#নিশুতি_তিথি,পর্ব ২২ শেষ
লেখা : মান্নাত মিম
৫৫.
‘সময় গড়ালে, আপন হারালে
নিভন্ত আগুন, ফের জ্বলালে।’
বিয়ের দিন আলীর হাতে হাত রেখে স্টেজের বর-বউ’য়ের পাশে ছবি তুলতে ব্যস্ত রিমাকে দেখে তুষের আগুনে জ্বলছে সমীর। পরক্ষণেই ঠোঁটের কোণের শয়তানি হাসির জানান দিলো, এই আগুনে কিছুক্ষণ পরে আরেকজন জ্বলবে। দাউদাউ, দাউদাউ করে। হিসেব কষা শেষ, গুটি ছাড়ার পালা।
‘কিছুক্ষণ কাটিয়ে নে সুখের ভেলা চড়ে। পরে ডুবতে হবে না। উপভোগ কর আপাতত।’
চলে যায় সেখান থেকে সমীর।
‘আরে বাবা, সোজা হয়ে দাঁড়াও না। এমন বাচ্চাদের মতো নড়ছ কেন? আজ হলোটা কী তোমার?’
রিমার গরম মেজাজের কথার ভারিক্কিতে আলীর ভেতরকার হাঁসফাঁস বিন্দুমাত্র ছুঁলো না। ভেতরে থাকা অদূর ভাবনারা বলছে, কিছু একটা ঠিক নেই। অঘটনের ঘন্টার নিচে পিষ্ট হতে চলেছে তার সুখপাখি। অশুভ কালো বাদল গ্রাস করে নিলো খানিকের মধ্যে আলোছায়ার দান করা অর্যমাকে। ধ্যান নেই কোথাও আলীর। ভেতরে থাকা অমঙ্গল আভাসে কুটকুট করে খাচ্ছে তাকে। এরমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেল কনভেনশন সেন্টারের জ্বলজ্বল আলোকসজ্জা। সকলের হইচইপূর্ণ অবস্থা আরো বৃদ্ধি পেল। এমন সময় বড়ো টিভিতে আলো জ্বলে উঠল আলীর আর রিমার একসাথে সুন্দর এক ছবি। রিমা সারপ্রাইজ মনে করে খুশির চিৎকার করে আলীর হাত ঝাপটে ধরল। আরো এলো ছবি দুয়েকটা। কিন্তু খুশি বেশিক্ষণ ধরল না মুখশ্রীতে। পরের চিত্রেই ভেসে উঠল আঞ্জুমানের ছবি। যেখানে বিধস্ত আঞ্জুমান বড়ো বাড়ির বাগানের গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। আশেপাশে লোকজনে পরিপূর্ণ। বোঝাই যাচ্ছে যে, এটা বিচারসভা। এতটুকু ধারণা আছে সকলের। ঝামেলাপূর্ণ অবস্থায় আলী ও আঞ্জুমানের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার সাথে বিয়ের খাতায় স্বাক্ষর নেওয়ার দৃশ্যও বাদ রইল না। একের পর এক দৃশ্য টিভির পর্দা চিঁড়ে বেরিয়ে আসতে লাগল। সবচেয়ে সুন্দর দু’টো ছবি ছিল, একই দোলনায় আলীর কোলে বসে আঞ্জুমানের দোল খাওয়া এবং বারান্দার চেয়ারে বসে থাকা ভোরের সূর্য ওঠার দৃশ্য দেখা। আলীর হাত ছেড়ে কখন যে টিভির একেবারে সামনে চলে এলো রিমা খেয়ালই হলো না তার। সর্বশেষ ছবিতে ছিল বারান্দায় রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা আঞ্জুমানকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে রাখা আলীর ছবি। হয়তো এটাই সবচেয়ে সুন্দর ছবি। রিমা এগিয়ে গিয়ে ঝুম করে থাকা আলীর মুখাবয়বে নিজের হাত ছুঁইয়ে দিলো। পাশে থাকা আঞ্জুমানের দিকে তাকালো। অতঃপর দু’জনের নজর কাড়া হাসি দেখে বলে উঠল, কী সুন্দর মানিয়েছে দু’জনকে! চমৎকার হাসি দু’জনের। বোঝাই যাচ্ছে, হ্যাপি কাপল। মেয়েটাও আমার চেয়ে বয়সে ছোটো, সুন্দরী। সেই কোনক্ষণেই কনভেনশন সেন্টারের আলো জ্বলে উঠেছে। কিন্তু সেদিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই রিমার। তার ভাবনাগুলো অকেজো হয়ে গেছে। অপ্রকৃতস্থের মতো দেখা যাচ্ছে তাকে।
৫৬.
অনাহুতের মতো আচমকা আগমন ঘটে আঞ্জুমানের। এই মুহূর্তে আলীর হাত-পা অসাড়তায় বাঁধা পড়েছে। নিবোর্ধের মতো দিক-বেদিক তাকিয়ে বিশ্বাস করতে চেষ্টা চালাচ্ছে, সবকিছু মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার। কাল বিকেলেও সে মেয়েটাকে গ্রামে রেখে এসেছিল ঢাকায়। এমন একটা অবস্থায় একা থাকা নিয়ে কতই না ভয় পেয়েছিল মেয়েটা। শেষে গিয়ে লিমাকে বাড়িতে রেখে আসতে বললে, আলী ঠিক তাই করে। সাথে লিমাকে সাবধান করে দেয় অতিরঞ্জিত কথা না বলতে। একদিন পরেই ফিরে আসবে বলে। কিন্তু ঘটনা কী থেকে কী হয়ে গেল এখনো সে ঠাওর করতে পারছে না। গতকালের হাসি-খুশি মুখরিত পরিবেশ একদিনে পালটে কালো ঝড়ে পরিবর্তন হতে বিন্দুমাত্র মন সায় দিচ্ছে না তার। মূর্তিমান হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, নির্বাকান্বিত চোখে আঞ্জুমানকে টিভির পর্দায় আলী ও তার ছবির দিকে তাকিয়ে দেখতে। যদি-ও অদ্ভুত ঠেকছে না বিষয়টা আঞ্জুমানের কাছে। কারণ সে ভাবছে, আলী যেহেতু এখানে সেহেতু সারপ্রাইজ এটাই সম্ভবত। তাকে তো এটাই বলে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। সমীর লোক পাঠিয়ে এনেছে তাকে, আলী না কি সারপ্রাইজ রেখেছে সেখানে তার জন্য। যদিওবা লিমা গো ধরেছিল, আলী না এসে তাকে নেওয়ার জন্য লোক পাঠাবে কেন প্রশ্ন করে। চতুর লোকগুলো কৌশলতা খাটিয়ে আলীর কণ্ঠস্বরে বলা কতগুলো কথার রেকর্ডিং চালিয়ে দিলো। যা সমীর রেকর্ডিং রেখেছিল আলীর সাথে কথা বলার সময়। অপরিচিতের মতোই কথা বলেছিল, নম্বর সংগ্রহ করেছিল রিমার ফোন থেকে। বিশ্বাস তৈরি করেছিল যে, তারা আলীর ঢাকার অফিসের লোক, সারপ্রাইজ প্ল্যানিং ব্যস্ত আলী আসতে না পেরে তাদের পাঠিয়েছে। নির্বোধ, মূর্খ, বোকা প্রাণী বলে কি না বিষয়টা ধরতে পারেনি। অগত্যা আজ এখানে সে দাঁড়িয়ে। আঞ্জুমানকে দেখতে পেয়ে রিমার মুখভঙ্গিমা বদলে গেল অদ্ভুত রহস্যময়তায়। চারিপাশের গুঞ্জন থেমে গেছে কোনক্ষণেই। এগিয়ে যাওয়া ধরল রিমা মেয়েটার কাছে। সেটা দেখে মনটা বড়োই অশান্ত হয়ে উঠল আলীর। একবার চোখ ঘুরিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া আলীকে দেখে নিলো।
‘তুমি-ই তাহলে আমার সতীন?’
কয়েক শব্দের বাক্য আঞ্জুমানের কাছে ভারি লাগল বেশ। ‘সতীন’ শব্দটা আওড়ালো খানিক। অতঃপর আলীর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে আলীর থমথমে মুখটা নজরে এলো। বোকা প্রাণীর মধ্যে আচমকাই বোধহয় বড়োদের জ্ঞানবুদ্ধির প্রবৃত্তি দেখা দিলো। যা বোঝার বুঝে নিলো। তবে সে বোঝা স্বতঃস্ফূর্ত নয়, বড়োই ক্লেশকর ঠেকল। নিশ্বাস নিতে কষ্টকর বোধ করল। আঞ্জুমানের অবাকান্বিত দৃষ্টির বদলে চোখের সীমানা ছুঁয়ে কেবল দুফোঁটা অশ্রুপাত হতে দেখা গেল। আলী ক্লিষ্টতার সহিত এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় পা বাড়ানোর আগেই ঘটে গেল দূর্ঘটনা। রিমার থেমে থাকা ক্রোধের বলিতে চড়তে হলো আঞ্জুমানকে। সেটা দেখে আলী চিৎকার করে বলল,
‘রিমা না! ও প্রেগন্যান্ট।’
৫৭.
রিমার মনমস্তিষ্ক জুড়ে চলছে একপ্রকার যুদ্ধ, অস্থিরতা। সাথে মিশে আছে কারোর অপেক্ষার ব্যাকুলতা। কিন্তু হায়! এতোসব ব্যাকুলতা, চপলতা সবকিছুই বিফলে ফলিত। এই উগ্রতার অবসান ঘটিয়ে মানুষটার পদচারণ হবে না। এই ঘাটে আর ভেড়বে না সে। সেদিনের প্রতিক্রিয়ায় নষ্ট হয়েছে তিনটি জীবন। নাহ, তিনটি নয় চারটি জীবনের সুতো বিছিন্ন হয়েছে। তার আফসোস নয়, দীর্ঘশ্বাস কেবল সকলের হয়।
সেদিনের কনভেনশন সেন্টারের দোতলায় ওঠে সিঁড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে আঞ্জুমান হতভম্ব হয়ে টিভির পর্দায় দেখছিল নিজের ও আলীর ছবি। রিমার কথাতে আলীর সায়ে তার শরীরে হিমশীতল বাতাস বয়ে যায়। কাঁদতে ভুলে যায় খানিকক্ষণ। অবশতা ছড়িয়ে সারা শরীরে নিজেকে ভার শূন্য মনে হয়। এই বুঝি গড়িয়ে পড়বে নিচে। সত্যি হয়েছিল তার মনের কথাটা। রিমার ধাক্কায় দোতলার সিঁড়ি গড়িয়ে পড়েছিল নিচতলায়। কামনা করেছিল মৃত্যুকে। আলীর কথাটা শুনেছিল স্পষ্ট শেষদিকে। হেসেছিল ভেবে, লোকটা তাকে ঠিক কেমন ভালোবাসে নিজেরও বোধগম্য হয়নি। তবে সন্তান আসার খবরে কদর ও আদর করেছিল খুব গতকাল। আগেও করত তবে এখন বুঝে আসলো সবকিছুই মেকি ছিল। আঞ্জুমান আজ পর্যন্ত কখনো কারো ভালোবাসার পাত্রী হতে দেখেনি নিজেকে। সবসময়ই পেয়েছে অনাদর, অবহেলা, তুচ্ছতাচ্ছিল্যতা। পাওয়ার যোগ্য না তাও তার আঁচলে এসব এসেই পড়ে। সে কি একটুও ভালোবাসা, আদর পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না? পেয়েছিল গতকালও তো। একটু সুখানুভূতি অনুভব করেছিল উদরে হাত রেখে। কিন্তু সেই আশা এখন ধূলিকণায় পরিণত করল। যেখানে ভালোবাসারা বাষ্পীভূত হাওয়ার মতো, ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। সবকিছুতেই কৃত্রিমতা প্রকাশ পায়। সেখানে তার সন্তানের আগমন সুখকর নয়, এই পৃথিবী তার জন্য নয়। চোখ মুদিত হওয়ার আগে কেবল ওপর থেকে আলীর হতবাক ও দুঃখ মিশ্রিত অনুভূতি সৃষ্ট মুখ নজরে এলো।
৫৮.
আলী স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল ওপর থেকে আঞ্জুমানের হাসিমাখা মুখ। বুঝতে পেরেছিল আঞ্জুমানের নিদারুণ কষ্টদায়ক মুহূর্তেও হাসির কারণ। হাসপাতালের বেডে মৃত্যুমুখী লড়াইয়ে থাকা আঞ্জুমানকে চেয়েছিল খুব করে মুনাজাতে। ফিরেও এসেছিল মেয়েটা তবে ভারসাম্যহীন অবস্থায় প্যারালাইস হয়ে। সেটাকে এখন বেঁচে থাকা বলে না। আলী যদি জানত, এমন বেঁচে ফিরবে। তারচেয়ে সে মেয়েটার মৃত্যুই কামনা করত। জীবন্ত অবস্থাতে সবসময় মেয়েটা কষ্ট করে থেকেছে, এখনও। এত উঁচু থেকে পড়ে সন্তানটা মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। সকলের দোষী অবশ্য সে। তাই তার চাওয়ার সাথে এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। সকলের হায় লেগেছে যে। আঞ্জুমানকে যে জন্য বিয়ে করল আজ সেই কারণটাও রইল না। তবুও মেয়েটাকে মনের কোথাও ভালোবেসে ফেলেছিল। কিন্তু আলী এখন এক সর্বহারা পথিক। দিক-দিশাহীন জীবন তার। শেষটা নিজেও জানে না।
রিমার অবস্থা বদ্ধ উন্মাদে পরিণত হয়েছে। অত্যাধিক ভালোবাসে কি না তাই। সেই ভালোবাসা তাকেও নিঃস্ব করে ছেড়েছে। রিমার বাবা-মা আলীর নামে কেস করলেও ফের হেরে যান মেয়ের কাছে। মেয়ের অবস্থা দেখে চোখের জল ছাড়া কোনকিছুই করতে পারেন না তাঁরা। শিকলে বাঁধা হয়ে রিমা পথ চেয়ে শুধু বসে থাকে আলীর আগমনের জন্য। কিন্তু নাহ, এ তীরে আর আলীর পদচারণ হয় না। সমীর ধরা পরেনি অবশ্য। পরিকল্পনা না যে এভাবে মোড় নিবে ভাবেওনি সে কখনো। ভালোবাসা ভয়ের কাছে পরাজয় মেনে নেয় বিধায় বিদেশে পগারপার হয় সে।
‘ভালোবাসা সে তো অভিনয়,
চোরাবালি নামক মায়াজালে
তলায় যে, জানে সে-ই বোধহয়।’
সমাপ্ত।