অগত্যা_তুলকালাম,পর্ব ৩৯,৪০

#অগত্যা_তুলকালাম,পর্ব ৩৯,৪০
নাফীছাহ ইফফাত
পর্ব ৩৯

“বাড়িতে ঢোকামাত্র কি শুরু করেছো বুবু? এসব নিয়ে পরে আলাপ করা যাবে।” আমার দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করে বললেন মা।
খালামণি আমাদেরকে রুম দেখিয়ে দিলেন। এ’বাড়িতে যথেষ্ট রুম রয়েছে। প্রত্যেকে আলাদা রুমে থাকলেও অনেকগুলো রুম রয়ে যাবে। মান্ধাতা আমলের বিশাল বাড়িটা আমার বেশ পছন্দ হলো। আমার রুম দেখিয়ে দিতে খালামণি তানভীর ভাইয়াকেই পাঠালেন। যদিও তানভীর ভাইয়া আসতে চাননি আমার সাথে। খালামণির এসব বাড়াবাড়ি তানভীর ভাইয়ারও পছন্দ না। এখানে এসে এভাবে ফিতনার জালে আটকা পড়বো ভাবতেই পারিনি৷

সিঁড়ি বেয়ে উঠে তানভীর ভাইয়ার পাশাপাশি হাঁটছি। সিঁড়ির পর লম্বা করিডোরের দু’পাশে একটা করে রুম। অনেক লম্বা করিডোর। ঘর কয়টা আল্লাহ ভালো জানে। তানভীর ভাইয়া মোবাইল টিপতে টিপতে আসছেন আমার সাথে। বলা বাহুল্য, একবারও তাকাননি আমার দিকে। এতক্ষণ যা-ও একটু স্বাভাবিক ছিলাম কিন্তু খালার কথা শোনার পর থেকে অস্বস্তি লাগছে। যার সাথে আমার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই জন্মা-জন্মান্তর থেকে তার সাথে…? বুক ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

“কেমন আছো জেদি?” এতক্ষণে কথা বললেন তানভীর ভাইয়া।
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”
কিছুক্ষণ আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
“জেদি বললাম রাগ করলে না তো?”
“আমি যেটা না সেটা শুনে রাগ করার কি আছে?”
“অনেক বুঝতে শিখেছো। ভালো।”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বললেন,
“বাট তুমি আসলেই জেদি।”
“আচ্ছা।”

আমার কাটখোট্টা জবাব পেয়ে ভাইয়া আর কোনো কথা বললেন না। রাফিন কথা বলতো এইভাবে। মেজাজ খারাপ থাকলে সব কথার কাট কাট জবাব দিতো। ওর তো বারোমাসি মেজাজ খারাপ। এত জেদ কোথা থেকে পায় কে জানে? তানভীর ভাইয়া আমায় জেদি ডাকে। রাফিনকে দেখলে আমাকে জেদি বলার অপরাধে পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতো। ধুর! এখন আবার রাফিনের কথা ভাবছি কেন? আমার ভাবনায় চড়ে রাফিন এই এতদূরেও চলে এলো? এরকম বাড়ি বড়লোকের ব্যাটা চোখে দেখেছে কিনা কে জানে? সে থাকতে পারবে বিলাসবহুল পুরোনো, জীর্ণশীর্ণ এই রাজপ্রাসাদে? ধুরর! আবার ভাবছি ওর কথা? অসহ্য যন্ত্রণা তো!

“কোন ঘরে থাকবো আমি?”
“এই তো এই রুমটায়, পাশের রুমে নাকীব৷”
”আচ্ছা।”

ভাইয়াকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রুমে ঢুকে গেলাম। পাশের রুমে যদি নাকীবই হয় তাহলে তানভীর ভাইয়াকে আমার সাথে পাঠানোর মানে কি? কতগুলো গুনাহ স্বেচ্ছায় অর্জন করে নেওয়া। যত্তসব! এজন্যই আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। ছোটফুফি থাকলে বেশ ভালো হতো। এসব মাহরাম-গায়রে মাহরাম ছোটফুফিই সবচেয়ে ভালো ম্যানেজ করতে পারে৷ দুনিয়ার এক কোণায় এসে আমার শহরের সব মানুষের কথা মনে হতে লাগলো।
ভাইয়া রুমের বাইরে থেকে বললেন,
“কিছু লাগলে মাকে বলো হৃদি।” বলেই চলে গেলেন।

খাবার টেবিলে গিয়ে হলো আরেক জ্বালা। আমাকে আর তানভীর ভাইয়াকে পাশাপাশি চেয়ার ছাড়া বসতে দিবেন না খালা। নাকীবটাও যে কোথায় হাওয়া হয়ে গেছে? ওকে নিয়ে ওসব ভাবা একদম উচিত হয়নি। একবার কাছে পেলেই আদর করে দিবো। উফ! আমার আদরের ভাইটা। চোখের একদম কাছ ঘেঁষে হঠাৎ কারো মুখ দেখে ‘আহ!’ করে চেঁচিয়ে পেছনে সরে আসতেই নাকীব বললো,
“আদর করবে ভাবছিলে তো তাই গাল বাড়িয়ে দিয়েছি।”
ঠোঁট গোল করে বড় একটা শ্বাস ছেড়ে আস্তে করে বললাম, “ওহ।”
“আদর করে দাও, বাকিটা আমি ম্যানেজ করছি।”

এত ন্যাকা… ভাবতে গিয়ে ভাবনা স্টপ করে ওকে গাল টেনে দিয়ে মুচকি হাসলাম। বুঝলাম না, আমি কি ভাবি সেটা ও কিভাবে জানে? এমন কেন হয়? জ্বিন আছে নাকি সাথে?
“যেটা ভাবতে গিয়েছিলে সেটা ভুলেও আর ভেবো না। এতক্ষণ যা খারাপ ঘটেছে তারচেয়েও খারাপ কিছু ঘটবে আমি পাশে না থাকলে। সো, বি কেয়ারফুল।”
“অকে, অকে ব্রো।”

নাকীব আমার হাত ধরে বললো,
“আপু পাশে না থাকলে আমি ভাত খেতে পারি না। আর আপুই আমাকে সবসময় খাইয়ে দেয়। আজকেও আপুর হাত ছাড়া খেতে পারবো না।”
মা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তার আগেই বাবা বলে বসলেন,
“তাই তো, তাই তো!”
“আমরা নাহয় ভাত নিয়ে রুমে চলে যাই। আপুর তো সবার সামনে আমাকে খাওয়াতে লজ্জা লাগবে তাই না?”

আমি উপর-নিচ মাথা নাড়ালাম। অগত্যা খালামণি আমাদের খাবার রুমে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। উফ! বাঁচা গেল। একটা ভাই যে আল্লাহর কতবড় নেয়ামত হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
“শুকরিয়া আপু।” খেতে খেতে বললো নাকীব।
“কেন?”
“আমি যে আল্লাহর বড় নেয়ামত এটা বুঝতে পারার জন্য।”
“উফ! কিভাবে পড়িস মন?”
“তোমার চোখ দেখলেই সব পড়া যায়৷ এত বোকা বোকা চেহারা তোমার। এখানে এসে আরও বেশি বুঝতে পারছি।”
“ভীষণ ফাযিল তুই। বাই দ্যা ওয়ে, তানভীর ভাইয়ার সাথে আমার.. মানে এসব কি? এসবের সাথে কি কোনোভাবে তুইও জড়িত?”
“ট্রাস্ট মি আপু, তোমাকে রাফিন ভাইয়ার সাথে ছাড়া কারো সাথে কখনো ভাবিওনি আমি। তখন মায়ের মুখ দেখে মনে হচ্ছিলো খালামণির বাড়ি যাওয়ার জন্য উৎসুক হয়ে আছে। শুধু সুযোগ খুঁজছিলো কথাটা কিভাবে বলা যায়। দেখলে না আমি বলামাত্র কিভাবে কথাটা লুফে নিলো?”
“তাও ঠিক।”
“তাছাড়া আমিও তো আসতে চাইনি।”
“তুই যদি সবটা আগেই বুঝে যাস তাহলে মায়ের এই মতলবটা বুঝলি না কেন?”
“আমি সব বুঝি না আপু। আমি শুধু তোমার হাবভাব দেখে তোমার মনের কথাটা বুঝে যাই। চিন্তা করার সময় তোমার এক্সপ্রেশন চেঞ্জ হয়ে যায়। চিন্তার সাথে খাপে খাপ মিলে যায় চেহারার ভাব। আর তাছাড়া তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে যে কেউ তোমার মনের কথা বলে দিতে পারবে, যারা তোমাকে বুঝে আর কি! তুমি কোনোকিছু চেপে রাখতে চাইলেও তোমার চোখমুখে সেই আভাস ফুটে উঠে। বুঝলে এখন?”
“হু।” দূর্বল গলায় বললাম।

বিকেলে আমাদের তিনজনকে বাইরে যেতে বললেন খালামণি৷ মাথা ব্যাথার অযুহাতে বাড়িতে রয়ে গেলাম একাই। তানভীর ভাইয়া ও নাকীব একসাথে বেরিয়ে গেল। খালামণি, খালু এবং আঙ্কেল (খালুর বড় ভাই) মা-বাবাকে নিয়ে কোথায় যেন বেরুলেন। এই ফাঁকে আমি ডায়েরি নিয়ে বসলাম। হাতে অফুরন্ত সময়৷ আজ পুরো দুটো অধ্যায় শেষ না করার আগে উঠছি না ইন শা আল্লাহ। ডায়েরিটা যত দ্রুত সম্ভব শেষ করে রেখে দিতে হবে। এক ডায়েরি নিয়ে নষ্ট করার মতো এত সময় নেই আমার৷।

“ভালোবাসার আরেক নাম অসহায়ত্ব” অধ্যায়ের অর্ধেকাংশ পড়েছিলাম।
“রাতে আরেকবার চেষ্টা করলাম প্রেয়সীর সাথে যোগাযোগ করার। শেষরাতের দিকে হলোও যোগাযোগ। এতদিন ফোন বন্ধ ছিল। হুট করে কল ঢুকে গেল। কিন্তু কল রিসিভ না হয়ে কেটে গেল। আবার কল দিলাম। এবার তার বেশ বিরক্তিকর কন্ঠস্বর শোনা গেল। বিরক্তিতে একগাদা কথা শুনিয়ে ফোন কেটে দিলো। আমি আবার কল করলাম। এবারও রিসিভ করে গালমন্দ করছিলো। আমার কন্ঠ শুনে হঠাৎ যেন থেমে গেল সে। সেই রাতে প্রথমবারের মতো সে ভীষণ বাজে ব্যবহার করেছে আমার সাথে। যেটা আমি সবসময় তার সাথে করে এসছি এতদিন যাবৎ ঠিক সেই ব্যবহারটা সে সেই রাতে করলো আমার সাথে। ভীষণ অবাক হয়েছিলাম আমি, ভীষণ। কষ্টও পেয়েছি সীমাহীন। সে নিজের মতো আমার প্রত্যেকটা কথার কাটকাট জবাব দিয়ে ফোন কেটে দিয়েছিলো। আমার কোনো কথা শোনার প্রয়োজন অব্দি মনে করেনি৷ কি যে অসহায় লাগছিলো আমার বলে বোঝাতে পারবো না। তাকে বলেছিলাম পরদিন যেন দেখা করে আমার সাথে। সে কিছুতেই রাজি হলো না। সকালে আবার কি যেন ভেবে টেক্সট করলো যে বিকেলে মিট করবে। আমিও কাশবনে বসে আছি তার অপেক্ষায়। সে এলো। আবার বিজনেস, বিয়ে, ক্যারিয়ার এসব নিয়ে কথা তুললো। ফলাফল হলো ভয়াবহ। আবার তুমুল ঝগড়া হলো আমাদের। তার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে বললো। ওকে কিভাবে বোঝাই এই সময়ে আমার বিয়ে কিভাবে সম্ভব? বাবা কখনোই মেনে নিবে না। এই সমাজে যিনা করা সহজ; বৈধ উপায়ে বিয়ে অসম্ভব। এসব কি ও বোঝে না? ও তো আমাকেও বোঝে না। একবারও চেষ্টা করেছে আমার সিচুয়েশন বোঝার? রাগে, ক্ষোভে বললাম, যাও বিয়ে করে নাও। মনের সাথে তুমুল যুদ্ধ করে সিদ্ধান্ত নিলাম যা হওয়ার হোক, ওকে আমার জীবনের সাথে আটকে রেখে কোনো লাভ নেই। বাবার মতিগতির কোনো ঠিক নেই। আদৌ আমার ব্যবসায় সফল হওয়ার পরও ওকে মেনে নিবে কিনা আমার জানা নেই। ওর প্রত্যেকটা কথার জবাব দিয়েছি রাগের সহিত। ওকে বললাম, আমার পক্ষে কখনো সম্ভব না কোনো মেয়ের বাবার কাছে গিয়ে হাত পাতা। বরং মেয়ের বাবা আসবে আমার কাছে। এসব বলেছিলাম মূলত ও আমায় ভুল বুঝে সরে যাওয়ার জন্য। এত অনিশ্চিত জীবনের সাথে ওকে আমি কিছুতেই জড়িয়ে রাখতে চাইছিলাম না। ও আমাকে ভুল বুঝলোও। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলেছিলো,

“কত যে যোগ্যতা তোমার জানা আছে। শত শত মেয়ের বাবারা আসবে তোমার কাছে সেই আশায় বসে আছো। এদিকে আরেকজন মেয়ে যে তোমার অপেক্ষায়, তোমাকে পাওয়ার জন্য বসে আছে তাকে পায়ে ছুঁড়ে ফেলছো। এতই যদি যোগ্যতা থাকতো তাহলে এখনই সেটা প্রমাণ করতে। তুমি না যাও, অন্তত তোমার যোগ্যতা দেখে বাবাকে তো তোমার কাছে পাঠাতে পারতাম। এখন কি যোগ্যতা আছে তোমার? কি দেখিয়ে আমি বাবাকে পাঠাবো?”
“পাঠিও না। পাঠাতে বলছে কে? আফটারঅল, আমি বিয়ে করবো সেটাইবা তোমায় কে বললো?”
“তাহলে আমাদের সম্পর্কের মানে কি?”
“কোনো মানে নেই। আমরা জাস্ট বন্ধু।”
“হোয়াট? এতদিন পর তুমি এটা বলছো?”
“আগেও বলেছি। তুমি কানে তোলোনি। কেন আগে বলিনি, তুমি বরং রিলেশনটা ব্রেক করে দাও? পরে আবার আমার কাছে এই সময়গুলো ফেরত চাইলে আমি কি দিবো তোমাকে? বলিনি বলো?”

সে আর কোনো কথা না বলে চলে গেল। নিজেকে কি ভীষণ অসহায় লাগছিলো বোঝাই কি করে? ওকে কতটা ভালোবাসি তা তো আমার চেয়ে বেশি ভালো আর কেউ জানে না। যদি বৃদ্ধ বয়সেও আমার সুযোগ হয় ওকে বিয়ে করার, কাছে পাওয়ার তবে আমি তাই করবো। তবে আজ শুধু ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই। ও আমাকে একটুও বুঝলো না সেটাই আমার কাছে আফসোসের। এতদিন সম্পর্কে জড়িয়ে থাকার পরও ও ভাবছে, আমাদের ভালোবাসা একতরফা। ও একাই শুধু আমায় ভালোবাসে। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেছে কখনো? আমার চোখে তো ওর জন্য স্পষ্ট ভালোবাসা বিরাজমান। ওকে যদি সত্যিটা বলতাম, যদি জানাতাম আমার সিচুয়েশন ও আমার জন্য অপেক্ষা করতো। ওর জীবনটা তখন অনেক কঠিন হয়ে যেত। ও না জানলেও আমি জানি ও আমাকে কতটা ভালোবাসে। আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না এ-ও জানি। কিন্তু সেটা না করে ওকে ভুল বোঝার সুযোগ করে দিলাম। ভুল বুঝলোও আমায়৷ আমার উদ্দেশ্য সফল। বুক ভাঙ্গা কষ্ট নিয়ে, চোখ ভরা জল নিয়ে ঠাঁই বসে রইলাম কাশবনে।”

কি ভুলটাই না বুঝেছিলাম রাফিনকে। ভাবতেই শিউরে উঠছি। শুধুমাত্র আমি ভালো থাকার জন্য ও এতকিছু করেছে? অথচ ওকে আমি এতদিন ধরে ভুলই বুঝে আসছি। কেন এত চাপা স্বভাব ছেলেটার?

#Be_Continued_In_Sha_Allah 🥀

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ৪০

একরাশ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে পরের লেখাগুলো পড়তে লাগলাম। এই অধ্যায়ের নাম “এবং হঠাৎ…”

যথারীতি বন্ধুর সাথে পাত্রী দেখতে গেলাম। অন্যের পাত্রী দেখায় কি ফায়দা বুঝলাম না। এতজনকে ঘটা করে পাত্রী দেখতে নিয়ে যাওয়ার কি আছে? যার পাত্রী সে দেখলেই তো হয়। যাইহোক, বাবার কথা রাখতে গেলাম সেখানে।

গাড়ি গিয়ে থামলো আমারই প্রেয়সীর বাড়ির সামনে। আমার বিস্ময়ের সীমা রইলো না। একরাশ উত্তেজনা নিয়ে ভেতরে গেলাম। শলাবাবু… উঁহু শলাবাবু না বলি আর। সে আর আমার শলাবাবু হওয়ার নয় বোধহয়। শলাবাবুর নাম নাকীব। ও-বাড়িতে নাকীবকে দেখে আমার বুকের ভেতর চেপে রাখা কষ্টটা এঁফোড়ওঁফোড় হয়ে বেরিয়ে এলো। নাকীবের সাথে কথা বলার সুযোগ পাইনি আমি। এককোণায় বুকে হাত দিয়ে বসেছিলাম। আজ আমার কষ্টটা আমি কাকে বোঝাবো? এত কষ্ট তো জীবনে হয়নি আমার৷ এরচেয়ে মৃত্যু যন্ত্রণাও বোধহয় ঢের সহজ।

পাত্রীকে হঠাৎ টানতে টানতে নিয়ে এলেন মামী। অর্থাৎ, পাত্রের মা। পাত্রী আর কেউ নয়, আমার… আমারই প্রেয়সী। অনেক কষ্টে মুখ ঢেকে রেখেছে। মামী বারবার ওর মুখ থেকে কাপড়টা সরিয়ে নিতে চাইছেন। আমার গলায় আটকে রাখা কষ্টটা আর চেপে রাখতে পারছিলাম না। আর কতটা যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে আমায়? শেষপর্যন্ত এতগুলো লোকের সামনে ওকেই পণ্য বানালো? যে নিজেকে ঢেকে রাখতে চাইলো তাকেই খোলা ময়দানে ছেড়ে দেওয়া হলো? আমি শুধু চেঁচিয়ে বলেছিলাম, ওকে ছেড়ে দিতে, ভেতরে যেতে। ও সাথে সাথেই চলে গেল। যাওয়ার আগে একবার আমার দিকে তাকিয়েছিলো, শুধু একবার। সেই তাকানো আমাকে ভেঙ্গে চুরমার করে ছেড়েছে। আমি কিভাবে থাকবো ওকে ছাড়া? এই মানুষটা ছাড়া বাঁচা যে অসম্ভব আমার পক্ষে। ওর চোখ আমায় বলে দিচ্ছে, এই অসহায়ত্বের জন্য শুধু আমি দায়ী, শুধুমাত্র আমি।”

বুকের ভেতর কেমন যেন করছে। অজানা কথাগুলো কেন জানতে গেলাম, অজানাই থাকতো। কেন পড়তে গেলাম ডায়েরিটা? এখন তো আমার কষ্ট হচ্ছে। কে নিবে এর দায়? পেইজটা কুঁচকানো। জায়গায় জায়গায় গোল চিহ্ন। চোখের পানি! আমার বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠলো। কেঁদেছে ও আমার জন্য? কেন এত ভালোবাসতে? কেন? কেনই বা জানতে দাওনি? গা হিম করা ঠান্ডা বাতাসে কেঁপে উঠলাম কিছুটা। চোখের পানির ছাপগুলোয় হাত বুলিয়ে দিলাম। দীর্ঘশ্বাসের সাথে অস্ফুটে মুখে উচ্চারণ হলো, পাপের ছাপ! এই অবৈধ ভালোবাসাময় ডায়েরির পাতাটা একদিন আমি ঠিক ছিড়ে ফেলবো। বৈধ পাতায় সাজাবো অন্য এক ভালোবাসার ডায়েরি। রাফিনও যেন পারে বৈধ ভালেবাসার কাঙ্গালি হয়ে উঠতে।

আমি তো আল্লাহকে ভালোবেসেছি, আল্লাহর প্রেমে পড়েছি। আল্লাহ আমাকে কাছে টেনে নিয়েছেন, তাওফিক দিয়েছেন তাঁকে ভালোবাসার। আমাকে সাহায্য করেছেন দীর্ঘদিন ধরে রাফিনকে ভুলে থাকতে। আমার সমস্ত ব্যাথা, বেদনা, দুঃখ-কষ্ট লাঘব করেছেন। সেই মহান আল্লাহকে আমি ভালোবেসেছি হৃদয়ের সবটুকু দিয়ে। পুরো পৃথিবী আমার সামনে এনে দিলেও আমি পারবো না সেই রবকে ভুলে তাঁর সৃষ্টির প্রেমে মশগুল হতে। আমার জীবনের সমস্ত দায়ভার আমি তাঁর হাতে সঁপে দিয়েছি। এবার তিনি যা ঘটাবেন তাই আমি মেনে নিবো নির্দ্বিধায়।

নাকীবরা ফিরে এসেছে। আমি ডায়েরি লুকিয়ে ফেললাম। অনেক পড়েছি আজ, আর না। আমার মনে তখনো রাফিনের ডায়েরির পাতা ভাসছে৷ ভাসছে অজস্র দুঃখের বুলিগুলো। জানতে ইচ্ছে করছে পরের ঘটনা, খুব ইচ্ছে করছে।

সন্ধ্যায় সবাই মিলে ড্রইংয়ে বসে আছে। আমি যাইনি দেখে খালামনি নিজে এলেন রুমে। পাশে বসে বললেন,
“কিরে হৃদি, তুই এত দূরে বেড়াতে এলি তাও একা একা বসে আছিস? কখনো তো আসিসও না। যেই এলি তাও তোর একা সময় কাটাতে হচ্ছে? এত ঘরকুনো হলি কবে থেকে তুই? তুই তো সারাদিন বাইরে বাইরে টই টই করতি জানতাম। বিকেলবেলা না বেরোলে তোর ভাত হজম হতো না। সেই তুই এমন হলি কবে থেকে বলতো?”

খালামণির প্রশ্ন করা শেষ হতেই নড়েচড়ে বসলাম। খালামণি আবার জেরা শুরু করলেন।
“কি হলো চুপ করে আছিস কেন?”
“কি বলবো? এমনিই রুমে বসে আছি। কার সাথে ঘুরবো? আমার সমবয়সী কেউই তো নেই এখানে।”
“তানভীর, নাকীব যে ঘুরছে বাইরে বাইরে। ওদের সাথে যাসনা কেন? কাল সকাল সকাল বেরুবি ওদের সাথে।”
“ওরা তো ছেলে। কত জায়গায় যাবে। আমি পারবো ওদের সাথে যেতে? থাক না, আমি ঠিক আছি তো এখানে।”
“কিচ্ছু ঠিক নেই। অতদূর থেকে এসে ঘরে বসেই দিন কাটিয়ে দিবি বুঝি? কাল বেরুবি অবশ্যই।”

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খালামণির কথায় সম্মতি দিলাম।
“এখন চল নিচে আমাদের সাথে আড্ডা দিবি।”

খালামণি আমাকে রীতিমতো টেনে নিয়ে গেলেন নিচে। খালুসহ সবাই বসে আছে সোফায়। শুধু তানভীর ভাইয়া ও নাকীব কিছুটা দূরে ডাইনিংয়ে বসে মোবাইলে কি যেন করছে আর হাসাহাসি করছে। আমি চুপচাপ ননির পুতুল হয়ে বসে রইলাম সবার মাঝখানে। বহুদিন পর হতাশায় আমার হৃদয় ছেঁয়ে গেল। হাহাকারে ভরে উঠলো অন্তর। দ্বীনের পথে ফেরার পর থেকে কখনো হতাশায় পড়তে হয়নি। কখনো কোনো ছেলের সামনেও পড়তে হয়নি। শুরুর দিকে ঐ দুজন পাত্রপক্ষের মুখোমুখি ছাড়া আর কোনো পরপুরুষের মুখোমুখি হতে হয়নি। কত শান্তিতেই না দিন কেটে যাচ্ছিলো। কোন দুঃখে মা আমায় এই ফেৎনাময় পরিবেশে নিয়ে এলেন আমি জানি না। বুকের ভেতরটা অসহ্য ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলো। হয়তো এটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার জন্য পরীক্ষা। ভালোয় ভালোয় এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেই আমি সফল। ওড়না দিয়ে নিকাবের মতো করে মুখ ঢেকে আছি। ভাবটা এমন যেন নাকেমুখে ধুলো ঢুকছে।

নাকীব ও তানভীর ভাইয়া ডাইনিং থেকে এসে আমাদের সাথে বসলেন। খালামণি বললেন,
“তোরা যে একা বেরিয়ে গেলি হৃদিকে সঙ্গে নিলি না কেন? মেয়েটা একা ঘরে বসে আছে সারাদিন।”
“খালামণি, আপু এমনিতেই ঘর থেকে বের হয় না, কারও সামনেও যায় না। এখন সবার সামনে বসে আছে তো বাধ্য হয়ে৷ মিনিট দশেক যেতে দিন দেখবেন চোখ বেয়ে টপাটপ অশ্রু ঝরছে। ওকে ওর মতো থাকতে দিন। সবার মাঝখানে নিয়ে এসে বেকায়দায় ফেলে দিয়েন না।” আস্তে আস্তে বললো নাকীব।
“তুই ওকে আমাদের চেয়ে বেশি চিনিস? ও তো সবসময় ঘুরতে ভালোবাসে।”
“ভালোবাসতো খালামণি, এখন বাসে না৷ ও আমার সাথে ছাড়া কোথাও বেরোয় না।”
“কালও তোর সাথেই বেরোবে। তানভীর, ওদেরকে কাল পাহাড় থেকে ঘুরিয়ে আনিস।”

আমি গম্ভীর কণ্ঠে বললাম, “আমি কোথাও যাবো না।”
“তোর মেয়েটা এমন ঘরকুনো কবে থেকে হলো বলতো?” মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন খালামণি।
“থাকগে বুবু, ওকে ঘাঁটিও না আর। ওকে ওর মতোই থাকতে দাও।”
তানভীর ভাইয়া বললেন, “কাল তো আমার কাজ আছে। তোমরা দুজনে নাহয় আশেপাশেই ঘুরে এসো। নাকীব বাইক চালাতে পারো?”
“হ্যাঁ, ভাইয়া, আমি সাইকেল, বাইক, কার সবই ড্রাইভ করতে পারি।”
“তাহলে তো ভালোই। বাইক নিয়ে ঘুরে এসো তাহলে।”
“আচ্ছা।”

আলাপ শেষে খাওয়া-দাওয়া হলো। আজকে ছেলেমেয়ে আলাদা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। হয়তো মায়ের অনুরোধে। ছেলেরা আগে খেয়ে চলে গেল তারপর মা, খালামণি, কাজের আন্টি আর আমি খেতে বসলাম।
খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে রুমে চলে এলাম। বড্ড একঘেয়ে জীবন। মাত্র দুটো দিন পার হয়েছে এরমধ্যেই বিরক্ত লাগছে আমার। বাকি দিনগুলো কিভাবে কাটাবো কে জানে!

আমার ঘরটায় তিনটা জানালা। একটা পশ্চিম দিকে, আরেকটা দক্ষিণে ও আরেকটা উত্তরে। বেশ আলোকিত পরিবেশ। পশ্চিম দিকে খাট বরাবর জানালাটায় চোখ রাখলে বিশাল নদীর দেখা মিলে। দক্ষিণের জানালায় চোখ রাখলে সেই নদীতে নামার সিঁড়ি দেখা যায়৷ রাতের বেলা সিঁড়িতে মিটিমিটি কয়েকটা আলো জ্বলছে। আর নদীর ওপারেও কয়েকটা নিভু নিভু আলো দেখা যাচ্ছে। জানালা দিয়ে হু হু করে গা হিম করা ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে। ঘরের দরজা আটকে চুল খুলে দিলাম। অনেকদিন মুক্ত বাতাসে চুল ওড়ানো হয়নি৷ ঘরের সমস্ত পাখা, বাতি নিভিয়ে সবগুলো জানালা খুলে দিলাম। জানালা খুলতেই দমকা বাতাসে জানালার পর্দা উড়ে প্রায় ফ্যানের কাছাকাছি চলে গেল। আপাতত ফ্যান বন্ধ বলে রক্ষা। জানালার উপর গাছের একটা ডাল এসে পড়েছে। ডালের ফাঁকে গোল চাঁদ আর মেঘেদের উড়াউড়ি দেখা যাচ্ছে। জানালা থেকে খানিকটা দূরে খাটের পাশের ছোট টেবিলে একটা মোমবাতি দেখা যাচ্ছে, পাশে দেয়াশলাই। মোমবাতিটা জ্বালিয়ে দিলাম। দমকা বাতাস এসে সাথে সাথেই প্রায় নিভিয়ে দিলো মোমবাতি। দু’হাত দিয়ে মোমবাতির আলোকে বাতাসের হাত থেকে রক্ষা করলাম। দখিনের জানালায় একটা চাঁদের শোপিস দেখা যাচ্ছে। ওটা হাতে নিতেই দেখি খানিকটা জ্বলজ্বল করছে। উল্টেপাল্টে দেখতে গিয়ে একটা বাটন লাগলো আঙ্গুলে। প্রেস করতেই ঝলমল করে আলো জ্বলে গেল। মা শা আল্লাহ! কি সুন্দর বাতি। বাতিটা চাঁদের আলোর মতোই আলো ছড়াতে লাগলো। দখিনের জানালা দিয়ে সাঁই সাঁই বাতাস আসছে। বাতাস এসে মোমবাতির আর শেষ রক্ষা হলো না। ধপ করে নিভে গেল আলো। জানালার নিচে টেবিলে চাঁদের বাতিটা জ্বালিয়ে দিয়ে পশ্চিমের জানালার কাছে চেয়ার নিয়ে চুল খুলে বসে পড়লাম। বাতাসে খোলা চুল উড়তে থাকলো। মনটা অন্যরকম ভালো লাগায় ছেঁয়ে গেল।

আকাশে গোল চাঁদ। চাঁদের আলোয় নদীর পানি ঝিকমিক করছে। মাঝেমাঝে মেঘের ছোট ছোট টুকরো এসে চাঁদকে ঢেকে দিচ্ছে। কিছু সময়ের জন্য চাঁদের আলো ম্লান হয়ে আবার আলোকিত হয়ে পড়ছে ভূবন। ইচ্ছে করছে রাতের আঁধারে নদীর পার ধরে হাঁটি। কিন্তু একা তো এতরাতে বেরুনো সম্ভব না। মেয়ে হওয়ায় খুব আফসোস হলো। ইস! যদি ছেলে হতাম তাহলে একাকী ঐখানে হাঁটতে পারতাম, যেখানে খুশি যেতে পারতাম। প্রত্যেকটা মেয়েই হয়তো জীবনে একবার হলেও ছেলে হতে না পারার জন্য আফসোস করে। মেয়েরা কখনোই একাকী চলতে পারে না। দিনের বেলায় একাকী চললে ছেলে মানব ঝাঁপিয়ে পড়ে আর রাতের বেলায় একাকী চললে জ্বীন জাতি হামলা করে। মনুষ্য জাতি অবশ্য রাতেও হামলা চালায়৷ বলা যায়, পুরুষের ভয়েই একজন মেয়েকে অন্য পুরুষের কাছে আশ্রয় নিতে হয়। হয় তাকে একজন ছেলে হতে হয় নাহয় একজন ছেলের আশ্রয় নিতে হয়। জীবনে প্রথমবার একজন জীবনসঙ্গীর খুব অভাব বোধ হলো আমার। ইচ্ছে হলো এক্ষুনি বিয়ে করে তার হাত ধরে পুরো নদীর পার চষে বেড়াই। আহ!

বয়স তো পেরিয়ে যাচ্ছে। এবার যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে করে জীবনটাকে অন্য আঙ্গিকে সাজিয়ে ফেলতে হবে। এত এত পুরুষের হাত থেকে, ফেৎনা থেকে বাঁচতে পারছি না কিছুতেই। এই যন্ত্রণা যে আর সহ্য হচ্ছে না। আচ্ছা, যে আমার জীবনসঙ্গী হবে সে পারবে তো আমাকে দ্বীনের পথে আগলে রাখতে? পারবে তো শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য আমায় ভালোবাসতে? বিয়ের পরও কি আমি দ্বীনের ওপর অটল থাকতে পারবো? আয়েশার (রা.) বিবাহিত জীবনের সমাপ্তি ঘটেছিল তাঁর ১৮ বছর বয়সে। অথচ আমরা ১৮ বছর বয়সে জীবন শুরুই করতে পারি না।

কতক্ষণ বসেছিলাম কে জানে। ফোনে তাহাজ্জুদের এলার্ম বাজতেই আমার বোধোদয় হলো। রাত অনেক গভীর হয়েছে। এলার্মের শব্দ রাতের নিঃস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে খানখান করে দিলো। দ্রুত পায়ে গিয়ে এলার্ম বন্ধ করে ওযু করে এলাম। ওযু করতে হয় নিচতলায় গিয়ে। টিউবওয়েল আছে, ওখান থেকে। আমার ইচ্ছে করছিলো নদীতে গিয়ে অযু করে আসি। খোলা আকাশের নিচে রাশি রাশি জল থেকে ইচ্ছেমতো সময় নিয়ে অযু করি। আবার ইচ্ছে হলো রাতের আঁধারে নদীর ঘন কালো জলে গা ভাসিয়ে শুয়ে থাকি। পৃথিবীটাকে হঠাৎ বড্ড সুন্দর মনে হতে লাগলো। একটা নাশিদ মনে পড়ছে এই মুহুর্তে। মৃদু সুরে সেটা গাইতে লাগলাম।

“দমকা বাতাস এলে আগলে রাখবো ঠিকই
আমি তুই হাত মিলিয়ে হাঁটবো চারিদিকই।

আকাশের ধুম্র কালোয় যদি হারিয়ে যাস
জোড়া চোখ দেখিস খুলে আছি ঠিক তোরই পাশ।
মেঘেদের ভেলায় চড়ে আমি তোর সাথেই যাবো
রাজি তুই থাকলে পরে প্রণয়ের কথা কবো।”

তাহাজ্জুদের সিজদাহয় অজস্র দোয়া করলাম আল্লাহর কাছে। একজন দ্বীনদার জীবনসঙ্গী চাইলাম। জীবনের প্রতিটা রাত, প্রতিটা দিন যেন আল্লাহর রাস্তায় কাটাতে পারি, প্রতিটি দিন যেন সুন্দর হয়, মধুর থেকেও মধুরতম হয় সেই দোয়া করলাম আল্লাহর কাছে। আল্লাহর প্রতি আমার শতভাগ বিশ্বাস আছে, আমার জন্য যদি এই চাওয়াগুলো কল্যাণকর হয় তবে অবশ্যই আমার দোয়া কবুল হবে, হবেই ইন শা আল্লাহ।

#Be_Continued_In_Sha_Allah 🥀

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here