#নিশুতি_তিথি,পর্ব ২০,২১
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ২০
___________
৪৭.
অস্বস্তিতে গা কাঁটা দিয়ে উঠছে। যতই বলুক না কেন, স্বাভাবিক থাকো। তবুও কি স্বাভাবিক হওয়া যায়? যখন একটা লোক তাকে বিবাহিত জানার পরও পাওয়ার চেষ্টায় অবিবাহিত থেকে যায়, তখন দেহ-মন সবকিছুই সংকুচিত হয়ে আসে আপনা-আপনিই। বছর তিনেক আগে, রিমাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়েছিল ছোটো ভাবি সামিয়া নিজের বাড়িতে। অবশ্য কারণ আছে এমন টানাটানির। সেটা হলো, বরপাগল মেয়ে রিমা বাবার বাড়ি আর গ্রাম ছাড়া কোথাও বেরোয়-টেরোয় না খুব একটা। উপরন্তু রিমার ভাইয়ের সাথে সামিয়ার বিয়ে হয়েছিল ফোনে ফোনে। ছেলে বিদেশ ছিল তখন নতুন নতুন। দু’বছর পরে গিয়ে আকামা পায়। এর আগে আসা-যাওয়ার সুযোগ নেই, যার ফলে সামিয়াকে বাড়িতে তুলে নেওয়া হয়নি তখন। পরে একসময় তুলে নেওয়া হয়। তবে এর আগে সামিয়া শ্বশুর বাড়িতে এসে দু-একদিন থেকে যেত। রিমার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ভালোই গড়িয়েছিল, যে ক’দিন তাকে পেয়েছিল। রিমার স্বামী আলীর সাথেও কথাবার্তা হয়ে ফ্রি মাইন্ডে। একদিন যখন শুনল আলী আসবে না কয়েকদিন, গ্রামে থাকবে জরুরি কাজের ভিত্তিতে৷ তখন সামিয়া আবদার রাখে রিমাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে ঘুরিয়ে আনতে। একগুঁয়ে রিমা রাজি না হলেও পরক্ষণে রাজি হয়েছিল, যখন আলী বলল ঘুরে আসতে। মন ভালো থাকবে। সে-ও তো আসবে না কয়েকদিন। সেদিন হাসিখুশি মুখে নিতে আসা সমীরের সাথে গাড়ি চড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে আজও সেই ব্যক্তি নিতে এসেছে, সে-ও গাড়িতে চড়েছে, তবে মুখে হাসির বদলে ঢাকা পড়া কালো মেঘে। লুকিং গ্লাসে আড়চোখে কয়েকপলক দেখল সমীর। গাড়ির ভেতর থাকা গুমোট বাঁধা আবহাওয়াকে বেগে আনতে সামিয়া কথা জুড়ে দিলো রিমার সাথে। কিন্তু নিম্নস্বরের হু, হা ছাড়া কোনো কথা বের করতে পারল না রিমার মুখ থেকে। ঘন্টাখানেক এমনই নিশ্চুপ আবহাওয়া ও বৃষ্টির মাঝে পৌঁছে গেল কাঙ্ক্ষিত স্থানে।
৪৮.
বৃষ্টির পরে মেঘ সরে যেই সূর্যতাপ নিসৃত হয়, সেটা বেশ আরামপ্রদ। আদ্র উষ্ণতা মিশানো উত্তাপে আরামে আঞ্জুমানকে আরেকটু গভীরভাবে জড়িয়ে নিলো আলী নিজের সাথে। ঘুম কাটেনি এখনো কারোরই। তৃপ্তির রেশ হয়তো বেশ। তাই যেখানে আলীর ঘুম আগে কাটার কথা, সেখানে তার মুখ পরিতৃপ্ততার সাথে ঘুম পরি’রা এসে ভর করেছে। ঘড়ির কাঁটা দশটার ঘরে পৌঁছায় ফোন আসে তখন, ভাইব্রেশন মুডে। বিপ বিপ’ শব্দ তুলে। ব্যাঘাত ঘটায় আলীর ঘুমে। আলী এতদিন বেশ ভালোভাবে বুঝেছে আঞ্জুমানের ঘুমের গভীরতা। আলীর ঘুম পাতলা বিধায় টের পায় সুক্ষ্ম শব্দও। সাইড-টেবিলে হাতড়ে ফোন নিয়ে দেখে রিমার কল আসছে। রেখে দেয় সেভাবেই। মেয়েটা ড্রাইভার দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে ফোনটা। ইদানীং কেন জানি এত বাড়াবাড়ি ভালো লাগে না, অসহ্যকর ঠেকে। হয়তো আঞ্জুমানের সান্নিধ্যে বাঁধা প্রদান করায়। বিরক্তিতে মুখ তেঁতো হয়ে এলেও পরক্ষণেই মুখের মুগ্ধতার মোহজাল তৈরি হয় বুকের বাঁপাশে মাথা রাখা আঞ্জুমানের পবিত্র মুখ দর্শনে। জাগতিক সুখের খোঁজ যেন এই মুখের মধ্যে নিহিত। পাষণ্ড মনে ভালোবাসার বীজ এই শুভ্র, নির্মল, নিষ্পাপ মেয়েটির মাধ্যমেই তো বপন করা হয়েছিল। এখন সেই বীজ থেকে থেকে পরিণত গাছে পরিপূর্ণ হচ্ছে। হয়তো আজ পরিপূর্ণ হলো। আদুরে বিড়ালছানার ন্যায় আলীর বুকে চুপটি করে শুয়ে থাকা আঞ্জুমান এবার ঘুম ভেঙে চোখ পিটপিট করে মেললে আলী তার দিকে তাকিয়ে ভুবন ভুলানো হাসি দেয়। পিটপিট করে তাকিয়ে থাকা আঞ্জুমান হাই তুলে। বোধগম্য হয়নি বোধহয় মেয়েটার ঘুম ভাঙা বাকি। শরীরও হালকা গরম। জ্বর আসার পূর্ব সংকেত বুঝল আলী। আঞ্জুমান আবারো চোখ বোজার আগে আলী তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘আর ঘুমোতে যাস না। ওঠে ফ্রেশ হয়ে নে।’
কথাগুলো কর্ণকুহরে পৌঁছতে দেরি আঞ্জুমানের চোখ ডিম্বাকৃতি হতে দেরি হয় না। আলীর অতি নিকটে নিজেকে দেখে মিনিট খানেক লাগে ধাতস্থ হতে ঘটনা বুঝতে। মিনিট গড়ালে কুঁকড়ে যায় আলীর সাথে থাকা একই চাদরে। মুখ ডেকে ফেলে লজ্জা না কান্নার কারণ আলী ঠাওর করতে পারে না। আঞ্জুমানকে তখনের জন্য ছেড়ে ওঠে পা বাড়ায় ফ্রেশ হওয়ার তাগিদে লাগোয়া ওয়াশরুমে।
৪৯.
রিমা ফোনের ওপর ফোন দিয়ে যাচ্ছে আলীকে। নাহ, তার নাগাল পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ছে। অতটা জরুরি নয়, তবুও জানানোর তাগিদ অনুভব করছে বাধ্য, অনুগত স্ত্রী মন। গতবার যখন এসেছিল আলী জানত না। ঘটনা ঘটার পরে জেনেছে। এবার আগেভাগেই জানিয়ে দিয়ে চাইছে রিমা। কিন্তু, মিয়া ফোনটা ধরলে তো। ক্লান্ত হয়ে একসময় রেখে দিলো ফোন। সামিয়ার সাথে এক রুমে থাকবে সে। আলাদা গেস্টরুম যদিওবা দিতে চেয়েছিল কিন্তু রিমা-ই রাজি হয়নি। ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়- প্রবাদে বিশ্বাসী কি না। সকলের সাথে সকালের নাস্তার টেবিলে যায়নি মাথা ধরার নাম করে। সেজন্য সামিয়া নিয়ে এলো নাস্তা ট্রে করে। খেতে খেতে আলোচনা করল দু’জন মিলে হলুদে কে কী পরবে, মেয়ের বাড়ি যাবে না কি। যাবতীয় অনুষ্ঠানের আনুষাঙ্গিক বিষয় নিয়ে। বিয়ে হবে এই বাড়ি থেকেই। সামিয়ার বাবা নেই বিধায় সামিয়া মা চার সন্তানকে নিয়ে মা’য়ের বাড়িতে ওঠেন শ্বশুর বাড়ি ছিল না। স্বামীসহ ভাড়া থাকত ফ্ল্যাট নিয়ে। বড়ো মেয়ে, ছোটো মেয়ে দুটোরই বিয়ে দিয়েছেন, বড়ো ছেলেরও বিয়ে হয়ে গেছে আলাদা থাকে বউ-সন্তান নিয়ে। ছোটো ছেলে সমীর রয়েছে বাকি। সে না কি পণ করেছে বিয়ে না করার। অতি আদরের ঘাড়ত্যাড়া বলে বিয়ের জন্য চাপও দিতে পারছেন না। আগের ঘটনাও কিছুটা দায়ী সেখানে।
৫০.
‘কেমন আছ শ্যামাঙ্গী?’
একা একা দাঁড়িয়ে ছিল বিধায় সমীর সুযোগে জিজ্ঞেস করেই ফেলল বছরখানেক থাকা আবদ্ধ হওয়া প্রশ্ন। মেয়েটাকে যে খুবই ভালোবাসে সে। অন্যের কাছে ভালো থাকা দেখা যায় না বিধায় প্রশ্ন করা। তার কাছে থাকলে কী হতো? আলীর চেয়ে দ্বিগুণ ভালোবাসা কি দিতে পারে না সমীর? অবশ্যই পারে। সারাক্ষণ বক্ষের সাথে লেপ্টে রাখত তার শ্যামাঙ্গীকে। কিন্তু মেয়েটা, সে তো মত্ত অন্য পুরুষে। অন্য পুরুষ নয়, তার শ্যামাঙ্গে।
‘জি, ভালো।’
রিমার মুখ থেকে দু শব্দের উচ্চারিত হওয়া ভালো থাকার কথা যেন তৃপ্ত হলো না সমীর। মেয়েটা কি আর একটু কিছু বলতে পারল না? নিষ্ঠুর, পাষণ্ড, হৃদয়হীন কত কী যে উপাধি দিলো সমীর তাকে। শুনল না মেয়েটা। মনের কথা কি আর শোনা যায়, যদি যেত তাহলে আজ অর্ধাঙ্গ হতো সে-ই।
‘চলো, কোথাও বসি গিয়ে। সামিয়ার আসতে সময় হবে সম্ভবত।’
‘না আমি এভাবেই ঠিক আছি।’
‘এত রোদে ঘেমে-নেয়ে আছ। ঠিক থাকার কথা না। আসো ওখানে এক…’
এমন সময় আলীর ফোনকলে অদূরে সরে দাঁড়ায় রিমা ফোন রিসিভ করে। সেটা দেখে রাগে কপালের শিরা দপদপ করতে লাগল। এই আলী সবসময়ই তাদের কথার মাঝে আসবেই, তাকে যেন আসতেই হবে। এর কিছু একটা এবার করেই ছাড়বে। কিন্তু নির্বোধ, ভালোবাসায় না কি মোহে অন্ধ হওয়া সমীর বুঝল না, রিমা ও আলী বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে জড়িত আগে থেকেই। মাঝে তো সে এসেছে। সামিয়া ফুলের অর্ডার দিয়ে এলো। এবার সমীরের কাছে বায়না রাখল রেস্টুরেন্টে খাওয়ার জন্য। কিন্তু আশেপাশে রিমাকে না পেয়ে আঁতকে ওঠে সমীরকে জিজ্ঞেস করে,
‘রিমা কোথায়?’
‘ফোনে কথা বলে। ওই যে।’
চোখ-মুখ কুঁচকে জবাব দেয় সমীর। হাতের ইশারা দিয়ে ফোনে কথায় ব্যস্ত রিমাকেও দেখিয়ে দেয়। সমীরের বিরক্তভাব সামিয়ার চোখে পড়ে। সেটা দেখে সমীরকে বুঝাতে বলল,
‘ভাই প্লিজ এবার কোনো অশান্তি ডেকে এনো না। মেয়েটা ভুলে গেছে সব, তুমি-ও ভুলে যাও। লাইফে এগিয়ে যাও। রিমাকে সুখে থাকতে দাও, প্লিজ। বারবার বলছি, অনুষ্ঠানে কোনো ব্যাঘাত চাই না।’
এতগুলো কথার মাঝে কেবল সমীরের কর্ণকুহরে ঘন্টার ন্যায় বাজছে, মেয়েটা সব ভুলে গেছে।
চলবে…
#নিশুতি_তিথি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ২১
___________
৫১.
সেই কোন সকাল থেকে আঞ্জুমান মুখ তালাবদ্ধ করে রেখেছে। স্বাভাবিকও সেটা। মানসিক বিপর্যস্ত কাটিয়ে ওঠার পূর্বেই শরীরী মিলনের ঝক্কি সামলানো কঠিন থেকেও কঠিনতম। কিন্তু উৎকণ্ঠা হয়ে থাকা আলী সেটা মেনে নিতে পারছে না। এতে আঞ্জুমানের মানসিক সমস্যা আরে বৃদ্ধির প্রবাণতা বেশি। ডাক্তার তো না-ই বলেছিলেন মিলনের সম্পর্কে যেতে। কোন এক সম্মোহনে দু’জনই সম্মোহিত হয়ে একত্রিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যা হওয়ার হয়েছে বলতে গেলে ভালোই হয়েছে। মনের পাশাপাশি শরীরী টানে তো আলীর সাথে স্বাভাবিক হবে, আশা করেছিল। কিন্তু পরিবেশ দেখা গেল আরো প্রকটভাবে গুমোট বেঁধেছে। আলী হাল ছাড়বে না। আবারো প্রচেষ্টা চালানোর বাহানায় বিছানায় শুয়ে থাকা আঞ্জুমানের কাছে গেল। মেয়েটা জেগেই আছে। অহেতুক ঘুমের ভান কেবল। আলী আলগোছে আঞ্জুমানের কাঁধে হাত রাখল। নিস্তরঙ্গ, স্থির হওয়ার আঞ্জুমানের গা খানিকটা কেঁপে উঠল। ঘুরিয়ে আলী নিজের দিকে ফেরালো তাকে। স্থিত হওয়া মুখটা নিজের দু’হাতের আঁজলায় তুলে নিয়ে আলী শোধাল,
‘এমন চুপ করে আছিস কেন? আমাকে কি একটুও ভালোবাসা যায় না? আমি তোর আগের চঞ্চলা, ছটফটে, উজ্জীবিত হওয়া ভাবটা দেখতে চাই। এমন চুপচাপ, শান্ত নদীর ঢেউ না। আগের মতো হয়ে যা না লক্ষ্মীটি। আমাকেও একটু ভালোবেসে মেনে নে।’
আঞ্জুমান এতক্ষণ যাবৎ চুপটি করে আলীর মুখের দিকে তাকিয়ে শুনল তার যত কথা। শেষে আলীর চোখজোড়া অশ্রুসিক্ত হতেও দেখল। অবাক হলো খানিক, এত শক্ত, গাম্ভীর্যের মানুষটাকে তার জন্য কাঁদতে দেখে। কিন্তু প্রকাশ করল না। তবে সে সেই সকাল থেকে অবুঝ মাথায় ভেবে চলেছে তার আর আলীর সম্পর্কের অগ্রগতির বিষয়ে। মেনে নেওয়ার সিধান্ত তার কাছে ভালো লেগেছে। সে-ও এতিম, আলী-ও। দু’জন মানুষ দু’জনকে আগলে রাখবে। প্রত্যাশাই এটা। ভাবতে ভাবতে দেখল আলী তার মুখের ওপর ঝুঁকে আসছে। সজ্ঞানে চোখ বন্ধ করে সায় দিলো। হয়তো এটাই সম্পর্ক মেনে নেওয়ার সম্মতি।
৫২.
রিমার সাথে প্রায়ই কথা বলার চেষ্টায় জড়িত সমীর এবার আগের বারের মতো ভুলের পরিকল্পনায় মত্ত হলো। গতবার যখন বেড়াতে এলো রিমা। তার শ্যামাঙ্গী সৌন্দর্যে মোহিত সমীর ভালোবেসে ফেলল তাকে, বিবাহিত জানার পরও। নিজের ভলোবাসা কেয়ার করার সহিত বিভিন্ন আকার-ইঙ্গিতে জাহির করত। মেয়েদের এসব বুঝতে পারার ক্ষমা যথেষ্ট। তাই রিমা-ও সেটা বুঝতে পেরে দূরে দূরে সরে থাকত। কিন্তু সমীর সেটা ধরতে পেরে লুকিয়ে-চুরিয়ে বোঝার প্রয়াস ছেড়ে সরাসরিভাবে বলার পরিকল্পনা করল। কিন্তু কোনকিছুতেই রিমাকে বাগে আনতে পারল না আর না একা তাকে পাওয়া গেল। সেইবার রিমাকে গেস্টরুমে থাকতে দেওয়া হয়েছিল। রাগ-ক্ষোভ মিলেমিশে যখন জেদ ঘাড়ে চাপল, তখন পা গিয়ে পৌঁছাল কাঙ্ক্ষিত রুমে। যখনই পৌরুষ সত্তাটা আকস্মিকভাবে আক্রমণ করবে ঘুমন্ত রিমাকে, তখনই খেয়াল হলো আঁধারে আধো আলোয় নিজের বোন সামিয়া ওপাশে শুয়ে। কিছু করার বা সরে যাওয়ার পূর্বেই রিমা তাকে দেখে চিৎকার জুড়ে দেয়। সেই চিৎকার কাল হয়ে দাঁড়ায় সমীরের জন্য। সেদিনই রাতে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকা রিমা নিজের বাড়ি ফিরে আসে। সবশুনে পুলিশে দিতে চেয়েছিলেন আফজাল সাহেব। কিন্তু সামিয়া ও তার মায়ের দিকে তাকিয়ে রিমা পর দুঃখ মোচনের প্রবৃত্তিতা দেখায়। অতঃপর সমীরকে ছেড়ে দেওয়া হয় তবে হুমকিধামকি কম দেওয়া হয়নি। সেই ঘটনা আলী শোনে অবাক, হতবাক হয়ে গিয়েছিল। প্রতিক্রিয়া দেখাতে ভুলে গিয়েছিল পর্যন্ত। তার স্ত্রীর জন্য কেউ এমনতরও করতে পারে ভাবনার বাহিরে ছিল। সেই ভুল পুনরায় করার ভূত চেপেছে সমীরের মাথায়। কিন্তু সেটা শেষমেশ পণ্ড হলো তার মা’য়ের কারণে। গতবার পুনরাবৃত্তি না হওয়ার পণে চোখে চোখে রাখতেন ছেলেকে, ছেলের স্বভাব সম্পর্কে অবহিত ছিলেন বিধায় বড়সড় ঝড় মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল, নাহলে যে কী হতো!
৫৩.
বিকেলের নরম সোনা ঝরা রোদের স্পর্শের চেয়ে মধুতর স্পর্শে মোহিত আঞ্জুমান। ভালোবাসা এমনও হয়? প্রশ্ন জাগে মনে। উত্তরও মেলে, হয়তো। নাহলে সে কেন কয়েকদিনের মাথায় আলীর ভালোবাসার নামক প্রেমের সাগরে ডুবে মরছে প্রতিনিয়ত? এত ভালোবাসা, যত্ন-আত্তিও কি তার ভাগ্যে লেখা ছিল? ছিল বলেই তাে পেল, নিজের করে একান্তে। আলীর বুকে মুখ গুঁজে প্রিয়তমর শরীরের মিষ্টি সুবাস নিজের মধ্যে টেনে নেওয়ার প্রচেষ্টা করতেই হাসির শব্দ মুখ তুলে তাকায়।
‘কী হইল হাসতাছেন ক্যান?’
‘ভালোবাসা পাচ্ছে দেখে।’
চোখ-মুখ কুঁচকে কপট রাগের ভঙ্গিতে ঘাড় বাঁকিয়ে চোখ রাঙায় আঞ্জুমান। বিন্দুমাত্র না ভড়কে আলী বলল,
‘কেন তোর পায়নি?’
ঘাড় ছুঁয়ে আলীর তপ্ত নিশ্বাসে আঞ্জুমান নিজের সত্তাকে হারানো অবস্থা। কেমন কেমন অনুভূতিতে ছেয়ে শরীর জুড়ে। আঞ্জুমানের নেশা নেশা চোখের ঘোলা হাল দেখে আলী ফের শোধায়,
‘পাচ্ছে বলেই এত আদুরে বুকে স্পর্শ করছিস তুই।’
আলী তখনকার অবস্থা বুঝেই জব্দ করল তাকে এভাবে! ভেবে দুয়েক কিল বসালো আলীর প্রসস্থ বুকে। আঞ্জুমানের দু’হাতে পিছমোড়া করে কাছে টেনে নিলো আলী। খুব গভীরে নিজের স্পর্শে উন্মাতাল করে তুলল আঞ্জুমানকে। দোলনায় দোল খাওয়া কপোত-কপোতীর মজে থাকা লীলাখেলায় বাগানের পাখিরাও লজ্জায় মুখ লুকায় পাতার ফাঁকে।
‘রাতে কী খাইবেন?’
‘তুই যা খাওয়াবি।’
আলীর কথায় আঞ্জুমান ঘুরে পিছনে তাকালে আলী তাকে চোখ টিপ মারলো। সে এবার ধরতে পারল আলীর দুষ্টুমির ইঙ্গিত। শাড়ি পরা, কোমরে গুঁজা আঁচল, হাতে খুন্তি নিয়ে পাক্কা গৃহিণী ভঙ্গিমায় বেশ আদুরে লাগছে আঞ্জুমানকে। ভাবতেই অবাক লাগে আলীর, কদিন আগেও মেয়েটা তার ভয়ে কতই না তটস্থ ছিল। এখন তার ভালোবাসার চাদরে আঞ্জুমান নিজেকে আগলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। উচ্ছলতা, চঞ্চলতা ভাব উজ্জীবিত হচ্ছে ধীরেধীরে। তার এই উন্নতিতে আলীর অনেক সুবিধাও হচ্ছে, সাথে ভালোলাগাও কাজ করছে।
‘এমন চোখ রাঙাচ্ছিস কেন? ভয় পাই নাকি?’
হাতের খুন্তি নিয়ে আলীর অনেকটা কাছে এগিয়ে এলো আঞ্জুমান। আলীর ঘাড়ে দু-হাত রেখে গলা জড়িয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে নেশাক্ত সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘সত্যিই ভয় পান না?’
‘এভাবে চিপকে আছিস কেন?’
আমতাআমতা জবাব আলীর। অনুভূতিগুলো সব ভোঁতা হয়ে আসছে আঞ্জুমানের কাছে আসায়। নিশ্বাস নিতে বাঁধ সাধছে শ্বাসনালী।
‘কী করলাম আমি আবার? একটু কাছেই তো এসেছি। আর তাতেই আপনি এভাবে ঘামাইতাছেন! আহারে!’
এবার বোঝা গেল, সেরের ওপর সোয়া সেরের- চাল দিয়েছে মেয়েটা। ভাবতেই হাসি পাচ্ছে আলীর। ভয়ের জায়গায় অনুভূতি নিয়ে নাড়াচাড়া করল।
‘গরম লাগছে বেশ। সেজন্য ঘাম হচ্ছে। বুঝতেই তো পাচ্ছিস, গরম জিনিস তো….’
শেষের বাক্য নিচু ও চাপা স্বরে আঞ্জুমানের কোমর আঁকড়ে বলল আলী। তাতেই খেই হারিয়ে ফেলল আঞ্জুমান। প্রেমানন্দে মশগুল নতুন কপোত-কপোতী।
৫৪.
সমীর বদ্ধ উন্মাদনায় নতুন করে আগুন জ্বলাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে আগুনে না জানি কে পুড়ে, ভস্মীভূত হয়। আলীর ওপর নজর রাখার জন্য মানুষ রেখেছে। সুযোগ পেলে মৃত্যু দেওয়ার আদেশ দিবে, এমন সময় নতুন তথ্য পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনে সে। ভাবতেই অবাকের চূড়ান্ত পৌঁছে গেল সমীর। যাকে পাওয়ার জন্য এতএত জল্পনা-কল্পনা, তাকে পাওয়ার পথ আলী-ই করে দিলো দ্বিতীয় বিয়ে করে। এবার খেলা জমবে বেশ, মজা অত্যাধিক।
‘রিমা, জানি কষ্ট পাবে তুমি। তবে মন খারাপ করো না। তোমাকে আগলে নিতে আমার এই বুক রয়েছে। তুমি মাথা পেতে সকল কষ্টের অবসান করো এখানটাই।’
নিজের বুকের বাঁপাশে হাত রেখে স্বগোতক্তি করল সমীর। অতঃপর উচ্চস্বরে হাসির শব্দে রুমের চার দেয়াল ভারী করে তুলল। বদ্ধ উন্মাদ, ক্ষিপ্ত দেখালো সমীরকে সেই অবস্থাতে।
চলবে…