছি নিজের’ই খামখেয়ালে।

তুমি খোঁজ না-কো রাতের গভীরে,
আমি হারিয়েছি চাঁদের আঁধারে।
ডুবেছি সমুদ্রের অতলে,
মরেছি যে ভালোবাসার-ই বিশ্বাসে।”

– মান্নাত মিম

কবিতা শেষে নন্দিতা দেখতে পেলো, এক অবাক করা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছে পলক। এতক্ষণের আলাপে এই প্রথম মুখ খুলল পলক,

“বাহ, তুমি তো ভালো কবিতা আবৃত্তি করতে পারো।”

প্রসংশাটা গায়ে না মেখে উলটো প্রশ্ন করল সে পলক’কে,

“কবিতার কথাগুলো কেমন লাগল?”

মাথা নেড়ে ঝুঁকে চোখ মুছার ভঙ্গিতে মুচকি হাসি দিয়ে পলক বলল,

“এক ধাক্কায় তোমাকে বড়ো করে তুলেছে দেখি।”

পলকের ঠোঁটের কোণের সেই হাসিটা ছিল মোহাবিষ্ট করে দেওয়ার মতো। কিন্তু নন্দিতা নিজের জায়গায় দৃঢ়, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

“জীবনটাকে বা তাকে ঘিরে থাকা মানুষগুলো চেনার জন্য মাঝেমধ্যে একটা বড়ো ধাক্কা’ই যথেষ্ট।”

স্মিত হেসে সম্মতি সূচক মাথা নেড়ে নন্দিতাকে নিচে যাওয়ার জন্য বললে, নন্দিতা এখন নিচে যাবে না বলে মানা করে দেয়। আরো বেশ কিছুটা সময় কাটাবে ছাদে বলে সেখানে রয়ে যায়। আর পলক তাকে কিছুটা সময় একা কাটানোর জন্য রেখে নিচে চলে যায়। আসলে নন্দিতার ইন্ডাইরেক্টলি না বলাটা পলক বুঝতে পেরেছে বলে, কষ্টগুলোকে নন্দিতাকে না দেখানোর জন্যই নিজেকে আড়াল করার উদ্দেশ্যে ছাদ থেকে সরে যাওয়া। সবাই বলে নিজের মন মতো চলো। অথচ সেখানে মন’ই চলে নিজের মন মতো। নিজের মনের ওপর কারো হাত থাকে না। এই যে যেমন এখন পলকের ক্ষেত্রে সেটা সাদৃশ্য। বিয়ে ঠিক একজনের সঙ্গে, মন পড়ে আছে আরেকজনের কাছে। উপরন্তু পছন্দের মানুষের কাছ থেকেই রিজেক্ট আসে ‘ভালোবাসি’ বলার আগেই। অনুভূতিটা কেমন? একতরফা ভালোবাসার অনুভূতি খুবই কষ্টের, জঘন্যতম।
_____

রিফাতকে তখন পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায়। হ্যারাসম্যান্টের কেসের দায়ের সাথে ধর্ষণের মামলা-ও লিখতে চেয়েছিল পলক। কিন্তু রিফাত এবং তার বাকি সাথি’রা খুব বিত্তবান, পাওয়ারফুল। তাদের মাথার ওপর বড়ো বড়ো নেতারা রয়েছে, যারফলে ছাড়া পেতে সময় লাগবে না। এসব আলোচনা করে পুলিশ সকলের স্বাক্ষী হিসেবে রিফাতকে নিয়ে যায়। মেহমানরা-ও একে একে সকলে বিদায় নেয়। আর সায়মা ও তার স্বামী আশফাক’কে আড়ম্বর ছাড়া কোনমতে বিদায় দেয় লায়লা বেগম ও পলক। সেই মারামারি থেকেই লায়লা বেগমের প্রেশার ওঠে রয়েছে। এতে তাঁর মাথা ঘুরে যায়, তখন তাঁকে ডাক্তার দেখালে পুরোপুরি বেড রেস্টে থাকতে বলা হয়। পলকের সাথে সেই তখন থেকেই কথা বলেন না তিনি। এতে পলক মনে মনে খুব কষ্ট পায়। পলক যেন নিরুপায় হয়ে গেল। কাউকে ভালো না বাসলে কীভাবে তার সঙ্গে সারাজীবন কাটিয়ে দেবে সে? বিষয়টাকে মা’কে বুঝাতে হবে কিন্তু তিনি কোনো কথাই তো বলছেন না। মন খারাপ করে পলক সোফায় আছে। এরইমধ্যে ফারজানাকে দেখল তার মা’র রুম থেকে বেরিয়ে আসতে।

“কী অবস্থা এখন?”

পলকের পাশে বসতে বসতে ফারজানার জবাব,

“ভালোই, ঘুমাচ্ছে এখনো। শরীর বেশ দূর্বল।”

“হুম, ডাক্তার তো তা-ই বলল।”

পলকের কথায় ফারজানা-ও সায় জানিয়ে তার হাতের ওপর হাত রেখে ভরসা বাণী দিলো। পলক নানান চিন্তা-ভাবনায় থাকায় অতোটা গা করল না হাত রাখার বিষয়টা। নাহলে অন্যসময় দেখা যেত হাত ঝেরে সরিয়ে দিতো। এখন সেটা ফারজানার কাছে দুঃসাহসিক কাজ ঠেকলেও তার মনে চলছে অন্যকথা। পলক’কে নিজের করে পাওয়ার আকুলতা। সায়মার বিয়ের জন্য অপেক্ষা করেছিল এতদিন, এখন আর একমুহূর্তের জন্যও অপেক্ষা নামক বস্তুটাকে সহ্য হচ্ছে না। সারাক্ষণ ভয়েরা তাড়া করে বেড়ায় এই বলে যে, পলক’কে তোমার কাছ থেকে কেউ ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। একদিন ফারজানা সেটা খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে, পলক যে নন্দিতার প্রতি উইক। বিষয়টা এখন আরো বেশি তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। এমন সময় সিঁড়ি বেয়ে ওপর থেকে নন্দিতাকে নিচে নামতে দেখল সে। চট করে মাথায় কিছু খেলে গেল। খুব ধীরগতিতে পলকের কাঁধে নিজের মাথাটা রাখল, যেটার আলাপ-ও পেল না পলক। কারণ পুরোপুরি মাথার ভর সে পলকের কাঁধে রাখেনি, আলগাভাবে রয়েছে। ওপর থেকে নামতে নামতেই ফারজানা ও পলক জুটিদের দেখে স্মিত হাসি দিয়ে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

“মেইড ফর ইচ আদার।”

পলক তার ঝুঁকে থাকা মস্তকের সম্মুখে কারো পা দেখলেও কণ্ঠ শোনে বুঝল নন্দিতার অস্তিত্বকে। কিন্তু কথাটা কী বলল? পরে খেয়াল হলো নিজের দু’হাতের মাঝে ফারজানার অবস্থান, পাশে ফিরলে দেখা যায় ফারজানার ললাটে পলকের ওষ্ঠ ছুঁয়ে যায়৷ আর ফারজানা সাহস বেড়ে দ্বিগুণ না হলে একইভাবে পড়ে রয় না পলকের কাঁধে। কিন্তু পলক তো সেটা সহ্য করবে না। বিয়ের আগেই এত ঘনিষ্ঠতা তার পছন্দনীয় নয়। তড়িৎ গতিতে সরে ওঠে দাঁড়িয়ে বলে,

“আমি সকালের নাস্তা নিয়ে আসি বাইরে থেকে।”

কিন্তু তার মুহূর্তে চলে যাওয়া রোধ করে ফারজানা পূর্ণ অধিকারে পলকের হাত ধরে।

“কালকের অনুষ্ঠানেরই তো কতো খাবার-দাবার রয়ে গেছে। সেগুলো দিয়েই তো নাস্তা করা যাবে।”

তন্মধ্যে নন্দিতা মিহি কণ্ঠে ঈষৎ বলে ওঠে,

“সকালে হালকা খাবার’ই ভালো। এমনিতেই গতকালের খাবার-দাবার ভারি ছিল।”

বোকার হদ্দ অধিকার ফলাও করতে গিয়েও ডাক্তর হওয়া স্বত্বেও বুঝলা না বিষয়টা। যেটা দু’বাক্যে নন্দিতা বুঝিয়ে দিলো। এদিকে পলকের নজর নন্দিতার দিকে নিক্ষেপ করা। সেটা বুঝতে পেরে আলগোছে সরে গেল নন্দিতা। ফারজানা কিছু বলবে পলক-ও পগারপার। মাঝে খালি ড্রয়িংরুমে একা সে অত্যন্ত রাগান্বিত, ক্রোধপূর্ণ হয়ে ভয়ংকর পরিকল্পনায় ব্যস্ত হয়ে শুধু হিসহিসিয়ে এতটুকুই বলল,

“ভালোবাসা আমাকে নিচুস্তরে নামিয়ে দিলো অবশেষে। দুঃখিত নন্দিতা।”

_______

বেশ কয়েকদিন পর…

“কিহ্!”

ফোনের অপরপাশের বক্তব্য শোনে পলকের মেজাজ বিগড়ে গেল। তবে সে এমনকিছুই আভাস পাচ্ছিল। তাই বলে এত দ্রুতই যা ভাবনার-ও বাইরে ছিল। কিন্তু ফোনের শোনা পুলিশের বক্তব্য নন্দিতার কাছে গিয়ে ব্যক্ত করলে সে মুচকি হেসে বলে,

“যে ন্যায় পেতে হলে আরো নিষ্পাপ জীবনের বলি দিতে হবে, সেই ন্যায় তখন পাওয়া অন্যায় হয়ে দাঁড়ায়।”

পলকের আর বুঝতে বাকি রইল না কাজটা যে নন্দিতার ছিল। এদিকে পলক রাগে-দুঃখে মিশ্র অনুভূতিতে জব্দ। এত কষ্টের ফল মেয়েটা বিফলে ফালালো। এই প্রথম তাকে এত রাগতে দেখা গেল। শেষে রাগকে সংবরণ করতে না পেরে সেটা ফলাও করল নন্দিতার ঠোঁট’কে ক্ষত করে। কিন্তু নন্দিতা টুঁশব্দ-ও করল না। ভালোবাসাটুকু একান্ত সংগোপনে নিজের করে রাখতে আগলে ধরল পলক’কে। এই শেষ ছোঁয়াটুকু নিয়েই সে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। মুখের ওপর অশ্রুপাত হতে দেখে চোখ খুলল পলক সেই অবস্থাতেই। জিহ্বায় রক্তের নোনতা স্বাদ পাওয়ায় বুঝল নন্দিতার অশ্রুসিক্ত ভেজা পাপড়ির কারণ। তখন ভালোবাসার অগভীরতা বেশ গভীরে প্রবেশ করল মসৃণতার সহিত অধরসুধা পানে ব্যস্ত দু’জন। দু’জন হুঁশ হারিয়ে বেশ সময় নিয়ে ভালোবাসল একে-অপরকে। চাওয়া-পাওয়ার শেষ কখনো থাকে না। কিন্তু সময়ের শেষ রয়ে যায়। তাকে ধরে রাখা যায় না, ধরে রাখা গেলে আজ নিজ অবস্থান সকলে’ই পরিবর্তন করতে পারত। তেমনই নন্দিতা আর পলকের ভালোবাসবাসির খানিকক্ষণ শেষ হয়ে এলো। নিশ্চুপ অবস্থায় পলক সরে আসে নন্দিতার তরফ থেকে। মাথা নত করে রাখে নন্দিতা। উঁচু করার সাহস যে নেই তার। আর না স্বপ্ন পুরুষটার চোখে চোখ রাখার। কিন্তু অপলকভাবে তাকিয়ে থাকে পলক তার দিকে। যেন প্রেয়সীকে শেষ দেখাই এটা। তার মন বলছে, নন্দিতা তার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশের ভালোবাসা, আর হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা-ও। ঠোঁট টকটকে লাল হয়ে স্ফীত হয়ে আছে, সাথে জখমিও। বোঝাই যাচ্ছে যে, তার ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। এগিয়ে গিয়ে থুঁতনিতে হাত রেখে নন্দিতার মুখটা উঁচু করে ধরল। নন্দিতা কেঁপে কেঁপে ওঠছে, কান্নারত যে এখনো। তবে উঁচু করা মুখে চোখ দু’টো বন্ধ হয়ে পাপড়িগুলো একে-অপরের সাথে লেপটে আছে। পলক নিজের অধরযুগল ছোঁয়াল সেই অশ্রুসিক্ত চোখে, যারা তাকে ভালোবেসে ঝরছে অবধারিতভাবে। বেশ সময় নিয়ে ফের ওষ্ঠের স্পর্শ করল সে নন্দিতার ললাটে। সেখানেও বেয় সময় ধরে নিজেকে ধরে রাখল। একসময় নিজেও অশ্রু বিসর্জন শুরু করে দিলো। সেটা দেখে নন্দিতা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ঝাপটে শক্ত করে আলিঙ্গনে নিলো পলক’কে। হায় বিধির কী খেলা! অসহায় কেন এত ভালোবাসা’রা? কিন্তু সব ভালোবাসা অসহায় হয় না, হারায়-ও না। শুধু তাদের মতো নিষিদ্ধ ভালোবাসাগুলোর মধ্যে না বোধক সিল লাগা থাকে। সেগুলোই অসহায় হয়।
________

সেদিন প্ল্যান মোতাবেক ফারজানা হাজতে অবস্থানরত রিফাতের কাছ থেকে কাইয়ূম খানের নম্বর সংগ্রহ করে। সেখান থেকে কাইয়ূম’কে সম্পূর্ণ ঘটনা খোলে বলে। কাইয়ূম তখন বলে,

“আপনাকে আমি কীভাবে বিশ্বাস করব? আপনিও তো আমার বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করতে ফোনটা করে থাকতে পারেন।”

বিশ্বাসী গলায় আশ্বাস দিয়ে ফারজানা বলে,

“পারি। তবে আপনি চাইলে রিফাতের সাথে কথা বলে দেখতে পারেন, আমি সত্য নাকি মিথ্যা বলছি। আর আরেকটা কথা, দু-এক দিন অপেক্ষা করলেই বুঝতে পারবেন সত্য নাকি মিথ্যা বলছি। তখন আবার জেলের ভেতর থাকবেন কি না।”

ফারজানার শেষোক্তিতে তাচ্ছিল্যের আভাস পেলে কাইয়ূম। বিচক্ষণতার সাথে বিচার বিশ্লেষণ করল, মেয়েটাকে বিশ্বাস করা যায় কি না। অতঃপর ফারজানার এতে কী ফায়দা প্রশ্ন করলে, ফারজানা বলে,

“আমার পলক’কে নিজের করে পেতেই আপনার শরণাগত।”

“ও, পলক! এই ছেলেটাই না সে যে, নন্দিতাকে ন্যায় দিতে ওঠে পড়ে লেগেছে। ছেলেটাকে গোড়া থেকেই সরিয়ে দিলে ঝামেলা শেষ।”

এরইমধ্যে হুংকার দিয়ে গর্জিয়ে ওঠে ফারজানা।

“আমার পলক’কে ছোঁয়ার চেষ্টা করবি না। নাহলে তোর অস্তিত্ব পৃথিবীতে থাকবে না।”

“আরিব্বাহ্! বাঘিনী, আই লাইক ইট। যাও তোমার পলক’কে ছেড়ে দিলাম। তবে বিষয়টা আমার মতো হ্যান্ডেল করব।”

“যেভাবেই হোক, তবে আমার পলকের যেন কোনো ক্ষতি না হয়।”

বলেই ফোন কেটে রেখে দিলো ফারজানা। অপরপাশে কাইয়ূম চিন্তায় পড়ল নন্দিতার পাখা গজানোর বিষয়ে। কিছু একটা ভেবে কুটিল হাসি ফোটল তার মুখে।
_______

অফিস থেকে বারবার লায়লা বেগমের ফোনে অনবরত কল আসছে। তিনি আবার রান্নাঘরে ছিলেন। নন্দিতা আবার পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় খোলা দরজা থেকে মিহি সুরের রিংটোন শুনতে পেল। কয়েক পল ভাবল ধরবে কি না৷ রান্নাঘর থেকে লায়লা বেগমের সাথে ফারজানার হাসির কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। সায়মা যাবার পর থেকে নাকি ঘরদোর খালি খালি লাগছে। তাই হরহামেশাই ফারজানা’কে ডেকে এনে গাল-গপ্পে মেতে ওঠেন লায়লা বেগম। নন্দিতা-ও আছে বাড়িতে, কিন্তু সে য়ে একটা প্রাণ সেটা বোধহয় ভুলেই গেছেন লায়লা বেগম। আর মন খারাপ করেও লাভ নেই, ক’দিন পরে ফারজানা’ই হবে বাড়ির বউ। তখন তার পদচারণা হবে ঘর জুড়ে। সেখানে নন্দিতার মন খারাপের কারণটা বেশ তুচ্ছতম। এদিকে অনবরত ফোন বেজেই চলেছে। তাই সে ভাবল জরুরি কল হতে পারে দেখে সেটা এতক্ষণ ধরে বাজছে। এগিয়ে গেল রুমের ভেতরে, বালিশের নিচে হাত রেখে ফোনটা তুলে কল রিসিভ করল। অতঃপর বোমা বিস্ফোরণের মতো করে কানে ওপর পাশের ব্যক্তির শব্দগুচ্ছ তারউপর পতিত হলো নিজেকে কেমন যেন ভারহীন, হালকা লাগছে। এই বুঝি শূন্য থেকে মাটিতে ঝরে পড়বে। পলকের এক্সিডেন্ট তার কাছে নিজের মৃত্যুর মতো মনে হলো। এমনটা কেন? কীসের এত দায় তার প্রতি? সাধারণ জীবন বাঁচিয়েছে বলেই কি তার এক্সিডেন্ট নিজের মৃত্যুসম মনে হওয়ার কথা? সকল ভাবনাগুলো একপাশে রাখতে হলো, ফোনের অপরপাশের ব্যক্তির অবিরত ‘হ্যালো, হ্যালো’ করা শব্দে। সম্বিত ফিরে পেলে একছুটে দৌড়ে রান্নাঘরে লায়লা বেগম’কে খবরটা পৌঁছে দেয় নন্দিতা। সেখানে তাদের কাছেও বিষয়টা বড়ো ধরনের বিস্ফোরণ ঘটায়। সকলের পছন্দের পাত্র পলকের সাথে হওয়া হঠাৎ এক্সিডেন্ট কারোই কাম্য নয়। তাই কুটিল বুদ্ধিধারী ফারজানার মনে অন্যকিছুই ঘুরছে এ-সময়েও। বর্তমানে সবকিছু ছাপিয়ে সবাই চলল পলকের কাছে নন্দিতার-ও খুব ইচ্ছে পলক’কে একবার দেখে চক্ষুদ্বয়কে শান্তি দেওয়ার। কিন্তু লজ্জা-শরমের ভয়ে সেটা প্রকাশ করতে পারল না। আর তারা-ও তাকে নিয়ে গেল না সাথে করে। সেটা কি এখন ইচ্ছে করেই নাকি তাড়াহুড়োয়? তবে লায়লা বেগমের তাড়াহুড়ো হলেও ফারজানা না দেখার ভান করে তাকে নিয়ে হসপিটালে চলে যায় নন্দিতাকে একা ফেলে। সেটা অবশ্য নন্দিতার বোধগম্য হয়নি। কারণ সে তো চিন্তিত পলকের দুর্ঘটনা হওয়ার চিন্তায়।

সরকারি হসপিটালের সারি সারি বেডের কর্ণারের এক বেডে বসা পলক। বেশিকিছু হয়নি শুধু একটু হাত-পা কেটে গেছে, আর মাথাতে আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে। বাঁচতে বাঁচতে আজ বেঁচে গেছে গাড়িটা ধাক্কা দেওয়ার আগেই সরে গেছে সে। তবে পড়ে গিয়ে হাত-পা-মাথা জখম হয়েছে। লায়লা বেগমের সাথে ফারজানাকে দেখলেও তার নজর খুঁজছে অন্য কাউকেই। কিন্তু ফলাফল শূন্য কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটি আসেনি। মন খারাপ করে লায়লা বেগমের সাথে শুধু হা হু জাতীয় শব্দ করছে। এদিকে সে-সব খুব ভালোভাবে অবলোকন করেছে ফারজানা। মনে মনে সে বেশ রুষ্ট হলো পলকের প্রতি আর নন্দিতাকে তো পারলে নিজ হাতে খুন করে। ফারজানা ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানল পলক’কে নিয়ে যাওয়া যাবে আজই।
_______

ঘুমন্ত পলকের মুখ, হাত ছুঁয়ে দেখছে নন্দিতা। ঠোঁট কামড়ে রেখেছে কান্না থামানোর জন্য। কান্নার শব্দে না যেন পলক জেগে যায়, আর না তাকে দেখে ফেল। এমনই পলক তার প্রতি দূর্বল। সেটা আরো বাড়িয়ে দহনের মতো জ্বালা সে পলক’কে দিতে চায় না। হসপিটালে তাকে যখন লায়লা বেগম দেখতে যান। তখন নন্দিতার কাছে ফোন আসে কাইয়ূমের। ফোনটা সায়মার, স্বামী বাড়ি যাওয়ার সময় সে নন্দিতাকে ফোনটা দিয়ে গেছে মাঝেমধ্যে তার সাথে কথা বলার জন্য। ফোনে কাইয়ূমের কথোপকথন ছিলো,

“পলকের অবস্থা কেমন এখন?”

গলারস্বর চিনতে নন্দিতার বিন্দুমাত্র ভুল হয়নি, আজীবন মনে রাখার মতো এই কণ্ঠস্বর সে ভুলবে কীভাবে? এমন সময় আবারো সেই কণ্ঠে বলা কথা,

“ওহ্হ, আফসোস বাড়িতে মনে হয় তুমি একা, না?”

ভয়ে নাকি ভাবনার কারণে নন্দিতা চুপ করে রইল। তবে কেঁপে কেঁপে ওঠছে তার শরীর, অবশ্য লক্ষ্মণ ভয়েরই। এর কারণ সে যে বাড়িতে একা সেটা কাইয়ূম জানল কীভাবে? ভাবতেও সময় দিতে পছন্দ হলো না বোধহয় কাইয়ূমের। তাই ফোনের মাঝেই হুমকি দিয়ে ধমকাতে শুরু করল,

“এখন তো বেঁচে ফিরেছে, হাত-পা-মাথাসহ। সামনে যদি বড়ো একটা ট্রাক কিংবা ট্রেনের নিচে পলকের শরীরটা চাপা পড়ে, তখন কি শরীরের প্রতিটি অংশগুলো নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবে? আমার কথাগুলো হালকাভাবে নিবে না, জানোই তো আমি কী কী করতে পারি।”

কথাগুলো বলেই ফট করে ফোন কেটে দিলো কাইয়ূম খান। নন্দিতার উত্তরের আশায় রইল না। এদিকে নন্দিতা তার বলা কথাগুলোই কল্পনায়ও আনতে পারছে না। ফোন রেখে দু’হাতে মুখ চেপে ডুকরে কেঁদে ওঠছে।

বাসায় ফেরা পর থেকেই পলক কেমন যেন চুপচাপ হয়ে নিজের রুমে পড়ে রইল। লায়লা বেগম ওষুধ খাইয়ে দিয়ে চলে যায়। ফারজানা-ও বেশি রাত পর্যন্ত থাকেনি। এখন মাঝরাতে একটা যুবক ছেলের ঘরে নন্দিতার মতো যুবতীক দেখা বেশ কেলেঙ্কারি ব্যাপার। যদি-ও সারা বাড়িতে মাত্র তিনটা প্রাণী, তাই বাড়িটা কেমন নিরব, নিস্তব্ধ, ভুতুড়ে ধরনের লাগছে। কিন্তু নন্দিতার কেবল প্রেম প্রেম পাচ্ছে। তার কারণ হলো পলকের মতো নির্মল, পরোপকারী, সত্যবাদী ব্যক্তিত্বের প্রেমে পার গেছে। কী করবে সে? মন তো তার কথা শোনে না। আর মেয়েদের মন এমনই পুরুষের সান্নিধ্য পেতে চায় বারংবার। সেখানে যদি সে জানে পুরুষটা তার’ই অপেক্ষারত, তাহলে তো আর কথাই নেই। তবে সেটা মন’ই মনে তালা দিয়ে সে আবদ্ধ করে রাখবে। নাহলে সেটার প্রকাশ অনেকের কষ্টের কারণ হবে যে। ওষুধের কড়া ডোজের কারণে ঘুমে অচেতন অবস্থা পলকের। তবুও নন্দিতার দু-চোখ বেয়ে পড়া অশ্রু তার গভীর ঘুমকে-ও হালকা করতে সক্ষম হলো। আধোঘুমে চোখ মেলে ভালোবাসার প্রেয়সীকে সম্মুখ অবনত মুখে তার হাত-মুখ ছুঁয়ে দেখতে বলে ওঠে,

“ছুঁবে না আমায় তুমি। তখন কেন এলে না? কত খুঁজেছি তোমায় জানো অথচ আম্মুর সাথে তোমাকে দেখতে পাইনি।”

হঠাৎই পলকের জেগে যাওয়ার ঘটনায় নন্দিতা আঁতকে ওঠে আতংকে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজে সামলে নেয়। কারণ পলক ঘুমের ঘুরে কথা বলছে। পুরোপুরি ঘুম ভাঙেনি। তাই সে-ও তাল মিলিয়ে পলক’কে বলল,

“এই যে এখন একান্তে দেখব বলেই তো তখন যাইনি তাদের সাথে। কেন এখন আমাকে দেখে ভালো লাগছে না?”

পলকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কথাগুলো বলে নন্দিতা। এদিকে তার চোখে নিদ্রারা হানা দিতে শুরু করে মাথায় হাত বুলানোর আরামের কারণে। তবুও ঘুমঘুম চোখে আলতো কে বলল,

“না, না ভালো লাগছে। তুমি থেকে যাও আমার কাছে। তোমাকে ছাড়া সারাক্ষণ বুকটা শূন্য শূন্য লাগে।”

নন্দিতার খালি থাকা হাতটা বুকের বাঁপাশে নিয়ে চেপে ধরে বুঝায়। নন্দিতার চোখ আবারও ভিজে ওঠে। পলকের ঘুমানোর জন্য অপেক্ষা করে। অতঃপর ঘুমিয়ে পড়লে আলগোছে চলে যায় নন্দিতা। পিছন ফিরে পলক’কে একবার দেখার জন্য মনটা বারবার হাঁসফাঁস করে। কিন্তু নাহ, মায়া বাড়ানোর জন্য কোনো পথ খোলা নেই যে। তার জন্য সামনে প্রলয়ঙ্কারী ঝড় অপেক্ষাকৃত।
_______

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here